বাড়িটা দেখার পরে, গাইড বলল, আপনার পছন্দ-অপছন্দ আছে, কোথায় সুবিধা হবে, তা বেশ ভালো বুঝতে পারেন। চলুন–মাদাম ম্যাভিলিয়া দ্য ফ্রাঞ্চির বাড়িতেই আমরা যাই।
একটা খটকা লাগল আমার মনে, মহিলা যদি বাড়ির মালিক হয়, তাহলে তার ওখানে উঠতে গেলে সে আপত্তি করতে পারে।
‘আপত্তি কেন করবে?’ গাইড সে আশংকা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল।
আমার ভয়ের কারণ আমি তখন তাকে খুলে বললাম, বাড়ির মালিক যদি তরুণী হয় আর আমি তার ওখানে রাত কাটাই তাহলে তার বদনাম হতে পারে?
‘বদনাম!’ গাইড অবাক হলো।
‘মহিলা যদি বিধবা হয়।’
গাইড জানাল–‘বিধবাই তো’।
‘আমার মতো একজন যুবককে তিনি তাহলে কি বলে বাড়িতে থাকতে দেবেন।’
‘১৮৪১ সালে এই ডুমার বয়স ছিল সাড়ে ছত্রিশ। সুতরাং নিজেকে আমি যুবক বলেই মনে করতে পারি।’
‘আমার কথাগুলোই গাইড হুবহু আউড়ে গেল, আপনার মতো যুবককে কি বলে বাড়িতে থাকতে দেবেন?’ তারপর উল্টো প্রশ্ন করল,–‘আপনি যুবক হোন বা বৃদ্ধ, তার সঙ্গে অতিথি হওয়ার সম্পর্ক কী?’
এভাবে প্রশ্ন করে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই আমাকে অন্য পথ ধরতে হলো।
‘মাদাম ম্যাডিলিয়ার বয়স কত?’
‘প্রায় চল্লিশ তার বয়স।’
‘মনটা খুশি হয়ে গেল, বাঁচা গেল। তাহলে তার ছেলেমেয়েও আছে?’ নিশ্চিত মনে বললাম।
‘দুই ছেলে, দুজনেই যুবক।’
‘তাদের সঙ্গে দেখা হতে পারে?’
‘যে ছেলেটি ওখানে থাকে, তার সাথে দেখা হতে পারে।‘
‘অপরজন?’
‘সে প্যারিসে থাকে।‘
‘ওদের বয়স কত?’
‘একুশ।’
‘দুজনেরই?’
‘কী করে ওরা?’
‘যে থাকে প্যারিসে, সে উকিল।’
‘আর দ্বিতীয়জন?’
‘সে আসল কর্সিকাবাসীর যেরকম হওয়া দরকার সেরকমই। অন্যজন ঠিক তেমনই।’
একটা আলাদা অর্থ আছে উত্তরটার। গাইড কিন্তু সে ব্যাপারে মোটেই সচেতন নয়। বললাম, ‘চলো তাহলে মাদাম ম্যাভিলিয়ার বাড়িতে যাই।’
মিনিট দশেক সময় লাগল গ্রামে পৌঁছাতে। পাহাড়ের উপর থেকে যা দেখা যায়নি। তা এখন চোখে পড়ল। প্রত্যেকটা বাড়িতেই ছোট ছোট আত্মরক্ষার ব্যবস্থা আছে। মাদাম ম্যাভিলিয়ার বাড়ির মতো না হলেও সবাই জানালার পিছনে মোটা মোটা কাঠ খাড়া করে রেখেছে। আততায়ী জানালা। ভাঙলেও কাঠের বেড়া দিয়ে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু কাঠের ফাঁক দিয়ে বাড়ির বাসিন্দা বন্দুক চালাতে পারবে। অনেক জানালা আবার সম্পূর্ণ ইট দিয়ে গেথে বন্ধ করে দিয়েছে।
গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম–বন্দুক চালানোর ওই ফাঁকগুলোকে ওদের ভাষায় কী বলে?
‘তীর ফাঁক। সে জানাল। বংশগত মারামারি যে এদেশে অনেক পুরানো তা নাম শুনেই বোঝা যায়। যখন বন্দুকের আবিষ্কার হয়নি, তীর ছিল যুদ্ধের একমাত্র অস্ত্র তখন থেকেই কর্সিকাবাসীরা তীর-ধনুক দিয়ে লড়াই করত।
গ্রামের পথে চলার সময় মনে হয় একটা ঠাণ্ডা থমথমে ভাব। অনেক বাড়ির দেয়ালেই গুলির চিহ্ন দেখতে পেলাম।
মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে–‘তীর ফাঁক দিয়ে ভেতরের বাসিন্দাদের চাউনি, এক পলক আমাদের দেখে নিয়েই সরে যাচ্ছে। এরা পুরুষ না মেয়ে তা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না।
উপর থেকে গাইডকে যে বাড়িটা দেখিয়েছিলাম, সেখানে এসে থামার পর দেখলাম গ্রামের সবচেয়ে ভালো বাড়িই এটা।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম কাছে এসে। উঁচু থেকে খুব সুরক্ষিত মনে হয়েছিল বাড়িটাকে, কিন্তু আসলে তা না! দেয়াল আছে, গম্বুজ আছে, তীর ফাঁক সব ঠিক আছে। কিন্তু জানালা? জানালাগুলো শুধু রুইতন আকৃতির কাঁচের টুকরো দিয়ে ঢাকা। তার পিছনে কাঠের বেড়া তো দূরের কথা কাঠের পাল্লা পর্যন্ত নেই। কোনো জানালা ইট দিয়ে বন্ধ করা নেই। অথচ আশেপাশের দেয়ালের গায়ে বহু গুলির চিহ্ন রয়েছে। অন্তত দশ বছরের পুরনো হবে সে দাগগুলো।
গাইড দরজায় নক করতেই দরজা খুলে গেল। উঁকি দেয়ার বা দ্বিধার ভাবে নয় একেবারে দরজা পুরো খুলে একজন খানসামা বেরিয়ে এল।
খানসামা বলে মনে হয় ভুল করলাম, খানসামা না বলে বলা উচিত ছিল–মানুষ। পোশাক না থাকলে কেউ তাকে খানসামা বলতে পারবে না। এর পরনে একটা শুধু ভেলভেটের জ্যাকেট ও পাজামা। একটা ডোরাদার রেশমি বেল্ট দিয়ে আটকানো। সেই বেল্টে আছে আবার বড় একটা স্পেনীয় ছোরা।
আমি তাকে লক্ষ করেই বললাম–‘বন্ধু আমি এদেশে নতুন। সুন্না কারাতে কাউকেই চিনি না। তোমার মালিকের বাড়িতে অতিথি হতে চাওয়া কি আমার পক্ষে অবিবেচনার কাজ হবে?’
‘না, মালিক, না’–লোকটি সবিনয়ে জবাব দিল–কারও বাড়িতে অতিথি হওয়া মানে তাকে সম্মানিত করা।’
এরই মধ্যে একজন দাসী এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে, লোকটি তাকে বলল, ‘যাও মেরায়া মাদাম ম্যাভিলিয়াকে বলো, একজন ফরাসী পর্যটক তার গৃহে অতিথি হতে চান।
কথা বলতে বলতে সে বাঁশের মইয়ের মতো খাড়া সেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে আমার ঘোড়ার লাগাম হাতে তুলে নিল।
‘ভেতরে চলে আসুন আপনি। আমরা আপনার জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছি ।’
খুশি হলাম কথাটা শুনে। পথ চলার এই পরিশ্রমের পর এই কষ্টটুকু থেকে বাঁচাও অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।
মইয়ের মতো সেই সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির ভেতর উঠে গেলাম। সামনেই একটা লম্বা বারিন্দা। তার শেষ মাথায় এক মহিলার সঙ্গে দেখা হলো। পরনে কালো ড্রেস, বেশ লম্বা।
মনে হলো এর বয়স হতে পারে ৩৮ বা ৪০। এই বয়সেও বেশ সুন্দরী ইনি। বাড়ির মালিক বোধ হয়। থেমে গিয়ে সালাম দিলাম। তাকে ভদ্রভাবে বললাম, ‘মাদাম আমাকে হয়তো অবিবেচক ভাববেন আপনি। তবে দেশের নিয়মে এবং আপনার চাকর বাকরের আমন্ত্রণ–এই দুয়ের কথা চিন্তা করে আমাকে আপনি ক্ষমাও করতে পারেন।