কাকা চলে যেতেই ল্যাবরেটরির দরজা বন্ধ করে আমি ডিভানে শুয়ে পড়লাম। আমার শারীরিক শক্তি আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই। আর ভয়ের কথা যদি আসে, এটুকু বলতে পারি যে মানুষের মস্তিষ্কে এক সময় একটিমাত্র মানসিক অবস্থা থাকতে পারে। অর্থাৎ, এই অলৌকিক রহস্য উন্মোচনের জন্য যে উৎসাহ ও কৌতূহল এই মুহূর্তে আমার সত্তাকে আচ্ছন্ন করেছে, সেখানে ভয়ের কোনও স্থান নেই। খেলা শুরুর আগে একজন খেলোয়াড় যেমন উত্তেজনা মেশানো উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করে, আমার মানসিক অবস্থাও তখন সেইরকম।
ঘরটাকে অবশ্য কোনওভাবেই আদর্শ শয়নকক্ষ বলা যাবে না। বিভিন্ন কেমিক্যালের গন্ধে ভরা। তা ছাড়া, জারে রাখা বিকৃত ও অসুস্থ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকেও ঘুম আসার পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক বলা যায় না। আমি মোমবাতিটা নিভিয়ে দিতেই দেখলাম, জানালার মধ্য দিয়ে চাঁদের আলো ঘরের একটা অংশকে আলোকিত করেছে। সবকিছু মিলিয়ে আলো আঁধারিতে পরিবেশটা একটু ভূতুড়েই লাগছিল। পুরো বাড়িটা এত নিস্তব্ধ যে বাইরে হাওয়ায় গাছের পাতা বা শাখা নড়ার আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল। এপাশ ওপাশ করে কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে থেকে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম–একেবারে গভীর, স্বপ্নহীন ঘুম।
হঠাৎ ঘরের ভেতর একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে একটু উঠে চারদিকে তাকালাম। কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছল–কেন না চাঁদের আলো সরতে সরতে এখন আমার বিছানার কাছাকাছি এসে গেছে। বাকি পুরো ঘরটা ছায়াচ্ছন্ন। আস্তে-আস্তে অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে দেখলাম কিছু একটা চলাফেরা করছে দেওয়ালের ধার ঘেঁষে। বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আমার বিছানার কাছে আলোকিত জায়গার পাশে যখন জিনিসটা এসে গেল, বুঝলাম সেটা একটা মানুষের আকৃতি। চেহারাটা ছোটখাটো কিন্তু ষণ্ডা গোছের, শরীরটা একটা আলখাল্লায় ঢাকা। তার মুখের ওপর চাঁদের আলো পড়তে দেখলাম, মুখের রং অনেকটা চকোলেটের মতো আর মাথায় চুলে একটা ঝুঁটি বাঁধা। ধীরে-ধীরে হেঁটে সে প্রত্যেকটা জারের ভেতরের বস্তু নিবিষ্টচিত্তে নিরীক্ষণ করছিল–একটার পর একটা। জার রাখার তাক শেষ হয়েছে আমার বিছানার কাছে। ওখানে এসে সে হঠাৎ থেমে আমার দিকে তাকাল আর হতাশার ভঙ্গিতে দু-হাত শূন্যে ছুঁড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হাত বলা হয়তো ঠিক হল না–লোকটা বাহু দুটো তুলেছিল। বাহু ওপরে তোলার সময় আলখাল্লার আস্তিন নেমে আসতেই ওর বাঁ-হাতটা পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলাম –কিন্তু ডান হাতের জায়গাটা ঠুটো, হাত নেই। এই ব্যতিক্রমটুকু ছাড়া লোকটার চেহারা ও চলাফেরা এত স্বাভাবিক ছিল যে, ওকে সহজেই স্যার ডোমিনিকের আর একজন ভারতীয় ভৃত্য বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু লোকটার হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা বেশ রহস্যময়। মোমবাতি জ্বেলে ঘরের চারদিক খুঁজেও তার কোনও হদিস পেলাম না। বাকি রাতটুকু জেগে কাটিয়ে দিলাম। অবশ্য সেই রাতে আর কোনও ঘটনা ঘটেনি।
ভোর হতেই বাইরে বেরিয়ে দেখলাম। কাকা লনে পায়চারি করছেন। আমাকে দেখেই উত্তেজিতভাবে বললেন, লোকটাকে দেখেছ? ভারতীয়। একটা হাত নেই।
–হ্যাঁ, দেখেছি।
–ব্রেকফাস্টের সময় এখনও হয়নি। এসো, তোমায় ততক্ষণে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। গত চারবছরে,–বোম্বেতে, দেশে ফেরার সময় জাহাজে, এই বাড়িতে–প্রতিটি রাত এই লোকটা আমার ঘুম ভাঙিয়েছে। ওর রুটিন একেবারে স্থির। আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙায়, তারপর আমার শোওয়ার ঘর থেকে ল্যাবরেটরিতে যায়, তাকে রাখা সবকটা জার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখে, তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। এক হাজারেরও বেশিবার এই রুটিন দেখে-দেখে আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
–কী চায় লোকটা?
–ওর হাত ফেরত চায়।
–হাত?
–ব্যাপারটা তোমায় খুলে বলি। বছরদশেক আগে একবার আমাকে ডাক্তারি কাজে পেশোয়ার যেতে হয়েছিল। সেই সময় ঘটনাচক্রে এক রোগীকে আমার কাছে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। লোকটা আফগানিস্তানের প্রত্যন্তের কোনও উপজাতি সম্প্রদায়ের। ভাঙা-ভাঙা পোশতু-তে কথা বলছিল। ওর হাতের গাঁটে সাংঘাতিক একটা গ্যাংগ্রিন গোছের কিছু হয়েছিল। দেখেই বুঝলাম, ওই হাত কেটে বাদ না দিলে ওর বাঁচার কোনও আশা নেই। অনেক বোঝানোর পর ও অপারেশন করাতে রাজি হল। অপারেশনের পর ও আমার ফি জানতে চাইল। লোকটার আর্থিক অবস্থা প্রায় ভিখারির মতো। আমি হেসে ওকে বললাম যে, তোমার এই কেটে বাদ দেওয়া হাতটাই আমার ফি। আমার প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে আর একটা নুতন আইটেম আর কী!
কাকা বলে চললেন,–লোকটা আমার এই প্রস্তাবে বিশেষ আপত্তি জানাল। ওদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুর পরে আত্মা আবার শরীরে প্রবেশ করে। সে ক্ষেত্রে মৃত মানুষের অঙ্গ হীনতা বা কোনও খুঁত আত্মার পক্ষে একটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমি ওকে বললাম, তোমার তো হাতটা বাদই গেছে। তা হলে ওটাকে কীভাবে রেখে দেবে? ও বলল, হাতটাকে নুনজলে চবিয়ে আমার সঙ্গে নিয়েই ঘুরব। আমি তখন ওকে বোঝালাম যে হাতটা আমি আরও ভালোভাবে সংরক্ষণ করব। শেষ পর্যন্ত ও রাজি হয়ে গেল। কিন্তু বলল, সাহেব, আমি মারা যাওয়ার পরে কিন্তু ওই হাতটা আমার চাই। ব্যাপারটা আমি তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। তারপর বোম্বে ফিরে এসে আমি যথারীতি আমার প্রাইভেট প্র্যাকটিসে লেগে গেলাম। লোকটাও সম্ভবত ওর দেশে ফিরে যায়।