ক্যাপ্টেন মাথা ঝাঁকিয়ে না বললেন। কাউন্টের মুখের শীতল হাসি আর জ্বলজ্বলে চোখ দেখে তার ভয় করছিল।
–ওই জার্মান অফিসার আমার ছেলের সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু পরের দিন ওদের একটা অন্য গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। জানেন ক্যাপ্টেন, দুর্ভাগ্যবশত এই নতুন জায়গার জার্মান অফিসারটি ছিল গুন্ডা প্রকৃতির ও অত্যন্ত বদ। সে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করত আর কারণে-অকারণে তাদের অপমান করত। একদিন রাতে তার অপমানের বিরুদ্ধে আমার ছেলে উচিত জবাব দিতেই ওই বদমাইশ জার্মান অফিসার তার চোখের ওপর ঘুসি মারে–ঠিক এইরকম করে!
ঘুষির আওয়াজে সারা ঘরটা যেন ঝনঝন করে উঠল। ক্যাপ্টেন বাউমগার্টেনের মাথাটা ঝুলে পড়ল বুকের ওপর আর তিনি মুখে হাত চাপা দিতেই হাতের ফাঁক দিয়ে রক্তের ধারা বেরিয়ে এল। কাউন্ট আবার ধীরেসুস্থে তার চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
–ওই ঘুষিতে আমার ছেলের মুখটা বিকৃত হয়ে যায় আর সেই পাষণ্ড জার্মান তাই নিয়ে আমার ছেলেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত।…ক্যাপ্টেন, আপনাকেও এখন দেখতে বেশ হাস্যকর লাগছে। আপনাকে এখন দেখলে আপনার কর্নেল নিশ্চয় ভাববেন যে কোথাও দুষ্টুমি করতে গিয়ে আপনি মার খেয়ে এসেছেন। যাই হোক, গল্পেতে আবার ফেরা যাক। আমার ছেলে তখন কপর্দকশূন্য। তাই দেখে একজন দয়ালু জার্মান মেজর ওকে দশটি স্বর্ণমুদ্রা কোনওরকম কিছু বন্ধক ছাড়াই ধার দেন। আমি সেই মেজরকে চিনি না, তাই এই দশটি স্বর্ণমুদ্রা, ক্যাপ্টেন, আপনার মাধ্যমে আমি ফেরত দিলাম–এগুলি গ্রহণ করুন। সেই দয়ালু জার্মান মেজরের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
–ওই গুন্ডা প্রকৃতির অফিসারটি ইতোমধ্যে যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে একটার-পর-একটা নতুন জায়গায় যাচ্ছিল। আমাদের বংশের কেউ কখনও কোনও অপরাধ মাথা নুয়ে সহ্য করে না। তাই আমার ছেলের ওপর সেই পাষণ্ডের অত্যাচার চলতেই থাকল। সে আমার ছেলেকে কখনও হাত দিয়ে মারত, কখনও লাথি মারত, আবার কখনও বা তার গোঁফের চুল টেনে ছিড়ত–ঠিক এইভাবে, এইভাবে, এইভাবে।
ক্যাপ্টেন বাউমগার্টেন যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন। কিন্তু বিশালকায় এই মানুষটির ক্রমান্বয় আঘাতের সামনে তিনি অসহায়। শেষে অর্ধচেতন ও প্রায় অন্ধ অবস্থায় তিনি যখন কোনওক্রমে উঠে দাঁড়ালেন, কাউন্ট আবার ধাক্কা মেরে তাকে সেই চেয়ারেই বসিয়ে দিলেন। নিষ্ফল রাগে, অপমানে ক্যাপ্টেন ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন।
–আমার ছেলেটাও অপমানে এইরকমই আপনার মতো কেঁদে ফেলত। বললেন কাউন্ট,-ভেবে দেখুন, উদ্ধত ও নির্দয় শত্রুর বিরুদ্ধে কিছু না করতে পারার অসহায়তা কী নিদারুণ! আমার ছেলের মুখের বিকৃত, রক্তাক্ত অবস্থা দেখে একজন জার্মান সেপাই ওর মুখে ব্যান্ডেজ করে দেয়। আপনারও দেখছি চোখের থেকে রক্তপাত হয়েছে। আমার এই সিল্কের রুমালটা দিয়ে আপনার ক্ষতস্থানটা কি বেঁধে দেব?
কাউন্ট ঝুঁকতেই, ক্যাপ্টেন এক ঝটকায় তার হাতটা সরিয়ে দিলেন।
–তোমার মতো পাষণ্ডের অত্যাচার সহ্য করতে পারি, কিন্তু অসহ্য তোমার এই ভণ্ডামি। বিকৃত গলায় পেঁচিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে কাউন্ট বললেন–ঘটনাগুলি আমি খালি ক্রমানুসারে বলে যাচ্ছি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, প্রথম যে জার্মান অফিসারের সঙ্গে আমার দেখা হবে, তাকে সবকিছু বলব। কত অবধি যেন বলেছি-হ্যাঁ, সেই দয়ালু জার্মান সেপাইয়ের কথা পর্যন্ত। খুবই খারাপ লাগছে যে আপনি আমার হাতের থেকে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও করাতে চাইছেন না! যাই হোক, আমার ছেলেকে এর পর পনেরো দিন বন্দি করে রাখা হয়। সবথেকে খারাপ লাগত যখন ও কুঠুরির জানলার কাছে সন্ধের সময় চুপচাপ বসে থাকত আর জার্মান সেপাইরা ওকে নিয়ে ব্যঙ্গ করত, যেন ও একটা রাস্তার কুকুর! আপনিও আপাতত যেভাবে বসে আছেন তা নিয়ে ব্যঙ্গ করা যায়, তাই না?–চুপ করে বোস ওই চেয়ারে, কুকুর কোথাকার!
–হ্যাঁ, দিন পনেরো বন্দি থাকার পর আমার ছেলে আর ওর বন্ধু পালাল। কত বিপদের সামনে যে ওরা পড়েছিল, কত কষ্ট করতে হয়েছিল ওদের–সেসব এখন বলে লাভ নেই। ওরা কৃষকের ছদ্মবেশে রাতের পর রাত হেঁটে জার্মানদের অধিকৃত জায়গার শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। মুক্তি যখন মাত্র আর একমাইল দূরে, তখন জার্মানদের এক টহলদারী সেনাদলের হাতে ওরা ধরা পড়ে গেল। তীরে এসে তরী ডোবা একেই বলে, তাই না?
কাউন্ট এবার হুইসলটা দু-বার বাজালেন। তিনজন রুক্ষদর্শন চাষা-ভূষো গোছের লোক ঘরের মধ্যে চলে এল।
–মনে করুন, এই তিনজন আমার টহলদারী সেনা। বললেন কাউন্ট,–যে জার্মান ক্যাপ্টেনের কাছে আমার ছেলে ও তার বন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হল, তিনি বিনা বিচারেওদের ফাঁসির হুকুম দিলেন। ওদের অপরাধ? ওরা ফরাসি সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও বেসামরিক পোশাকে জার্মানি অধিকৃত জায়গায় ধরা পড়েছে। যা, ওই মাঝখানের কড়িকাঠটা ব্যবহার কর, ওটা বেশ পোক্ত আছে।
তারপর ক্যাপ্টেনকে তাঁর চেয়ার থেকে উঠিয়ে টানতে টানতে ঘরের মাঝখানে নিয়ে যাওয়া হল। তার মাথার ঠিক ওপরেই ফাঁস দেওয়া একটা মোটা দড়ি ঝোলানো। ফঁসটা ক্যাপ্টেনের মাথার ওপর দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হল। তিনি গলায় দড়ির কর্কশভাব অনুভব করতে পারছিলেন। সেই তিনজন লোক দড়ির এক প্রান্ত ধরে কাউন্টের আদেশের অপেক্ষায় রইল।