‘তাহলে নিশ্চয়ই ধরে নিতে পারি, আপনি প্রেতাত্মায় বিশ্বাসী?’
‘এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতাটি আপনাকে বলব?’
‘বললে আমার পক্ষে সুবিধা হয় আমার ব্যাপার বলতে।’
‘আমার বাবা মারা যায় ১৮০৭ সালে, তখন আমার বয়স সাড়ে তিন বছর মাত্র। আমাকে এক বৃদ্ধা আত্মীয়ার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো, যখন। ডাক্তার বাবার সম্পর্কে শেষ উত্তর দিয়ে গেলেন। আত্মীয়ার কাছেই একটা ছোট বাড়িতে আলাদা বাস করতেন।
তিনি তার বিছানার সামনে আমার জন্য আলাদা বিছানা করে দিলেন। আমাকে ওখানে শুইয়ে দেয়ার পর এক সময় ঘুমিয়ে গেলাম। বাড়িতে তখন কি বিপদ চলছে তা জানতাম না, জানলেও বুঝতাম না।
ঘুমিয়ে আছি, হঠাৎ শুনলাম দরজায় পরপর তিনবার শব্দ। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দরজার দিকে ছুটলাম।
আত্মীয়া বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
দরজায় নক করার শব্দ তিনিও শুনেছেন। তা শুনেই ঘুম ভেঙেছে তাঁরও। তিনি ভয়ে কাঁপছেন। কারণ তিনি তো জানেন যে সদর দরজায় তালা বন্ধ করা আছে। কোনো দেহধারীর পক্ষেই উপরে উঠে এসে শোবার ঘরের দরজায় শব্দ করা সম্ভব না।
আত্মীয়ার প্রশ্নে আমি উত্তর দিলাম–‘শুনছ না, বাবা এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন? তিনি বিদায় নিতে এসেছেন আমার কাছে, আমি তাকে দরজা খুলে দিতে যাচ্ছি।’
কথা শুনেই তিনি বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। আর আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে ধরে রাখলেন। আমি কেঁদে বার বার চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম।
‘বাবা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছেন। আমি তাঁকে শেষ বারের মতো দেখব না?’
ছোটবেলার সেই দুঃখের অভিজ্ঞতার কথা স্বল্প পরিচিত এক যুবকের কাছে বলার সময় এতদিন পরেও কান্নায় আমার গলা বন্ধ হয়ে গেল। আমি চুপ করে রইলাম।
লুসিয়েন জিজ্ঞাসা করল, আপনার বাবার আত্মা পরে কখনো এসেছিল?’
‘না। যদিও আমি অনেক সময় ব্যাকুল হয়ে তাকে স্মরণ করেছি। অবশ্য এর কারণ হিসেবে আমি ধরে নিয়েছি, নিষ্পাপ শিশুর সাথে আত্মা সহজেই যোগাযোগ করতে পারে। কিন্তু বয়স্ক পাপীর ভাগ্যে সে রকম হয় না।’
লুসিয়েন মৃদু হেসে জানাল। আমাদের পরিবারের লোকেরা কিন্তু ওদিক থেকে ভাগ্যবান।
‘আপনারা তাহলে মৃত আত্মার দেখা পান?’
‘পাই যখনই কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটবে বা ঘটেছে।
‘আপনাদের এই সৌভাগ্য কিভাবে ঘটল সে ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণা আছে?
আমার কোনো ধারণা নেই, এটা আগে থেকে ঘটে আসছে, আপনাকে যে স্যাভেলিয়ার কথা বলেছিলাম তার দুই ছেলে ছিল, মায়ের মারা যাবার সময়, আজাইচোতে এক চাচার কাছে থেকে লেখাপড়া করছিল। বড় হবার পরে তারা পরস্পর ভাইকে এমন ভালোবাসায় জড়িয়ে গেল, একদিন প্রতিজ্ঞা করল, মৃত্যুও দুজনে আলাদা করতে পারবে না। মুখে প্রতিজ্ঞা করেও তারা তৃপ্ত হতে পারল না। পাঁচমেন্টের উপরে রক্ত দিয়ে লিখে তাতে পরস্পর সই দিল। তাতে লিখল, দুজনের ভেতর একজন যদি আগে মারা যায়, তবে অন্য জনকে যে মারা যাওয়ার সাথে সাথে দেখা দেবে। আরও তার জীবনে প্রত্যেক সংকটময় সময় একবার করে দেখা দেবে।
এরপর মাত্র তিন মাস গিয়েছে।
এই ভাই দেশের বাইরে, অন্যজন বাড়িতে। প্রবাসী ভাই গুপ্তশত্রু দ্বারা। নিহত হন। ঠিক সেই সময় অন্য ভাই দেশের বাড়িতে বসে তাকে একটা চিঠি লিখছিল। চিঠি শেষ করে মোম দিয়ে মুখ আটকাতে যাবে, এমন সময় কে যেন ঠিক তার পিছনে নিঃশ্বাস ফেলল। চমকে গিয়ে সে পিছনে ফিরে দেখে তার ভাই দাঁড়িয়ে আছে। যার কাছে সে এতক্ষণ চিঠি লিখছিল।
তার কাঁধে হাত রেখে ভাই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু হাতের স্পর্শ তার কাঁধে অনুভব করতে পারছে না, কিন্তু ভাই তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সে তখন বুঝতে পারছিল কিনা জানি না। এ ভাই এইমাত্র লেখা চিঠিটা ও ভায়ের হাতে দেয়া মাত্র, চিঠিটা নিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ওই ভাইকে সে পরেও একবার দেখতে পেয়েছিল নিজের মৃত্যুর আগে। তাদের যে শপথ এবং চুক্তি শুধু তাদের দুজনকেই বাঁধেনি। তাদের ভাবী বংশধরদেরও যুগ যুগ ধরে বেঁধে রেখেছে। প্রতি পুরুষে এ বংশের লোক মারা যাওয়ার আগে আপনজনের আত্মাকে দেখতে পায়। তারা দেখা দেয় গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার আগে।
‘আপনি নিজে কোনো আত্মার দেখা পেয়েছেন?
‘না তবে নিশ্চয়ই পাব। আমার বাবা তার মারা যাওয়ার আগে তার বাবাকে দেখেছিলেন। সেভাবে আমিও আমার বাবার আত্মার দেখা পাব। বলে আশা করি। এতদিন যে অনুগ্রহ আমাদের বংশে পেয়ে আসছে, তা আমাদের বেলায় বাতিল হয়ে যাবে। এমন কোনো অপরাধ আমরা করিনি।’
‘কিন্তু এই অনুগ্রহ কি শুধু মাত্র পুরুষদের বেলায়?’ প্রশ্ন করলাম আমি।’
‘হ্যাঁ।’
‘আশ্চর্য।’
‘আশ্চর্য হতে পারেন কিন্তু সত্য।
আমি তার দিকে ভালো করে দেখলাম। অন্য যে কোনো লোক এসব কথা বললে পাগল বলেই তাকে মনে হবে। কিন্তু লুসিয়েন শান্ত অবিচলিতভাবে এই অবাস্তব ব্যাপারকে সত্য বলে বলছে। ওর মনে হ্যামনেটের সেই মনোভাব রয়েছে–‘বন্ধু হোরেশিও। দর্শন বিজ্ঞান যা স্বপ্নেও ধারণা করতে পারেনি কোনোদিন, স্বর্গে এমন পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে।’
এই যুবকের সাথে যদি প্যারিসে বসে আমার সাথে দেখা হত, তবে তাকে আমি ধাপ্পাবাজ বলে ধরে নিতাম। কিন্তু এই কর্সিকার অজ গ্রামে বসে কি ভাবা যায়। নির্বোধ বলে, না বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী অপদেবতা বা অতিথি মানুষ বলে। অতি মানুষ যদি হয় তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে যে অনেক বেশি সুখি।