এর মধ্যে গির্জার ভেতরে ঈশ্বরের মহিমা গান শুরু হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে বিরাট একটা যুদ্ধের জয় হয়েছে।
এদিকে স্বাক্ষরের পর স্বাক্ষর। যে কোনো স্তরের লোক গ্রামের বা বাইরের, নির্বিচারে এসে দলিলে সই করে যাচ্ছে।
তারপর এই নাটকের দুই নায়ক এক সথে গির্জায় ঢুকে বেদীর এক পাশে এক একজন প্রার্থনার জন্য বসল। এতক্ষণ পরে লুসিয়েন সহজভাবে নিঃশ্বাস ফেলছে। একটা দুশ্চিন্তার বোঝা তার মাথা থেকে নেমে গিয়েছে। আর চিন্তা নেই, প্রতিদ্বন্দ্বীরা মেনে নিয়েছে, শুধু মানুষের সামনে না, ঈশ্বরের সামনেও। প্রার্থনা শেষ হলো। অলাৰ্ত্তি আর কলোনা বের হবার সময় আর একবার মেয়রের অনুরোধে হাত মেলাতে বাধ্য হলো।
তারপর ওরা নিজের নিজের দলের সঙ্গে নিজেদের বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। গত তিন বছরের মধ্যে ওরা কেউই এ ঘরে ঢুকতে পারেনি।
লুসিয়েন আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। তারপরই ডিনার সকালের নাস্তাটা আমাদের বাদ পড়েছে।
ডিনারে দেখলাম বিশেষ আয়োজন। যেন মস্ত একটা লোকের আপ্যায়ন হচ্ছে। বুঝলাম ব্যাপারটা। আমাকে দলিলে যখন নাম সই করতে হয়েছিল তখন নিশ্চয়ই নামটা লুসিয়েন দেখে নিয়েছে। নিশ্চয়ই এ নাম তার একেবারে অজানা না।
সকালেই আমি বলে ছিলাম যে, ডিনারের পরেই আমি রওনা হয়ে যাব। আমার একটা নাটকের রিহার্সাল প্যারিসে শুরু হতে যাচ্ছে। কাজেই ফিরে যাওয়াটা আমার পক্ষে একান্ত জরুরি। কাজেই লুসিয়েন এবং তার মায়ের বিশেষ অনুরোধ ফেলে আমাকে রওয়ানা দিতে হলো।
লুসিয়েন বলল, আপনি তো লুইকে একটা চিঠি পৌঁছে দেবার কথা বলেছিলেন, তাহলে সেই চিঠিটা লিখে দেই।’ মাদাম ফ্রাঞ্চির বাইরের কঠোরতা তো ছদ্মবেশ মাত্র। ভেতরে মাতৃ হে একেবারে কোমল। তিনি আমায় শপথ করিয়ে নিলেন, চিঠিটা আমি নিজ হাতে লুইকে দেব। সেটা অবশ্য আমার পক্ষে কষ্টের হবে না, কারণ রু দ্য হেলডার ৭নং সে থাকে। আমার বাসা থেকে কাছেই।
বিদায় নেবার আগে লুসিয়েনের ঘরে আর একবার গেলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম প্রত্যেকটা জিনিস, লুসিয়েন উদার হৃদয়ে আমায় অনুমতি দিল–
‘এখান থেকে যে কোনো একটা জিনিস উপহার হিসাবে আপনি নিলে আমি অত্যন্ত খুশি হব।’
এখন কিছু একটা না নিলে অভদ্রতা দেখায়। কাজেই আমি এক পাশ থেকে একটা ছোরা তুলে নিয়ে কোমরে রাখলাম। এখন আমি কি উপহার দেই? আমার বেল্টটি শিকারিদের কাজে লাগার কথা, কারণ ওটা শিকারিদের জন্যই তৈরি। আমি সেটা লুসিয়েনকে উপহার দিলাম। সেটা যে সহজ ভাবেই নিল, শুধু বন্ধুত্বের উপহার হিসাবে।
গ্রিদো এসে খবর দিল, আমার ঘোড়া তৈরি এবং গাইডও এসে পড়েছে। গ্রিদোকে আমি একটা শিকারের ভোজালি দিলাম তার ফলার দুই পাশে দুদিকে দুটো পিস্তল। উপহার পেয়ে গ্রিদো এমন আনন্দ প্রকাশ করল, যা আমি আর কাউকে দেখিনি।
নিচে এসে দেখলাম, মাদাম ফ্রাঞ্চি সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, বিদায় জানাবার জন্য ঠিক সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন–যেখান থেকেই উনি স্বাগত জানিয়েছিলেন কালকে। তার হাতে চুমু খেয়ে বিদায় নিলাম। সাধারণ জীবনে এভাবে সম্মানীয়া মহিলা আমি কমই দেখেছি। তার প্রতি এখন আমার সম্ভম অটুট, অক্ষুণ্ণ।
লুসিয়েন আমার সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এল।
‘অন্য কোনো সময় হলে আমি ঘোড়া নিয়ে পাহাড় পর্যন্ত আপনার সাথে যেতাম। কিন্তু আজকে অলাৰ্ত্তিরা কলোনাদের জন্য সে সাহস পাচ্ছি না, ওরা যে কোনো সময় আবার একটা অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারে। শান্তির জীবনে অভ্যস্ত হতে ওদের সময় লাগবে।’
এই অল্প পরিচিত বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলাম, বললাম, আবার দেখা হবে?
‘নিশ্চয়ই হবে, যদি দয়া করে আবার কর্সিকায় আসেন।’
‘আপনিও তো প্যারিসে আসতে পারেন।’
‘না, ওখানে আমার যাওয়া হবে না।
‘আপনার ভাইয়ের ঘরে টেবিলের উপর আমার কার্ড রেখে এসেছি। ঠিকানাটা অন্তত ভুলবেন না।
‘না, তা ভুলব না। যদি কখনও ইউরোপে কোথাও যেতেই হয়, গিয়ে সবার আগে আপনার সাথে দেখা করব।’
‘তাহলে এই কথাই রইল।’ বলে আর একবার হাত মিলিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম। গ্রাম ছেড়ে নদী, নদীর পর পাহাড়। পাহাড়ে দেখা হলো অলাৰ্ত্তির সাথে।
সে আমাকে বিদায় জানাবার জন্য এখানে এসে অপেক্ষা করছে। গির্জার অনুষ্ঠানের সময় তার পরনে ছিল সভ্য পোশাক। কিন্তু এখন তার পরনে সেই পাহাড়ে চড়ার পুরানো ছেঁড়া পোশাক। বলল, ‘গ্রামে কি মানুষ থাকতে পারে? কেবলই মনে হয় ঘরের ছাদ এই বুঝি মাথায় ভেঙে পড়ল।
আমি বললাম, ‘কলোনার সঙ্গে মিলনটা যেন স্থায়ী হয়।
সে মুখ বাঁকাল। আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু কলোনা যে মুরগি দিয়েছিল, তার মাংসটা যেন ছিবড়ে।
৭. প্যারিসে এসে পৌঁছলাম
৭.
প্যারিসে এসে পৌঁছলাম আটদিন পর।
পৌঁছেই মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি ঘরে নেই।
আমার নামের কার্ড রেখে এলাম। চাকরকে জানিয়ে এলাম আমি কিছুদিন আগে সুল্লাকারো থেকে এসেছি এবং মঁসিয়ে লুসিয়েন দ্য ফ্রাঞ্চির কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে এসেছি, যা আমি শুধুমাত্র মঁসিয়ে লুইর হাতে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
চাকরটি আমাকে তার মনিবের পড়ার ঘরে বসতে দিয়েছিল, খাওয়ার ও বসার ঘর দুটো পেরিয়েই সে ঘরে যেতে হয়। যাবার সময়ই আমি দুটো ঘরের আসবাবপত্র দেখে নিলাম। সেই একই রুচি, যা সুল্লাকারোতে আমি লুইর ঘরে দেখে এসেছি। বরং এখানে এটা আরও বেশি মার্জিত। সেটা নিশ্চয়ই প্যারিসের কাতারের জন্য। অবিবাহিত এক যুবক। তা একার পক্ষে এই এলাকাটি খুবই আরামের বলে মনে হলো।