–প্রথমদিকে আমিও দু-একবার প্রায় ফেঁসে গেছলাম। এখন গলি-খুঁজির প্ল্যান একটু আধটু বুঝতে পারি। তা সত্ত্বেও এখনও বেশি ভেতরে যেতে গেলে সুতোর গোলা সঙ্গে নিয়ে সুতো ছাড়তে-ছাড়তে যাই।
প্রায় বিশ ফুট নীচে একটা চৌকো মতো জায়গায় ওরা দুজনে দাঁড়িয়ে। লণ্ঠনের কঁপা আলোয় হলদেটে ফাটা দেওয়াল চোখে পড়ছে। আর এই চৌকোনা জায়গাতে চারদিক থেকে বেরিয়েছে অজস্র সুড়ঙ্গের মতো গলি গলির মুখগুলো ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
বার্গার কেনেডিকে বলল,–তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে-সঙ্গে এসো। অন্য কোনওদিকে যাওয়ার চেষ্টা কোরো না। তোমাকে সোজা নিয়ে যাচ্ছি দুর্লভ জিনিসের জায়গাটায়।
মাঝে-মাঝেই এক-একটা গলি দুভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বার্গার নির্দ্বিধায় এগিয়ে চলল। মনে হয় যাওয়ার পথে ও কোনও গোপন চিহ্ন রেখে দিয়েছে। চতুর্দিকে দেওয়ালের ধারে-ধারে মমি-তে পরিণত মৃতদেহ থাকে-থাকে রাখা। আধো-আলো আধো-আঁধারে কঙ্কালসার মমিগুলো দেখে গা ছমছম করছিল কেনেডির। কিন্তু তবুও ও উৎসুকভাবে দেখছিল মৃতদেহগুলির চারপাশে ছড়িয়ে রাখা শিলালিপি, বাসনপত্র, গয়না ও অন্য টুকিটাকি জিনিস। কেনেডি বুঝতে পারছিল যে ভূগর্ভের আবিষ্কৃত সমাধিগুলির মধ্যে এই সমাধিটি অতি প্রাচীন এবং পুরোনো রোমে আদি খ্রিস্টানদের একটা উল্লেখযোগ্য কবরখানা।
হঠাৎ কেনেডি জিগ্যেস করল,–আচ্ছা, লণ্ঠনের আলো নিভে গেলে কী হবে?
–আমার কাছে মোমবাতি আর দেশলাই আছে। তোমার কাছে দেশলাই আছে কি?
কেনেডি উত্তর দিল,–না। তুমি বরং আমায় কটা দেশলাই দাও।
–না, তার কোনও দরকার নেই। আমাদের দুজনের ছাড়াছাড়ি হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই।
–আচ্ছা, বার্গার, আর কত দূরে যেতে হবে? প্রায় সিকি মাইল তো হাঁটা হয়ে গেল।
–সিকি মাইলেরও বেশি। আসলে এই বিস্তীর্ণ সমাধিক্ষেত্রের কোথায় যে শেষ, তা আমিও জানি না। দাঁড়াও, আমার সুতোর গোলাটা বের করি। বাকি পথটায় হাঁটা আরও কঠিন।
সুতোর একপ্রান্ত একটা পাথরের কোণায় বেঁধে সুতোর গোলাটা বুক পকেটে নিয়ে বার্গার চলতে লাগল। কেনেডি বুঝতে পারছিল যে গলিগুলো এখন গোলকধাঁধার মতো জটিল হয়ে উঠেছে। খানিকক্ষণ পরে ওরা একটা বড় গোলাকার হলঘরে পৌঁছে গেল। ঘরের মাঝখানে চৌকো এক বেদির ওপর একটা শ্বেতপাথরের ফলক রাখা।
লণ্ঠনের আলোয় ফলকটা দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে কেনেডি বলল,–এ তো দারুণ জিনিস! খ্রিস্টানদের বানানো প্রথম বেদি হয়তো এটাই। নিশ্চয়ই এই ঘরটাকে চার্চ হিসেবে ব্যবহার করা হত।
বার্গার বলল,–ঠিক বলেছ। এই ঘরের দেওয়ালের ফাঁকে-ফাঁকে যে দেহগুলো মমি করে রাখা আছে, সেগুলো সবই সেই সময়ের বিশপ ও পোপদের। তুমি অন্তত একটা দেহ কাছে গিয়ে দেখে এসো।
কেনেডি দেওয়ালের দিকে গিয়ে একটা মৃতদেহের মাথার দিকে তাকিয়ে বলল,–আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তোমার এই আবিষ্কার সত্যিই অভূতপূর্ব। লণ্ঠনটা একটু কাছে নিয়ে এসো–আমি এগুলো সব দেখতে চাই।
ততক্ষণে বার্গার একটু দূরে সরে গেছে এবং হলঘরের অন্যদিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ ও কেনেডিকে বলল, এইখান থেকে বাইরে বেরোেনোর সিঁড়ি অবধি যাওয়ার পথে কতগুলো ভুল রাস্তা আছে জানেন? দুহাজারের ওপর। প্রাচীন খ্রিস্টান সম্প্রদায় এইরকম গোলকধাঁধা বানিয়ে নিজেদের সমাধিক্ষেত্র রক্ষা করত। সঙ্গে আলো থাকলেও এখান থেকে বেরোনো কঠিন। আর অন্ধকার হলে তো কথাই নেই।
–হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।
–আর এই অন্ধকার ভয়াবহ। একবার এই অন্ধকারের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের চেষ্টা করেছিলাম। আজ আবার একবার চেষ্টা করি।
এই বলেই বার্গার লণ্ঠনের দিকে ঝুঁকল আর পর মুহূর্তেই সবকিছু নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢেকে গেল। যেন একটা অদৃশ্য হাত কেনেডির দুচোখ চেপে ধরে আছে। এই অন্ধকারের যেন একটা শরীরী সত্তা আছে যা কেনেডিকে পিষে ফেলতে চাইছে। এই অন্ধকার যেন একটা নিরেট দেওয়াল, যার কাছে যেতে শরীর ভয়ে কেঁপে ওঠে।
–অনেক হয়েছে বার্গার। এবার আলোটা জ্বালো।
বার্গার তখন হাসতে আরম্ভ করল ও সেই হাসির গা ছমছমে প্রতিধ্বনি ঘরের চারদিক থেকে শোনা যেতে লাগল। বার্গার বলল, কী হল কেনেডি, ঘাবড়ে গেলে না কি?
–আর দেরি কোরো না–এবার আলোটা জ্বালাও। কেনেডির গলায় ব্যাকুলতা।
–জানো কেনেডি, তোমার কথা শুনে বুঝতেই পারছি, যে তুমি কোনখানে দাঁড়িয়ে। তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কোথায়।
–না। মনে হচ্ছে তুমি আমার চারদিকেই দাঁড়িয়ে আছ।
–এই সুতোটা আমার হাতে না থাকলে বুঝতেই পারতাম না যে কোন রাস্তা ধরব।
–তাড়াতাড়ি আলোটা জ্বালাও। শেষ করে এই তামাশা।
–কেনেডি, তুমি দুটো জিনিস খুব পছন্দ করো। এক হচ্ছে অ্যাডভেঞ্চার আর দুনম্বর হল যে-কোনও বাধা অতিক্রম করা। এই গোলকধাঁধা থেকে বেরোনো হবে আসল অ্যাডভেঞ্চার। আর বাধাগুলো হচ্ছে, এই অন্ধকার আর দুহাজার ভুল রাস্তা। ঠিক জায়গায় পৌঁছোতে একটু অসুবিধে হবে অবশ্যই। কিন্তু তোমার হাতে এখন প্রচুর সময়–তাড়াহুড়ো করার কোনও দরকার নেই। মাঝে-মাঝে যখন বিশ্রামের জন্য একটু থামবে তখন একটু মেরি সান্ডারসনের কথা ভেব। আর এটাও ভেবে দেখো, তুমি ওর সঙ্গে যথাযথ ব্যবহার করেছিলে কি না।
–শয়তান! তুমি কী বোঝাতে চাইছ? বিকৃত গলায় চিৎকার করে কেনেডি সেই ঘরে ছোট-ছোট বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল আর যেন সেই ঘন অন্ধকারকে দুহাত দিয়ে ধরতে চাইল।