লুই চুপ। বুঝলাম, তার দুশ্চিন্তার কারণটা সে গোপন রাখতে চায়, কাজেই ও নিয়ে আর কোনো কৌতূহল নয়।
চুপচাপ দুজনে বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা হাটছি। আমার তো সত্যিই কারো সঙ্গে দেখা বা আলাপ করার কথা নাই। সুতরাং আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু লুই প্রত্যেকটা গোড়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে।
আমি বললাম, ‘শুনুন এক কাজ করুন।
সে একেবারে চমকে উঠল, আমার কথা তার মনে ছিল না। তারপর অপ্রতিভের মতো বলল, ‘কী কাজ?
‘কিছু একটা করুন যাতে একটু অন্যমনস্ক হওয়া যায়।’
‘যেমন?’
‘আমার এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত আছে। সেখানে চলুন।
না, এমন দুঃখিত চেহারার অতিথিকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইবেন ।’
‘দুঃখিতদের তো ওই রকম জায়গায় যাওয়া দরকার। সেখানে সব অবাস্তব কথাবার্তা হবে। তাতে আপনার মনের মেঘ কেটে যাবে।
এরমধ্যে মাইওমোটিসের তোড়া নিয়ে ‘ডি’ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, চোখ পড়তেই ছুটে এল।
‘কথা ঠিক আছে তো? তিনটের সময়—’
‘না, বন্ধু। আমার আসা সম্ভব নয়।’
‘ডি’ রাগ করে চুলোয় যাও’ বলে চলে গেল।
লুই তার সম্পর্কে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে, ভদ্রতাবশত জিজ্ঞেস করল, ‘ভদ্রলোকটি কে?
‘এ আমার বন্ধু ‘ডি’। একটা নামকরা কাগজের মালিক। খুব আমুদে লোক।
‘ডি, ওকে আপনি ভালো করে চেনেন নাকি?’
‘চিনি না? দুই তিন বছর ধরে ওর সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
‘রাতের দাওয়াত কি ওর বাড়িতে?’
‘হ্যাঁ, ওখানে তো তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।’
‘তাহলে আমি আনন্দের সাথে রাজি।
‘খুব ভালো কথা। কিন্তু শুধু আমাকে খুশি করার জন্য খাবার দরকার নেই, কারণ খাওয়া না খাওয়া আমার কোনো লাভ ক্ষতি নেই।
দুঃখের হাসি হেসে লুই বলল, আমারও হয়তো যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু কাল যে বলেছিলাম, মনে আছে? যেখানে যাওয়া উচিত সেখানে আমরা যাই না, যাই সেখানে ভাগ্য আমাদের টেনে নিয়ে যায়। আসল কথা হলো–আজকে আমি এখানে না এলেই সব চেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। করতাম।’
তখনই আবার ‘ডি’-এর সাথে দেখা হলো।
তাকে থামিয়ে, আমার তার ওখানে যাবার কথা জানিয়ে দিলাম।
যাবে, পরশু রাতেও তাকে আমাদের সাথে খেতে হবে।’
‘কারণ?’
‘শ্যাটো রেনোর সাথে একটা বাজি হয়েছে।’
লুই আমার পাশেই ছিল। সে আমার হাতটা বেশ জোড়েই চেপে ধরল হঠাৎ। তার দিকে তাকালাম, মুখটা একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
‘ডি’ কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাজিটা কি?
এখানে দাঁড়িয়ে অত বড় গল্প বলা যাবে না। তাছাড়া এর সাথে এক মহিলা জড়িয়ে আছেন, তাঁর কানে বাড়ির কথা উঠলে, শ্যাটো রেননা। অবশ্যই ঠকে যাবেন।
‘ঠিক আছে, তিনটার সময় তাহলে
‘ডি’ চলে গেল। ঘড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখলাম দুটো পঁয়ত্রিশ।
লুই নিজেকে স্থির রাখতে ব্যর্থ হয়ে জানতে চাইল আমি শ্যাটো রেনোকে চিনি কিনা?
‘মুখটাই শুধু পরিচিত। বন্ধুদের বাড়িতে দু একবার শুধু দেখেছি।’
‘তাহলে সে আপনার বন্ধু না?
‘বন্ধু তো নয়ই। সাধারণ পরিচিতও না।’
‘বাঁচলাম।’
‘কেন? কীভাবে বাঁচলেন?’
‘না, এমনিই। এমনিই বলেছি ও কথা।‘
‘পালটা প্রশ্ন করলাম–‘আপনি কি চেনেন নাকি?’
‘মোটামুটি।’
এই এড়িয়ে উত্তর সত্ত্বেও বোঝা গেল সে মঁসিয়ে ফ্রাঞ্চি এবং মঁসিয়ে শ্যাটো রেনোর মধ্যে একটা রহস্য আছে এবং সে ব্যাপারে যোগ সূত্র হচ্ছে এক মহিলা। আমার কেমন যেন মনে হতে লাগল, আমি এবং লুই বাড়িতে চলে গেলেই আমাদের জন্য ভালো হবে।
সে কথা আমি লুইকে বললাম, ‘ডি’র বাড়িতে না যাবার জন্য। কিন্তু উত্তরে বলল, ‘কেন? যাব না কেন? তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। আপনি নিজেই তো তাকে একজন অতিথি নিয়ে আসবেন বলে জানিয়েছেন।
‘সব ঠিক আছে। তবুও আমার মন কেন যেন বলছে, আমরা না গেলেই ভালো হয়।’
‘একটু আগেই তো আপনি আমাকে নিয়ে যাবার জন্য জোড়াজুড়ি করেছেন, এখন আবার ওরকম ভাবছেন কেন?’
শ্যাটো রেনোর সঙ্গে সেখানে দেখা হবেই।
দেখা হলে ভালোই তো। শুনেছি খুব আমুদে লোক, তার সঙ্গে ভালো করে আলাপ হলে আমি খুশিই হব।
বেশ তাহলে চলুন, আপনার যখন এত আগ্রহ।
নিচে গিয়ে কোট পরলাম। অপেরার কাছেই ‘ডি’র বাসা। পরিষ্কার আবহাওয়া তাই হেঁটে যাওয়ার জন্য লুইকে বললাম, লুই রাজি হলো, আশা হলো, ঠাণ্ডা বাতাস লুইসের মাথা শান্ত করে দিতে পারবে।
.
৭.
ড্রয়িং রুমে ঢুকে আমার বন্ধুদের অনেককেই দেখতে পেলাম। এরা সবাই নিয়মিত অপেরা দেখতে যায়। থিয়েটারের বক্সের দর্শনার্থী সবাই। মুখোশ খোলা কয়েকজন নাচিয়েও আছেন। সাথে ‘তোড়া’রা আছে।
তাদের কয়েকজনের সঙ্গে লুই দ্য ফ্রাঞ্চিকে আলাপ করিয়ে দিলাম। সবাই তাকে সাদরে অভ্যর্থনা করল।
‘ডি’ তার মাইওমোটিস তোড়াকে সাথে নিয়ে দশ মিনিট পর এসে পড়ল। এসে সহজে মুখোশ খুলে ফেলল মাইওমোটিস, তার দ্বিধা করার কথাও না। এরকম পার্টিতে তার যাতায়াত অভ্যাস আছে তারপর সে। অত্যন্ত সুন্দরী।
‘ডি’র সাথেও ফ্রাঞ্চির পরিচয় করিয়ে দিলাম।
ডি, ঘোষণা করল–‘আমি প্রস্তাব করছি–সবার সাথে পরিচয়ের কাজ যদি শেষ হয়, তবে এবার খাবার টেবিলে গিয়ে বসা যাক।
‘কিন্তু শ্যাটো রেনো এখনও আসেনি?’
‘তাই তো। তার সে বাজি?’
‘বাজি ঠিক আছে, যে হারবে, সে বারোজন বন্ধুকে ডিনার খাওয়াবে।’
‘কিন্তু বাজিটা কি নিয়ে?
‘শ্যাটো রেনো বাজি ধরেছে, সে বিশেষ এক মহিলাকে এই খাবার আসরে নিয়ে আসবে। আমরা বলেছি সে পারবে না।’