গাইদিসের অনুচরেরা দুর্গ আক্রমণের সাহস পেল না, স্যাভিলিয়া ঘোষণা করে দিয়েছিল, সেরকম কোনো চেষ্টা হলে সঙ্গে সঙ্গে গাইদিস মারা যাবেন।
অনেক দিন স্যাভিলিয়ার কারাগারে ছিলেন গাইদিস। তাকে না মেরে বাঁচিয়ে রাখাটা যে কত বড় ভুল হয়েছে, তা টের পেলেন অনেক দেরিতে। এক চাকরাণীর সাহায্যে গাইদিস পালিয়ে গেল কারাগার থেকে এবং সঙ্গে সঙ্গে অনেক সৈন্য নিয়ে এসে আক্রমণ করল ইস্ত্রিয়া। যুদ্ধে পরাজিত এবং বন্দি হলো স্যাভিলিয়া। গাইদিস এক লোহার খাঁচায় বন্দি করে তাকে রাস্তার উপর রেখে দিলেন। সেইখানেই কয়েকদিন দুঃখ ভোগের পর মারা গেলেন স্যাভিলিয়ার।’
কথা বলতে বলতে ততক্ষণে আমরা ভাঙা দুর্গের ভেতরে এসে পড়েছি। দেয়ালের ফাঁক দিয়ে জ্যোা এসে প্লাবিত করে দিয়েছে সম্পূর্ণ দুৰ্গটা। কিন্তু দেয়ালের নিচেই জমাট অন্ধকার। সেদিকে তাকিয়েই লুসিয়েন ইতিহাস বলে চলল সেই দুর্গের।
স্যাভিলিয়ার মৃত্যুতে যে ভেনডেটা শুরু হলো, তা শেষ হলো চারশো বছর পর। আমার বাবার সময়। আমাদের বাড়ি পাশাপাশি দুটো বন্দুক ঝোলান দেখেছেন। তাতে একটাই তারিখ খোদাই কর আছে ১৮১৯ এর ২১ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা। ঐ তারিখেই গাইদিস বংশের শেষ দুই বংশধর মারা যায়। একজন আবার বাবার গুলিতে, দ্বিতীয়জন আমার মায়ের গুলিতে।’
ওরা কি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়াই করছিলেন? আমি জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না।
‘মোটেই না। গাইদিস বংশে ১৮১৯ সালে দুই ভাইই বেঁচে ছিল। আমাদের বংশে আমার বাবা। বাবা ২১ সেপ্টেম্বর সার্টেন গিয়েছিলেন, তিনি ফিরে আসবেন অনসেভো রোড ধরে। গাইদিসদের একজন সেই জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল, আড়াল থেকে গুলি করার জন্য। অন্য ভাই লোজন নিয়ে এসে ২১ সেপ্টেম্বর সকাল বেলায় আক্রমণ করল আমাদের সুল্লাকারোর বাড়ি। বাবা বাড়িতে নেই। অরক্ষিত ঘর দখল করে ধ্বংস করার এই সুযোগ।
সুযোগ কিন্তু দুর্যোগে পরিণত হলো ওদের জন্য। বাবা ছিলেন সর্তক। অলমেডোর রাস্তায় গাইদিস যে কোথায় লুকিয়ে আছে। তা তিনি আগেই জেনে ফেলেছিলেন। ফলে গাইদিস গুলি করার আগেই বাবার গুলিতে গাইদিস ভাই মারা পড়ল জঙ্গলে। বাবা পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখলেন তখন ঠিক বেলা এগারোটা।
ঠিক একই সময় সুল্লাকারোর বাড়িতে দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে মাও বন্দুক ছুড়ছেন। নিচে দ্বিতীয় গাইদিস ভাই দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে তার লোকজন নিয়ে। কিন্তু মায়ের বন্দুক থেকে ছোঁড়া গুলি কয়েক লোকের মধ্যে থেকে ঠিক দ্বিতীয় গাইদিস ভাইয়ের শরীরে ঢুকল। মাটিতে পড়ার সাথে সাথে মারা গেল সে। মা মুখ ফিরিয়ে দেয়ালের গায়ে ঘড়ি দেখলেন, দুপুর ঠিক এগারোটা।
চারশো বছর পরে স্যাভিলিয়ার মৃত্যুর প্রতিহিংসা শেষ হলো, এক সাথে গাইদিসের শেষ দুই বংশধর পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। এই ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যেই বন্দুক দুটিতে সন তারিখ লিখে টানানো। হয়েছে।
ওই তারিখের ঠিক সাত মাস পর আমাদের জন্ম। এমন মা বাবার ছেলে হয়ে কি করে যে লুই দার্শনিক হয়। তা আমার বোঝার বাইরে।
ঠিক এমন সময়।
চাঁদের আবছায়া আলো।
সেই আলো ছায়ায় এসে দাঁড়াল একজন মানুষ সাথে কুকুর। এসেই খুনি বা দস্যু অলাৰ্ত্তি সাথে কুকুর ডায়ামন্টি। সময় রাত নয়টা।
সময়ানুবর্তিতাই রাজাদের সৌজন্য–‘বলতেন ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই। এই অলাৰ্ত্তি ও তারই অনুসারী।
অলাৰ্ত্তি দেখে আমরা দুইজনেই উঠে দাঁড়ালাম।
অলাৰ্ত্তি বলল, ‘আপনার সঙ্গে ইনি কে, সেনর লুসিয়েন।
‘ওর জন্য চিন্তার কোনো কারণ নেই অলাৰ্ত্তি। ইনি আমার বন্ধু। আমার মুখ থেকে তোমার কথা শুনেই তোমার সাথে দেখা করার জন্য আগ্রহী হয়েছে। তাই তাকে সাথে নিয়ে এসেছি।
আমাকে সালাম জানিয়ে অলাৰ্ত্তি বলল, এদেশে মঁসিয়ে কে স্বাগত জানাচ্ছি।’
আমিও তাকে ফিরতি সালাম দিলাম।
অলাৰ্ত্তি বলল, ‘আপনারা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন?’
‘প্রায় বিশ মিনিট হবে।’
‘মাচিওতে ডায়ামাল্টি যখন কাঁদছিল তখন আমি শুনেছি। তারপর পনেরো মিনিট আগে সে আমার কাছে এল। ডায়ামাল্টি সত্যিই খুব বিশ্বস্ত কুকুর। মঁসিয়ে লুসিয়েন।
ডায়ামাল্টিকে আদর করতে করতে বলল, তোমার কথা ঠিক, অলার্তি ডায়ামাল্টি সত্যিই বিশ্বস্ত কুকুর।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যদি জানতেন লুসিয়েন এখানে কুড়ি মিনিট আগে এসেছেন, তাহলে এত দেরি করলেন কেন?
‘আসব কেন? অলাৰ্ত্তি বলল, আমাদের দেখা করার সময় ঠিক হয়েছে। রাত নয়টায়। ঠিক সময়ের পরে এলেও যেমন সময়ানুবর্তিতা ঠিক থাকে না তেমনি ঠিক থাকে না আগে এলেও।
‘তুমি কি আমাকে লক্ষ্য করে কথা বলছ?’ লুসিয়েন হেসে জিজ্ঞেস করল।
‘না–আপনার সাথে নতুন একজন বন্ধু রয়েছে, তার জন্যই আপনাকে আগে আসতে হয়েছে। তা আমি জানি। আমার জন্য অনেক কষ্ট আপনি করেছেন।’
তার জন্য আর ধন্যবাদ দিতে হবে না। অলাৰ্ত্তি, সে কষ্ট বোধ হয় শেষ হতে চলল এবার।
‘সে ব্যাপারে তো এখনও আলোচনা করার দরকার আছে, মঁসিয়ে লুসিয়েন।
আমার দিকে ফিরে লুসিয়েন বলল, আমরা যদি একটু আড়ালে যাই তা হলে আপনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না।
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলাম।
ভাঙা দেয়ালের যে পথ দিয়ে অলাৰ্ত্তি এসেছিল। সেই ফাঁক দিয়েই দুজনে বেরিয়ে গেল। জ্যোত্নার আলোয় এবার অলার্তিকে ভালোভাবে দেখতে পেলাম।