–লোকটা বক্সিং-এ সত্যিই পারদর্শী। গায়ে সিংহের মতো শক্তি। শরীরটা যেন একটা তক্তা। প্রচুর চর্চা করেছে। তবে শিখেছে কোথায় বলতে পারব না। বলল অ্যালফ। কান থেকে একটু রক্তপাত ছাড়া অ্যালফের শরীরে চোখে পড়ার মতো কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই।
রাউন্ডের পর রাউন্ড চলতে লাগল দুজনের লড়াই। সন্দেহ নেই, অ্যালফ শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর পাল্লায় পড়েছে। টমের দ্রুত পায়ের কাজ, বিদ্যুৎগতিতে হাত চালানো, মুখে আলতোভাবে লেগে থাকা বদমায়েশি হাসি–এসব থেকে বোঝা যাচ্ছিল লোকটা বিপজ্জনক ধরনের। বারবার চেষ্টা করে শেষে ও অ্যালফের মুখে মারল একটা মারাত্মক আপারকাট। অ্যালফ মাটিতে পড়ে গেল। জো হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,টম, লাগাও ওইরকম আর একটা ঘুষি। তাহলেই কেল্লা ফতে।
চিন্তিত মিলবার্ন তখন অ্যালফকে বললেন,–ব্যাপারটা ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে। তুমি এইরকম মার খেলে আমাদের ওখানে গিয়ে কেমন করে লড়বে? তার থেকে বরং এর কাছে হার স্বীকার করে নাও।
–গুলি মারুন আপনাদের সার্জেন্ট বার্টনের সঙ্গে লড়াই। এই লোকটাকে হারিয়ে ওর মুখের হাসি মুছে না নেওয়া পর্যন্ত আমি লড়ে যাব। অ্যালফ উত্তর দিল।
–কী হল? লড়াইয়ের সাধ মিটেছে? টম বিদ্রুপের সুরে অ্যালফকে জিগ্যেস করল।
উত্তরে শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে নিয়ে টমের দিকে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো এগিয়ে গেল অ্যালফ। কিছুক্ষণের জন্যে সে টমকে বেকায়দায় ফেলে দিলেও অক্লান্ত টম আবার আগের মতোই হাত চালাতে লাগল। অ্যালফের শক্তি তখন প্রায় শেষ–কিন্তু টমের ক্ষমতায় তখনও কোনও ঘাটতি নেই। টমের অবিরত ঘুষির আঘাতে জর্জরিত অ্যালফ হয়তো আর এক মিনিট পরেই ভূমিশয্যা নিত। কিন্তু হঠাৎ একটা কিছু ঘটে গেল।
কাছেই গাছপালা, ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল–যেন কোনও মানবশিশু বা জন্তুজানোয়ার ব্যথায় আর্তনাদ করছে। আওয়াজটা শুনেই টম হঠাৎ যেন অসহায় হয়ে পড়ল, ওর মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। আর্তস্বরে টম জো-কে বলল,–ওই দেখো! ও আবার আমাকে লক্ষ করে আওয়াজ করছে।
–ওদিকে মন দিও না। কিছু হবে না তোমার। আগে এই ছোকরাকে হারাও। আশ্বাস দিল জো।
–না, না, তুমি বুঝতে পারছ না। যার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ, সে আমাকে আঘাত করবেই। হ্যাঁ, তাকে আমি দেখতে পাচ্ছি। তার সামনে আমি দাঁড়াতে পারব না।
ভয়ে চিৎকার করতে করতে টম দৌড়ে জঙ্গলের অন্যদিকে দৌড়ে গেল। জো-ও টমের জামাকাপড়গুলো কুড়িয়ে নিয়ে টমের পিছনে-পিছনে দৌড়োল। গাছগুলোর ছায়া যেন দুজনকে গ্রাস করে নিল।
মার খেয়ে প্রায় অচেতন অ্যালফ তখন কোনওরকমে টলতে-টলতে এসে মিলবার্নের কাঁধে মাথা রাখল। মিলবার্ন ওর ঠোঁটে লাগিয়ে দিলেন ব্র্যান্ডির বোতলটা। জঙ্গলের দিক থেকে আসা সেই আওয়াজটা তখন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। তারপরে দেখা গেল, ঝোঁপের মধ্যে থেকে একটা সাদা রঙের কুকুর বেরিয়ে এসে যেন কাউকে খুঁজতে খুঁজতে দৌড়ে চলে গেল। কেউ-কেঁউ আওয়াজ করতে-করতে।
একটু পরে কুকুরটাও যেন ছায়ার মধ্যে হারিয়ে গেল। মিলবার্ন আর অ্যালফ তখন একটা অজানা আশঙ্কায় আর ভয়ে শিউয়ে উঠে কালক্ষেপ না করে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। গাড়িতে মাইদুয়েক যাওয়ার পর মিলবার্নের মুখ থেকে আওয়াজ বেরোল,–এইরকম টাইপের কুকুর তুমি আগে কখনও দেখেছ?
–না। আর যেন দেখতেও না হয়। আর্তস্বরে বলল অ্যালফ।
রাত একটু গম্ভীর হতেই দুজনে আশ্রয় নিলেন এক সরাইখানায়। খাওয়াদাওয়ার পর একটা পানীয় নিয়ে বসে কথা হচ্ছিল সরাইখানার মালিক আর স্থানীয় এক ভদ্রলোক মিঃ হরনারের সঙ্গে। হরনার বক্সিং-এর ব্যাপারে বেশ ওয়াকিবহাল। উনি হঠাৎ বললেন,–অ্যালফ, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি কোথাও বক্সিং লড়ে এসেছ। কিন্তু কই, আজকের কাগজে তো কোনও বক্সিং প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন ছিল না।
–থাকগে ওসব কথা। অ্যালফ বলল।
হঠাৎ হরনারের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল,–আচ্ছা, ব্রোকাসের সেই তথাকথিত বদমেজাজি বক্সারটার সঙ্গে কি তোমাদের পথে দেখা হয়েছিল?
অ্যালফ বলল,–যদি দেখা হয়েই থাকে তো কী?
–আমাদের এখানকার বিখ্যাত বক্সার বব মেডোসকে ওই লোকটাই একবার ব্রোকাস কোর্টে লড়াই করতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। লোকটার একটা সঙ্গীও আছে বলে শুনেছি। পরেরদিন সকালে বব মেডোসকে গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় ওখানে পাওয়া যায়। বললেন হরনার।
মিলবার্ন আস্তে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন যে তাঁদের সঙ্গেও ওই লোকটারই দেখা হয়েছিল।
সরাইখানার মালিক তখন ফিসফিস করে মিলবানকে জিগ্যেস করলেন,–মেডোস বলেছিল ওই লোকদুটোর পোশাক নাকি আমাদের ঠাকুরদার আমলের–সেটা কি সত্যি? আর বক্সার লোকটার কপাল বলতে নাকি কিছু নেই?
–মেডোস ঠিকই বলেছিল। আমাদের অভিজ্ঞতাও তাই। বললেন মিলবার্ন।
সরাইখানার মালিক তখন উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন,–ব্যাপারটা আপনাদের খুলেই বলি। এই অঞ্চলের বিখ্যাত বক্সার টম হিকম্যান আর তার বন্ধু জো রো ঠিক ওই ব্রোকাস কোর্টের কাছেই বহুকাল আগে, সম্ভবত ১৮২২ সালে, মত্ত অবস্থায় ঘোড়ার গাড়ি চালাতে চালাতে অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল। দুজনেই মারা গেছল। গাড়ির চাকাটা নাকি হিকম্যানের কপালের ওপর দিয়ে চলে গেছল।