আমার ব্যাবসার অবস্থা খুব খারাপ। এই কারণে আমি কিছুদিনের জন্যে তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তবে অবশ্যই যত শীঘ্র সম্ভব চলে আসব। আমাদের এই বিচ্ছেদ অতি অল্প সময়ের জন্য। সুতরাং এ নিয়ে ভেবে তুমি শরীর খারাপ কোরো না।
আমার একটা বিশেষ অনুরোধ আছে। চেষ্টা কোরো কোনওমতেই যেন এই অনুরোধ পালনে কোনও অন্যথা না হয়। লনে যাওয়ার প্যাসেজে আমার যে ডার্করুমটা আছে, যেখানে আমার ফোটোগ্রাফির কাজ করি, সে-ঘরে এমন কিছু জিনিস আছে যেগুলি আমি গোপন রাখতে চাই। তবে সেগুলির সঙ্গে কিন্তু কলঙ্কজনক কিছু জড়িয়ে নেই। তা সত্ত্বেও আমি চাই তুমি বা ফেলিক্স অবশ্যই আমার এই অনুরোধ রাখবে। ফেলিক্সের বয়েস যখন একুশ বছর হবে, তখন ও ওই ঘরে ঢুকতে পারে, তা আগে নয়।
এখন তোমার কাছ থেকে বিদায় নিই। আমার এই অল্পদিনের অনুপস্থিতিতে যে কোনও ব্যাপারে পরামর্শ নিতে গেলে মিঃ পার্সিভলের সঙ্গে যোগাযোগ কোরো। ওঁর ওপর আমার অগাধ আস্থা। তোমাকে আর ফেলিক্সকে এভাবে ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছে–কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি নিরুপায়।
ইতি–
তোমার স্ট্যানিসলস
৪ঠা জুন, ১৮৮৭
আমার চিঠি পরা শেষ হলে ফেলিক্স খানিকটা কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল, আমাদের এই পারিবারিক ব্যাপার আলোচনা করে হয়তো আপনার সময় নষ্ট করলাম। ধরে নিন, আপনি সবকিছু একজন ল’ইয়ার হিসেবে শুনলেন। অনেক বছর ধরে কাউকে এই কথাগুলো বলতে চাইছিলাম।
আমাকে বিশ্বাস করে এত কিছু বললে এতেই আমি খুশি। তা ছাড়া পুরো ব্যাপারটা বেশ কৌতূহল জাগায়।
জানেন, আমার বাবার সত্যের প্রতি আকর্ষণ ছিল এমনই যে, মাঝে-মাঝে সেটা প্রায় মানসিক রোগের পর্যায়ে চলে যেত। কখনও তিনি মিথ্যেকথা বলতেন না। সুতরাং তিনি যখন বলেছিলেন যে, মায়ের সঙ্গে শিগগিরই আবার দেখা করবেন এবং ডার্করুমে কোনও কলঙ্কজনক ব্যাপার নেই, বাবা নিশ্চয়ই সত্যি কথাই বলছিলেন।
তাহলে ওই ঘরে কী থাকতে পারে?
সেটা আমার বা মায়ের কল্পনার বাইরে। আমরা বাবার কথায় আমরা দরজায় সিল লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এবং সেই সিল এখনও লাগানো। বাবার অন্তর্ধানের পর মা বছরপাঁচেক বেঁচে ছিলেন। যদিও ডাক্তাররা ভেবেছিলেন যে, মা বেশিদিন বাঁচবেন না। মায়ের হার্টের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছল। বাবার যাওয়ার পর প্রথম কয়েক মাসে মাকে লেখা বাবার দুটো চিঠি এসেছিল। দুটোই প্যারিস থেকে পোস্ট করা, কিন্তু কোনও ঠিকানা নেই। দুটো চিঠিই ছিল ছোট বক্তব্য একই? চিন্তা কোরো না, শিগগির দেখা হবে। এর পরে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত আর কোনও চিঠি আসেনি। তারপরে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন তার বক্তব্য এতই ব্যক্তিগত যে, চিঠিটা আপনাকে দেখাতে পারছি না। চিঠিতে মোটামুটি বলেছিলেন, আমি যেন তাকে খারাপ মানুষ না ভাবি। আমায় অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। এ-ও বলেছিলেন যে, মায়ের মৃত্যুর পর ওই ঘরটার দরজা বন্ধ রাখার যৌক্তিকতা অনেক কমে গেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার একুশ বছর বয়েস না হওয়া অবধি ওই ঘর না খোলাই ভালো। ঘর খুললে অত্যন্ত বেদনাদায়ক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। বরং অপেক্ষা করলে সময়ের প্রভাবে ওই পরিস্থিতি সামলে নেওয়া সম্ভব হবে। আর বলেছিলেন, ওই ঘরের দায়িত্ব আমার ওপর থাকল। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, চরম দারিদ্র সত্ত্বেও এই বাড়ি আমি কেন বিক্রি করিনি বা ভাড়া দিইনি।
বন্ধক তো রাখতে পারতে!
বাবা বাড়িটা আগেই বন্ধক রেখেছেন।
পুরো পরিস্থিতিটাই অদ্ভুত।
আমি আর আমার মা এতকাল আসবাবপত্র বিক্রি করে চালিয়েছি। চাকরবাকরদের একে-একে বিদায় করা হয়েছে। আপাতত, আমি এই একটা ঘরেই থাকি–আমাকে দেখাশোনা করারও কেউ নেই। তবে আর মাত্র দু-মাস অপেক্ষা করতে হবে।
তার মানে?
আমার একুশ বছর বয়স হতে আর দু-মাস বাকি। তার পরেই প্রথম কাজ ওই ঘরের দরজাটা খোলা, আর দ্বিতীয় কাজ বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া।
আচ্ছা, ফাটকায় লাগানো টাকা যখন উদ্ধার হয়েই গেছল, তখন তোমার বাবা ফিরে এলেন না কেন?
বাবা নিশ্চয়ই ততদিনে গত হয়েছিলেন।
আচ্ছা, তুমি বললে দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে তোমার বাবা আইনত দণ্ডনীয় কোনও অপরাধ করেননি।
হ্যাঁ।
তাহলে তোমার মাকে সঙ্গে নিয়ে যাননি কেন? জানি না।
নিজের ঠিকানা গোপন করার কারণ কী হতে পারে?
তা-ও বলা কঠিন।
মা মারা গেলেন, তাঁর শেষকৃত্যও হয়ে গেল–তবুও তোমার বাবা কেন ফিরে এলেন না?
জানি না। দ্যাখো, একজন পেশাদার উকিল হিসেবে তোমাকে এটুকু বলতে পারি যে, তোমার বাবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পেছনে অবশ্যই কোনও গুরুতর কারণ ছিল। যদিও তার বিরুদ্ধে কোনও অপরাধের প্রমাণ ছিল না। তিনি হয়তো জানতেন কোনও প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যাপারটা থানা-আদালত অবধি গড়াতে পারে। সুতরাং তিনি দেশের বাইরে চলে যাওয়াই সমীচীন মনে করেন। এ ছাড়া তো আর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাচ্ছি না।
ফেলিক্স স্বভাবতই একটু ক্ষুণ্ণ হল। আমায় ঠান্ডা গলায় বলল, আপনি আমার বাবাকে চিনতেন না। যখন আমাদের ছেড়ে যান, তখন আমি খুবই ছোট। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বাবাই আমার আদর্শ। বাবার দোষ ছিল একটাই, তিনি একটু স্পর্শকাতর মানুষ ছিলেন। আর নিজের স্বার্থ নিয়ে কখনও ভাবেননি। তার মাধ্যমে কারুর আর্থিক ক্ষতির কথা তিনি ভাবতেই পারতেন না। তাঁর আত্মসম্মানবোধও ছিল অত্যন্ত প্রখর। সুতরাং তার অন্তর্ধানের কারণ খুঁজতে গিয়ে তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো ভুলে গেলে চলবে না।