‘তাই? তাহলে শুনুন, এ মীমাংসার ব্যাপারে আমার যে কি আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, তা আপনি ভাষা না বোঝার কারণে বুঝতে পারবেন না। তবে ভাষার ব্যাপারে কোনো চিন্তা নাই। আপনি দশ বছর পরে এলে দেখবেন, সবাই ফরাসি ভাষায় কথা বলছে।
‘আপনি চমৎকার উকিল হতে পারতেন।
‘মোটেই না। মীমাংসার ব্যাপারটা হয়তো কিছুটা পারি। সেটা হলো ঝগড়া মেটানোর কাজ, সবাই মিলে আমাকে ঈশ্বর আর শয়তানের মধ্যে সালিশ করে দিতে বলে তবে আমি নিশ্চয়ই সফল হব। আবার এটাও মানতে হবে আমার যুক্তি তর্ক মেনে নেয়া ঈশ্বরের পক্ষে চরম বোকামি হবে।
আর আলোচনা চালিয়ে গেলে লুসিয়েনের পক্ষে ধৈৰ্য্যচুত্যি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই আমি কথা বলা বন্ধ করলাম। লুসিয়েন ও চুপ রইল। ফলে বাকিটা পথ নীরবে চলতে চলতে এক সময় বাড়ি পৌঁছে গেলাম।
.
আমাদের জন্য গ্রিদো অপেক্ষায় ছিল।
লুসিয়েন কিছু বলার আগেই গ্রিদো তার জামার লম্বা পকেটে হাত ঢুকিয়ে তিতির পাখিটা বের করল। বন্দুকের আওয়াজেই সে পরিস্থিতি বুঝেছিল।
মাদাম ফ্রাঞ্চি তখন ঘুমাননি। তবে ঘরে চলে গিয়েছেন, গ্রিদোকে বলে গিয়েছেন, লুসিয়েন ফিরলে তার খবর পাঠিয়ে দিতে।
লুসিয়েন আমাকে জিজ্ঞেস করল, বিছানায় যাবার আগে কোনো কিছু আমার দরকার আছে কিনা। উত্তরে আমি জানালাম আর কিছু দরকার নেই।
সে তখন মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইল, আমি তাকে যেতে বলে নিজের ঘরে ঢুকলাম।
ঘরটাকে আবার ভালো করে দেখলাম, এই ঘরটাই লুইর চরিত্র সম্পর্কে আমাকে ধারণা দিয়েছিল। আমার সে অনুমান সত্য। লুই কেন লুসিয়েন। সম্পর্কেও আমার ধারণা সত্য। কিন্তু লুসিয়েনকে সামনে দেখেছি–লুইকে দেখিনি।
জামা কাপড় ছেড়ে বসলাম। এদের কাছে এসে কর্সিকার জনগণের হাবভাব সম্বন্ধে জানতে পেরে, সনাতা বেশ খুশি। ঘুম এলো না, লুই ওর আনসিরা থেকে ভিক্টর হুগো, ওরিয়েন্টালস’ বইটা বের করলাম। আগেও অনেকবার পড়েছি, তবু পড়তে ভালো লাগে। প্রথম পৃষ্ঠা পড়া শেষ হয়েছে, সেই সময় বারান্দায় পায়ের আওয়াজ পেলাম। দরজার কাছেই থেমে গেল সে শব্দ। বুঝলাম লুসিয়েন আমাকে শুভ রাত্রি জানাতে এসেছেন। কিন্তু আমি ঘুমিয়েছি ভেবে ডাকতে সাহস করছেন না।
বই টেবিলে রেখে ডাকলাম, ভেতরে আসুন।
সাথে সাথে দরজা খুলে লুসিয়েন ভেতরে এল।
এসেই বলল, ‘ফেরার পথে তেমন একটা কথা বলিনি বলে হয়তো আমাকে আপনি অভদ্র ভাবছেন, তাই আপনার কাছে ক্ষমা না চেয়ে শুতে যেতে পারছি না। ক্ষমা করুণ এবং আমার কাছে আরও যদি কিছু জানার থাকে, প্রশ্ন করুন।
আমি বললাম, ধন্যবাদ, আমার যা জানার ছিল তা জেনে গিয়েছি। তবে একটা ব্যাপারে আমি প্রশ্ন করব না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘কেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
‘ও নিয়ে আর কথার দরকার নেই। যদি জেদ ধরে বসেন, তবে প্রশ্নটা করলে আপনাকে বিব্রত হতে হবে।’
‘জেদ ধরলেই বলবেন, এ যদি হয় তাহলে আমি জেদই ধরলাম। বলে ফেলুন, কৌতূহলই সন্দেহের সৃষ্টি করে। সন্দেহই হয় অপ্রীতিকর। অপ্রিয় সন্দেহের চেয়ে অপ্রিয় সত্য ভালো।’
‘ও ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনার ব্যাপারে একটা মাত্র ধারণা আমার, সেটা হলো আপনি যাদুকর।
লুসিয়েন হেসে ফেলল, ‘বেশ ভেবেছেন, এখন আপনার চেয়ে আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। তা আমাকে আপনি যাদুকর ভাবলেন কি ভাবে?
দেখুন, আগে যা অস্পষ্ট ছিল আমার কাছে তা আপনি সবই পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তারপর দেখিয়েছেন ঐতিহ্যপূর্ণ অস্ত্রগুলি, যা আর একবার দেখার ইচ্ছা আমার আছে, একই নেয়ার দুই বন্দুকের ইতিহাসও আপনি জানিয়েছেন।
‘কিন্তু এগুলোতেই কেউ যাদুকর হয়ে যায় না।’
‘হ্যাঁ, আসল বিষয় হলো জন্মের সময় একটা দেহের বৈশিষ্ট্যের জন্য আপনি নয়শো মাইল দূরের আপনার ভাইয়ের সমস্ত অনুভূতি আপনি এখানে বসেই সমান ভাবে অনুভব করতে পারেন। আপনার ভাইও নিশ্চয়ই এই ভাবে আপনার সুখ-দুঃখের অনুভব করছে। তারপর মাদাম ফ্রাঞ্চি আপনার বিষণ্ণতার ব্যাপারে প্রশ্ন করায় আপনি জানালেন। আপনার ভাই নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছেন, কিন্তু আপনার ভাই মারা গিয়েছেন কিনা এর উত্তরে–আপনি জানালেন–না, মরে গেলে আপনি তাকে দেখতে পেতেন।
লুসিয়েন এবার গম্ভীর হয়ে গেল, ‘হ্যাঁ সেটা ঠিকই বলেছিলাম।
‘যদি অপরাধ না হয়, তাহলে ওই কথাগুলোর অর্থ আমাকে খুলে বলুন। এটাই আমার শেষ কৌতূহল।
লুসিয়েনের মুখ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হতে দেখে আমি বেশ দ্বিধার সাথেই শেষ কথাগুলো বললাম।
কথা শেষ হওয়ার পরে আমি চুপ করে যাওয়ার পরেও লুসিয়েন নীরব রইল।
কাজেই আমি আবার বললাম। সত্যিই আমার প্রশ্নটা যে বিব্রতকর তাতে এখন আমার সন্দেহ নাই। ও কথা আপনি ভুলে যান। মনে করুন ও প্রশ্ন আমি করিনি।
না ও ব্যাপারে শুধু এই বলতে পারি। আপনি একজন সাধারণ লোকের মতোই সন্দেহ পিপাসু। চার শতাব্দী থেকে আমাদের বংশে একটা প্রবাদ একটা অন্ধ বিশ্বাস চলে আসছে। সেটার সত্যতা সম্পর্কে আপনি সন্দেহ করলে আমাদের পক্ষে খুবই দুঃখের কারণ হবে।
আমি জানালাম–‘একটা কথা জেনে রাখুন। প্রবাদ বা উপকথা যাই বলুন না কেন–এ ব্যাপারে আমার চেয়ে বড় বিশ্বাসী আপনি আর কাউকে পাবেন না। এমন অনেক জিনিস আছে, যা অন্য কেউ অসম্ভব বললেও আমি সেটা সম্পূর্ণ সম্ভব বলে মনে করি।