পরের দিন বেলা এগারোটার সময় আমি যখন পোশাক পড়ছি, তখন আমার চাকর এসে মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির আসার খবর জানাল, আমি বললাম–ভদ্রলোককে বসার ঘরে বসিয়ে খবরের কাগজগুলো পড়তে দাও আর বল আমি এক্ষুনি আসছি।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি লুইর কাছে গেলাম।
গিয়ে দেখি ‘প্রেস’ কাগজে আমার যে ধারাবাহিক লেখাটা ছাপা হচ্ছে, সেটা উনি পড়ছেন। কিন্তু আমাকে আকর্ষণ করল লুসিয়েনের সাথে এই লুইয়ের দৈহিক সাদৃশ্য।
লুই বলল, মঁসিয়ে কাজের লোকের হাত থেকে এই ছোট চিঠিটা যখন পেলাম, আমি আমার সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি অন্তত বিশবার আপনার চেহারার বর্ণনা তার মুখ থেকে শুনে নিলাম বর্ণনা মিলিয়ে নিলাম, কাগজে দেখা আপনার ছবির সাথে। ফলে দেখছেন তো বড় বেশি সকাল সকাল আপনার কাছে এসে গেছি। আপনার হয়তো অসুবিধা হলো। কিন্তু দুটো কারণে আমি আর ধৈৰ্য্য রাখতে পারছিলাম না। প্রথমত আপনাকে ধন্যবাদ দেয়া আমার কর্তব্য। দ্বিতীয়ত বাড়ির খবরের জন্য আমি বড় বেশি অস্থির।
লুই আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি তাকে বাধা দিলাম। আমার প্রশংসার জন্য আপনাকে পরে ধন্যবাদ দেব, আগে বলুন তো আমি কি মঁসিয়ে লুসিয়েন না মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির সাথে কথা বলছি?’
লুইয়ের ঠোঁটের কোণায় একটু হাসি ফুটে উঠল।
‘আমাদের আকৃতি হুবহু এক। আমি যখন সুল্লাকারোতে ছিলাম, তখন শুধুমাত্র দুজনের ভুল হতো না–কে লুইয়ের আর কে লুসিয়েন, তারা হলো আমরা দু ভাই নিজেদের। তবে চেহারায় পার্থক্য না হলেও, পোশাকে তফাৎ ছিল প্রচুর। এর মধ্যে যদি লুসিয়েন তার কর্সিকার পোশাক পরিবর্তন না করে থাকেন এবং আপনি তা দেখে থাকেন। তাহলে সহজে বুঝতে পারবেন। পোশাকের জন্যই সাধারণ লোকের আমাদের চিনতে ভুল হতো না।’
আমি স্বীকার করলাম কথাটা সত্য, কিন্তু শেষ যখন আমি তাকে দেখি, তখন পরনে ছিল এই ফরাসি পোশাকই, তাতে তার সাথে আপনার বর্তমানে কোনো তফাৎ ধরতে পারছি না।
ব্যাগ থেকে চিঠি দুটো বের করে লুইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই বাড়ির খবরের জন্য অস্থির হয়ে রয়েছেন। কালকে এই চিঠি আপনার চাকরের হাতে দিয়ে আসিনি, তার কারণ, আপনার মায়ের কাছে আমি শপথ করেছিলাম যে চিঠি নিজের হাতে আমি আপনাকে দেব।
‘বাড়িতে সকলকে ভালো দেখে এসেছেন তো?
‘সবাই ভালো। কিন্তু আপনার জন্য চিন্তিত। চিঠি পড়লেই জানতে পারবেন।’
‘আপনি কিছু মনে করবেন না তো?’
‘না আপনি পড়ন।
লুই চিঠি খুলে পড়তে লাগল, আমি চুরুট পাকাতে লাগলাম।
আমি তার মুখের দিকে লক্ষ্য রাখছি। কোনো ভাবান্তর যেন আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে না পারে। সে তাড়াতাড়ি চিঠি পড়ছে। আর মাঝে মাঝে একটু হাসছে। মধ্যে মধ্যে অস্ফুট স্বরে দুই একটা মন্তব্য করছে। চেহারার দিক দিয়ে দুই ভাইয়ের এত মিল যে, সে ধাক্কাটা তখনও আমি সামলে উঠতে পারিনি। তবে লক্ষ করেছি যে, লুসিয়েনের কথাই ঠিক। লুইয়ের গায়ের রং একটু বেশি সাদা এবং তার ফরাসি উচ্চারণ অনেক বেশি নিখুঁত।
তার চিঠি পড়া শেষ হতে, তাকে একটা নিজের পাকানো চুরুট দিলাম। আমার জ্বলন্ত চুরুট থেকে সেটা জ্বালিয়ে নিল। বললাম, চিঠিতে পড়লেন তো? ওরা আপনার জন্য খুবই চিন্তায় আছেন। তবে আমি আশ্বস্ত হচ্ছি এই দেখে যে তাদের দুঃশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না।’
লুই একটু দুঃখিত গলায় বলল, একেবারে কারণ ছিল না, তা নয়। আমি অসুস্থ ছিলাম তারচেয়েও গুরুতর ব্যাপার হলো একটা ব্যাপারে আমি দারুণভাবে মানসিক অশান্তিতে আছি। স্বাভাবিক অবস্থায় আমি এত অস্থির হতাম না। কিন্তু যখন ভাবছি আমার জন্য লুসিয়েনকেও কষ্ট দেয়া হচ্ছে—’
বাঁধা দিয়ে বললাম–ব্যাপারটার কিছুটা ইঙ্গিত আপনার ভাইয়ের মুখ থেকে পেয়েছিলাম। এভাবে আশ্চর্য রকম যোগাযোগ যে দুই মানুষের মধ্যে থাকতে পারে তা সহজ বুদ্ধিতে বিশ্বাস হয় না। তবে আমার সামনে প্রমাণ রয়েছে। আপনাদের চেহারার মিল, এটা সচক্ষে দেখার পর মানসিক মিল সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা চলে না।
লুই বিষণ্ণভাবে হাসল।
‘তা হলে আপনিও বিশ্বাস করেন আপনার ভাই যে অশান্তি ভোগ করেছেন তা আপনার অশান্তির ফলে।
‘তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
‘আপনার এই বিশ্বাস দেখে একটা প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি। কৌতূহলের জন্য নয়। আপনাদের উপরে আকর্ষণের জন্য। যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমি জিজ্ঞেস করতে পারি? আপনার সেই মানসিক অশান্তি শেষ হয়েছে?
একটু চুপ থেকে লুই বলল, আপনি তো জানেন যে, দুঃখ যত তীব্রই হোক না সময়ের জন্য তা আস্তে আস্তে কমে যায়।
আমার হৃদয়ের রক্তাক্ত ক্ষত যদি কোনো কারণে বিষিয়ে না ওঠে, তাহলে কয়েকদিন তা থেকে রক্ত ঝরবে। তারপর নিজে থেকেই ক্ষত শুকিয়ে যাবে। আপনি যে অনেক কষ্ট করে চিঠি নিয়ে এসেছেন তার জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এখন আপনি যদি বিরক্ত না হয়ে আপনার কাছে আসার অনুমতি দেন, তাহলে মাঝে মাঝে এসে আপনার সাথে সুল্লাকারোর গল্প করে যাব।’
‘আপনি যদি আসেন এবং গল্প করেন তবে আমিও প্রচুর আনন্দ পাব, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা না করে, এখনই কিছু আলাপ করা যাক। আসুন দুজনে নাস্তা খাই আর গল্প করি।’
‘কিন্তু আজকে সম্ভব নয়। কালকে বিচার মন্ত্রীর কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি, আজকে তার সাথে দেখা করার কথা, একটা আলোচনা আছে, আমার মতো নতুন উকিলের পক্ষে তার ডাক অগ্রাহ্য করা সম্ভব না।