মেয়রের নির্দেশেই দুজনের হাতে দুটো জলপাইর ডাল, মেয়রের ভেতর বিত্ব আছে।
কলোনার হাতে জলপাইর ডাল ছাড়া আর একটি জিনিস আছে। তার হাতে ঝুলছে একটা সাদা মুরগি। এটা দশ বছর আগের মুরগিটার
ক্ষতিপূরণ, যেটা নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়েছিল।
অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছিল এই ক্ষতিপূরণ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত মীমাংসাই নষ্ট হতে গিয়েছিল এই সমস্যা নিয়ে। কলোনা ভেবেছিল মরা মুরগির ক্ষতিপূরণ বাবদ জ্যান্ত মুরগি দিলে তার অপমান হবে, অনেক কষ্টে অনেক বুঝানোর ফলে তাকে জীবিত মুরগি দিতে রাজী করিয়ে ছিল লুসিয়েন।
যেই সময় দুই দল দেখা গেল গির্জার দুই পাশে। সজোরে গির্জার ঘণ্টা বাজতে আরম্ভ করল আনন্দের ধ্বনি তুলে।
কিন্তু অলাৰ্ত্তি আর কলোনা? তাদের মুখে আনন্দের চিহ্ন নেই। তারা পরস্পরের দিকে চোখ পড়লেই হিংসায় রাগে ফেটে পড়ছে। যা হোক তারা কোনো ঝগড়া না করে চুপচাপ এগিয়ে এল।
গির্জার গেটের সামনে এসে তারা চার গজ ফাঁক রেখে পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়াল। মাত্র তিন দিন আগেও যদি কেউ কারো ১০০ গজের ভেতরেও চোখে পড়ত, তবে যে কোনো একজন মারা যেত।
পুরো মিনিট পাঁচেক চুপ। শুধু মিছিলে লোকই না, উপস্থিত সমস্ত জনতা। অনুষ্ঠানটি যদিও শান্তির জন্যই। তবুও নীরবতাকে শান্তির সপক্ষে ভাবার কোনো কারণ নেই।
অবশেষে মেয়র নিস্তব্ধতা ভাঙলেন। কলোনা প্রথমে তুমি বলবে, সেটা ভুলে গেছ?
কলোনা অতিকষ্টে নিজেকে সামলাল, তারপর নিচু স্বরে গ্রাম্য ভাষায় বিড়বিড় করে কিছু বলল।
আমি অতিকষ্টে তার বক্তৃতা থেকে এটুকুই শুধু বুঝলাম যে গত বছর ধরে তার মহৎ প্রতিবেশী অলাৰ্ত্তির সঙ্গে তার যে শোচনীয় ভেনডেটা চলছে, তার জন্য সে দুঃখিত এবং ক্ষতিপূরণ হিসাবে অলাৰ্ত্তিকে এই সাদা মুরগিটা দিচ্ছে।
কলোনার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অলাৰ্ত্তি চুপ করে ছিল। তারপর কর্সিকার ভাষায় সেও কিছু বলল, তার কথার অর্থ হলো অতীতের কথা সে ভুলে যাবে। মনে রাখবে শুধু আজকের ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠান এবং পুর্ণমিলনের কথা। স্বয়ং মেয়রের উপস্থিতিতে এবং মঁসিয়ে লুসিয়েন ফ্রাঞ্চির মাধ্যমে যে পুর্ণমিলন আজ ঘটল, মাননীয় উকিল যার দলিল নিজ হাতে লিখে এনেছেন।
তারপর আবার দুজনেই চুপ।
মেয়র আবার বলতে বাধ্য হলেন–এই যে ভদ্রলোকেরা–তোমরা হাত মিলাবে এরকম একটা কথা হয়েছিল না।’
নিজেদের অজান্তেই প্রতিদ্বন্দ্বীরা দুজনেই নিজে নিজের হাত পিছনে লুকিয়ে ফেলল।
বাধ্য হয়ে মেয়র সিঁড়ির মাথা থেকে নেমে এলেন। প্রথমে কলোনার হাত তার পিছন থেকে টেনে সামনের দিকে আনলেন, তারপর অলাৰ্ত্তির হাতও তেমনিভাবে সামনে নিয়ে এলেন, তাকে এই টানাটানিতে বেশ কষ্ট করতে হলো–কিন্তু মুখে দরাজ হাসি ফুটিয়ে নিজের বিব্রত অবস্থা ঢাকার চেষ্টা করলেন।
তারপর কোনো রকমে মেয়র দুই শত্রুর হাত এক করে শক্ত করে চেপে রাখলেন। উকিল এই শুভ সময়ের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি দলিল হাতে উঠে দাঁড়ালেন।
মেয়র দুই শত্রুর হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা করছিল দুজনেই। কিন্তু না পেরে এখন ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে।
উকিল দলিল পড়তে শুরু করেছেন–মার্টেন প্রদেশের সরকারি উকিল। আমি গাইসেল আন্তোলিও সরোনা আমার উপস্থিতিগ্রামের গির্জার সামনে মাননীয় মেয়র। বিশেষ অতিথি এবং যাবতীয় গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে–
এক পক্ষে গাইতালো অর্সো-অলার্তি-সংক্ষেপে অলাৰ্ত্তি–এদের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বিচার করে এভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে–
আজ ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ তারিখে দশ বছর আগে উভয় পক্ষের মধ্যে যে ভেনডেটা ঘোষিত হয়েছিল আজ তার শেষ হলো।
আজ থেকে তারা সহৃদয় প্রতিবেশী এবং বন্ধুর মতো পাশাপাশি বাস করতে থাকবে–যেমন করত তারা–এই ঝগড়া শুরু হওয়ার আগে।
তার প্রমাণ স্বরূপ তারা আজ এই দলিলে সই দিয়েছে। এই গ্রামের গির্জার সামনে মেয়র পোলো আরজরি। সালিস লুসিয়েন দ্য ফ্রাঞ্চি। উভয় পক্ষের লোক এবং সরকারি উকিলের সামনে।
.
লুল্লাকারো, ৪ মার্চ, ১৮৪১।
লেখাটা শুনে মনে মনে উকিলের প্রশংসা করলাম, মুরগির কথাটা না লিখে খুব ভালো কাজ করেছেন। ওই মুরগির ব্যাপারেই কলোনার আপত্তি ছিল। ওটাই তার পরাজয়ের চিহ্ন।
দলিল শুনতে শুনতে যেমন কলোনার মুখ উজ্জ্বল হচ্ছে, তেমনি অলাৰ্ত্তির মুখ তত কালো হয়ে যাচ্ছিল, অলাৰ্ত্তি স্থির চোখে হাতের মুরগির দিকে তাকিয় আছে, যেন এক্ষুনি ওটা কলোনার মুখের উপর ছুঁড়ে মারবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মনের ইচ্ছে কাজে পরিণত করার আগে মুখ তুলতেই লুসিয়েনের সাথে চোখাচোখি হলো, সেই ইচ্ছাটা শেষ হয়ে গেল।
মেয়র দেখলেন আর দেরি করলেই সব নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি পিছন হেঁটে সিঁড়ির মাথায় উঠতে লাগলেন, কলোনা আর অলাৰ্ত্তির হাত দুইটি তার হাতে ধরাই আছে। তার চোখও দুজনকেই পর্যবেক্ষণ করছে।
এবার দলিলে সই করার পালা, এখানেও সংকট আছে। যাকে আগে সই করতে বলা হবে সেই অপমানিত বোধ করবে। হয়তো কলম ছুঁড়ে ফেলে চত্বর থেকে বেরিয়েও যেতে পারে। মেয়র বুদ্ধি করে এ সংকটটা কাটিয়ে দিলেন, তিনি নিজেই সবার আগে সই করলেন। কাজেই আগে এখন সই করাটা অপমানের বিষয় না হয়ে সম্মানের হয়ে দাঁড়াল। অলাৰ্ত্তির হাতে কলম দিলেন মেয়র–অলাৰ্ত্তি সই করে কলম দিল লুসিয়েনকে। লুসিয়েনের পর কলোনা-কলোনা আবার সই জানে না। সে দিল একটা ক্ৰশ চিহ্ন।