অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর সে জিজ্ঞেস করল। ‘আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন তো।’
‘নিশ্চয়ই। আপনাকে ধন্যবাদ। বিশ্বাস করে আমাকে সব কথা বলার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি আপনার এ গোপন কথা কখনও ফাঁস করব না।’
আশ্চর্য হয়ে সে বলল, কিন্তু কোনোটাকে গোপন কথা বলছেন? এর মধ্যে তো কোনো কিছুই গোপনের নেই। এ গ্রামের যে কোনো লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করলেই আপনি আমাদের সম্বন্ধে এসব কথা জানতে পারতেন। কর্সিকাতে এ কথা গোপন করার কোনো কারণও নেই। তবে আমার ভাই যদি প্যারিসে বসে সব কথা বলতে থাকে, তাহলে সমস্যা হবে–পুরুষেরা মুখ ঘুরিয়ে অবিশ্বাসের হাসি হাসবে আর মেয়েরা ভয়ে। চিৎকার করবে।
এরপর সে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
খুব বেশি ক্লান্ত থাকলেও ঘুম আসছিল না। শেষে ঘুম এলেও তা ছিল আজকে দেখা হওয়া সব লোককে নিয়ে আজগুবি স্বপ্নে বোঝাই, যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। শেষ রাত্রে একটু গভীর ঘুম আসার ফলে, সকালে উঠতে অনেক বেলা হয়ে গেল।
লুই ফ্রাঞ্চির আরামের প্রমাণ পেলাম হাতের কাছেই ঘরে ঘণ্টা রয়েছে চাকরদের ডাকার জন্য। মনে হয় এই গ্রামে এটাই একমাত্র ঘণ্টা।
ঘণ্টা বাজাতেই গরম জল নিয়ে এলো গ্রিফো, লুই ফ্রাঞ্চি তার চাকরকে ভালো শিক্ষাই দিয়েছে।
লুসিয়েন এর মধ্যে দুবার আমার খোঁজ নিয়েছেন এবং সাড়ে নয়টার সময় আমার ঘরে আসার জন্য অনুমতি চেয়েছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি নটা পঁচিশ বাজে। লুসিয়েন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘরে এসে হাজির হলেন।
ফরাসি স্টাইলের পোশাক পরে একজন সৌখিন ফরাসি রূপে সে আমার ঘরে এসে ঢুকল। সাদা প্যান্টের উপর চটকদার জামা, তার উপরে কালো কোট। মার্চ শুরু হয়েছে কাজেই সাদা প্যান্টই তখন রেওয়াজ।
আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে, লুসিয়েন বলল, আমার পোশাক দেখে আপনি অবাক হয়েছেন? আমি যে সভ্য মানুষ তার প্রমাণ পেলেন?
‘পেলাম, আজাইচোতে এত ভালো দরজি আছে তা আমি ভাবতে পারিনি। এই ভেনভেটের কোট পরে আপনার পাশে দাঁড়ালে আমাকে প্যারিসের রাজপথের মজুরের মতো লাগবে।’
আজাইচোর কথা কি বলছেন, আমার এ পোশাক বানিয়ে আনা হয়েছে, প্যারিসের হুমালের ওখান থেকে। অর্থাৎ পোশাকটা প্রথমে আমারই জন্য বানানো হয়নি, হয়েছিল লুই এর জন্য। আমরা দুজনে লম্বায়-চওড়ায় একই মানের হওয়ায়–লুই নিজের গায়ের পোশাক আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে একটু আনন্দ করতে চেয়েছে। এই একটাই নয়, অনেকগুলো পাঠিয়েছে। বিশেষ কোনো উপলক্ষ থাকলে আমি সেগুলো পড়ি। যখন জেলা শাসক আসেন। আঞ্চলিক সৈন্যের সেনাপতি পরিদর্শনে বের হন। কিংবা আপনার মতো মাননীয় অতিথি যখন পায়ের ধুলো দেন, বিশেষ করে তার সাথে জড়িত থাকে আজকের এই অনুষ্ঠানের মতো মর্মস্পর্শী ব্যাপার। তখন সাদাসিধে পোশাক পরলে কি ফ্রাঞ্চি বংশের মর্যাদা বজায় থাকে।
লুসিয়েন ভদ্র ভাষায় তিক্ত ব্যঙ্গ করার ব্যাপারে সুদক্ষ। কিন্তু সে ব্যঙ্গ রুচিকে অতিক্রম করে না। আর অন্যকে আঘাত করার চাইতে নিজেকেই চাবুক মারার দিকে তার ঝোঁক বেশি। কাজেই কথার উত্তর না দিয়ে ঘাড় নেড়ে তাতে সায় দিলাম। সে তখন হাতে দস্তানা পরছে। বয়সিন বা রুসোর বাড়ির হলুদ দস্তানা–যা ঠিক মতো পরতে হলে এক কৌশল জানা প্রয়োজন।
এদিকে আমিও পোশাক পরে নিয়েছি। পৌনে দশটা বাজল।
লুসিয়েন বলল, এবার যাওয়া উচিত, অনুষ্ঠানটা দেখতে হলে নাশতার টেবিলে বসা চলে না। আপনি কি করবেন? না খেয়ে ওখানে যাওয়া নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
‘কেন হবে না? ফিরে এসে তো খেতে পারব। এগারটার আগে আমি সকালের নাস্তা করি না।’ এই বলে টুপিটা হাতে নিয়ে আমি ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম।
.
৬.
ফ্রাঞ্চিদের সদর দরজার আট ধাপ সিঁড়ির উপর দাঁড়ালেই গ্রামের গির্জাটার সামনের চত্বর চোখে পড়ে।
কালকেও চত্বরের পাশ দিয়েই এসেছি। কিন্তু তখন ছিল পুরো নির্জন। এখন ওখানে লোকের ভিড়, শুধুমাত্র নারী এবং শিশু। কোনো পুরুষ চোখে পড়ল না।
তিন রঙের চাদর বুকে আটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়র ভদ্রলোক।
সামনে টেবিল চেয়ার নিয়ে উকিল ভদ্রলোক বসে আছেন। হাতে মীমাংসার দলিল লেখা কাগজ।
টেবিলের পাশে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম–ওখানে অর্লাত্তি অন্য জামিনদার দাঁড়িয়ে আছে। অন্য পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে–কলোনার জামিনদারেরা লুসিয়েন দাঁড়িয়েছে উকিলের পিছনে, উনি তো উভয় পক্ষের লোক।
ঘড়িতে দশটা বাজল।
জনতার মধ্যে সাথে সাথে যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল। গ্রামের পথের দিকে সবাই একসাথে তাকাল। অবশ্য একে পথ বলা যায় কিনা সেটা গবেষণার বিষয়। পঞ্চাশটা বাড়ি ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তার পাশ দিয়ে একেবেকে চলে গেছে লম্বাটে একটা জমি, ওখান দিয়ে তোক চলাচল করে, কাজেই ওটাকেই পথ বলতে হবে।
আমাদের উৎসুক চোখের সামনে দুই পাশ দিয়ে দুটো মিছিল দেখা দিল। পাহাড়ের দিক থেকে অলাৰ্ত্তি, নদীর দিক থেকে কলোনাদের মিছিল। প্রত্যেকের হাতে জলপাইর ডাল (জলপাইর ডাল চিরদিনই ইউরোপের শান্তির প্রতীক) সাথে আত্মীয় বন্ধু। শুধু মুখগুলোর ভাবভঙ্গি যদি সহজ হত তাহলে একটা ধর্মীয় মিছিল বলে চালিয়ে দেয়া যেত।
দুই দলের দুই নেতা, চেহারা সম্পূর্ণ বিপরীত। অলাৰ্ত্তি হলো লম্বা ছিপছিপে, কালো চুল ভাবভঙ্গি চটপটে। কলোনা ঠিক এর উল্টো, বেঁটে, মোটা, শক্তিশালী। ওর চুল দাড়ি লালচে ছোট করে কাটা এবং কোকড়ানো।