–স্যর, আমি মার্থা।
-আপনি এই মুহূর্তে নিজের ঘরে চলে যান। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।
কথাগুলো কর্কশ লাগলেও এবং এই ধরনের কথা বলা ডাক্তারের স্বভাব বিরুদ্ধ হলেও, মার্থার ধারণা কথাগুলো ডাক্তারেরই এবং গলার আওয়াজও তার। যাই হোক, সাড়ে এগারোটা নাগাদ মার্থা নিজের ঘরে ফিরে যান।
রাত এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে কোনও সময়ে ডাঃ লানার সঙ্গে দেখা করতে আসেন মিসেস ম্যাডিং। তার স্বামী টাইফয়েড-এ ভুগছিলেন, এবং ডাক্তার বলেছিলেন রাতের দিকে রোগীর অবস্থাটা তাকে জানিয়ে যেতে।
মিসেস ম্যাডিং দেখেন ডাক্তারের ঘরে আলো জ্বলছে। কিন্তু বেশ কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়েও ডাক্তারের সাড়া না পেয়ে তিনি ভাবলেন যে ডাক্তার হয়তো কোথাও বেরিয়েছেন। অগত্যা মিসেস ম্যাডিং নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়ান। কম্পাউন্ডের ভেতর থেকে গেটের কাছে যাওয়ার সময় গেটের আলোয় তিনি একজন লোককে আসতে দেখেন। প্রথমে মনে হয়েছিল, হয়তো ডাক্তারই ফিরে আসছেন। কিন্তু মিসেস ম্যাডিং কিছুটা অবাক হয়েই দেখেন যে আগন্তুক আর কেউ নন, ফ্রান্সেস মর্টনের দাদা আর্থার মর্টন। আর্থারের হাবভাবে উত্তেজনা, হাতে একটা চাবুক।
ডাক্তার বাড়িতে নেই, এ কথা বলার পরও আর্থার বেশ কড়াভাবে বলল,-ঘরে যখন আলো জ্বলছে, কখনও
কখনও তো ডাক্তার ফিরবেনই। এই বলে আর্থার বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে গেল আর মিসেস ম্যাডিং চলে গেলেন নিজের বাড়ির দিকে।
রাত তিনটে নাগাদ অসুস্থ মিঃ ম্যাডিং-এর অবস্থার দ্রুত অবনতি হল। মিসেস ম্যাডিং তক্ষুনি আবার ডাক্তারের বাড়িতে যান। বাড়ির কম্পাউন্ডে ঝোঁপের আড়ালে একটা লোককে তিনি দেখতে পান। মিসেস ম্যাডিং-এর ধারণা, লোকটা আর্থার মর্টন। যাই হোক, এ ব্যাপারে আর মাথা না ঘামিয়ে বাড়ির কাছে গিয়ে তিনি দেখতে পান, পড়ার ঘরের সেই আলোটা একইরকম উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে। দরজায় বহুবার করাঘাত করে এবং জানালায় টোকা দিয়েও ডাক্তারের সাড়া পাওয়া গেল না। তখন বাধ্য হয়েই জানলার কাঠের ফ্রেম ও পরদার মধ্যে এক জায়গায় একটু ফাঁক পেয়ে ঘরের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলেন মিসেস ম্যাডিং।
ঘরের মাঝখানে একটা বড় বাতি জ্বলছে। টেবিলের ওপর ডাক্তারের বইপত্র, যন্ত্রপাতি ছড়ানো। প্রথমে মনে হল, ঘরের মেঝের ওপর একটা ময়লা সাদা দস্তানা পড়ে আছে। কিন্তু আলোয় চোখটা একটু সয়ে যেতেই মিসেস ম্যাডিং বুঝতে পারলেন যে দস্তানাটা আসলে একটা মানুষের হাত আর মানুষটা মেঝের ওপর নিঃসাড়ভাবে পড়ে আছে।
সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটেছে এটা বুঝতে পেরে তিনি তখন বাড়ির সামনের দরজায় গিয়ে বেল বাজিয়ে মার্থাকে ডাকলেন। তারপর মার্থা ও তিনি ঢুকলেন ওই পড়ার ঘরে। আর মেরিকে পাঠানো হল পুলিশে খবর দিতে।
টেবিলের পাশেই, জানলার থেকে একটু দূরে ডাঃ লানা চিত হয়ে পড়ে আছেন এবং নিঃসন্দেহে তিনি মৃত। মুখে ও ঘাড়ে কালশিটে পড়া আঘাতের চিহ্ন। একটা চোখের ওপরেও আঘাত লেগেছে মনে হল। মুখচোখের ফোলাভাব দেখে মনে হয়, ডাক্তারকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।
ডাক্তারের পরনে তার ডাক্তারি অ্যাপ্রন, পায়ে কাপড়ের চটি। চটিজোড়া কিন্তু পরিষ্কার, তাতে কোনও ময়লা লেগে নেই। অথচ কার্পেটের ওপর কাদামাখা বুটজোড়ার ছাপ– হয়তো খুনির বুট জোড়ারই।
সবকিছু দেখে শুনে পুলিশ এই সিদ্ধান্তে এল যে অপারেশনের ঘরের দরজা দিয়েই খুনি ঘরে ঢুকেছিল, এবং কাজ সেরে লুকিয়ে পালিয়ে গেছে। আঘাতের প্রকৃতি ও জুতোর ছাপ দেখে মনে হয়, খুনি পুরুষ।
ঘরের ভেতর থেকে কোনও কিছু চুরি যায়নি–এমনকী ডাক্তারের সোনার ঘড়িটাও তাঁর পকেটে আছে। ফ্রান্সেস মর্টনের একটা ছবি থাকত এই ঘরে–মার্থা দেখলেন, ছবিটা নেই। মেঝের ওপর সবুজ রঙের একটা চোখ-ঢাকা দেওয়ার প্যাঁচ পড়ে আছে। এটা অবশ্য ডাক্তারেরই জিনিস হতে পারে, যদিও মার্থা আগে কখনও এটা দ্যাখেননি।
সমস্ত সন্দেহ গিয়ে পড়ল একজনেরই ওপর–আর্থার মটন। এবং পুলিশ তকে গ্রেফতার করল। আর্থারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও আনুষঙ্গিক প্রমাণ সাংঘাতিক। বোনের সঙ্গে ডাঃ লানা বিচ্ছেদ হওয়ার পর আর্থারের প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি অনেকেই শুনেছে। পুলিশের অনুমান, চাবুক হাতে রাত এগারোটায় আর্থার ডাক্তারের ঘরে ঢোকে। সেই সময় ভয়ে বা রাগে ডাক্তার চেঁচিয়ে ওঠেন, মার্থা সেই চিৎকার শুনেছেন। তারপর আর্থার ও ডাক্তারের মধ্যে বাবিতণ্ডা এমন পর্যায় পৌঁছয় যে, আর্থারের আঘাতে ডাক্তারের মৃত্যু হয়।
ময়না তদন্তের রিপোর্টে জানা যায় যে, ডাক্তারের হার্টের রোগ ছিল–সেটা অবশ্য তার পরিচিতরা কেউ জানত না। হয়তো দুর্বল হার্টের জন্যই তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে। তার পরেই আর্থার বোনের ছবিটা ফ্রেম থেকে ছিঁড়ে নিয়ে কম্পাউন্ডের ঝোঁপঝাড়ের পাশ দিয়ে লুকিয়ে বাড়ি চলে যায়। সরকার পক্ষের উকিল এই ঘটনাচক্রের ভিত্তিতেই তার বক্তব্য রাখলেন।
অবশ্য আর্থারের স্বপক্ষেও কিছু তথ্য ছিল। একটু গোঁয়ার ভাব থাকলেও ওর সরলতা ও দিলখোলা স্বভাবের জন্য সবাই ওকে ভালোবাসত। ও পুলিশকে শুধু এটুকুই বলেছিল যে, ডাক্তারের সঙ্গে পারিবারিক কিছু ব্যাপারে কথা বলার জন্যই ও ডাক্তারের বাড়ি গিয়েছিল। নিজের বয়ানে বা পুলিশের জেরার উত্তরে ও কিন্তু কখনও নিজের বোনের সম্বন্ধে কোনও কথা বলেনি। যাই হোক, ডাক্তারকে না পেয়ে কম্পাউন্ডে অপেক্ষা করে করে শেষে রাত তিনটের সময় ও বাড়ি ফিরে যায়। ডাক্তারের মৃত্যুর ব্যাপারে ও কিছুই জানত না।