মাইওমোটিস তোড়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘কে সেই মহিলা? যাকে নিয়ে এভাবে বাজি ধরা চলে?
আমি তাকিয়ে আছি লুই ফ্রাঞ্চির দিকে, বাইরে সে সম্পূর্ণ শান্ত। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখলাম, তার মুখ মরা মানুষের মতো সাদা।
‘ডি’ বলল, আমি তার নাম বলায় কোনো বাঁধা আছে বলে মনে করি না। আপনারা তাকে অনেকেই চেনেন না।
‘ডি’, হাত ধরল লুই–‘মঁসিয়ে দয়া করে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন কি?
‘ডি’ ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘কি অনুরোধ?
‘শ্যাটো রেনোর সাথে যে মহিলার আসার কথা। তার নামটি প্রকাশ করবেন না। তিনি বিবাহিতা, তা তো জানেন।
‘হোক বিবাহিতা, কিন্তু তার স্বামী তো ভারতবর্ষ বা মেক্সিকো বা ওইরকম বহু দূর কোনো দেশের প্রবাসী। অতদূরে স্বামী থাকা আর না থাকা সমান।’
‘কিন্তু সেই স্বামী আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দেশে আসছেন, আমি তাকে চিনি। সাহসী পুরুষ। ফিরে এসে যদি শোনেন যে, তার অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী কিছু ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন। তিনি মনে আঘাত পাবেন। সম্ভব হলে সে আঘাত থেকে আমি তাঁকে বাঁচাতে চাই।’
‘ডি’ বলল, আমাকে মাফ করবেন। আমি জানতাম না, আপনার সাথে মহিলার পরিচয় আছে। এও আমি সত্যি জানতাম না যে তার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আপনি যখন ও ব্যাপারে নিশ্চিন্ত এবং স্বামীকেও চেনেন-’
‘তা চিনি।’
এখন অবশ্যই কথাবার্তায় আমাদের সংযত হতে হবে। ভদ্রমহিলা মহোদয়গণ, শ্যাটো রেননা আসুক বা না আসুক। বাজিতে তিনি জিতুন বা হারুন। আমার অনুরোধ এই ব্যাপারে আপনারা আর একটাও কথা বলবেন না।’
সবাই এর কথায়, এ ব্যাপারে আর কোনো কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিল। সামাজিক শালীনতার জন্যই যে এ প্রতিজ্ঞা তারা করল তা বোধহয় না। আসল কারণ হয়তো এই যে প্রত্যেকের দারুণ ক্ষুধা লেগেছিল। ফাও তর্ক করার উৎসাহ ছিল না।
ডি-এর সাথে হাত মেলালো ফ্রাঞ্চি। ধন্যবাদ মঁসিয়ে। আমার সন্দেহ তাই। আপনি মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছেন।’
এবার সবাই খাবার ঘরে গিয়ে খেতে বসল। দুটো চেয়ার খালি রইল একটি শ্যাটো রেনের অন্যটি তার সাথে আসার সেই মহিলার।
বাড়তি চেয়ার দুটি চাকরেরা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
‘ডি’ মানা করল, ‘শ্যাটো রেনো চারটে পর্যন্ত সময় নিয়েছে, এখনও সময় আছে। চারটা বাজার সাথে সাথে চেয়ার সরিয়ে নিয়ে যাবে। চারটে বেজে গেলে সে হেরে গেল।
আমি ফ্রাঞ্চির দিকে তাকিয়ে আছি, সে চেয়ে আছে ঘড়ির দিকে। ঘড়িতে তখন চারটে বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি।
‘ডি’ কে ফ্রাঞ্চি জিজ্ঞেস করল-’আপনার ঘড়ি ঠিক আছে তো?
‘ঘড়ি ঠিক বেঠিকের ব্যাপারে মাথা ঘামাবে শ্যাটো রেনো–আমার কোনো দরকার নেই। তবু সে যাতে এ ব্যাপারে আপত্তি তুলতে না পারে। তার জন্য তার ঘড়ির সাথে আমি ওই দেয়াল ঘড়ির সময় মিলিয়ে নিয়েছি।’
মাইওসোটিম তোড়া বলে উঠল–‘মঁসিয়ে শ্যাটো রেনো এবং তার বান্ধবীর ব্যাপারে কথা বলা যখন নিষেধ, তখন ও প্রসঙ্গ বাদ দিন। কারো। নাম বলতে না পারলে প্রতাঁকের আশ্রয় নিতে হয়। ঘরোয়া আলাপের ভেতর এই ব্যাপারটা আমার অসহ্য বলে মনে হয়।
‘ডি’ বলল–তুমি ঠিক বলেছ এটা। আর কোনো দুঃখেই বা আমরা প্রতাঁকের আশ্রয় নিতে যাব? যাদের নাম ধরে ডাকা যায়, এমন সুন্দরীর অভাব এখনও পড়েনি। তাঁদের সম্বন্ধে কথা বললে তারা বরং খুশিই হবে।’ আসুন তাঁদের সকলের স্বাস্থ্যই আমরা পান করি।
প্রত্যেক অতিথির হাতের কাছেই একটি করে বোতল। তা থেকে বরফ দেয়া শ্যাম্পেন ঢালছে গ্লাসে, আর গ্লাসের পানীয় ঢালছে গলায়।
লুই খুব কমই গ্লাস মুখে তুলছে।
আমি বললাম–‘আসুন, একটু পান করুন। দেখছেন তো শ্যাটো রেননা আসছে না।’
লুই বলল সে পরে পান করবে। আমি আর কিছু না বলে নিজের গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলাম।
আমরা কথা বলছি বেশ আস্তে। কিন্তু বাকি সবার গলা আস্তে আস্তে বাড়ছে। রীতিমতো গোলমাল শুরু হয়েছে। মাত্র দুজন লোক সেই হট্টগোলে যোগ দিচ্ছে না, সে লোক দুজন হলো–ডি এবং লুই। তারা ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।
চারটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। আমি আবার লুই-এর দিকে তাকালাম। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। বলে গ্লাস মুখে উঠালাম।
সেও মৃদু হেসে তার গ্লাস ঠোঁটে ছোঁয়াল। গ্লাস প্রায় অর্ধেক খালি হয়েছে। এমন সময় জোরে ঘণ্টা বেজে উঠল।
তার মুখ প্রথম থেকেই বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। কিন্তু সেটা যে আরও বিবর্ণ হতে পারে এ ব্যাপারে আমার ধারণা ছিল ন। কিন্তু চোখের উপরেই দেখলাম তার মুখটা একেবারে ফ্যাকাসে রক্তশূন্য হয়ে গেল।
‘এ সেই’ ফ্রাঞ্চি বলল।
আমি ভরসা দিলাম–বোধহয় সেই। হয়তো সে মহিলাকে আনতে পারেনি।’
‘এখনি দেখা যাবে।’
ঘণ্টা বেজে উঠার পর প্রত্যেকের মনোযোগ সেই দিকে চলে গিয়েছে। এতক্ষণ আলাপ চলছিল হট্টগোলের মতো, মাঝে মাঝে সেটা চিৎকার পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে গোলমাল একদম চুপ হয়ে গেল।
সামনের ঘরে একটা কিছু নিয়ে তর্ক হচ্ছে।
‘ডি’ তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
লুই আমার কবজি চেপে ধরল জোরে। ‘তার গলা শুনছি।‘
আমি বললাম, তাতে কী! একদম ভেঙে পড়বেন না, মনে জোর আনুন, ভেবে দেখুন–কোনো মহিলা যদি তার অল্প পরিচিত বন্ধুর সাথে অপরিচিত কোনো বাড়িতে রাতে খেতে আসেন, যেখানে অন্য পুরুষরাও তার অপরিচিত, তাহলে বুঝতে হবে তিনি তরল প্রকৃতির মহিলা। চরিত্রহীনাই তাকে বলা যেতে পারে এবং তাই যদি মেনে নেয়া হয়। তাহলে সেকি আর কোনো ভদ্রলোকের শ্রদ্ধা বা সম্মান দাবি করতে পারে?