জার্মানির এক সেনাধিকারী কর্নেল ফন গ্রাম এইরকম চোরাগোপ্তা আক্রমণে বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তার পদাতিক সেনাদল তখন নর্মান্ডির একটা ছোট শহরে। আশপাশে ছোট-ছোট গ্রাম আর খামারবাড়ি। ফরাসি সেনাদের কোনও চিহ্ন নেই কোথাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিদিন সকালে খারাপ খবর আসত-হয় কোনও জার্মান সান্ত্রীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, কিংবা জার্মান সেনাদের কোনও ছোট দল নিখোঁজ।
এইরকম খবর পেলেই কর্নেল রেগে গিয়ে গ্রামের কিছু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতেন। নিরীহ গ্রামবাসীরা ভয়ে কাঁপত। কিন্তু পরদিন সকালে আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
এই অদৃশ্য শত্রুকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছিল, অপরাধের উৎস একটাই। কেন না জার্মান সেনাদের হত্যা বা নিখোঁজ করা হচ্ছিল একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতেই।
গ্রামবাসীদের ভয় দেখিয়েও অপরাধের কোনও সূত্র পাওয়া গেল না। তখন বাধ্য হয়েই কর্নেল ফন গ্রাম অপরাধীকে ধরে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করলেন।
প্রথমে পাঁচশো ফ্রাংক, তারপরে আটশো ফ্রাংক পুরস্কার ঘোষণা করেও কোনও লাভ হল না। গ্রামবাসীরা কেউই। প্রলোভনের ফাঁদে পা দিল না।
শেষে একজন পদস্থ জার্মান সেনাধিকারীর হত্যার পর পুরস্কারের অঙ্ক বাড়িয়ে করা হল এক হাজার ফ্রাংক।
এবার আশার আলো দেখা গেল। ফ্রঁসোয়া নামের এক কৃষি শ্রমিক আর লোভ সামলাতে পারল না।
নীল পোশাক পরা, ক্ষয়াটে মুখের সোয়ার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে কর্নেল জিগ্যেস করলেন, তুমি ঠিক জানো অপরাধী কে?
–হ্যাঁ, হুজুর।
–অপরাধীর নাম?
–হুজুর, ওই এক হাজার ফ্রাংক–
–যতক্ষণ না তোমার কথার সত্যতা প্রমাণিত হচ্ছে, এক পয়সাও পাবে না। এবার বলো! আমাদের লোকদের কে হত্যা করছে?
–ওই কালো প্রাসাদের মালিক কাউন্ট ইউস্তাস!
–মিথ্যে কথা! অভিজাত সম্প্রদায়ের একজন ভদ্রলোক কখনই এই জঘন্য অপরাধ করতে পারেন না।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফ্রাঁসোয়া বলল,বুঝতে পারছি আপনি কাউন্টকে চেনেন না। আমি যা বলছি তা সত্যি। আপনি নির্দ্বিধায় খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। কাউন্ট ইউস্তাস এমনিতেই কড়া ধাতের মানুষ। কিন্তু একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর পর থেকে উনি ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন। তার ছেলে যুদ্ধের সময় জার্মান সেনাদের হাতে ধরা পড়েছিল। জার্মানি থেকে পালাবার সময় তার মৃত্যু হয়। তারপর থেকেই কাউন্ট উন্মাদের মতো হয়ে যান। নিজের প্রজাদের সঙ্গে নিয়ে জার্মান সৈন্যদের নিয়মিত অনুসরণ করেন। জানি না কতজন জার্মানকে আজ পর্যন্ত মেরেছেন। মৃতদের কপালে ছুরি দিয়ে কেটে তৈরি করা যে ক্ৰশটা দেখা যায়, সেটা কাউন্টের বংশের চিহ্ন।
কথাটা সত্যি। প্রত্যেক মৃত জার্মানের কপালে ক্রুশ চিহ্ন পাওয়া গেছে। কর্নেল একটু ঝুঁকে পড়ে টেবিলের ওপর রাখা ম্যাপটার ওপর আঙুল বুলিয়ে বললেন,–প্রাসাদটাতো কাছেই।
–হ্যাঁ, হুজুর। এখান থেকে মাত্র সাড়ে তিন মাইল।
–তুমি জায়গাটা চেনো?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি তো ওখানেই কাজ করতাম।
কর্নেল বেল বাজিয়ে একজন সার্জেন্টকে ডেকে বললেন,–এই লোকটাকে কিছু খেতে দাও, আর আপাতত একে আটকে রাখো।
–কেন হুজুর, আমাকে আটকে রাখবেন কেন? আমি তো আর কিছুই জানি না।
–তোমাকে আমরা গাইড হিসেবে চাই।
কিন্তু কাউন্ট ইউস্তাস যদি আমাকে দেখতে পান, যদি তার হাতে পড়ি–দোহাই হুজুর–
সোয়াকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সার্জেন্টকে ইশারা করলেন কর্নেল। সেইসঙ্গে বললেন, ক্যাপ্টেন বাউমগার্টেনকে এক্ষুনি আমার কাছে পাঠাও।
ক্যাপ্টেন বাউমগার্টেন তক্ষুনি এলেন। তিনি মাঝবয়েসি। চোয়াল চওড়া, চোখ দুটো নীল, হলদেটে গোঁফ আর পোড়া ইটের মতো লাল মুখের রং। মাথায় চুল নেই। মাথার চামড়াটা টানটান আর এত উজ্জ্বল যে তা আয়নার মতো লাগে। একটু ধীরপ্রকৃতির লোক হলেও ক্যাপ্টেন খুব সাহসী আর নির্ভরযোগ্য। কর্নেলের তাই বিশেষ আস্থা বাউমগার্টেনের ওপর।
–ক্যাপ্টেন, তুমি আজ রাতেই ওই কালো প্রাসাদে চলে যাও। একটা গাইড দিয়ে দিচ্ছি। তুমি কাউন্ট ইউস্তাসকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসবে। কোনওরকম প্রতিরোধের চেষ্টা করলে তৎক্ষণাৎ গুলি চালাবে।
–কজন লোক নিয়ে যাব, কর্নেল?
–দেখো। চারদিকে তো গুপ্তচর! কাউন্ট কিছু বোঝা বা জানার আগেই তার ওপর হামলা করা দরকার। বেশি লোক না নিলেই ভালো।
–ঠিক আছে, জনা কুড়ি লোক নিলেই হবে। আর উত্তরদিকে যাওয়ার ভান করে ম্যাপে দেখানো এই রাস্তায় হঠাৎ ঢুকে পড়বে। তাতে কেউ কিছু বোঝার আগেই কালো প্রাসাদে পৌঁছনো যাবে।
–বেশ। কাল সকালেই তোমার সঙ্গে দেখা হবে বন্দিসহ।
ডিসেম্বরের ওই শীতের রাতে ক্যাপ্টেন বাউমগার্টেন কুড়ি জন সৈনিক নিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে বড় রাস্তা ধরে রওনা হলেন। দু-মাইল গিয়েই দলটি ঢুকে পড়ল একটা সরু মেঠো রাস্তায়। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছিল। পপলার গাছ আর দু-পাশের খেতের মধ্যে থেকে ভেসে আসছিল বৃষ্টি আর হাওয়ার শব্দ।
ক্যাপ্টেনের পাশেই ঘটছিল সার্জেন্ট মোসার। সার্জেন্টের কবজির সঙ্গে সোয়ার একটা হাত বাঁধা। ফ্রাসোয়ার কানে কানে বলে দেওয়া হয়েছে, এই দলের ওপর কোনও অতর্কিত আক্রমণ হলে প্রথম গুলিটা তার মাথায় ঢুকবে। পেছনে-পেছনে হাঁটছিল দলের বাকি সেনারা। নরম ভেজা মাটিতে তাদের জুতোর শপশপ আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। গন্তব্য, উদ্দেশ্য এসবই তাদের জানা এবং সাথীদের মৃত্যুর বদলা নেওয়ার সুযোগ পেয়ে তারা সকলেই উদ্দীপ্ত।