কিছু মনে কোরো না আমি তো বাইরের লোক, একটা নিরপেক্ষ মত দিলাম, এই মাত্র। যাক্, এবার উঠি, অনেকটা হাঁটতে হবে এখন। সমস্ত ঘটনাটা এমনই যে, এর শেষটুকু জানার কৌতূহল থাকবে।
আপনার কার্ডটা রেখে যান, বলল ফেলিক্স।
কার্ড রেখে শুভ রাত্রি জানিয়ে রওনা দিলাম।
বেশ কিছুকাল আর কোনও খবর পেলাম না।
হঠাৎ একদিন দুপুরে আমার অফিসে বেয়ারা একটা কার্ড দিয়ে গেল–একজন মিঃ জে, এইচ, পার্সিভাল আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন তিনি–বয়েস বছর পঞ্চাশেক, ছোটখাটো চেহারা। চোখদুটো কিন্তু উজ্জ্বল।
ফেলিক্স স্ট্যানিফোর্ডের কাছে আমার নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন, উনি বললেন।
অবশ্যই। আমার মনে আছে, বললাম।
ফেলিক্স আপনাকে ওর বাবার অন্তর্ধান এবং একটা সিল করা ঘরের কথা বলে থাকবে।
হ্যাঁ।
তা হলে আপনি নিশ্চয় জানেন যে, ফেলিক্সের একুশ বছর বয়েস হলে ওই ঘরটা খোলার অনুমতি দিয়েছিলেন ওর বাবা।
জানি।
আজই ফেলিক্সের বয়স একুশ হল।
ঘরটা খুলেছেন? উৎসাহের সঙ্গে জিগ্যেস করলাম।
এখনও খুলিনি, গম্ভীরভাবে বললেন মিঃ পার্সিভাল।
আমার মনে হয় দরজাটা ভোলা সময় একজন সাক্ষী উপস্থিত থাকা দরকার। আপনি সাক্ষী হিসাবে থাকতে রাজি?
সানন্দে।
দিনের বেলা আপনি আর আমি দুজনেই ব্যস্ত। রাত নটায় যদি আমরা ওই বাড়িতে পৌঁছই?
নিশ্চয়ই আসব।
ওই কথাই রইল। আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করব, এই বলে মিঃ পার্সিভাল বিদায় নিলেন।
রাতে পৌঁছলাম ওই বাড়িতে। ফেলিক্সের ছোট ঘরটিতে ওরা দুজনে আমার অপেক্ষায় বসেছিলেন। ফেলিক্সকে স্বাভাবিকভাবেই বেশ নার্ভাস লাগছিল। কিন্তু মিঃ পার্সিভালের বিশেষ উত্তেজিত ভাব দেখে অস্বাভাবিক লাগল, ওঁর মুখ লালচে। হাতগুলো অস্থিরভাবে নড়াচড়া করছে।
ফেলিক্স আমাকে দেখে বিশেষ খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানাল। তার পরেই সে বলল পার্সিভালকে, আর দেরি করে কী লাভ? চলুন, যা হওয়ার তাড়াতাড়ি হয়ে যাক।
পার্সিভাল বাতিটা হাতে নিয়ে আগে চললেন। কিন্তু দরজাটার কাছে পৌঁছনোর আগেই প্যাসেজে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ওঁর হাত এত কঁপছিল যে, বাতির আলোর ছায়া দেওয়ালে ওঠানামা করছিল।
একটু ভাঙা গলায় পার্সিভাল বললেন, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আপনি মন শক্ত করুন। সিল ভেঙে দরজা খোলার পর যাতে কোনও মানসিক আঘাত না পান।
কী থাকতে পারে ওই ঘরে, পার্সিভাল? আপনি কি বলছেন আমি ভয় পাব?
না, মিঃ স্ট্যানিফোর্ড। কিন্তু আমাদের তৈরি থাকা দরকার…মন শক্ত করা চাই..আপনার যাতে কিছু পার্সিভাল শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে অতিকষ্টে টুকরো-টুকরো কথাগুলি বলছিলেন। তখনও আমি স্পষ্ট বুঝলাম যে, পার্সিভাল জানেন ওই ঘরে কী আছে এবং যা আছে তা ভয়ানক, বীভৎস।
মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, এই নিন চাবি। কিন্তু আমার সতর্কবাণী মনে রাখবেন, বললেন পার্সিভাল।
পার্সিভালের হাত থেকে চাবির গোছাটা ফেলিক্স ছিনিয়ে নিল। তারপর বিবর্ণ সিলটির নীচে একটা ছুরি ঢুকিয়ে এক ঝটকায় সিলটি উঠিয়ে ফেলল। বাতিটা পার্সিভালের হাতে কাঁপছে, তাই আমি বাতিটা আমার হাতে নিয়ে চাবির ফুটোর ওপর আলো ফেললাম। আর ফেলিক্স একটার-পর-একটা চাবি দিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল।
হঠাৎ একটা চাবি লেগে গেল আর দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে গেল। আর তার পরেই ফেলিক্স ঘরের ভেতরে এক পা গিয়েই একটা আর্তচিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে আমাদের পায়ের কাছে পড়ে গেল।
আমিও যদি পার্সিলের সতর্কবাণী না শুনতাম বা ভয়াবহ কিছু সহ্য করার জন্য তৈরি না থাকতাম, বাতিটা হয়তো আমার হাত থেকে পড়ে যেত। ঘরটায় কোনও জানালা বা আসবাবপত্র নেই। একটা ফটোগ্রাফিক ল্যাবরেটরির মতো সাজানো-একপাশে একটা সিংক ও তাতে একটা কল লাগানো। একটা তাকে কিছু শিশি বোতল রাখা। এবং ঘরের মধ্যে তীব্র, অস্বস্তিকর একটা গন্ধ কিছুটা কেমিক্যালের, কিছুটা জান্তব। আমাদের সামনে একটা টেবিল ও চেয়ার রাখা আছে। আমাদের দিকে পেছন ফিরে একজন ওই চেয়ারে বসে কিছু যেন লিখছে। মানুষটির দেহরেখা ও ভঙ্গী একদম জীবন্ত মানুষের মতো, কিন্তু তার ওপর আলো পড়তেই আতঙ্কে আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। লোকটির ঘাড় আমার কবজির মতো সরু। ঘাড়ের চামড়া কোঁচকানো কালো। তার শরীরের ওপর ধুলোর পুরু প্রলেপ-ঘন, হলদেটে ধুলো। চুল, কাধ, হলদে কুঁচকে যাওয়া হাত–সবেতেই ধুলোর প্রলেপ। মাথাটি ঝুঁকে বুকের ওপর। তার কলমটি একটি বিবর্ণ কাগজের ওপর পড়ে আছে।
হায়! মিঃ স্ট্যানিফোর্ড, আমার মালিক! পার্সিভাল এই বলে কেঁদে উঠলেন এবং তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
ইনিই মিঃ স্ট্যানিস স্ট্যানিফোর্ড! আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম।
এইখানে উনি সাতবছর বসে আছেন–সাত-সাতটি বছর। কেন এমন করলেন উনি? কত অনুরোধ করেছি, পায়ে ধরেছি–তা-ও আমার কথা শোনেননি। দেখুন টেবিলে একটা চাবি পড়ে আছে। ভেতর থেকে দরজায় চাবি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ওই দেখুন, কিছু লিখে রেখেছেন। ওটা দেখতে হবে।
হ্যাঁ, ওই কাগজটা নিয়ে নিন আর, ভগবানের দোহাই, এই ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন, আমি বললাম। এই ঘরের হাওয়া বিষাক্ত। আসুন, স্ট্যানিফোর্ড, বেরিয়ে আসুন! আতঙ্ক বিহ্বল ফেলিক্স স্ট্যানিফোর্ডের দু-হাত দুজনে ধরে ওকে কিছুটা টানতে টানতে, কিছুটা বয়ে নিয়ে আমরা ওর ঘরে চলে এলাম।