বিচার মন্ত্রী কি সেই অলাৰ্ত্তি আর কলোনাদের ব্যাপারে ডেকেছেন?
‘খুব সম্ভব তাই। আমি মন্ত্রীকে সুখবরটা দিতে পারব। কারণ লুসিয়েন লিখেছে যে, ব্যাপারটার মীমাংসা হয়ে গিয়েছে।’
‘আমি নিজের চোখে দেখেছি, সরকারি উকিলের সামনে, আমিও অলাৰ্ত্তির পক্ষে জামিনদার ছিলাম।
‘লুসিয়েন সব কিছু লিখেছে। ঘড়ি বার করে দেখে নিয়ে সে বলল, ‘বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, আমি গিয়ে আমার ভাইয়ের প্রতিশ্রুতি পালন করার কথা বলে আসছি।’
‘সব সুন্দর ভাবে হয়েছে, আমি তার সাক্ষী।
‘আমি জানতাম এ কাজ লুসিয়েনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেও সে এ কাজ করবে।’ লুসিয়েনের মতো ছেলে হয় না।’
‘নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধের কাজও যেরকম নিষ্ঠার সাথে তিনি করেছেন। তার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়।
‘নিশ্চয়ই, আপনার সাথে কথা বলে আমি প্রচুর আনন্দ পাচ্ছি। আমার মাকে, ভাইকে, আমার প্রিয় স্বদেশকে যেন চোখের সামনে দেখছি, আপনার কথার ভেতর থেকে, তবুও আজকে আর সম্ভব না, কোনো সময় এলে আপনাকে একটু একা পাব
‘অনেকদিন পর প্যারিসে ফিরে এসেছি, এখন কিছুদিন ব্যস্ত থাকতে হবে, তার চেয়ে আপনাকে কোথায় পাব তা যদি বলেন
‘কাল মাই বারেসের উৎসব-’ (ধর্মীয় উৎসব)
‘কালকেই উৎসব নাকি?’
‘আপনি কি গিয়ে অপেরার নাচের উৎসবে যোগ দেবেন।
‘যদি আপনাকে গিয়ে সেখানে পাওয়া যায়, তাহলে যেতে পারি, কিন্তু আর কোনো আগ্রহ নেই ও ব্যাপারে।
‘আমাকে কিন্তু যেতেই হবে। যেতে আমি বাধ্য।
আমি হেসে বললাম, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, সময় সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। হৃদয়ের ক্ষত নিজ থেকেই শুকিয়ে যায়।
লুই মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করল, ‘আপনি ভুল করছেন। আমি সেখানে আনন্দের জন্য যাচ্ছি না, যাবার জন্য হয়তো নতুন করে অশান্তি শুরু হতে পারে। তবু আমাকে যেতেই হবে।’
‘কেন উপায় নেই? ঝামেলার সম্ভাবনা যেখানে, সেখানে যাবেন না।
‘মানুষ কি নিজের ইচ্ছায় কিছু করতে পারে? ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমার ভাগ্য, না গেলে যে ভালো হয় তা আমি জানি। তবু যেতে হবে।’
‘ঠিক আছে আপনি যখন যাবেন, আমিও কালকে অপেরায় যাব। কখন?
‘সাড়ে বারোটায়, যদি আপনার অসুবিধা না হয়।’
‘কোথায়?
‘ঘড়ির নিচে। ঠিক একটার সময় সেখানে আমার সাথে একজনের দেখা করার কথা।
হাত মিলিয়ে সে দ্রুত বেরিয়ে গেল। প্রায় বারোটা বাজে।
এরপর সেদিন বিকেল এবং পরদিন সমস্ত দিনই আমাকে ব্যস্ত থাকতে হলো। আঠারো মাস পরে ফেরার জন্যই আমাকে এই ব্যস্ততার মাঝে কাটাতে হলো। এর কোনো বিকল্প নেই।
নির্দিষ্ট স্থানে রাত বারোটার সময় লুইয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম। তখনও লুই আসেনি। সে এলে পর শুনলাম, এক মুখোশধারিনীর পিছনে সে এতক্ষণ ছুটছিল। তাকে ধরতে পারেনি শেষ পর্যন্ত, ভিড়ের মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
আমি চাইছিলাম কর্সিকার কথা আলোচনা করতে। কিন্তু লুইয়ের মন এখন শুধু ঘড়ির উপর ব্যস্ত। শুধু ঘড়িই দেখছে। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল : ওই যে আমার ভায়োলেট ফুলের তোড়া।
বলেই সে উধাও হয়ে গেল।
নাচ ঘরে বিভিন্ন ধরনের তোড়া উপস্থিত। ক্যাসিনিয়ার একটা ভোড়া এসে আমাকে বলল : প্যারিসে আপনার পুনঃরাগমনের উপলক্ষ্যে অভিনন্দন জানাতে চাই।’
ক্যাসিনিয়ার পরে এল গোলাপের তোড়া। গোলাপের পরে হেলিওট্রোন, তারও পরে ৪নং তোড়ার সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখা বন্ধু ডি’র সঙ্গে।
ওর পুরো নামটা কেউ বলে না। দরকার হয় না। ডি বললেই সবাই বুঝে নেয়।
ডি নিজেই ডেকে বলল, ‘আরে বন্ধু তুমি ঠিক সময়েই এসেছ। আজ আমার বাড়িতে একটা নৈশ ভোজনের ব্যবস্থা আছে। তোমাকে আসতেই হবে, এই বলে আরও তিন-চার জনের নাম করে বলল, এরা সবাই আসছে।
আমি ধন্যবাদ দিয়ে মাফ চাইলাম। তোমাদের সাথে যোগ দিতে পারলে খুশিই হতাম। কিন্তু আমার আর একজন সাথী আছে।
‘তাতে কোনো অসুবিধা নেই। আমরা প্রত্যেকেই একটি করে তোড়া নিয়ে যাব। তুমিও এনো। টেবিলে ছয় কলসি ‘জল’ রেখেছি তোড়াদের তাজা রাখার জন্য।’
‘তুমি ভুল করেছ বন্ধু, তোড়া নয়। আমার সাথে আছে এক পুরুষ বন্ধু।
‘তাতে কোনো অসুবিধা নেই, প্রবাদই তো আছে বন্ধুর যে বন্ধু, সে আমার বন্ধু।
‘কিন্তু যুবকটিকে তো তোমরা চেন না?’
‘চিনে নেব।’
‘তাহলে তাকে গিয়ে তোমার নিমন্ত্রণের কথা বলি।’
‘বলো, যদি আসতে না চায় জোর করে ধরে এনো।’
‘যতদূর পারি চেষ্টা করব, খেতে বসবে কখন?’
‘রাত তিনটে। ছয়টা পর্যন্ত খাওয়া চলবে, যথেষ্ট সময় পাবে।’
‘আচ্ছা, বলে বিদায় নিলাম ‘ডি’-এর কাছ থেকে।
মাইওমোটিস এর একটি তোড়া দূরে থেকে আমাদের কথা শুনছিল, এবার এগিয়ে এসে ‘ডি’-এর হাত ধরে চলে গেল।
কয়েক মিনিট পরেই লুইর সঙ্গে দেখা। তার সাথে আর ভায়োলেটের তোড়া নেই। আমার সাথে তখন যে তোড়াটি ছিল, তা এক বন্ধুর সাথে দিয়ে আমি লুইয়ের সঙ্গ নিলাম।
‘যা জানার দরকার ছিল, জানতে পেরেছেন?
‘তা জেনেছি, মুখোশ নাচের ব্যাপার তো জানেন? সেসব কথা বাদ দেয়া উচিত, সেটাই এখানকার একমাত্র কথা।’
‘বেচারী’ এই বলেই হঠাৎ মনে হলো, মাত্র দুদিনের পরিচিতর সাথে এই ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলা হয়তো উচিত হলো না। সাথে সাথে তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। কিছু মনে করবেন না। আপনার ভাইয়ের সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল সেটাই আপনার উপর ব্যবহারে চাপিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু কথাটি কী? ভাগ্যের চাকা বুঝি নিচে দিয়ে যাচ্ছে।