মনে হচ্ছে, গোড়ালিটা মচকে গেছে–খুব ব্যথা। আপনার হাতটা একটু বাড়ান–ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, ও বলল।
সাইকেলের ম্লান আলোয় ওকে দাঁড় করাতে গিয়ে দেখলাম ভদ্রঘরের ছেলে। বয়স বেশি নয়। ছোট কালো গোঁফ আছে। চোখদুটি বড় বাদামি রঙের, ভাঙা চোয়াল আর একটু নার্ভাস দেখতে। স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো নয়। হয় পরিশ্রম নয় দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে ওর ফ্যাকাশে মুখে। আমি ওর হাত ধরে টানতেই উঠে দাঁড়াল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা পা মাটি থেকে তুলে নিল। ওই পা-টা নাড়াতে গেলেই যন্ত্রণার আওয়াজ করছিল।
পা-টা মাটিতে ফেলতে পারছি না। বলল ও।
তুমি বয়সে অনেক ছোট। তোমাকে আর আপনি বলছি না। কোথায় থাকো।
এই তো, এই বাড়িতেই, বলে মাথা নেড়ে ওই বড়, অন্ধকার বাড়িটার দিকে দেখাল।
রাস্তা পার হয়ে বাড়ির গেটে ঢোকার সময়েই হতভাগা ঘোড়ার গাড়িটা ধাক্কা মারল। আমায় একটু বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন?
সহজেই তা করা গেল। প্রথমে ওর সাইকেলটা গেটের ভেতরে রাখলাম। তারপর ওকে ধরে কম্পাউন্ডের ড্রাইভ দিয়ে নিয়ে গিয়ে হলঘরের দরজার সামনে পৌঁছলাম। কোথাও একটুও আলো নেই–অন্ধকার। নৈঃশব্দের জন্য মনে হচ্ছিল, এই বাড়িতে কেউ কোনওদিন থাকেনি।
ঠিক আছে অনেক ধন্যবাদ, বলে ও দরজার তলায় চাবি লাগানোর চেষ্টা করল।
আমি বললাম, দাঁড়াও, আমি তোমাকে ঠিকমত ঘরের ভেতর পৌঁছে দিই।
ও মৃদু আপত্তি জানালেও এটা বুঝতে পারল যে, আমাকে ছাড়া ওর চলবে না।
দরজাটা খুলতেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে ঢাকা হলঘর। ও একদিকে হেলে গিয়ে এগিয়ে গেল। আমার হাত ওর বাহুতে। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে নিতে ও বলল, এই যে, ডানদিকের এই দরজাটা।
আমি দরজাটা খুললাম আর তক্ষুনি ও কোনওরকমে একটা দেশলাই জ্বালাল। টেবিলের ওপর একটা বাতি ছিল। দুজনে মিলে সেটা জ্বালালাম।
এখন আমি একদম ঠিক। আপনি যেতে পারেন। শুভরাত্রি, এই বলে ও একটা চেয়ারে বসল এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে গেল।
আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ছেলেটিকে এভাবে ছেড়ে যাই কী করে? ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, ও হয়তো মারাই গেছে। একটু পরে ওর ঠোঁটটা কেঁপে উঠল, বুকের একটু ওঠানামা দেখা গেল। কিন্তু ওর আধবোজা চোখদুটি একেবারে সাদা এবং ওর শরীর ফ্যাকাশে লাগছিল। আমার একার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন, তাই ঘণ্টা বাজানোর দড়িটায় একটা টান দিলাম আর বহুদূরে ঘণ্টা বাজার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিন্তু কেউ এল না। আস্তে-আস্তে ঘণ্টার আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে গেল, অথচ কোনও মানুষের কথা বা পায়ের শব্দ শুনলাম না। একটু অপেক্ষা করে আবার ঘণ্টা বাজালাম, কিন্তু ফলের কোনও হেরফের হল না। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কেউ আছে–এই ছেলেটি নিশ্চয়ই এত বড় বাড়িতে একা থাকে না। বাড়ির লোকদের ওর অবস্থা জানানো দরকার। তারা যদি ঘণ্টার আওয়াজে সাড়া না দেয়, আমাকেই তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমি বাতিটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের বাইরে গেলাম।
যা দেখলাম, তা বিস্ময়কর। পুরো হলঘরটা খালি। সিঁড়িগুলো কার্পেটহীন ও ধুলোয় ঢাকা। দেখলাম তিনটে দরজা–তিনটে বড়-বড় ঘরে যাওয়ার। তিনটে ঘরেই কার্পেট বা পরদা নেই, ওপরে মাকড়সার জাল ও দেওয়ালে সঁাতাপড়া দাগ। নিস্তব্ধ শূন্য ঘরগুলোতে আমার পায়ের আওয়াজের প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। তারপর ভেতরের প্যাসেজ দিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলাম–ওখানে অন্তত কাউকে পাওয়া যাবে। হয়তো আশপাশের কোনও ঘরে কেয়ারটেকারকে দেখতে পাব। কিন্তু কোথাও কেউ নেই সব খালি। হতাশ হয়ে আর-একটি দালান ধরে এগোলাম কিন্তু সেখানে অন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।
দালানটা শেষ হয়েছে একটা বড় বাদামি রঙের দরজার সামনে আর দরজার চাবির ফুটোর ওপর প্রায় পাঁচ শিলিং মুদ্রার মাপের একটা লাল মোমের সিল লাগানো। সিলটা নিশ্চয়ই বহুকাল আগের, কারণ সেটি বিবর্ণ হয়ে গেছে, তার ওপরে ধুলোর পলেস্তারা। দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবছি ঘরের ভেতর কী থাকতে পারে, এমন সময় শুনলাম কেউ ডাকছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি ছেলেটি চেয়ারে বসে আছে। ঘরে আলো না থাকাতে ও বেশ অবাক হয়ে গেছে।
আপনি ঘরের বাতিটা নিয়ে কেন চলে গেছলেন? ও জিগ্যেস করল।
আমি লোকজন খুঁজছিলাম–তোমার সাহায্যের জন্য।
আমি এই বাড়িতে একা থাকি।
তোমার শরীর খারাপ হলে তো মুশকিল হয়ে যাবে।
হঠাৎ কেমন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আসলে আমার মায়ের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে দুর্বল হার্ট পেয়েছি। ব্যথা পেলে বা আবেগবশত এরকম হয়। মনে হয় মায়ের মতো এতেই আমার মৃত্যু হবে। আপনি কি ডাক্তার?
না, উকিল। আমার নাম ফ্রাঙ্ক অল্ডার।
আমি ফেলিক্স স্টানিফোর্ড। ভালোই হল আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে। আমার বন্ধু মিঃ পার্সিভাল বলছিলেন, আমাদের শিগগিরই একজন উকিল লাগবে।
বেশ তো।
সেটা অবশ্য মিঃ পার্সিভালের ওপর নির্ভর করছে। আচ্ছা, আপনি বাতি হাতে বাড়ির পুরো একতলাটা ঘুরে এলেন?
হ্যাঁ।
পুরোটা? ও বেশ জোর দিয়ে জিগ্যেস করল আর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
তাই তো মনে হল। আশা করেছিলাম কাউকে-না কাউকে পাবই।
সবকটা ঘরে ঢুকেছিলেন কি? তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন।
যে কটায় ঢুকতে পেরেছিলাম।