চেঁচামেচি করে ঘুষি পাকিয়ে আমার দিকে হঠাৎ একবার এগিয়ে আসার সময় ও হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে বুকের একপাশ চেপে ধরে একটা চিৎকার করে ধড়াস করে মেঝের ওপর পড়ে গেল। ওকে তুলে ধরে সোফাতে শোওয়ালাম। কোনও সাড়াশব্দ নেই মুখে, হাত ঠান্ডা। ওর বদমেজাজ ও অসুস্থ হার্ট–দুয়ে মিলে ওর মৃত্যু হয়েছে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। পুরো ব্যাপারটা একটা সাংঘাতিক দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিল। আর্নেস্টের শেষ চিৎকারটা শুনে মার্থা দরজায় করাঘাত করেছিলেন–তাকে আমি চলে যেতে বলেছিলাম। তারপরে আমার চেম্বারের দরজায় টোকা দিয়েছিল কেউ সম্ভবত কোনও রোগী। আমি দরজা খুললাম না। বসে বসে বিশেষ কোনও চিন্তা ছাড়াই মাথায় হঠাৎ একটা প্ল্যান এসে গেল।
আপনারা জানেন, বিশপস ক্রসিং-এ থাকা আমার পক্ষে ব্যক্তিগত কারণে একটু অসুবিধাজনক হয়ে পড়ছিল। বিশেষত ফ্রান্সেস-এর সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার ব্যাপারটা ভেঙে যাওয়াতে আমি লোকের সহানুভূতির বদলে খারাপ ব্যবহারই পেয়েছিলাম। আর্নেস্টের মৃতদেহ দেখে আমার মনে হল, বিশপস্ ক্রসিং থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার একটা সুবর্ণ সুযোগ এখন আমার হাতে।
শরীরটা আমার থেকে একটু বেশি ভারী ও মুখে একটা কর্কশভাব–এ ছাড়া আমার আর আর্নেস্টের মধ্যে কোনও শারীরিক তফাত নেই। এমনকী দুজনেরই দাড়িগোঁফ কামানো। মাথার চুলও প্রায় একই দৈর্ঘের। যদি ওর সঙ্গে আমার পোশাকটা বদলে নিই, তাহলে সবাই ভাববে, ডাঃ লানা মারা গেছে।
প্ল্যানমতে এক ঘণ্টার মধ্যে ভাইয়ের সঙ্গে আমার পোশাক বদল করে বাড়িতে যা টাকাকড়ি ছিল তা সঙ্গে নিয়ে আমার চেম্বারের বাইরের দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম=-সঙ্গে ছিল একজনের একটা ছবি। ভুল করে ফেলে এসেছিলাম খালি একটা জিনিস–ভাইয়ের চোখের ওপর লাগানো সেই প্যাঁচটা। সেই রাতেই পৌঁছে গেলাম লিভারপুল।
জজসাহেব, আমি শপথ করে বলতে পারি যে আমি কখনও ভাবিনি যে লোকে বুঝবে আমাকে খুন করা হয়েছে, এবং সেইজন্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। বরং আমি ভেবেছিলাম এখান থেকে চলে গেলে কিছু লোক আর আমাকে দেখে বিবিব্রত বোধ করবেন না।
কোনও দূর দেশে চলে যাওয়ার আগে কিছুদিনের জন্য জাহাজ ভ্রমণে যাব এই ভেবে লিভারপুলে একটা জাহাজের টিকিট কেটে ফেললাম। কিন্তু জাহাজে ওঠার আগে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। মর্টন পরিবারের আর সবাই আমার সঙ্গে যেরকম ব্যবহারই করে থাকুন না কেন, আমি জানতাম আমার মৃত্যু সংবাদে ফ্রান্সেস খুবই কষ্ট পাবে। তাই ফ্রান্সেসকে সবকিছু জানিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। চিঠিটার কথা আদালতে জানিয়ে ফ্রান্সেস ভালোই করেছে—না হলে নিরপরাধ আর্থার হয়তো শাস্তি পেত। যদিও আমি ওকে চিঠির ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলেছিলাম।
গতরাতেই জাহাজ ভ্রমণে শেষ করে লিভারপুলে ফিরেছি। আমার তথাকথিত মৃত্যু নিয়ে জল কতদূর গড়িয়েছে অথবা আর্থার মর্টন আমাকে হত্যার ব্যাপারে অভিযুক্ত হয়েছে–এসব আমি কিছুই জানতাম না। গতকাল সন্ধের কাগজে আইন-আদালত সংক্রান্ত পাতায় খবরটা পড়েই একটা এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে এখানে চলে এসেছি–আদালতকে সত্যিটুকু বলব বলে।
বলা বাহুল্য, ডাঃ লানার এই বিবৃতির পরে মামলা খারিজ হয়ে গেল। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য পুলিশ আরও খোঁজখবর নিল। যেমন, যে জাহাজে ডাঃ লানার ভাই আর্জেন্টিনা থেকে ইংল্যান্ডে এসেছিল, সেই জাহাজের ডাক্তার পুলিশকে জানালেন যে, আর্নেস্টের হৃদরোগের ব্যাপারটা জাহাজেই ধরা পড়েছিল এবং পোস্ট মর্টেম রিপোর্টেও ওর মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ।
ডাঃ লানা আবার থাকতে শুরু করলেন তার হঠাৎ ছেড়ে যাওয়া বিশপস ক্রসিং-এই। আর্থার বুঝতে পারল, কি কারণে ডাক্তারের সঙ্গে তার বোন ফ্রান্সেস-এর ছড়াছড়ি হয়ে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে ডাক্তারের পুরোনো সহজ সম্পর্ক আবার গড়ে উঠল।
এর কিছুদিন পরে মর্নিং পোস্ট কাগজে ব্যক্তিগত কলমে নিম্নোক্ত খবর অনেকেরই চোখে পড়েছিল :
“গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিশপস্ ক্রসিং চার্চে রেভারেন্ড স্টিফেন জনসন-এর পৌরোহিত্যে আর্জেন্টিনার প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী ডন অ্যালফ্রেডো লানার পুত্র অ্যালোইলিয়াস জেভিয়ার লানার সঙ্গে লি হল নিবাসী স্বর্গীয় জেমস্ মর্টনের একমাত্র কন্যা ফ্রান্সেস মর্টনের শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হয়।”
The Block Doctor গল্পের অনুবাদ
কালো প্রাসাদের মালিক
দুশো বছরেরও আগের কথা। জার্মান সেনাদল ফ্রান্সে ( ঢুকে পড়েছে এবং প্যারি শহরকে তারা ঘিরে ফেলেছে উত্তরে ও দক্ষিণে। ফরাসি সৈনারা তাড়া খেয়ে ফ্রান্সের উত্তরদিকে চলে যাচ্ছে। জার্মানরা ধীরে-ধীরে ফ্রান্সের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
পরাজয়ের অপমান ও গ্লানিতে ফরাসি নাগরিকরা মুহ্যমান। পদাতিক, অশ্বারোহী, গোলন্দাজ–সব ধরনের সেনাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে ফ্রান্স অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের মুখোমুখি। দল বেঁধে লড়াইয়ে ফরাসিরা জার্মানদের থেকে কম দক্ষ হলেও, চোরাগোপ্তা একক যুদ্ধে ফরাসিরা নিপুন। তাই প্রকাশ্য যুদ্ধের বাইরেও আর এক ধরনের যুদ্ধ চলতে লাগল ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিহিংসার যুদ্ধ। জার্মানরা একজন ফরাসিকে হত্যা করলেই আর এক ফরাসি তার প্রতিশোধ নিতে লাগল।