থেমে, একটু দুখের হাসি দিল লুসিয়েন, মানুষ ঝগড়া করে। আবার ঝগড়া মিটেও যায়। ঝগড়া শেষে শান্তিতে থাকে। গির্জায় গিয়ে এক সাথে উপসনাও করে। কিন্তু কুকুররা একবার ঝগড়া করলে কখনও আর একপাত্র থেকে খাবার খাবে না।’
‘সত্যিকার কর্সিকার আবহাওয়ায় মানুষ আপনার কুকুর দুটো। হেসে বললাম আমি। কিন্তু ডায়ামাল্টির কথা বলার পর থেকেই তো তাকে দেখতে পাচ্ছি না। কোথাও গেল ও।
‘ব্যস্ত হবেন না। ও গেছে লী মাচিওতে।
ভাবছি জিজ্ঞেস করব, কোথায় লী মাচিও। তখনই কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম। ডাক না বলে কান্না বলাই উচিত। এত করুণ এবং একটানা আমি ক্ষেপে উঠলাম অমঙ্গল আশা করে। লুসিয়েনের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও কী?’
‘ডায়ামাল্টি কাঁদছে।’
‘কাঁদছে, কার জন্য?
‘ওর মালিকের জন্য। ও মানুষ না, যে ওর মালিক মরে গেছে বলেই তাকে ভুলে যাবে।’
‘আর একবার আরও করুণ, একটানা সুরে ডায়ামাল্টি কেঁদে উঠল।’
‘বুঝেছি ওর মালিক এর কাছাকাছিই শত্রুর হাতে মারা গিয়েছিল।
‘হ্যাঁ। তাই আমাদের পিছনে ফেলে ডায়ামাল্টি লী মাচিতে চলে গেছে।’
‘তার কবর কি লী মাচিওতে?’
‘তা, কবর বলুন বা স্মৃতিস্তম্ভ বলুন। আমাদের দেশের নিয়ম হলো যখন কোনো লোক নিহত হবে, তার কবরের পাশ দিয়ে যে কেউ হেঁটে যাবে। সেই কবরের উপর রেখে যাবে একটা গাছের ডাল অথবা এক টুকরো পাথর। তার ফলে সাধারণ লোকের কবর এক সময় ধুলায় মিশে গেলেও যারা এই ভেলডেটায় শহীদ হন তাদের কবর দিনে দিনে বাড়তে থাকে। যেমন বেড়ে চলে তাদের জীবিত আত্মীয়দের প্রতিহিংসা।’
তৃতীয় বার শোনা গেল ডায়ামাল্টির কান্না। এবার এত কাছে যে সব জানার পরও আমি শিউরে উঠলাম। তারপরেই পথের মোড় ঘুরতেই আমাদের বিশ গজ সামনে দেখলাম ৪/৫ ফুট উঁচু সাদা একটা পাথরের ঢিবি। সমাধিস্তম্ভ। এরই নাম লী মাচিও।
এই অদ্ভুত স্মৃতিস্তম্ভের সামনে ডায়ামাল্টি সে আছে। লুসিয়েন একটা পাথর তুলে নিয়ে মাথার টুপি খুলে লী মাচিওর কাছে গেল।
লুসিয়েনের দেখাদেখি আমিও তার অনুসরণ করলাম।
স্তম্ভের কাছে দাঁড়িয়ে সে একটা ওক গাছের ডাল ভেঙে নিল। তারপর প্রথমে পাথর রাখল তারপর দিল ডাল। তারপর তাড়াতাড়ি বুড়ো আঙুল দিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন আঁকল। স্বয়ং নেপোলিয়নকেও সংকটের সময় এই রকম চিহ্ন আঁকতে দেখা গিয়েছে।
লুসিয়েন যা করছে। আমিও তাই করছি।
তারপর আবার হাঁটতে শুরু করলাম–ডায়ামাল্টি পিছনে বসে রইল। প্রায় দশ মিনিট পরে তার শেষ হাহাকার শুনতে পেলাম আমরা। প্রায় সাথে সাথে সে মাথা এবং নেজ নিচু করে আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে এগিয়ে গেল। প্রায় একশো গজ এগিয়ে আবার ঝোঁপের ভেতর শত্রুর খোঁজ করতে লাগল।
.
পথ চলতেই বুঝলাম, লুসিয়েন ঠিকই বলেছিল। পথ বেশ কষ্টের চড়াই। বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলাম। কারণ এবার উপরে উঠতে দুই হাতই দরকার। আমার সামনের লোকের কথা আলাদা। সে এমন ভাবে পথ চলছে যেন সমতল দিয়েই সে হেঁটে যাচ্ছে। পাথর থেকে পাথরে লাফাতে লাফাতে কিছুক্ষণ পরেই আমরা একটা সমান জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। তার মাথার উপর চারিদিকে ভাঙা দেয়াল। এই ইস্ত্রিয়া দুর্গ, আমাদের গন্তব্য স্থান।
আরও পাঁচ মিনিট চড়াই উঠতে হলো, আরও খাড়া আরও দুর্গম। সবচেয়ে উঁচু ধাপে উঠে লুসিয়েন হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে তুলল।
‘প্যারিসে বাড়ি হলে কি হবে? পাহাড়ে উঠতে আপনি আনাড়ি না।’
‘তা নই। এর আগেও আমি পাহাড়ে উঠেছি।’
লুসিয়েন হেসে বলল, ‘প্যারিসের মন্ট মার্টার পাহাড়ে বুঝি।’
‘তা তো ঠিক। কিন্তু মন্ট মার্টার পাহাড় ছাড়াও অনেক পাহাড়ে উঠেছি আমি রিগি, ফ্রাউন হল, জেসি, ভিসুভিয়াস, ঐখনি, এটনা।’
তাহলে এখন আপনার কাছে শিশু হয়ে গেলাম। আমি তো এক মন্ট রোগেন্ডে ছাড়া আর অন্য কোনো পাহাড়েই চড়িনি। যাক, আমরা এসে গেছি, চার শতাব্দী আগে এলে আপনাকে এখন আমার পূর্ব পুরুষেরা সিংহ দরজা খুলে দিয়ে ইস্ত্রিয়া দুর্গে স্বাগত জানাত। আজ তার বংশধর এই ভাঙা দেয়াল দেখিয়ে আপনাকে বলতে পারে। স্বাগত এই ধ্বংস স্তূপে।’
‘তাহলে কি এই দুর্গ ভিসেন্টনো দ্য ইস্ত্রিয়ার মৃত্যুর পর থেকে আপনাদের দখলে আছে।’
‘না, তা নেই লুসিয়েন তাড়াতাড়ি উত্তর দিল–কখনও এ দুর্গ আমাদের অধিকারে আসেনি। কিন্তু এর শেষ মালিক ছিলেন সেই বিখ্যাত স্যাভিলিয়া, লুসিয়েন দি ফ্রাঞ্চির বিধবা স্ত্রী। ওই লুসিয়েন যে আমাদের পূর্ব পুরুষ তা তো আপনাকে আগে জানিয়েছি।
এই মহিলার সম্পর্কে একটা ভয়াবহ গল্প প্রচলিত আছে না? একটু ইতস্তত ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘হ্যাঁ আছে, দিনে হলে থামলেই আর একটা ধ্বংসস্তূপ দেখতে পেতেন, সেটা ছিল সেনর দ্য গাইদিস এর বাড়ি। স্যাভিলিয়া যেমন ছিল সবার শ্রদ্ধার পাত্রী ওই গাইদিস ছিল সবার ঘৃণার পাত্র, স্যাভিলিয়া ছিলেন সুন্দরী, গাইদিস ছিল কুশ্রী। কিন্তু নিয়তি স্যাভিলিয়া বিধবা হবার পর গাইদিস তাকে বিয়ে করতে চাইল। স্যাভিলিয়া সে প্রস্তাব ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করার পর, গাইদিস শাসিয়ে খবর পাঠাল স্বেচ্ছায় বিয়ে না করলে, গায়ের জোরে সে স্যাভিলিয়াকে তুলে নিয়ে যাবে, তখন স্যাভিলিয়ার চাইতে গাইদিসের লোকজন ছিল বেশি, যুদ্ধ হলে স্যাভিলিয়ার জয়ের সম্ভবনা ছিল না। তাই তিনি আশ্রয় নিলেন কৌশলের। নিমরাজী ভাব দেখিয়ে তাকে দাওয়াত দিলেন এই দুর্গে খাবারের। ফাঁদে পা দিল মূর্খ গাইদিস। সে যে তাকে আগে ভয় দেখিয়েছিল, এ কথা ভুলে গিয়ে মাত্র একজন সঙ্গী নিয়ে ইস্ত্রিয়া দুর্গে এসে হাজির হলো। আসার সাথে সাথে তাকে বন্দি করলেন স্যাভিলিয়া।