শীতের কাঁপুনি থেকে বাঁচতে কাকা ফায়ার প্লেসের কাছেই ঝুঁকে বসেছিলেন। ঘরে তখনও কোনও বাতি জ্বালানো হয়নি। ওই আগুনের আলোয় দেখলাম কাকাকে–বিশাল মুখমণ্ডল, চেহারায় পাহাড়ের রুক্ষতা, নাক ও গাল রেড ইন্ডিয়ানদের মতো, থুতনি থেকে চোখের কোণ অবধি চামড়ার ওপর অজস্র আঁকিবুকি। আমাকে দেখেই কাকা তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করলেন। ঘরে এবার একটা বাতি জ্বালানো হল। ঘন ভূ-র নীচে থেকে তার তীক্ষ্ণ দুটি চোখ আমাকে যে বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করছে, তা বুঝতে পারলাম।
আমিও ততক্ষণে কাকাকে ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। শরীরের গঠন প্রায় দৈত্যের মতো, কিন্তু শরীরটা এত শুকিয়ে গেছে, যে চওড়া হাড্ডিসার কাঁধের থেকে ঝোলানো কোটটা দেখে মনে হচ্ছিল যে, ওটা যেন হ্যাঁঙার থেকে ঝুলছে। চওড়া কবজিটা যেন শুধু হাড় দিয়ে তৈরি–হাতের শিরাগুলি বিশেষভাবে প্রকট। জীবিকায় সফল ও শারীরিকভাবে সমর্থ একজন মানুষের চোখে যে সাফল্য ও সন্তুষ্টির ঔজ্জ্বল্য থাকে, তা নেই। চোখে একটা সন্ত্রস্ত ভাব-যেন কোনও অজানা বিপদের ছায়া। মনে হয়, স্যার ডোমিনিকের অদম্য জীবনীশক্তিকে যেন কেউ শুষে নিয়েছে। আমার ডাক্তারি বুদ্ধিতে মনে হল, কাকার হয়তো কোনও মারাত্মক রোগ হয়েছে এবং আসন্ন মৃত্যু চিন্তায় তিনি সন্ত্রস্ত। অবশ্য পরে বুঝেছিলাম, আমার সিদ্ধান্ত ভুল।
আগেই বলেছি, কাকার অভ্যর্থনায় উষ্ণতার কোনও অভাব ছিল না। ঘণ্টাখানেক পরে কাকা ও কাকিমার সঙ্গে ডিনারে বসলাম। পরিবেশন করছে একজন ভারতীয় পরিচারক।
আমার কাকিমা লেডি হোলডেন ছোটখাটো চেহারার মানুষ, চোখে যুগপৎ মমতা ও সতর্কতার ছাপ। দুজন সারা জীবন বিভিন্ন পরিবেশে অনেক লোকজনের মধ্যে কাটিয়ে আজ জীবন-সায়াহ্নে এই নির্জন পরিবেশে কেবল পরস্পরের সাহচর্যে দিন কাটাচ্ছেন।
ডিনারের সময় কথাবার্তা ও হাসিঠাট্টা চলতে থাকলেও এটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, ওদের দুজনের চোখেই কোনও অজানা আতঙ্কের ছায়া। খানিকটা জোর করেই যেন ওঁরা পরিস্থিতিটাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন।
খাওয়ার পরে ওয়াইনের গ্লাস হাতে একটু গল্পগুজব হল। কীভাবে জানি না গল্পের বিষয়টা চলে গেল অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনার দিকে। কথায়-কথায় আমি ওঁদের বললাম যে ডাক্তার হিসেবে আমার বিশেষজ্ঞতা স্নায়ুসম্বন্ধিত অসুখের ব্যাপারে। এমনকী কয়েকজন ডাক্তারবন্ধু মিলে ভূতুড়ে বাড়িতেও রাত কাটিয়েছি–যদিও বলার মতো তেমন কিছু উত্তেজক অভিজ্ঞতা হয়নি। কাকা-কাকিমা দুজনেই খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনছিলেন। মাঝে-মাঝেই অর্থপূর্ণভাবে পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করছিলেন। একটু পরে কাকিমা শুতে চলে গেলেন।
এরপর কাকা একটা চুরুট ধরালেন। চুরুট ধরানোর সময় তার কাঁপতে থাকা হাত আর মুখের ভাব দেখে মনে হল তিনি আমাকে কিছু গোপন কথা জানাতে চান। ঠিক তাই! একটু পরেই কাকা বললেন, তোমারই মতো একজনের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাইছিলাম। অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক ব্যাপারে তোমার যে যথেষ্ট উৎসাহ ও জ্ঞান আছে, সেটা বুঝতে পারছি। শুধু তাই নয়, এসব বিষয়ের একটা যুক্তিগ্রাহ্য ও দার্শনিক দিকও আছে–সেটাও তুমি জানো। তোমার মাথাও ঠান্ডা। ভূতপ্রেত দেখলে তুমি কি ঘাবড়ে যাবে?
–মোটেই না। বরং এসব ব্যাপারে আমি খুব উৎসাহী।
–আশাকরি বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকেই তুমি এসব ব্যাপার দ্যাখো।
—অবশ্যই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাকা বললেন,–জানো, হার্ডএকর, আমি আগে ঠিক তোমার মতোই ছিলাম। ইন্ডিয়ায় সবাই আমার সাহস ও শক্ত নার্ভ দেখে অবাক হয়ে যেত। এমনকী সিপাহী বিদ্রোহের সময়েও আমি একটুও ঘাবড়াইনি। আর আজ? এই অঞ্চলে আমার মতো ভীতু লোক একটাও পাবে না। তুমিও অবশ্য খুব বেশি সাহস দেখাতে যেও না–তা হলে তোমার অবস্থা আমার মতোই হয়ে যেতে পারে।
আমার উৎসাহ দেখে কাকা আবার শুরু করলেন, কয়েক বছর হল একটা অদ্ভুত কারণে আমার ও তোমার কাকিমার জীবন থেকে সুখ-শান্তি চলে গেছে। কারণটা শুনলে অনেকেই হয়তো হেসে ফেলবে। কিন্তু এই ব্যাপারটার সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করে আমরা দুজনেই শেষ হয়ে গেলাম।
–ব্যাপারটা কী, একটু খুলে বলবেন?
–আগে থেকে সেটা বলে দিলে হয়তো তুমি স্বাধীনভাবে জিনিসটার বিচার করতে পারবে না। তুমি নিজের চোখেই সবকিছু দেখলে ভালো হয়। আমার সঙ্গে একটু এদিকে এসো।
খাওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে একটা লম্বা প্যাসেজের শেষে বেশ বড় একটা ঘরে আমরা এলাম। ঘরটা একটা ল্যাবরেটরি –অনেক যন্ত্রপাতিতে ভরা আর দেওয়াল জোড়া তাকে অজস্র কাঁচের জার রাখা।
কাকা বললেন,–মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিশাল সংগ্রহ ছিল আমার। বোম্বেতে আমার বাড়িতে আগুন লেগে তার অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে যায়। যা অবশিষ্ট ছিল, সেগুলোই এখানে দেখতে পাচ্ছ।
ভারতের বিভিন্ন জায়গার মানুষের শরীরের অস্বাভাবিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জারগুলিতে রাখা ফুলে যাওয়া লিভার বা কিডনি, বাঁকা হাত-পা, বিচিত্র রকমের সিস্ট, বিকৃত বা অসুস্থ কোনও অঙ্গ।
কাকা বললেন, তুমি যদি এ ঘরেই রাতটা কাটাও তাহলে ভালো হয়। এই ডিভানটাতে শুতে পারো। কোনওরকম আপত্তি থাকলে আমায় বলল।
–না, না। কোনও আপত্তি নেই।
–বাইরের প্যাসেজে বাঁ-দিকে দ্বিতীয় ঘরটা আমার। দরকার পড়লেই আমায় কিন্তু ডেকো। আমার তো রাতে ভালো ঘুম হয় না। তুমি ডাকলেই আমি চলে আসব।