রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ সোয়া সবাইকে নিয়ে এসে থামল দুটো বড় থাম লাগানো একটা প্রকাণ্ড লোহার গেটের সামনে। গেটের সঙ্গে লাগানো পাঁচিল মাঝে-মাঝেই ভেঙে গেছে। চারপাশে আগাছা আর কাটাঝোঁপ। ভাঙা পাঁচিলের মধ্য দিয়ে কম্পাউন্ডে ঢুকে পুরো দলটা ওক গাছের ছায়ার নীচে লুকিয়ে এগিয়ে গেল প্রাসাদের দিকে।
কালো রঙের প্রকাণ্ড প্রাসাদ। বর্ষাকালের ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না এসে প্রাসাদের ওপর একটা আলো আঁধারি পরিবেশ তৈরি করেছে। প্রাসাদের আকৃতি অনেকটা ইংরেজি এল অক্ষরের মতো। সামনে খিলান দেওয়া একটা নীচু দরজা। আর দেওয়াল জুড়ে জাহাজের জানলার মতো ছোট-ছোট জানলা। ছাদের কিছু কিছু অংশ কোণার দিকে ভেঙে পড়েছে।
একতলার একটা জানলায় আলো দেখা যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন নীচু গলায় আদেশ দিয়ে দলের লোকদের বাড়িটার বিভিন্ন দিকে পাহারা দিতে পাঠালেন। তিনি আর সার্জেন্টে পা টিপেটিপে জানলার কাছে গিয়ে উঁকি মারলেন ভেতরে।
ঘরটা ছোট, আসবাব সামান্যই। সাধারণ কাজের লোকের পোশাক পরা একজন বয়স্ক লোক একটা কাঠের চেয়ারে বসে মোমবাতির আলোয় একটা ছেঁড়া কাগজ পড়ছিল। পা দুটো সামনে একটা বাক্সের ওপর তোলা। পাশেই টুলের ওপর একটা মদের বোতল ও গেলাস। জানলার মধ্যে দিয়ে বন্দুক ঢোকাতেই লোকটা ভয়ে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল।
–একদম চুপ! পুরো বাড়ি আমরা ঘিরে ফেলেছি। পালানোর কোনও রাস্তা নেই। এসে দরজাটা খুলে দাও, নাহলে আমরা জোর করে ভেতরে ঢুকব।
–গুলি চালাবেন না! এক্ষুনি দরজা খুলে দিচ্ছি।
একটু পরেই পুরোনো তালা খোলার ও দরজার হুড়কো সরানোর আওয়াজের সঙ্গে-সঙ্গে দরজাটা খুলে গেল আর কয়েকজন জার্মান সৈন্যকে নিয়ে ক্যাপ্টেন বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
–এই প্রাসাদের মালিক কাউন্ট ইউস্তাস কোথায়?
–মালিক তো এখন নেই। বাইরে গেছেন।
–এত রাতে বাইরে? মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাওনি?
–সত্যি বলছি উনি বাড়িতে নেই।
–কোথায় গেছেন?
–জানি না।
–কী করতে গেছেন?
–জানি না…স্যার, পিস্তলটা আমার দিকে ওভাবে তাক করবেন না। আপনারা আমায় মেরে ফেলতে পারেন, কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই, তা কী করে দেব?
–প্রায়ই কি উনি এরকম সময়ে বাইরে যান?
–হ্যাঁ।
–কখন ফেরেন?
–রাত ফুরোবার ঠিক আগে।
ক্যাপ্টেন বাউমগার্টেন যুগপৎ হতাশ ও বিরক্ত হলেন। লোকটা বোধহয় ঠিকই বলছে–লর্ড হয়তো সত্যিই বাড়িতে নেই। কিছু লোককে প্রাসাদের সামনে আর কয়েকজনকে পিছনে পাহারা দিতে বলে তিনি আর সার্জেন্ট কাজের লোকটিকে সামনে রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লেন। বাড়িটা সার্চ করা দরকার। ভয়ে কাঁপছিল লোকটি। তার হাতে ধরা মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় বাড়ি সার্চ করা হল। একতলার বিশাল রান্নাঘর থেকে শুরু করে দোতলার বিশাল খাওয়ার ঘর পর্যন্ত পুরো প্রাসাদ সার্চ করেও কোথাও কোনও জীবনের লক্ষণ পাওয়া গেল না। একদম ওপরে চিলেকোঠায় ছিল মেরি–কাজের লোকটির স্ত্রী। বাড়িতে আর কোনও চাকর-বাকর নেই এবং মালিকের কোনও চিহ্ন নেই।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সার্চের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারলেন ক্যাপ্টেন বাউমগার্টেন।
বাড়িটা সার্চ করা সত্যিই কঠিন। সরু-সরু সিঁড়ি, যাতে একজনই যেতে পারে। বাড়ির চতুর্দিকে গোলোকধাঁধার মতো অজস্র অলিন্দ। দেওয়ালগুলো এত চওড়া যে পাশাপাশি ঘরগুলোও কার্যত সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। বিশাল সাইজের ফায়ার প্লেস। জানলাগুলো দেওয়ালের মধ্যে প্রায় ছফুট ঢোকানো। বহু চেষ্টা করেও কিন্তু ক্যাপ্টেন কোথাও কোনও গুপ্ত লুকোনোর জায়গা খুঁজে পেলেন না।
অবশেষে তিনি সার্জেন্টকে বললেন,–আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে। এই কাজের লোকটার সঙ্গে আমাদের একজন গার্ডকে রেখে দাও। লক্ষ রেখো, ও যেন কারোর সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ না করে। বাইরে যারা পাহারা দিচ্ছে তাদের বলে দাও অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য তৈরি থাকতে। মনে হয়, ভোরের আগেই পাখি বাসায় ফিরবে।
-–ঠিক আছে। আমাদের বাকি লোকরা কী করবে?
–ওদের সবাইকে রান্নাঘরে গিয়ে খেয়ে নিতে বলল। আর তুমিও কিছু খেয়ে নাও। ঝড়বৃষ্টির রাত, বাইরে থাকার বদলে বাড়িতে বসে পাহারা দেওয়াই ঠিক হবে। আমি এই খাওয়ার ঘরেই বসছি। কোনওরকম বিপদের আঁচ পেলেই আমায় ডাকবে।
ক্যাপ্টেন পোড়-খাওয়া সৈনিক। শত্ৰু পরিবেষ্টিত অনেক পরিবেশেই আগে রাত কাটিয়েছেন। কাজের লোকটিকে খাবার ও পানীয় আনতে বলে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালিয়ে তিনি আরামে রাত কাটাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। বাতিদানের দশটা মোমবাতিই জ্বালালেন। ফায়ারপ্লেস থেকে কাঠ জুলার গন্ধ আর নীল ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। জানলার কাছে গিয়ে দেখলেন, চাঁদ আবার মেঘের আড়ালে চলে গেছে। ঝেপে বৃষ্টি এসেছে। হাওয়ায় শোশোঁ শব্দ।
এরই মধ্যে খাবার ও পানীয় এসে গেল। সারাদিনের ধকলের পর ক্যাপ্টেন ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। সুতরাং তলোয়ার, হেলমেট ও বেল্টসুষ্ঠু রিভলভার খুলে একটা চেয়ারের ওপর রেখে তিনি খাওয়া সেরে নিলেন। তারপর পানীয়ের গেলাসটা সামনে রেখে একটা চুরুট ধরিয়ে চেয়ারটা পিছনদিকে হেলিয়ে আরাম করে বসলেন।
মোমবাতির আলোর বৃত্তের বাইরে এই বিশাল খাওয়ার ঘরের অন্যান্য অংশ আলোছায়ায় কেমন রহস্যময় লাগছিল। দুটো দেয়ালে কালো কাঠের প্যানেল আর দুটো দিকে পরদা ঝোলানো–তাতে শিকারের ছবি। ফায়ার প্লেসের ওপর বেশ কটা পারিবারিক শিল্ড রাখা–প্রতিটির ওপর ক্রশ