–আর ওই হাতটা?
–বলছি। তোমায় আগেই বলেছিলাম, বোম্বেতে আগুন লেগে আমার বাড়ির বহু জিনিস নষ্ট হয়। তার মধ্যে আমার সংগ্রহের বেশ কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও নষ্ট হয়ে যায়। ওই হাতটাও ছিল তারই মধ্যে। তখন অবশ্য সে ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাইনি। এসব হয়েছিল ছবছর আগে। এরপরই শুরু হল আসল কাণ্ড। বছরচারেক আগে এক রাতে ঘুমের মধ্যে কে যেন আমার জামার হাত ধরে টান মারল। প্রথমে ভাবলাম, আমার পোষা কুকুরটা। তারপরে দেখি, আলখাল্লা পরিহিত আমার সেই আফগান রোগী, ঠুটো বাহুটা তুলে আমায় দেখাচ্ছে। তারপরে ধীরে-ধীরে আমার ঘরে (তখনও আমার ল্যাবরেটরি ঘর মেরামত হয়নি) রাখা জারগুলো একে একে নিরীক্ষণ করে প্রথমে হতাশ, পরে ক্রুদ্ধ হয়ে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, লোকটা সদ্যই মারা গেছে এবং আমার কাছে তার জমা রাখা হাতটা নিতে এসেছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাকা বললেন,–এরপর গত চারবছর ধরে প্রতিটি রাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। রাতে এই ঘটনার জন্য অপেক্ষা করি বলে আমার ভালো ঘুম হয় না। তোমার কাকিমারও একই অবস্থা। আমাদের বার্ধকের শান্তিপূর্ণ জীবন এখন সম্পূর্ণভাবে বিষিয়ে গেছে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তোমার সাহসের জন্যই আজ আমরা এই ব্যাপারটা কারওকে প্রথম জানালাম। তা ছাড়া, তুমিও যেহেতু ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছ, একটু স্বস্তি পাচ্ছি এই ভেবে যে আমি এখনও পাগল হয়ে যাইনি এবং ব্যাপারটা আমার স্বকপোলকল্পিত নয়।
নিজের চোখে সবকিছু দেখে এবং এই ধরনের বিষয়ে আমার যেটুকু জ্ঞান তা দিয়ে এটুকু বুঝতে পারলাম যে পুরো ব্যাপারটাই নির্ভেজাল সত্যি। ব্রেকফাস্টের পরে কাকা কাকিমাকে বললাম যে আমায় এক্ষুনি একবার লন্ডনে যেতে হবে।
কাকা খানিকটা পরিতাপের সুরেই বললেন,–আমারই ভুল হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্যের বোঝা তোমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে অন্যায় করেছি। তাই তুমি চলে যাচ্ছ।
–না, না, আমি এই রহস্যের সমাধানের জন্যই লন্ডনে যাচ্ছি। সন্ধেবেলায় ফিরে এসে রাতটা আজ ওই ল্যাবরেটরি ঘরেই কাটাব।
কাকাকে আর কিছু ভেঙে বললাম না। দুপুরে লন্ডনে পৌঁছে আমার চেম্বারে গিয়ে একটা বই খুলে নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম :
মৃত্যুর সময়ে বিশেষ কোনও মানসিক অবস্থার জন্য কিছু কিছু আত্মা জড়জগত থেকে সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তি পায় না। লোভ, প্রতিহিংসা, উদ্বেগ, প্রেম, করুণা ইত্যাদির জন্য এরকম মানসিক অবস্থা হতে পারে। সাধারণত এর কারণ কোনও অপূর্ণ কামনা। সেই কামনার পূরণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মা পৃথিবীর স্কুল পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে পারে। এমনকী কামনা পূরণের একটা মোটামুটি বিকল্পের ব্যবস্থা করতে পারলেও আত্মার মুক্তি সম্ভব।
সকাল থেকেই এই মোটামুটি বিকল্প কথাগুলো আমার মাথায় আসছিল। বই থেকে এই অংশটা পড়ে নিশ্চিত হয়ে তক্ষুনি পৌঁছলাম শ্যাডওয়েলে নাবিকদের একটা হাসপাতালে যেখানে আমার বন্ধু জ্যাক হিউয়েট হাউস-সার্জন। ওকে খুঁটিনাটি না জানিয়ে খালি বললাম আমি কী চাই।
–কোনও ভারতীয় মানুষের একটা হাত! কেন? কী জন্যে চাই?
–তোমাকে পরে সবকিছু বলব। তোমাদের হাসপাতালে তো অনেক ভারতীয় রোগী আছে।
–দাঁড়াও, দেখি। বলে জ্যাক হাসপাতালের এক কম্পাউন্ডারকে ডেকে পাঠিয়ে জিগ্যেস করল,–আচ্ছা, জাহাজের মেশিনঘরে চাকায় ফেঁসে গিয়ে ওই যে জখম ভারতীয় নাবিকের হাত দুটো বাদ দেওয়া হল, সেই হাত দুটো এখন কোথায়?
–পোস্টমর্টেম-এর ঘরে আছে, স্যার।
-–আচ্ছা, ওখান থেকে চট করে একটা হাত অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে প্যাক করে ডাঃ হার্ডকরকে দিয়ে দাও।
রাতে কাকার বাড়িতে ফিরে ল্যাবরেটরি একটা খালি জারে হাতটা রাখলাম। জারটা যে তাকে রাখলাম, সেটা আমার বিছানার কাছাকাছি। কাকাকে বিশেষ কিছু খুলে বললাম না।
আজ ঘুমের কোনও প্রশ্নই নেই। আমার পরীক্ষা সফল হয় কি না তা দেখার জন্য ঢাকনা দেওয়া একটা বাতি জ্বালিয়ে প্রতীক্ষা শুরু করলাম। এবার তাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। প্রথমে দরজার কাছে একটা ছায়ার মতো দেখা গেল। তারপরে সেটা ধীরে-ধীরে একটা মানুষের অবয়রে পরিণত হল। কাল রাতের মতোই সে লাইন ধরে এক-এক করে জারগুলো দেখতে-দেখতে এসে থামল সেই জারের কাছে যাতে আমি লন্ডন থেকে আনা হাতটা রেখেছিলাম। আশায় অধীর হয়ে সে হাতটাকে জার থেকে বের করল, পরমুহূর্তের হতাশায় ও ক্রোধে কঁপতে-কাঁপতে হাতটাকে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সেই নিস্তব্ধ রাতে হাত ছুঁড়ে ফেলার আওয়াজ পুরো বাড়িতে শোনা গেল। তাকিয়ে দেখলাম, লোকটা আর নেই। স্যার ডোমিনিক দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে বললেন,–তোমার কোনও আঘাত লাগেনি তো?
–না-না। কিন্তু পরীক্ষা সফল হল না। খারাপ লাগছে। ভাঙা কাঁচের মধ্যে পড়ে থাকা হাতটাকে দেখে কাকা বললেন,–প্ল্যানটা তুমি ভালোই করেছিলে। কিন্তু এ রহস্যের কোনও সহজ সমাধান নেই। তুমি কিন্তু আর কখনও এ ঘরে ঢুকবে না। তোমার কোনওরকম ক্ষতি হলে আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না।
বাকি রাতটুকু ওই ঘরেই শুয়ে ভাবছিলাম আমার পরীক্ষার ব্যর্থতার কথা। ভোরের আলো ঘরে এসে পড়তেই মেঝেতে পড়ে থাকা হাতটার দিকে তাকালাম। হাতটা তুলে একবার দেখতেই বিদ্যুৎচমকের মতো মাথায় একটা সমাধানের সূত্র এসে গেল। যা ভেবেছি, ঠিক তাই। আমার আনা হাতটা ওই আহত নাবিকের বাঁ-হাত।