মিঃ হা : ফ্রান্সেস, এই ব্যাপারে তোমার কি কোনও বক্তব্য আছে?
ফ্রা : ডাঃ লানা চিঠির ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলেছিলেন।
মিঃ কার : তাহলে তুমি এখন এই চিঠিটা পেশ করলে কেন?
ফ্রা : আমার ভাইকে বাঁচানোর জন্য।
জজ : ঠিক আছে। আপাতত আদালত মুলতুবি রইল। আগামীকাল আবার শুনানি হবে। মিঃ হামফ্রিকে প্রমাণ করতে হবে মৃত মানুষটির দেহটা কার।
রহস্যের এই আকস্মিক মোচড় নিয়ে খবরের কাগজে প্রচুর লেখালেখি হয়। যদি সত্যিই প্রমাণ হয় যে ডাঃ লানা জীবিত, তাহলে সেই অপরিচিত লোকটির মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। হয়তো তার চিঠিতে এই ব্যাপারে স্বীকারোক্তি আছে। অর্থাৎ, ফ্রান্সেস যদি তার ভাইকে বাঁচাতে চায়, তাহলে ডাঃ লানাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে হবে–কেন না হত্যার শাস্তি মৃত্যু।
পরের দিন সকালে আদালত লোকজনে ভরতি। মিঃ হামফ্রির হাবভাব বেশ বিচলিত। উনি সরকার পক্ষের উকিল মিঃ কারের কানে কানে কিছু বললেন। তা শুনে মিঃ কারের মুখ চোখের চেহারা পালটে গেল। এর পর মিঃ হামফ্রি জজসাহেবকে বললেন যে, তিনি ফ্রান্সেসকে সাক্ষী দিতে আর ডাকছেন না এবং এ-ব্যাপারে মিঃ কারের কোনও আপত্তি নেই।
জজ : তাহলে কিন্তু, মিঃ হামফ্রি, এই রহস্যের সমাধান করা মুশকিল হয়ে পড়বে।
মিঃ হা : আমি অন্য একজন সাক্ষীকে পেশ করছি, যার সাক্ষে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।
জজ : ঠিক আছে। তাহলে ডাকুন আপনার সাক্ষীকে।
মিঃ হা : সাক্ষী ডাঃ অ্যালোইসিয়াস লানাকে ডাকা হোক।
বলা বাহুল্য, বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো আদালত এবং সমবেত লোকজন।
যে ডাক্তারকে নিয়ে এত আলোচনা এবং যার মৃত্যু নিয়ে এই বিচার, তাকে আদালতে সশরীরে দেখতে পেয়ে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। যারা ডাঃ লানাকে আগে দেখেছে, তাদের মনে হল ডাক্তারের চেহারা যেন একটু শুকিয়ে গেছে, মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার ব্যক্তিত্বের বিশিষ্টতা ও আভিজাত্য একটুও কমেনি। জজসাহেব অনুমতি দিলে ডাঃ লানা তার বিবৃতি শুরু করলেন ।
২১ জুন রাতে যা ঘটেছিল, তা আমি সম্পূর্ণ খোলাখুলিভাবে বলব। যদি আগেই জানতে পারতাম যে এই ঘটনার জন্য নিরপধ কেউ শাস্তি পেতে চলেছে, তাহলে আরও আগেই আমার বক্তব্য জানাতাম কিন্তু আমি নিজেও জানতাম না জল এতদূর গড়িয়েছে। যাই হোক, আমার দ্বারা যেটুকু ভুলভ্রান্তি হয়েছে, সেটাও আমি ঠিক করার চেষ্টা করছি।
আর্জেন্টিনা সম্বন্ধে যারা জানেন, তাদের কাছে লানা পরিবারের নাম সুবিদিত। প্রাচীন স্পেনের এক অভিজাত বংশের লোক আমরা। আমার বাবা আর্জেন্টিনা উচ্চ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। দাঙ্গায় তার মৃত্যু না হলে হয়তো আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতিও হয়ে যেতেন। আমি আর আর্নেস্ট ছিলাম দুই যমজ ভাই। আমাদের দুজনকে অবিকল একরকম দেখতে ছিল। লোকে প্রায়ই বুঝে উঠতে পারত না–কে আর্নেস্ট আর কে অ্যালোইসিয়াস। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা বলার ভঙ্গি বা মুখের অভিব্যক্তি একটু আলাদা হতে থাকলেও আমাদের শারীরিক মিল ছিল একইরকম।
মৃত ব্যক্তির সম্বন্ধে কোনও বিরূপ মন্তব্য করা ঠিক নয়, আর বিশেষত সেই ব্যক্তি যদি নিজের ভাই হয়। তবুও আপনাদের এটুকু জানা দরকার যে, আমার ভাই মোটেই ভালো মানুষ ছিল না। ওকে আমি রীতিমতো ভয় পেতাম, কেন না ওর অনেক অপকর্মের দায় আমাকে বহন করতে হয়েছিল আমাদের চেহারার সাদৃশ্যের জন্য।
অবশেষে একটা অত্যন্ত বিশ্রী ব্যাপারে যখন ওর কৃতকর্মের পুরো দায়টাই আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিল, তখন আমি জন্মভূমির মায়া কাটিয়ে চিরদিনের মতো ইউরোপে চলে এলাম। গ্লাসগো থেকে ডাক্তারি পাশ করে এই অঞ্চলে প্র্যাকটিস শুরু করে দিলাম। ভেবেছিলাম, ল্যাংকাশায়ারের এই প্রত্যন্ত গ্রামে আর্নেস্টের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, এত বছর পরেও ও আমার খোঁজ পেয়ে গেল। ওর টাকাকড়ি কিছু নেই, পুরোপুরি নিঃস্ব। একটা চিঠি লিখে আমাকে জানাল, ও আসছে। ও জানত, আমি ওকে ভয় পাই। তাই ওর মতলব, আমাকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা। আমি বুঝতে পারলাম, আর্নেস্টের আগমন যথেষ্ট বিপজ্জনক, এবং সেটা শুধু আমার কাছে নয়, আমার পরিচিত ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছেও।
যাই হোক, ওই দিন রাত দশটা নাগাদ, আমার ভাই এসে হাজির হল। জানলার কাঁচের বাইরে ওর মুখটা দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিলাম–এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল ওটা আমারই প্রতিচ্ছবি। এত মিল আমাদের দুজনের। চোখে পড়ল, ওর ঠোঁটের কোণে সেই পুরোনো বদমায়েসি হাসি। এই আমার সেই ভাই, যার জন্য আমি দেশছাড়া। মাথা ঠান্ডা রেখে দরজা খুলে দিলাম। ও ভেতরে এল।
দেখেই বুঝলাম ওর অবস্থা খুব খারাপ। হতদরিদ্র অবস্থায় লিভারপুল থেকে হেঁটে হেঁটে এখানে এসেছে। জাহাজে নাবিকদের সঙ্গে হয়তো মারপিট করেছিল। একটা চোখে আঘাত লেগেছে–সেই চোখের ওপর একটা প্যাঁচ লাগানো। কিন্তু আমার ডাক্তারি চোখে বুঝতে পারলাম যে ওর শরীরে সম্ভবত কোনও সাংঘাতিক ব্যাধিও আছে।
ও আমাকে কেমনভাবে অপমান করল বা কীসের ভয় দেখাল, সে বিষয়ে এখানে আর কিছু বলতে চাই না। কিন্তু এটুকু বলা দরকার যে ওর চরম দুর্ব্যবহার ও গালিগালাজ সত্ত্বেও আমার মাথা ঠান্ডা রেখেছিলাম। বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে ওর দারিদ্র্য ওকে আমার প্রতি এমন বিদ্বেষপূর্ণ করে তুলেছে–কেন না আমি প্রভূত বিত্তের মালিক।