আগের প্রজন্মের চারজন কাউন্টের বিশাল অয়েল পেন্টিং ঝুলছে ফায়ারপ্লেসের উলটোদিকের দেওয়ালে। প্রত্যেকেরই নাক বাজপাখির ঠোঁটের মতো আর মুখমণ্ডলে এক ধরনের উগ্রতা। চারজনকে প্রায় একইরকম দেখতে। পোশাকের তফাত ছাড়া তাদের আলাদাভাবে চেনা কঠিন। এই চারজনের ছবি দেখতে-দেখতে ঘরের আরামদায়ক উষ্ণতায় ঘুমে চোখ বুজে এল ক্যাপ্টেনের। একটু পরেই তার মাথাটা ঝুলে পড়ল বুকের ওপর।
হঠাৎ একটা ছোট্ট আওয়াজ শুনে ক্যাপ্টেন তড়াক করে উঠে পড়লেন। ঘুমের চোখে তার প্রথমে মনে হল পেন্টিং এর একটি চরিত্র যেন ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। তারপরেই ক্যাপ্টেন বুঝলেন তার একহাত দূরে টেবিলের পাশে বিশাল চেহারার এক রক্তমাংসের মানুষ দাঁড়িয়ে। স্থির, জ্বলজ্বলে দুটি চোখ ছাড়া প্রায় মৃতের মতো স্তব্ধ।
মানুষটির চুল কালো, গায়ের রং জলপাইয়ের মতো। থুতনিতে চুঁচলো কালো দাড়ি। নাকটা বাজপাখির ঠোঁটের মত। গালের চামড়া কিছুটা কুঁচকে গেছে, কিন্তু চওড়া কাঁধ আর কবজির হাড় দেখে বোঝা যায় যে বয়স তাঁর অপরিসীম শারীরিক শক্তিকে গ্রাস করতে পারেনি। হাত দুটো বুকের ওপর জড়ো করা আর মুখে শীতল হাসি।
–না, না, আপনার অস্ত্রশস্ত্রগুলো খোঁজার জন্য কষ্ট করবেন না। ক্যাপ্টেন খালি চেয়ারের দিকে আড়চোখে তাকাতেই মানুষটি বলে উঠলেন,–আপনি বোধহয় একটু অবিবেচক। যে বাড়ির ভেতরটা এমন গোলোকধাঁধার মতো, আর যেখানে এত গোপন যাতায়াতের জায়গা আছে, সেখানে আপনি এত নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলেন! কেমন মজা দেখুন তো-আপনি যখন খাওয়াদাওয়া করছিলেন, তখন আমার চল্লিশজন লোক আপনার ওপর নজর রাখছিল।…এ কী, এটা আবার কী করছেন?
ক্যাপ্টেন দু-হাতে ঘুষি পাকিয়ে এগোতেই, আগন্তুক ডান হাতে রিভলভার ধরে বাঁ-হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে ক্যাপ্টেনকে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।
–চুপ করে বসে থাকুন। আপনার লোকজনের ব্যাপারে ভাবতে হবে না। ওদের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এখন আর আপনার অধীনস্থ কোনও দল এখানে নেই। সুতরাং এখন খালি নিজের কথাই ভাবুন।…কী নাম আপনার?
–আমি ২৪ নম্বর পোসেন রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন বাউমগার্টেন।
–বেশ ভালোই ফরাসি বলেন দেখছি, অবশ্য একটু জার্মানসুলভ টান আছে উচ্চারণে। আশা করি জানেন আমি কে।
–আপনি এই প্রাসাদের মালিক কাউন্ট ইউস্তাস।
–ঠিক ধরেছেন। আমার বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে দেখা বা একটু কথাবার্তা না হলে খুব দুভাগ্যের ব্যাপার হত। এর আগে বহু জার্মান সৈনিকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, কিন্তু এই প্রথম একজন জার্মান অফিসারের মুখোমুখি হলাম। আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে।
ক্যাপ্টেন চেয়ারে চুপ করে বসে রইলেন। কাউন্টের কথা ও ব্যবহারের মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যে ক্যাপ্টেন তাঁর শিরদাঁড়ায় একটা অজানা আশংকার শিরশিরানি টের পেলেন। তার অস্ত্রশস্ত্র আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলেন না। তাছাড়া কাউন্টের বিশাল আকৃতি ও শক্তির কাছে তিনি যে শিশু, সেটা একটু আগেই ক্যাপ্টেন বুঝতে পেরেছেন। কাউন্ট হঠাৎ মদের বোতলটা আলোর দিকে তুলে বলে উঠলেন,–ছি! ছি! পিয়ের আপনাকে এই অতিসাধারণ ওয়াইনটা দিয়েছে। কী লজ্জার কথা বলুন তো! না, না, আরও ভালো কিছু আনানো যাক।
কাউন্টের জ্যাকেটের গলার কাছে ঝোলানো একটা হুইল–সেটা তিনি বাজালেন। সেই কাজের লোকটি তৎক্ষণাৎ ঘরে এসে হাজির হল।
–১৫ নম্বর বিন থেকে পুরোনো একটা ভালো ওয়াইন নিয়ে এসো।
কাউন্ট আদেশ দেওয়ার খানিক পরেই পিয়ের অতি সন্তর্পণে একটা বোতল নিয়ে এল। কাউন্ট তার থেকে দুটো গ্লাস ভরলেন।।
–নিন, খান! আমার সংগ্রহের সব থেকে ভালো ওয়াইনের মধ্যে এটি একটি। খান, আনন্দ করে খান। মাংস, গলদা চিংড়ি–এসবও আছে। কিছু আনাব নাকি? আর একবার একটু ভালো করে ডিনার করুন। বললেন কাউন্ট।
ক্যাপ্টেন ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানালেন। তবে ওয়াইনের গ্লাসটা শেষ করলেন। গ্লাসটা আবার ভরে দিয়ে কাউন্ট বললেন, আমার বাড়ির সবকিছুই আপনার জন্য। আপনি চাইলেই হল! যাই হোক, আপনি ওয়াইনটা খেতে থাকুন আর আপনাকে আমি একটা গল্প বলি। গল্পটি কোনও জার্মান অফিসারকে বলার জন্য আমি বড় উৎসুক ছিলাম। আমার একমাত্র সন্তানকে নিয়ে এইগল্প। ও যুদ্ধবন্দি হয়ে পালাতে গিয়ে মারা যায়। গল্পটি বিচিত্র এবং আপনাকে আমি হলফ করে বলতে পারি, এ-গল্প আপনি জীবনে ভুলতে পারবেন না।
–আমার ছেলেটা বড় ভালো ছিল ক্যাপ্টেন। গোলন্দাজ বাহিনীতে অফিসার, ওর মায়ের গর্ব। ওর মৃত্যুর খবর আসার এক সপ্তাহের মধ্যে ওর মা মারা যান। মৃত্যুর খবরটা এনেছিল ওর এক সহকর্মী, যে বেঁচে পালাতে পেরেছিল। ও যা বলেছিল সেটাই আপনাকে বলতে চাই।
–৪ঠা আগস্ট আমার ছেলে উইসেনবুর্গে ধরা পড়ে। যুদ্ধবন্দিদের কয়েকটা দলে ভাগ করে জার্মানরা তাদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। আমার ছেলেকে পাঁচ তারিখে যে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানকার জার্মান অফিসার ওদের সঙ্গে ভদ্র ও সদয় ব্যবহার করেন। ওই জার্মান অফিসার আমার ক্ষুধার্ত সন্তানকে খাবার দেন, সঙ্গে এক বোতল ভালো ওয়াইনও দেন–যেমন আমি আপনাকে দিলাম। উনি আমার ছেলেকে নিজের বাক্স থেকে একটা চুরুট-ও দেন।…নেবেন নাকি একটা চুরুট?