লোকটি বেশ লম্বা, মুখে দাড়ি, কাপড় ফ্রাঞ্চির মতোই। শুধু এটাই তফাৎ অলাৰ্ত্তির পোশাক ছেঁড়া এবং পুরানো। বিভিন্ন জায়গায় মাটি লেগে নোঙরা।
আমার থেকে তারা প্রায় বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে কর্সিকার এক গ্রাম্য ভাষায় কথা বলছে, কাজেই তা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব না, কিন্তু কথা না বুঝলেও ভাবভঙ্গি বোঝা যায়।
অলাৰ্ত্তি উত্তেজিত। একটু পরপরই জোরে হাত পা নাড়ছে। লুসিয়েনের যুক্তি সে যেন ফেরাতে চাইছে। কিন্তু লুসিয়েন ঠাণ্ডা। তার কথায়ও উত্তেজনা নেই। সে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভাবে একটা মীমাংসার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
শেষে অলাৰ্ত্তির হাত পা নাড়া বন্ধ হলো, গলার স্বর ছোট হয়ে এলো।
তারপর সে একসময় হাত বাড়িয়ে দিলো লুসিয়েনের হাতের দিকে। আলোচনা শেষ করে তারা আমার দিকে এগিয়ে এল।
লুসিয়েন বলল, ‘প্রিয় সিয়ে, অলাৰ্ত্তি আপনার সাথে হাত মিলিয়ে ধন্যবাদ দিতে এসেছেন।
হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমি বললাম, ‘কিন্তু ধন্যবাদটা কিসের জন্য?
‘আপনি ওর পক্ষে জামিন হতে রাজি হয়েছেন বলে। আমি কথা দিয়েছি যে আপনি জামিন হবেন।
‘আপনি যখন কথা দিয়েছেন, তখন আমারই কথা দেয়া হয়েছে। যদিও ব্যাপারটা আমি কিছুই জানি না।’
আমার বাড়িয়ে দেয়া হাতে, অলাৰ্ত্তি আঙুল দিয়ে তা ছুঁয়ে দিল মাত্র।
লুসিয়েন বলল, এবার প্যারিসে ফিরে গিয়ে আপনি লুইকে বলতে পারবেন, সমস্ত গোলমাল তার ইচ্ছায় মীমাংসা হয়ে গিয়েছে এবং চুক্তি নামায় আপনি নিজে সই করেছেন।
‘চুক্তি? কিসের চুক্তি? বিয়ের?’
‘না এখনই না, তবে হতে কতক্ষণ।
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে অলাৰ্ত্তি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আপনি শান্তির জন্য আগ্রহী। শান্তি স্থাপিত হোক, কিন্তু সম্পর্ক স্থাপনের কোনো কথা ওঠেনি। দলিলে ও ব্যাপারে কোনো লেখা হবে না।’
‘না, দলিলে ওসব লেখা হবে কেন? এটা হবে ভবিষ্যতের ব্যাপার। এখন অন্য কথা বল, আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, আমরা যখন ওদিকে কথা বলছিলাম, তখন একটা তিতির পাখির ডাক শুনেছিলেন?’
একবার যেন মনে হয়েছিল–একটা করর করর শব্দ শুনেছি, তারপরই ডাকটা থেমে গেল। মনে করেছিলাম ভুল শুনেছি।
‘না, ভুল আপনার হয়নি। পিছনের ওই বড় গাছটাতে একটা তিতির লুকিয়ে আছে। ওটাই কালকে আমাদের খাবার হবে।’
অলাৰ্ত্তি বলল, ‘অনেক আগেই ওটাকে গুলি করে নামাতাম। শুধুমাত্র গ্রামের লোকেরা কি মনে করে এটা ভেবে, সেটা করা হয়নি।
‘আমরা সে কাজ সম্পূর্ণ করে এসেছি,’ বলল লুসিয়েন। তার বন্দুকে গুলি ভরা শেষ হলে সেটা কাঁধে নিয়ে আমাকে প্রথম গুলি করতে বলল।
আমি বাধা দিয়ে জানালাম, আমি আপনার মতো বন্দুক বা পিস্তলে ওস্তাদ না, আমরা যাওয়ার সময় আমার সহযোগিতা পাবেন।
এরপর একটা দারুণ ব্যাপার হলো। অলাৰ্ত্তি করর, করর করে তিতিরের ডাক ডাকতে লাগল, গাছের তিতিরটা ভাবল সত্যি বুঝি তার কোনো সঙ্গী ডাকছে, সঙ্গীর জন্য সে বেচারী যেই গাছ থেকে আকাশের দিকে উড়ে যাওয়া শুরু করেছে, গুড়ম তিতিরটা ঝোঁপের মধ্যে পড়ে গেল, ডায়ামালি তাকে মুখে করে নিয়ে এলো, লুসিয়েনের গুলি পাখিটার ঠিক বুকেই লেগেছে।
‘তাহলে অলাৰ্ত্তি। কাল।’
‘হ্যাঁ মঁসিয়ে লুসিয়েন কাল।’
তোমার দেরি হবে না জানি। ঠিক সকাল দশটায়, তুমি, তোমার বন্ধুরা, আত্মীয়রা সবাই গ্রামের রাস্তার শেষ দিক দিয়ে ঢুকে গির্জায় আসবে। আমরা গির্জায় থাকব।
.
৫.
আবার জঙ্গলে ঢুকল অলাৰ্ত্তি, আমরা গ্রামের পথ ধরলাম। ডায়ামাল্টি প্রথমে ঠিক করতে পারছিল না কার সঙ্গে যাবে। তা শুধু এক মুহূর্তের জন্য তারপর আমাদের দিকেই ছুটে এল।
মনে পড়ল এবার, আসবার সময় কি কঠিন চড়াই না উঠতে হয়েছে। এখন আবার সে পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নামতে হবে। এ ভেবে অনেকটা দমে গেলাম। কারণ পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নামা অনেক কঠিন।
কিন্তু লুসিয়েন মনে হয় মনের কথাটা বুঝতে পারেন, সে এবার অন্য পথ ধরল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
ঢালু রাস্তা, কাজেই নামতে নামতে কথা বলার অসুবিধা নেই। পঞ্চাশ গজের মতো এগিয়েই আমি আবার প্রশ্ন করতে শুরু করলাম।
‘তাহলে সত্যি সত্যি শান্তি স্থাপিত হলো।’
‘অনেক ঝামেলার পর, শেষ পর্যন্ত ওকে বোঝাতে পেরেছি যে যতটুকু ক্ষতি স্বীকার করবার, তা করেছে কলোনারা। দেখুন কলোনাদের মারা পড়েছে পাঁচজন, অলাৰ্ত্তিদের চার। কলোনারা শান্তি আনতে রাজি হয়েছে। গতকাল। অলাৰ্ত্তিরা রাজি হলো আজ। এ ছাড়াও কলোনারা সবার সামনে একটা জ্যান্ত মুরগি দেবে অলাৰ্ত্তিদের দশ বছর আগের সেই মুরগির জন্য। এতেই তো তারা স্বীকার করে নিল দোষটা তাদের। শুধু এই শর্তটার জন্যই। অলাৰ্ত্তিরা নরম হয়েছে।
‘তাহলে কালকে একটা মর্মস্পর্শি পূণর্মিলন হচ্ছে।’
‘সকাল দশটার সময়। আপনি ভেনডেটা দেখতে চেয়েছিলেন, একটা ভেনডেটার শেষ দেখতে পাচ্ছেন। আপনার ভাগ্য একবারে খারাপ বলতে পারি না। হ্যাঁ, চারশো বছর ধরে কর্সিকার লোকের মুখে ভেনডেটা ছাড়া অন্য কোনো কথা ছিল না। কিন্তু ভেনডেটার শুরু চাইতে দুর্লভ হলো এর অবসান দেখা, আমাদের দেশে।
আমি হেসে ফেললাম।
লুসিয়েন বলল, আপনার হাসি পাচ্ছে। তা আমাদের চরিত্র এবং রীতি হাসি পাবার মতোই।
না, সে কারণে হাসিনি আমি। হেসেছি এটা লক্ষ্য করে যে, আপনার এই মীমাংসার সাফল্যে আপনি খুশি না হয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন।