–হিকম্যান! হিকম্যান! আচ্ছা, ওকেই তো লোকে গ্যাসম্যান নামে ডাকত, তাই না? জিগ্যেস করলেন মিলবার্ন।
–ঠিক তাই। ওকে অনেকে গ্যাস বলে ডাকত। বললেন সরাইখানার মালিক।
এইসব শুনে অ্যালফের মুখ তখন চকের মতো সাদা হয়ে গেছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,আর ভালো লাগছে না। চলুন, এবার রওনা হই।
সরাইখানার মালিক অ্যালফের পিঠ চাপড়ে বললেন, মন খারাপ কোরো না। তুমিই আজ পর্যন্ত একমাত্র লোক যে ওই পাজিটার হাতে পরাজিত হওনি। গ্যাসম্যানকে পিটিয়ে তুমি অনেকের প্রতি ওর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়েছ। নাও, আরেকটা পানীয় নাও, তোমার এই কৃতিত্বের জন্য। তুমি জানো, সরাইখানার এই ঘরে ও একবার কী করেছিল–সেই ছাপান্ন বছর আগে?
মিলবার্ন, অ্যালফ, হরনার সকলেই ঘরের চারদিকটা দেখলেন। উঁচু সিলিং, পাথরের মেঝে, কাঠে মোড়া দেওয়াল।
সরাইখানার মালিক বললেন, হ্যাঁ, এই ঘরেই। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাকে ঘটনাটা বলেছিলেন। সেদিন এই অঞ্চলে একটা বড় বক্সিং প্রতিযোগিতা ছিল। টম তাতে বাজি রেখে বেশ কিছু টাকা জিতেছিল। ও আর বন্ধু জো ফেরার পথে সম্পূর্ণ মত্ত অবস্থায় সরাইখানার এই ঘরেই এসেছিল। ওকে দেখে এখানকার লোকজন সবাই ভয়ে কুঁকড়ে যায়, কেউ কেউ টেবিলের নীচেও লুকিয়ে পড়ে। কেন না ওর মুখে সেই খুনির হাসি আর হাতে একটা লোহার রড। সবাই জানত টম মত্ত অবস্থায় খুন পর্যন্ত করতে পারে। ও কী করল জানো? ডিসেম্বরের ঠান্ডার থেকে বাঁচতে একটা ছোট সাদা কুকুর ফায়ার প্লেসের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিল। টম রডের এক ঘায়ে কুকুরটার পিঠ ভেঙে দিল। তারপর পাগলের মতো হাসতে-হাসতে আর গালিগালাজ করতে করতে টম ওর বন্ধু জো-কে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে বসে জোরে গাড়ি চালিয়ে দিল। পরে শোনা গেছিল, ওই রাতেই দুর্ঘটনায় গাড়ির একটা চাকায় মাথা থেঁতলে টম মারা যায়। জো-ও মারা গেছল। অনেকেই নাকি এখনও ওই কুকুরটাকে দেখতে পায়–পিঠ ভাঙা, রক্তাক্ত, কেউ কেউ আওয়াজ করছে। যেন কুকুরটা তার আততায়ীকে আজও খুঁজে বেড়াচ্ছে। সুতরাং অ্যালফ, তুমি নিজে লড়ার সঙ্গে-সঙ্গে আরও কারোর জন্যেও লড়াই করেছ।
অ্যালফ বলল,–তা হতে পারে। তবে এই ধরনের লড়াই আমি করতে চাই না। এখন সার্জেন্ট বার্টনের সঙ্গে লড়াই করলেই যথেষ্ট। মিঃ মিলবার্ন, চলুন, আমরা বরং একটা ট্রেনে করেই আপনাদের ক্যাম্পে যাই।
সেই হাতটা
ব্রিটিশ আমলে ভারতের বিখ্যাত শল্যচিকিৎসাবিদ আমার মি কাকা স্যার ডোমিনিক হোলডেন যে আমাকে তার বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে গেছেন, এ কথা সকলরই জানা। কিন্তু আর পাঁচজন সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীকে অগ্রাহ্য করে কেন তিনি আমাকেই তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গেলেন তার কারণ অনেকেই জানেন না। তার বদান্যতায় একজন সাধারণ পশারের ডাক্তার থেকে আমি রাতারাতি এক প্রভূত বিত্তশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়েছি। খুব কম লোকই জানেন যে স্যার ডোমিনিকের জীবনের শেষ কটা বছরে আমি তার জন্য যা করেছিলাম, তা আর কারও পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। সেই ব্যাপারটাই আজ খুলে বলছি–বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ওপর।
স্যার ডোমিনিক কর্মজীবন শুরু করেন ব্রিটিশ সেনাদলের ডাক্তার হিসেবে। পরে বোম্বেতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে তিনি প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে তার প্রায়ই ডাক পড়ত। তা ছাড়া বোম্বেতে তিনি একটা হাসপাতালও শুরু করেন, এবং সেই হাসপাতালের পরিচালনার কাজে নিজে যুক্ত ছিলেন। এত পরিশ্রমে তার স্বাস্থ্য ধীরে-ধীরে ভেঙে পড়ল। তখন বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীদের উপদেশে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন। উইল্টশায়ারে অনেক জমিজমা ও একটি জমিদারবাড়ি কিনে ওখানেই থাকতেন। তুলানমূলক প্যাথোলজি ছিল তাঁর প্রিয় বিষয় এবং তারই চর্চা করে সময় কাটাতেন।
আমাদের পরিবারের সকলেই এই ধনী ও নিঃসন্তান আত্মীয়ের দেশে ফিরে আসাতে, বলা বাহুল্য, খুব খুশি হয়েছিল। কাকাও মাঝে-মাঝেই এক এক করে তার ভাইপো, ভাইঝিদের ওখানে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পাঠাতেন। অবশ্য ওখানে গিয়ে কারওরই খুব একটা ভালো লাগত না। যাই হোক, আমারও একদিন আমন্ত্রণ এল ওখানে যাওয়ার। কিন্তু আমার একার, সপরিবার নয়। প্রথমে ভেবেছিলাম যাব না। তারপর সাতপাঁচ ভেবে অক্টোবরের এক দুপুরে উইল্টশায়ারের দিকে রওনা হলাম। তখনও জানি না এই যাত্রার পরিণতি কী।
ভিনটন স্টেশনে যখন নামলাম ততক্ষণে দিনের আলো ম্লান হয়ে এসেছে। উইল্টশায়ারের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিচিত্র লাগল। জায়গাটা উপত্যকার মতো–চারদিকে কৃষিজমি আর ছড়ানো ছিটোনো কৃষকদের ঘরবাড়ি। সমতল জমির পরেই শুরু হয়েছে সাদা-সাদা চকের পাহাড়, পাহাড়গুলোর ওপরে গোল, চৌকোনা প্রভৃতি বিভিন্ন আকারের প্রাচীর–অনেকটা দূর্গের প্রাচীরের মতো। কয়েকশো বছর আগে এই প্রাচীরগুলো কারা তৈরি করেছিল ব্রিটিশরা না রোমানরা–এ নিয়ে মতভেদ আছে। পাহাড়ের গায়ে ঢেউ-খেলানো জমির ওপরেও গোল গোল টিপি।
এই বিচিত্র পরিবেশে কাকার বাড়িটা বেশ মানিয়ে গেছে। গেটের স্তম্ভদুটো ভাঙা ও শ্যাওলা-ধরা। গেট থেকে বাড়ি অবধি পাথর ছড়ানো রাস্তাটার যত্ন হয়নি বহুদিন। হেমন্তের ঝরা পাতা ঠান্ডা হাওয়ায় এলোমলো উড়ছে। এম গাছের সারির ফাঁক দিয়ে দূরে বাড়ি থেকে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। সন্ধের আবছা আলোয় বাড়িটা দেখতে পেলাম– লম্বা, নীচু ধরনের। পুরোনো আমলের স্থাপত্যের ছাপ-ঢালু ছাদ, টালি দেওয়া, দেওয়ালের গায়ে কাঠের সাপোের্ট। গাড়িবারান্দা থেকে বাড়িতে ঢোকার দরজার পাশেই একটা চওড়া জানলা। সেই জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম, ঘরের মধ্যে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। ওই ঘরটাই কাকার স্টাডি। বাড়ির বুড়ো এক পরিচারক আমাকে ওই ঘরেই নিয়ে গেল।।