জ্ঞান ফিরে এলে ফেলিক্স বলল, উনিই আমার বাবা। মৃত অবস্থায় চেয়ারে বসে! পার্সিভাল, আপনি নিশ্চয় সবকিছু জানতেন। তাই আপনি ওই ঘরে ঢোকার আগে আমাকে সতর্ক করেছিলেন।
হ্যাঁ, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আমি জানতাম। আমি ভালো ভেবেই সবকিছু করেছি। কিন্তু আমার অবস্থাটা একটু বিবেচনা করে দেখুন–সাত বছর ধরে আমি জানি আপনার বাবা ওই ঘরে মরে পড়ে আছেন!
আপনি সবকিছু জেনেও আমাদের কিছু বলেননি!
আমার ওপর রাগ করবেন না, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড। আবার বলি, এই ঘটনায় আমার ভূমিকাই সবচেয়ে কঠিন ছিল।
আমার মাথা ঘুরছে। কিছুই বুঝতে পারছি না! এই বলে ফেলিক্স টলতে টলতে গিয়ে বোতল থেকে খানিকটা ব্র্যান্ডি খেল ও আমার মাকে ও আমাকে লেখা বাবার চিঠিগুলো কি তা হলে জাল?
না। চিঠিগুলো আপনার বাবাই লিখেছিলেন এবং আপনাদের ঠিকানাও ওঁরই হাতে লেখা। আমাকে ওগুলো দিয়েছিলেন ডাকবাক্সে ফেলার জন্য। আপনার বাবা আমার মালিক ছিলেন। এবং কর্মচারী হিসেবে তাঁর আদেশ আমি অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছি।
ততক্ষণে ব্র্যান্ডির প্রভাবে ফেলিক্স একটু সুস্থ হয়েছে। ও বলল, এবার বলুন। হয়তো এখন সহ্য করতে পারব।
মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আপনি তো জানেন একটা সময়ে আপনার বাবা বিশেষ বিপদে পড়েন। উনি ভেবেছিলেন, অনেকের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ওঁর গাফিলতির ফলে ডুবতে বসেছে। তখন উনি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আপনি ভাবতেও পারবেন না আপনার বাবার এই সিদ্ধান্ত বদলানোর জন্য আমি কী না করেছি–অনুরোধ, উপরোধ, জবরদস্তি। কিন্তু তিনি মনস্থির করে ফেলেছিলেন। আমাকে শুধু বলেছিলেন যে, ওঁর মৃত্যুটা সহজ না বেদনাদায়ক হবে, সেটা নির্ভর করছে আমার ওপর। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওঁর কথার নড়চড় হবে না। শেষপর্যন্ত আমাকে মেনেই নিতে হয় ওঁর অনুরোধ, আর ওঁর কথামতো সবকিছু করতে রাজি হলাম।।
ওঁর চিন্তার কারণ ছিল একটাই। লন্ডনের ডাক্তার ওঁকে বলে দিয়েছিলেন। ওঁর স্ত্রীর হৃদযন্ত্র খুবই দুর্বল এবং সামান্য মানসিক আঘাতেই তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। স্বামী হিসাবে উনি এমন কিছু করতে চাননি যাতে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এদিকে নিজের জীবনও তার কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কী করে স্ত্রীর কোনওরকম ক্ষতি না করে নিজের জীবন শেষ করা যায়, এই ছিল তার লক্ষ্য।
আপনি এখন নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন উনি কী রাস্তা নিয়েছিলেন। আপনার মা যে চিঠি পান, সেটা আপনার বাবারই লেখা। চিঠিতে যা লেখা ছিল, তা সবই সত্য। উনি লিখেছিলেন যে, আপনার মায়ের সঙ্গে শিগগিরই ওঁর দেখা হবে। তার মানে উনি কয়েক মাসের মধ্যেই আপনার মায়ের মৃত্যুর সম্ভাবনার ইঙ্গিত করছিলেন। আপনার মায়ের আসন্ন মৃত্যু সম্বন্ধে উনি এত নিশ্চিত ছিলেন যে, আপনার মাকে দুটো মাত্র চিঠি লিখে যানকিছুদিনের ব্যবধান রেখে পাঠানোর জন্য। কিন্তু আপনার মা পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন আর তাকে পাঠানোর জন্য আর কোনও চিঠি ছিল না।
আপনার বাবা আর-একটা চিঠি লিখে গেছলেন, যেটা আপনার মায়ের মৃত্যুর পর আপনাকে পাঠাতে বলেছিলেন। এই তিনটে চিঠিই আমি প্যারিসে গিয়ে ডাকবাক্সে ফেলি, যাতে সকলেই নিঃসন্দেহ হয় যে, আপনার বাবা বিদেশে আছেন। উনি আমাকে বলে গেছলেন কাউকে কিছু না জানাতে, তাই আমি চুপ করে থেকেছি। আমি তার বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলাম। উনি ভেবেছিলেন, সাত বছর পরে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলে ওঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন শোকটা অনেক সহজেই সামলে নেবে। উনি সর্বদা আর সবাইয়ের সুযোগ সুবিধে ভেবে কাজ করতেন।
আমরা চুপচাপ এতক্ষণ পার্সিভালের কথা শুনছিলাম। নৈঃশব্দ ভেঙে প্রথম কথা বলল ফেলিক্স, আপনার কোনও দোষ নেই, পার্সিভাল। আপনি আমার মাকে মানসিক আঘাত থেকে রক্ষা করেছেন, এবং তাই উনি আর কটা বছর বেঁচে ছিলেন। ওই কাগজটা কী?
আপনার বাবার মৃত্যুর সময়ে এইটাই লিখছিলেন। পড়ে শোনাব?
পড়ুন।
বিষটা খেয়েছি এবং বুঝতে পারছি তা আমার শিরায়-শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। অনুভূতিটা অদ্ভুত। কিন্তু কোনও যন্ত্রণা নেই। আমার ইচ্ছা অনুযায়ী যদি সবকিছু করা হয়, তা হলে এই লেখা যখন কেউ পড়বে, ততদিনে আমার মৃত্যুর পর কয়েক বছর কেটে যাবে। আমার কাছে যারা লগ্নীর জন্য টাকা দিয়েছিল, তারা এতদিনে নিশ্চয়ই আমার প্রতি তাদের বিরুপতা ভুলে গিয়ে থাকবে। আর, ফেলিক্স, তুমিও এই পারিবারিক কলঙ্কের জন্য আমায় ক্ষমা কোরো। ঈশ্বর আমার এই ক্লান্ত আত্মাকে বিশ্রাম দিন।
আমরা তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠলাম তাই হোক।
The Sealed Room গল্পের অনুবাদ
মুষ্টিযুদ্ধ
সালটা সম্ভবত ১৮৭৮। ইংল্যান্ডে লুটন শহরের কাছে ইংরেজ সেনাদলের একটা পল্টনের শিবির। কিন্তু সম্ভাব্য ইউরোপীয় যুদ্ধের ব্যাপারে পল্টনের সৈন্যদের বিশেষ কোনও ভাবনা চিন্তা নেই। ভাবনা তাদের একটাই সার্জেন্ট বার্টনকে কীভাবে মুষ্টিযুদ্ধে হারানো যায়। হাড়ে মাসে দু-শো পাউন্ড ওজনের শক্তপোক্ত চোহারা বার্টনের। দু-হাতেই ঘুষির এত জোর যে দলের আর কেউ তার সঙ্গে বক্সিং লড়তে গেলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কুপোকাত হয়। সবাইয়ের অভিমতবার্টনকে বক্সিং-এ একবার অন্তত হারাতে না পারলে ওর ঔদ্ধত্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অতএব দলের সিনিয়র অফিসার ফ্রেড মিলবার্নের ওপর ভার পড়ল লন্ডনে গিয়ে একজন ভালো বক্সারকে জোগাড় করে তার সঙ্গে বার্টনের একটা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা।