ও! তাহলে তো আপনি দেখেই ফেলেছেন! এই বলে ও কাধটা ঝাঁকাল, ভাবটা এমন যে যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
কী দেখে ফেলেছি?
ওই সিল করা দরজাটা।
হ্যাঁ, দেখেছি।
ভেতরে কী আছে, জানতে ইচ্ছে করেনি, আপনার?
ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লেগেছিল।
আচ্ছা, মনে করুন এই বাড়িতে আপনি বছরের-পর বছর কাটিয়ে যাচ্ছেন আর ভাবছেন ওই দরজার ওপারে কী আছে, অথচ ঢুকে দেখছেন না। পারবেন এমন করে থাকতে?
কী, বলতে চাইছ তুমি? তুমি জানো না ওই ঘরে কী আছে?
আপনি যতটা জানেন, আমিও ঠিক ততটাই জানি।
তাহলে দরজা খুলে দেখছ না কেন?
উপায় নেই, বলল ও।
ওর কথাবার্তায় একটা বিব্রত ভাব ছিল। হয়তো কোনও স্পর্শকাতর জায়গায় অজান্তে ঘা দিয়ে ফেলেছি। এমনিতে আমার সাধারণ শোকের মতো অহেতুক কৌতূহল কম, কিন্তু এখানের যা ব্যাপার, তাতে আমার কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠেছে। যা হোক, এ-বাড়িতে আর বেশিক্ষণ থাকার কোনও অজুহাত আপাতত নেই, কেন না ছেলেটি প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে, আমি তাই উঠে পড়লাম।
আপনার কি তাড়া আছে, ও জিগ্যেস করল।
না। আমার এখন এমন কিছু কাজ নেই।
তাহলে খানিকক্ষণ থাকুন না আমার সঙ্গে। আসলে একেবারে একা থাকি, কাজকর্মও কিছু নেই। লন্ডনে হয়তো এমন কোনও লোক পাবেন না যে আমার মতো জীবন কাটায়। কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগও তো পাই না।
আমি ছোট ঘরটির চারিদিক দেখলাম। সাজানো-গোছানো বিশেষ নয়–একটা সোফা-কাম-বেড একদিকে রাখা। মাথায় ঘুরছে এই বিশাল শূন্য বাড়িটা আর বিশেষজ্ঞ ওই সিল লাগানো রহস্যময় দরজাটা। প্রায় অপ্রাকৃত একটা পরিবেশ। ইচ্ছে করছিল, আরও একটু খোঁজখবর নিই। হয়তো আর খানিকক্ষণ থাকলেই জানতে পারব আরও কিছু। ওকে বললাম যে, আমার কিছুক্ষণ থাকতে ভালোই লাগবে।
ও বলল, “দেখুন, সাইড টেবিলে ড্রিংকসের ব্যবস্থা আছে। আমি তো হাঁটতে পারছি না, সুতরাং হেল্প ইয়োরসেলফ। আর ট্রেতে চুরুট রাখা আছে। আমিও একটু চুরুট খাব। এবার বলুন–আপনি তো উকিল। মিঃ অলডার?”
হ্যাঁ।
আর আমি কিছুই নই। পৃথিবীর চেয়ে অসহায় জীব আমি। লাখপতির সন্তান। বিশাল সম্পদ আমার আমার অধিকারে আসবে, এই আশায় বড় হয়েছি। আর দেখুন আজ আমি কী– কপর্দকহীন, সম্পূর্ণ বেকার। ভাগ্যের কী পরিহাস–আমি এই বিশাল বাড়ির মালিক, যে-বাড়ি ঠিকমতো রাখার সামর্থ্যও আমার নেই। ছোট এক চিলতে জমি গাধার বদলে ঘোড়া দিয়ে চাষ করানোর মতো হয়তো একটা কুঁড়েঘরই আমার পক্ষে যথেষ্ট।
তাহলে বাড়িটা বিক্রি করে দিচ্ছ না কেন?
সম্ভব নয়।
তা হলে ভাড়ায় দিয়ে দাও।
তারও উপায় নেই।
আমার অবাক ভাব দেখে ও হাসল : দাঁড়ান, আপনাকে পুরো ব্যপারটা বুঝিয়ে বলি–অবশ্য যদি আপনার শুনতে ভালো লাগে।
না-না, তুমি বলো।
আসলে আপনি আজ আমার যে-উপকারটা করলেন, তার সামান্য প্রতিদান হিসাবে অন্তত আপনার কৌতূহলটুকু তো মেটাতে পারি। আপনি হয়তো আমার বাবার নাম শুনে থাকবেন, বিখ্যাত ব্যাংকার স্ট্যানিলস স্ট্যানিফোর্ড।
ব্যাংকার স্ট্যানিফোর্ডের নাম সঙ্গে-সঙ্গে আমার মনে পড়ল।
বছরসাতেক আগে হঠাৎ করে তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে অনেক কেচ্ছা কেলেংকারি রটেছিল।
বুঝতে পারছি আমার বাবার কথা আপনার মনে পড়েছে। বাবা তার বেশ কিছু বন্ধুর টাকা ফাটকায় লাগিয়েছিলেন। সেই টাকা ডুবে যাওয়ায় বন্ধুদের এড়াতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
খুব নরমস্বভাবের সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন বাবা, বন্ধুদের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য তিনি ভীষণ বিচলিত হয়েছিলেন, আইনত তিনি কোনও অপরাধ করেননি। কিন্তু পুরো ব্যাপারটায় তিনি এত মর্মাহত হয়েছিলেন যে, নিজের পরিবারের লোকেদেরও মুখ দেখাতে চাননি। পরে তিনি বিদেশ বিভূঁইয়ে মারা যান–কোথায় মারা যান তা-ও আমরা জানি না।
তোমার বাবা মারা গেছেন!
আমার কাছে বাবার মৃত্যুর কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু ফাটকায় লগ্নী করা সেই টাকা আবার উদ্ধার হয়েছে। বেঁচে থাকলে উনি নিশ্চয়ই সসম্মানে ফিরে আসতেন। কিন্তু মনে হয় গত দু-বছরের মধ্যে কোনও একসময় তার মৃত্যু হয়েছে।
গত দু-বছরের মধ্যে কেন?
কেন-না দু-বছর আগেও তাঁর চিঠি পেয়েছি।
চিঠিতে উনি ওঁর ঠিকানা জানাননি?
চিঠিটা এসেছিল প্যারিস থেকে–কিন্তু কোনও ঠিকানা ছিল না। ওই সময়েই আমার মা মারা যান। তখনই বাবার চিঠিটা এসেছিল–আমাকে কিছু উপদেশ আর কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আর কোনও খবর নেই।
তার আগে কখনও বাবার খবর পেয়েছিলে?
হ্যাঁ এবং সিল লাগানো দরজার রহস্যের শুরু তখনই। টেবিলটা একটু আমার দিকে ঠেলে দিন।
এখানেই আমার বাবার চিঠিগুলো রাখা আছে। মিঃ পার্সিভাল ছাড়া আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই চিঠিগুলো দেখছেন।
কিছু মনে কোরো না, মিঃ পার্সিভাল কে?
উনি ছিলেন বাবার একান্ত সচিব এবং প্রথমে মায়ের ও পরে আমার বন্ধু এবং উপদেষ্টা। মিঃ পার্সিভাল না থাকলে আমাদের যে কী অবস্থা হত, তা ভাবতেও পারি না। উনি ছাড়া বাবার চিঠিগুলো আর কেউ দেখেনি। এই দেখুন প্রথম চিঠি সাত বছর আগে লেখা। দেশ ছাড়ার দিন। নিজেই পড়ে নিন। চিঠিটা ফেলিক্সের মাকে লেখা:
তোমাকে আমার ব্যাবসার ব্যাপারে কখনও কিছু বলিনি, কেন না ডঃ উইলিয়ম আমায় বলেছিলেন তোমার হার্ট খুব দুর্বল। কোনওরকম উত্তেজনা তোমার পক্ষে বিশেষ ক্ষতিকারক হবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন যে, তোমাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি।