একটু দূর থেকে বিদ্রুপের সুরে কথা ভেসে এল, বিদায় কেনেডি। তুমি এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে তুমি মেরির প্রতি অন্যায় করেছ। খালি একটা ছোট ব্যাপার তোমাকে বলা হয়নি। মেরির বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল একটা গরিব, সামাজিক আদবকায়দা না-জানা লোকের সঙ্গে আর সেই লোকটার নাম জুলিয়াস বার্গার।
জামাকাপড়ের একটা খসখসে আওয়াজ শোনা গেল। আর শোনা গেল পাথরের ওপর আস্তে-আস্তে মিলিয়ে যাওয়া পায়ের আওয়াজ। তারপরেই ভূগর্ভের সেই পুরোনো চার্চে নেমে এল এক নিচ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা। জলে ডুবে গেলে মানুষকে যেমন জল ঘিরে ধরে, সেই নিস্তব্ধতাও কেনেডিকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরল।
দুমাস পরে ইউরোপের খবরের কাগজে নিম্নলিখিত সংবাদটি বেরিয়েছিল:
রোমে সদ্য আবিষ্কৃত ভূগর্ভের একটি সমাধিক্ষেত্রকে পুরাতত্ত্বের জগতে একটা আবিষ্কার বলা যেতে পারে। জার্মানির তরুণ পুরাতত্ত্ববিদ জুলিয়াস বার্গার এই সমাধিক্ষেত্রটি আবিষ্কার করেন। প্রাচীন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্নে ভরা এই সমাধিক্ষেত্র পুরাতত্ত্বের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। যদিও এই আবিষ্কারের ওপর গবেষণাপত্রটি বার্গারের লেখা, তবে মনে হয় আর এক কম ভাগ্যবান পুরাতাত্ত্বিক এই জায়গাটি বার্গারের আগেই আবিষ্কার করেছিলেন। মাস দুই আগে তরুণ ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক কেনেডি হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। অনেকে ভেবেছিলেন, একটি মেয়েকে জড়িয়ে একটা কলঙ্কজনক ব্যাপারে তাঁর নাম এসে যাওয়ায় তিনি রোম ছেড়ে চলে গেছেন। এখন বোঝা যাচ্ছে পুরাতত্ত্বের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। কেনেডির মৃতদেহ সম্প্রতি ওই সমাধিক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে। মৃতদেহের পা আর জুতোর অবস্থা দেখে মনে হয়, কেনেডি দিনের পর দিন ওই ভূগর্ভের গোলোকধাঁধাঁয় পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। এমনকী মোমবাতি বা দেশলাই পর্যন্ত সঙ্গে না নিয়ে ওই ভূগর্ভে ঢুকে তিনি চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্যাপারটা আরও বেদনাদায়ক এই কারণে যে কেনেডি ছিলেন ডাঃ জুলিয়াস বার্গারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কেনেডিকে হারানোর বেদনা ডাঃ বার্গারের আবিষ্কারের আনন্দকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে।
The New catacomb গল্পের অনুবাদ
বন্ধ ঘরের রহস্য
ওকালতি আমার পেশা, কিন্তু অ্যাথলেটিক্স আমার নেশা। দশটা-পাঁচটা চার দেওয়ালের মধ্যে ব্যস্ত থাকার পর শারীরিক কসরত করার সময় পাই কেবল সন্ধেবেলায়। অফিসপাড়ার বদ্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে যখন হ্যাম্পস্টেড বা হাইগেটের দিকে একটু উঁচু জায়গায় রাতের দিকে হাঁটতে যাই, তখন মুক্ত হাওয়া সেবনে শরীর মন দুই-ই তাজা হয়ে ওঠে। এইরকমই এক সন্ধেবেলা নিরুদ্দেশ-ভ্রমণে আমার সঙ্গে ফেলিক্স স্ট্যানফোর্ডের প্রথম আলাপ হয়, আর এই আলাপ থেকেই আমার জীবনের সবচেয়ে রহস্যময় অভিজ্ঞতার আস্বাদ পাই।
মাসটা ছিল এপ্রিল বা মে, সাল ১৮৯৪। সেদিন হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি লন্ডনের প্রায় উত্তরসীমানায়। রাস্তার দুদিকে গাছের সারি আর বাংলো বাড়ি। বসন্তকালের মনোরম সন্ধ্যা-আকাশ পরিষ্কার, চাঁদের আলোয় সবকিছুই সুন্দর লাগছিল। আমি তখন বহু মাইল হেঁটে ধীরেসুস্থে চারিদিক দেখতে-দেখতে ফেরা শুরু করেছি। এক মনে হাঁটছি–হঠাৎ একটা বাড়ির দিকে আমার নজর গেল।
বাড়িটা বেশ বড়–রাস্তা থেকে একটু পেছিয়ে–সামনে বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি। এমনিতে বাড়িটা আধুনিক ঢঙে বানানো কিন্তু আশপাশের বাড়ির তুলনায় জলুসহীন। রাস্তার ধারের বাড়িগুলো সবই একলাইনে দাঁড়িয়ে–শুধু এই বাড়িটার সামনের জায়গাটুকু খালি থাকায় বাড়িটাকে একটু বেখাপ্পা লাগছিল। নিশ্চয়ই কোনও বড়লোক ব্যবসায়ীর বাগানবাড়ি ছিল এটা–শহর হয়তো তখনও এতদূর এসে পৌঁছয়নি। ধীরে-ধীরে লন্ডন শহরের লাল ইটের বাড়ির অক্টোপাস এই অঞ্চলটুকুকেও গ্রাস করেছে। আরও কিছুদিনে হয়তো সেই অক্টোপাস বাড়িটার সামনের ফাঁকা জমিটুকুও হজম করে নেবে, আর এখানে মাথা তুলবে বছরে আশি পাউন্ড ভাড়ার একডজন ছোট-ছোট বাড়ি। আমি যখন এইসব ভাবছি তখন হঠাৎ-ই একটি ঘটনা আমার মনকে অন্যদিকে ঘোরাল।
ঘোড়ায় টানা চারচাকার একটা নড়বড়ে গাড়ি কাঁচকোচ আওয়াজ করতে করতে দ্রুতবেগে ছুটে আসছিল, আর উলটোদিকে দেখা যাচ্ছিল একটা সাইকেলের মলিন আলো। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া এই লম্বা রাস্তায় মাত্র দুটি বাহনই চলমান অবস্থায় ছিল। কিন্তু তবুও যেমন আটলান্টিকে অনেকসময় দুটো জাহাজে ধাক্কা লাগে, ঠিক তেমনই আশ্চর্য নিপুণতায় গাড়িটার সঙ্গে সাইকেলের লাগাল ধাক্কা। দোষটা সাইকেল আরোহীরই। গাড়ির সামনে দিয়েই সে রাস্তা পার হতে গিয়েছিল, হিসেবে ভুল করে ঘোড়র ধাক্কায় ছিটকে পড়ল রাস্তায়। উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত খিঁচিয়ে সে তেড়ে গেল গাড়োয়ানের দিকে। তবে গাড়োয়ানও তাকে বেশ দু-চার কথা শুনিয়ে দিল। এই কথাকাটাকাটির ফাঁকে সাইকেল আরোহী ঘোড়ার গাড়ির নম্বরটা টুকে নিতে ভুলে গেল আর সেটা বুঝতে পেরেই গাড়োয়ান জোরে গাড়ি হাঁকিয়ে পিঠটান গেল। সাইকেল আরোহী পড়ে থাকা সাইকেলটা তুলতে গিয়ে হঠাৎ-ই বসে পড়ল আর যন্ত্রণায় অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠল। আমি ছুটে ওর কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, খুব লেগেছে?