সত্যিই কিছু তথ্য আর্থারের নির্দোষিতা প্রমাণ করে। ডাঃ লানা রাত এগারোটার সময় তার পড়ার ঘরে ছিলেন–জীবিত, কেন না মার্থা ওই সময় ডাক্তারের গলার আওয়াজ শুনেছিলেন। হতে পারে, তখন ডাক্তারের সঙ্গে অন্য কেউ ছিল। যেভাবে ডাক্তার অধৈর্যের সঙ্গে মার্থাকে ওই সময় চলে যেতে বলেন, তাতে তাই মনে হয়। এই যুক্তি যদি সত্যি হয়, তাহলে ডাক্তারের মৃত্যু হয়েছিল এই দুই ঘটনার মধ্যে কোনও সময়ের গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া এবং মিসেস ম্যাডিং-এর ডাক্তারের বাড়ি আসা। সে ক্ষেত্রে আর্থার নির্দোষ, কেন না মিসেস ম্যাডিং আর্থারকে দেখেন এর পরে, গেটের কাছে।
এবার প্রশ্ন, ডাক্তার লানার ঘরে তাহলে কে এসেছিল এবং কী উদ্দেশ্যে। আর্থারকে ছাড়া বাড়ির ত্রিসীমানায় আর কাউকে দেখা যায়নি। তা ছাড়া, ডাক্তারের প্রতি তার বিরূপ মনোভাব ছিল সুবিদিত। কাদামাখা জুতোর ছাপ দেখেও কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। সেদিন বৃষ্টি হওয়ায় যে কেউই ডাক্তারের ঘরে এসে থাকুক, তার জুতোর ছাপ কাদামাখাই হত। ফ্রান্সেসের ছবিটা আর্থারের কাছে না পাওয়া গেলেও তার মানে এই নয় যে, আর্থার নির্দোষ কেন না ছবিটা সরিয়ে ফেলার বা নষ্ট করার যথেষ্ট সময় আর্থারের হাতে ছিল। সব মিলিয়ে এটা কিছুতেই বোঝ যাচ্ছিল না যে আর্থার দোষী না নির্দোষ।
রহস্যময় এবং বিয়োগাত্মক ঘটনাটির এই হল সংক্ষিপ্তসার। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং আয়ার্ল্যান্ডে লোকজন এই রহস্য নিয়ে প্রচুর আলোচনা করেছিল। সমাধানের বিভিন্নরকম সূত্রও দিয়েছিল। কিন্তু আদালতে বিচারের সময় যে চাঞ্চল্যকর পরিণতির ইঙ্গিত পাওয়া গেল, তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। তখনকার “ল্যাংকাশায়ার উইলি” নামের খবরের কাগজে এই বিচারের যে রিপোর্ট বেরিয়েছিল, তারই একটা সংক্ষিপ্তসার এখানে দেওয়া যায়।
সরকার পক্ষের উকিল মিঃ কার আর্থারের বিরুদ্ধে এমনভাবে কেস সাজিয়েছিলেন যে আর্থারের উকিল মিঃ হামফ্রি প্রায় অসহায় হয়ে পড়লেন। বেশ কয়েকজন সাক্ষী জানাল যে, বোনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্য ডাক্তারের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার বাসনা তারা আর্থারের মুখে শুনেছে। মিসেস ম্যাডিং বললেন যে, তিনি আর্থারকে ওই রাতে ডাক্তারের বাড়ির কম্পাউন্ডে দেখেছেন। আরেকজন সাক্ষী বলল যে, আর্থার ভালোভাবেই জানত যে ডাঃ লানা
অনেক রাত অবধি মূল নিবাস থেকে বিচ্ছিন্ন তার চেম্বারে কাজ করেন এবং সেই জন্যই সে অত রাতে এসেছিল। ডাক্তারের এক চাকর তো মিঃ কারের জেরায় নাজেহাল হয়ে বলেই ফেলল যে ডাক্তার রাত তিনটের সময় বাড়ি ফিরেছিলেন। সুতরাং, মিসেস ম্যাডিং যেহেতু রাত তিনটের সময় আর্থারকে দেখেছিলেন, ব্যাপারটা দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেল।
এমনকী ডাক্তারের ঘরে পাওয়া জুতোর ছাপের সঙ্গে আর্থারের জুতোর ছাপের মিল সরকার পক্ষ প্রায় প্রমাণ করে দিল।
বেলা তিনটের সময় যখন মিঃ কার তার বক্তব্য শেষ করলেন এবং আদালত দ্বিপ্রহরিক বিরতির জন্য বন্ধ রইল, তখন উপস্থিত সবাই এটা বুঝে গেল যে, আর্থারকে নির্দোষ প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব।
সাড়ে চারটের সময় আবার আদালত চালু হতেই বেশ হই-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, কেন না আর্থারের উকিল পেশ করলেন তাঁর প্রথম সাক্ষীকে মিস ফ্রান্সেস মর্টন। ফ্রান্সেসকে একটু বিচলিত দেখালেও সে কিন্তু নীচু গলায় অথচ পরিষ্কারভাবে সাক্ষ্য দিল।
ও বলল, ডাক্তারের সঙ্গে ওর সম্পর্কের শীঘ্রই ছাড়াছাড়ি হতে চলেছে। ওর ভাই আর্থার ডাক্তার সম্বন্ধে যেসব মন্তব্য করেছে, সেগুলো অনুচিত, কেন না ডাঃ লানা অত্যন্ত সজ্জন এবং তিনি ফ্রান্সেস-এর সঙ্গে কোনওরকম দুর্ব্যবহার করেননি। আর্থারকে প্রচুর বোঝানো সত্ত্বেও ফ্রান্সেস ওকে শান্ত করতে পারেনি। এমনকী ঘটনার দিন সন্ধেবেলায় “ওই ডাক্তারকে আমি দেখে নেব” বলে আর্থার শাসিয়েছিলেন।
ফ্রান্সেস-এর বক্তব্য এখনও পর্যন্ত আর্থারের বিরুদ্ধেই যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই আর্থারের উকিল মিঃ হামফ্রি ব্যাপারটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন।
মিঃ হামফ্রি : আচ্ছা, ফ্রান্সেস, তোমার কি বিশ্বাস তোমার ভাই অপরাধী?
জজ : আদালতে বিশ্বাসের কোনও জায়গা নেই– প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করুন।
মিঃ হা : তুমি কি জানো তোমার ভাই ডাঃ লানাকে খুনের অপরাধে অভিযুক্ত নয়?
ফ্রান্সেস : জানি।
মিঃ হা : কীভাবে?
ফ্রা : কেন না ডাঃ লানা মারা যাননি।
এই চাঞ্চল্যকর উক্তিতে আদালতে বেশ গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। একটু পরে আবার শুরু হল সওয়াল জবাব।
মিঃ হা : ফ্রান্সেস, তুমি কী করে জানলে যে ডাঃ লানা মারা যাননি?
ফ্রা : কেন না তার তথাকথিত মৃত্যুর তারিখের পরে লেখা তাঁর চিঠি আমি পেয়েছি।
মিঃ হা : চিঠিটা তোমার কাছে আছে?
ফ্রা : আছে, কিন্তু সেটা আমি দেখাতে চাই না।
মিঃ হা : খামটা?
ফ্রা : হ্যাঁ–এই যে খামটা। লিভারপুল পোস্ট অফিসের ছাপ–তারিখ ২২ জুন।
মিঃ হা : তার মানে, তার তথাকথিত মৃত্যুর পরের দিন। তুমি শপথ করে বলতে পারো–এই হাতের লেখা ডাঃ লানার?
ফ্রা : অবশ্যই। আমি আরও ছজন লোককে আনতে পারি যারা এই হাতের লেখা চেনে।
জজ : মিঃ হামফ্রি, তাহলে আপনি সেই সাক্ষীদের কাল কোর্টে আসতে বলুন।
সরকার পক্ষের উকিল মিঃ কার তখন বললেন,–চিঠিটা আমাদের দেওয়া হোক, যাতে বিশেষজ্ঞ দিয়ে আমরা পরীক্ষা করাতে পারি হাতের লেখাটা সত্যিই ডাঃ লানার না নকল। এই চিঠিটা যখন মিস ফ্রান্সেস মর্টনের কাছেই ছিল, তাহলে সেটা উনি আগেই পুলিসকে দিলেন না কেন? তাহলে মামলাটা এতদুর গড়াত না। হয়তো অভিযুক্তকে বাঁচানোর জন্য শেষ মুহূর্তে এই নকল চিঠিটা দেখিয়ে আদালতের রায় বদলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।