‘আমি আনন্দিত আপনাকে স্বাগত জানাতে পেরে উত্তর দিলেন মাদাম ফ্রাঞ্চি ‘আপনাকে পেয়ে আমার ছেলেও খুশি হবে। এ বাড়িতে নিজের বাড়ি মনে করেই থাকুন।
‘ম্যাডাম, আমি কেবলমাত্র এক রাতের জন্যেই আশ্রয় চাই, কাল ভোরেই আমাকে চলে যেতে হবে। আবার তাকে সালাম দিয়ে আমি বললাম।
‘সে আপনার ইচ্ছে। যাতে আপনার সুবিধা হয়। তবে আমার আশা আপনি আপনার মত বদলাবেন এবং আরও দুই-চারদিন থেকে যাবেন এখানে।
আমি তৃতীয়বারের মতো তাকে সালাম দিলাম।
মাদাম ফ্রাঞ্চি তখন মেরীয়াকে বললেন–ভদ্রলোককে লুইয়ের ঘরে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি ঘরে আগুন জেলে গরম পানি পৌঁছে দাও। চাকরানি আদেশ শুনে চলে গেল।
মাদাম আমার দিকে ফিরে বললেন-’পরিশ্রান্ত পর্যটকের প্রথম দরকার হলো পানি আর আগুন। আপনি দয়া করে ওর সঙ্গে যান। যা কিছু দরকার হবে, ওকে বলবেন। এক ঘণ্টার ভেতরেই আমাদের রাতের খাবার খাবো। ততক্ষণে আমার ছেলেও এসে যাবে। আপনাকে দেখে সে খুশিই হবে।
সংকোচে জিজ্ঞাসা করলাম–‘আমার ভ্রমণের পোশাক পড়েই যদি খেতে যাই। বেয়াদবি হবে না তো?
মাদাম হেসে বললেন–‘না–কিন্তু বিনিময়ে আপনাকেও স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের গ্রাম্য আচার-ব্যবহারকে আপনি বেয়াদবি বলে ভাববেন না।’
উপর তলায় যাচ্ছে দাসী। আমি মাদামকে চতুর্থবারের মতো সালাম দিয়ে তার পিছনে চললাম।
দোতলায় একটা ঘরে আমরা গেলাম। জানালা দিয়ে বাড়ির পিছনটা চোখে পড়ে। পিছনে একটা ছোট বাগানে বিভিন্ন ফুল ফুটে আছে–পাশে ছোট একটি খাল, সেটা কিছুদূরে গিয়ে টাভারা নদীতে মিশেছে।
ফারগাছগুলো বাগানের শেষে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তা ভেদ করে পিছনে আর দেখা সম্ভব নয়। ঘরের ভেতর দেখা গেল, যা সাধারণত ইতালির সব ঘরেই দেখা যায়। বিভিন্ন দৃশ্যের ফ্রেস্কো দেখা গেল দেয়ালের চুনকামের উপর।
এই ঘরটা মাদাম ফ্রাঞ্চির যে ছেলে ফ্রান্সে থাকে তার ঘর। বাড়ির মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর ঘর। সেই জন্যে অতিথিকে দিয়েছেন। মালিকের রুচি ও অভ্যাসের খানিকটা আভাস পাওয়ার জন্য ঘরটা পরীক্ষা করলাম।
আধুনিক আসবাব সবই। কর্সিকার এতটা ভেতরে এই আধুনিক পরিবেশ তৈরি করতে যে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়েছে, সেটা বুঝতে সময় লাগলো না। লোহার একটা পালঙ্ক, তাতে একটার উপর আর একটা গদি। তার উপরও আর একটা। একটা লম্বা সোফা, চারটি ছোট সোফা, ছয়টি সাধারণ চেয়ার। বইয়ের আলমারি সংযুক্ত করা লেখার টেবিলের সাথে। প্রত্যেকটি ফার্নিচার দামি মেহগনি কাঠের, এগুলো শুধু আজাইচোর প্রথম শ্রেণির ফার্নিচারের দোকানেই পাওয়া যায়।
সবগুলো সোফা আর চেয়ারে ফুল তোলা দামি কাপড়ের ঢাকনা দেয়া। জানালার এবং বিছানার পর্দাও সেই একই কাপড়ের।
মেরায়া ভেতরে থাকার সময় শুধু চোখ দিয়ে দেখেছি, ও বাইরে চলে গেলে, বইয়ের আলমারিটা খুলে দেখলাম, কী আশ্চর্য। ভেতরে আমার দেশের সেরা কবি ও লেখকদের বই–কর্নিল, ব্যসিল, মলেয়ার, লা-ফান্তন, রসনার্ড, ভিক্তর হুগো, লা মাতিন–ঐতিহাসিক সেজার, স্যাটু ব্রায়ান্ড, থিয়েরি, দার্শনিক–মন্তেল, প্যাস্কান, লা ব্রইয়ের বিজ্ঞান কুভিয়ের, বেনদান্ট, এলিক দ্য বোমান্ট সব বই আছে আলমারীতে। উপন্যাসও আছে। কিছু। আমার সমুদ্রের স্মৃতি বইটাও রয়েছে দেখে মনটা ভরে উঠল। আলমারিগুলো চাবি দেয়া। আমি সবগুলো খুলে দেখলাম। একখণ্ড কর্সিকার ইতিহাস আছে। ভ্যান্ডেটা (বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসা) বন্ধ করার উপায়টি যে বিষয়ে প্রবন্ধ, ফরাসি ভাষায় লেখা কিছু কবিতা। ইতালীর ভাষায় লেখা সনেট–কিছু আছে পাণ্ডুলিপি।
এসব দেখেই আমি প্রবাসী লুই দ্য ফ্রাঞ্চির রুচি ও চরিত্রের একটা ছবি তৈরি করে ফেললাম।
যুবকটি অবশ্যই আলাপী এবং পড়ুয়া। কর্সিকায় ফরাসি সভ্যতা প্রচলন করতে ইচ্ছুক, তাতে সন্দেহ নেই। এখন এটাও বোঝা যাচ্ছে, উকিল হওয়ার জন্য কেন সে ফ্রান্সে গিয়েছে।
পোশাক পাল্টাতে গিয়ে আমি এগুলো চিন্তা করছিলাম। আমার পোশাক একদম খারাপ না হলেও, এগুলো পরে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে কিছু লোকের উদার মনের প্রয়োজন আছে। কালো ভেনভেটে টাইট জামা হাতার দিকে সেলাই খোলা। যাতে গরমের দিনে বাতাস লাগে। ভেতরের রেশমি শার্ট নজরে পড়ার জন্য জ্যাকেটের গায়ে মাঝে মাঝে ফারা। পাজামা ও জ্যাকেটের একই রং। হাঁটুর নিচে স্প্যানিশ ফ্যাশনের পট্টি জড়ানো। সেখানে রঙিন রেশমের কাজ করা। মাথায় পশমী কাপড়ের নরম টুপি, সেটা বিভিন্ন আকার দেয়া যায়। ভ্রমণকারীদের পক্ষে এই পোশাক খুব আরামের এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।
আমি তৈরি হবার সাথে সাথে আমাকে যে লোকটি প্রথমে স্বাগত জানিয়েছিল সে ভেতরে ঢুকে জানাল, তার তরুণ মালিক মঁসিয়ে লুসিয়েন দ্য ফ্রাঞ্চি এই মাত্র ফিরে এসেছেন এবং আমার অসুবিধা না হলে তিনি আমার সাথে আলাপ করতে চান।
আমি তাকে বললাম, মঁসিয়ে লুসিয়েনের যদি সুবিধা হয় তাতে আমি রাজি। তার সাথে দেখা হলে আমি-সম্মানিত বোধ করব।
একটু পরেই তাড়াতাড়ি পা ফেলে কেউ এদিকে আসছে শুনতে পেলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম আমার গৃহকর্তা সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
.
২.
হলো গাইডের কথাই। এর বয়স বিশ/একুশ। কালো চুল, কালো চোখ গায়ের রং তামাটে–বলা চলে একটু বেঁটেই। খুবই ভালো স্বাস্থ্য।