ইংল্যান্ডে বক্সিং-এর ইতিহাসে সেই সময়টা একটা সন্ধিক্ষণ। আগেকার দিনের খালি হাতে লড়ার ট্র্যাডিশন শেষ হয়ে এসেছে। অন্যদিকে দস্তানা পরে, স্টেডিয়ামের রিং-এর মধ্যে নিয়মকানুন মেনে বক্সিং-এর যে আধুনিক প্রথা, তা তখনও শুরু হয়নি। ফলে যে সময়ের কথা আমরা বলছি, সেই সময়ে বক্সিং সমাজের সবথেকে নিম্নস্তরের লোকদের খেলায় পরিণত হয়েছে। যত্র তত্র, অর্থাৎ খামারবাড়িতে, আস্তাবলে, যে-কোনও নির্জন জায়গায় বক্সিং লড়া হত। কোনও নিয়মকানুনের কেউ ধার ধারত না। খেলাটা চলে গেছল কিন্তু গুন্ডাপ্রকৃতির লোকের হাতে, যাদের একমাত্র লক্ষ ছিল বাজি রেখে খেলা ও কিছু টাকা কামিয়ে নেওয়া। মুষ্টিযুদ্ধে কুশলতা না থাকলেও কিছু লোক চোখ রাঙিয়ে, চেঁচামেচি করে নিজেদের দক্ষ বক্সার বলে চালিয়ে দিত।
এইরকম পরিস্থিতিতে বক্সিং-এর আখড়া ও খেলাধূলার ক্লাবে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করেও মিলবার্ন তেমন কোনও ভালো বক্সারের খোঁজ পেলেন না। হেভিওয়েট দু-একজনকে পাওয়া গেলেও তাদের চাহিদা অত্যন্ত বেশি। শেষে অ্যালফ স্টিভেন্স নামের একজন মিওয়েট বক্সারের খোঁজ পেলেন মিলবার্ন।
অ্যালফকে সবাই এক ডাকে চ্যাম্পিয়ন বলে চেনে। ও নাকি এখনও পর্যন্ত কোনও লড়াইতেই হারেনি। সার্জেন্ট বার্টনের থেকে ওজনে কম হলেও অ্যালফ সেটা পুষিয়ে নিতে পারবে তার অভিজ্ঞতা ও শরীরিক কুশলতা দিয়ে। এইসব ভেবে মিলবার্ন অ্যালফের সঙ্গেই কথা পাকা করে নিলেন এবং একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে দুজনে লুটন রওনা হলেন। প্ল্যানটা হল, রাতটা একটা সরাইখানায় কাটিয়ে পরের দিন শিবিরে পৌঁছে যাওয়া।
ট্রাফালগার স্কোয়ার হয়ে অক্সফোর্ড স্ট্রিট পেরিয়ে যাওয়ার পর আস্তে-আস্তে লন্ডনের জনবহুল অঞ্চল শেষ হয়ে গেল। রাস্তা একটু ফাঁকা, হতেই মিলবার্ন গাড়িটা একটু জোরে চালাতে লাগলেন। তার পাশে বসে অ্যালফ। আর সহিস বেটস গাড়ির পেছন দিকে। অ্যালফকে এই প্রথম খুঁটিয়ে দেখে খুশি হলেন মিলবার্ন। শরীরে একটুও মেদ নেই। মুখ চোখ দেখে বোঝা যায়, অসম্ভব সাহসী এবং প্রকৃত লড়িয়ে। মনে হয় এতদিনে ওই গোঁয়ার সার্জেন্ট বার্টনকে শায়েস্তা করা যাবে।
–তুমি কি নিয়মিত ট্রেনিং করো? মিলবার্ন জিগ্যেস করলেন।
–হাঁ স্যর। সবসময় ফিট থাকার চেষ্টা করি। এই তো গত সপ্তাহেই একটা বড় লড়াইতে জিতেছি।
–বেশ! এবার কিন্তু তোমাকে যার সঙ্গে লড়তে হবে, তার ওজন ও উচ্চতা তোমার থেকে অনেক বেশি।
অ্যালফ একটু হেসে বলল,–অনেক হেভিওয়েটকেই হারিয়েছি আমি। এটুকু বলতে পারি আমার চেষ্টার কোনও ত্রুটি থাকবে না।
হঠাৎ মিলবার্ন বললেন,জানো, এই অঞ্চলেই এই রাস্তায় একটা গুন্ডাপ্রকৃতির বক্সার থাকে বলে শুনেছি। কেউ-কেউ লোকটাকে দেখেছে, আবার কেউ-কেউ বলে লোকটা নাকি কাল্পনিক। লোকটার একটা সাথীও আছে। পূর্ণিমার রাতে নাকি ওরা দুজনে এই রাস্তায় চলে আসে আর কোনও পথচারীকে পেলে তার সঙ্গে লড়াই করার জন্যে চ্যালেঞ্জ জানায়। একজন ঘুষি মারতে থাকে, অন্যজন মাটিতে পড়ে যাওয়া প্রতিপক্ষকে আবার দাঁড় করায়। এমন অনেক পথিককে এই রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে, যাঁদের মুখ রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত। ভাবছিলাম আজ হঠাৎ যদি আমাদের সঙ্গে ওদের দেখা হয়ে যায়!
–স্যর, তাহলে কিন্তু খুব ভালো হয়। আমার খুব ইচ্ছে করে পুরোনো দিনের স্টাইলে খালি হাতে লড়াই করতে। অ্যালফ বলল।
–তোমার একটুও ভয় লাগবে না?
–ভয়! কী বলছেন! দশ মাইল দূরে গিয়েও ওদের সঙ্গে লড়তে রাজি আছি। খালি একটা জিনিস বুঝতে পারছি
–ওরা যদি এতই ভালো বক্সার তাহলে ওদের নাম শোনা যায় না কেন?
–কী জানি! হয়তো ওরা এদিকেই কোথাও ঘোড়া টোড়ার দেখাশোনা করে-বাইরে যায় না। তাই বিশেষ কেউ ওদের চেনে না। তবে ব্যাপারটা একটু রহস্যময়ই। আরে! আরে! এ কী!
হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠলেন মিলবার্ন। এই জায়গায় রাস্তাটা বেশ ঢালু হয়ে গেছে আর দুধারে বড় গাছের সারি এমনভাবে আছে যে, মনে হয় গাড়িটা যেন একটা টানেলে ঢুকছে। রাস্তার ঢালু অংশটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেইখানে পাথরের পুরোনো ভগ্নপ্রায় ও শ্যাওলাধরা দুটো স্তম্ভ। স্তম্ভের পরেই একটা জংধরা লোহার গেট এবং তার পরেই একটা পুরোনো পরিত্যক্ত প্রাসাদ। এই গেটের কাছেই প্রায় ছায়ার মধ্যে থেকে একটা লোক হঠাৎ বেরিয়ে রাস্তার মাঝখানে এসে মিলবার্নের গাড়ির ঘোড়া দুটোকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ধরে ফেলল। অতএব গাড়িটা গেল থেমে।
লোকটা আর একজনের উদ্দেশ্যে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে বলে উঠল,–জো, তুমি এসে ঘোড়াদুটো সামলাও। আমি আরোহী দুজনের সঙ্গে কথা বলব।
ছায়ার আড়াল থেকে আর একটা লোক বেরিয়ে এসে বিনাবাক্যব্যয়ে ঘোড়াদুটোকে ধরে ফেলল। লোকটা একটু খর্বাকৃতি, শরীরটা একটু গাট্টাগোট্টা টাইপের, মুখমণ্ডল লাল, নীচের ঠোঁটটা বাঁকামতো। লোকটার পোশাকের মধ্যে নজরে পড়ার মতো জিনিস হল, পুরোনো আমলের বাদামি রঙের ঝালর দেওয়া একটা ওভারকোট, গলায় কালোরঙের একটা স্কার্ফ। মাথায় টুপি নেই। ও ঘোড়ার লাগাম ধরতেই অন্য লোকটা গাড়ির ওপর চওড়া কবজিওয়ালা হাত রেখে মিলবার্ন আর অ্যালফের দিকে তাকাল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল, নীল দুটো চোখ, দৃষ্টিতে ক্রুরতা। মুখটা ভয়ংকর নিষ্ঠুর, পোড় খাওয়া। লোকটা ওর সঙ্গীকে বলে উঠল, এই দুজনের মধ্যে ছোকরাটাকেই বাছা যাক-লড়াই ভালো জমবে।