প্রফেসর তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন,–চিন্তার কিছু নেই। আমাদের সবাইয়ের যে অবস্থা, তাতে ক্লান্তির জন্যে ওরকম নেতিয়ে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষত আজ রাতে।
মিসেস প্যাটারসন বললেন,–আমারও ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। মাথা তুলে রাখতে পারছি না। বলতে-বলতেই চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝলেন তিনি।
মিঃ প্যাটারসন বললেন,–এইরকম ওর কখনও হয়নি– আশ্চর্য! খাওয়ার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘরের ভেতরটা কেমন যেন বদ্ধ লাগছে। আর খুব গরম লাগছে। আমিও আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব।
এইন্সলি কিন্তু ফুর্তিতে বকবক করেই যাচ্ছিল। হাতে ওয়াইনের গ্লাসটা নিয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে বলল,–আসুন, সবাই মিলে আর একটু ওয়াইন খেয়ে গানটান করি। এক সপ্তাহ ধরে আমরা বিভিন্ন দেশের লোক হয়েও বন্ধুর মতো থেকেছি, পরস্পরকে জানার সুযোগ পেয়েছি। কর্নেল জার্মানির প্রতিনিধি। ফাদার পিয়ের ফ্রান্সের। প্রফেসর আমেরিকার লোক। আমি আর র্যালস্টন ব্রিটেনের। আর এই মহিলারা এই বিপদের দিনে এঁরা ছিলেন করুণা ও সহনশীলতার প্রতিমূর্তি। আসুন, মহিলাদের স্বাস্থ্য কামনা করে ওয়াইনে চুমুক দিই। আরে! এ কী! কর্নেলকে দেখুন! উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
কথা বলতে-বলতেই এইন্সলির হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে। গেল আর ও বিড়বিড় করে কী বলতে-বলতে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ল। নার্স মিস সিনক্লেয়ারও মূছাহত ফুলের মতো চেয়ারের হাতলের দিকে ঝুঁকে বসে–কোনও সাড় নেই।
মিঃ প্যাটারসন হঠাৎ উঠে পড়ে চারদিকে তাকিয়ে মেয়েকে বললেন,–জেসি, ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক না। সকলেই কেন একে-একে ঘুমিয়ে পড়ছে? ওই দ্যাখো, ফাদার পিয়েরও নিদ্রামগ্ন। জেসি, তোমার মায়ের গা এত ঠান্ডা কেন? ও কি ঘুমোচ্ছে? না কি মারা গেছে? কে কোথায় আছ-জানলাগুলোও খুলে দাও!
জানলার দিকে টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে মাঝপথে হাঁটু মুড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন মিঃ প্যাটারসন।
আতঙ্কে বিহ্বল মিস প্যাটারসন চারদিকে ছড়ানো নিষ্পন্দ দেহগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,–প্রফেসর মার্সার! কী হয়েছে বলুন তো? এরা কি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? না-না, মনে হচ্ছে সকলেই মারা গেছে।
বৃদ্ধ প্রফেসরের চোখেও তখন মৃত্যুর অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। তা সত্ত্বেও প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে উঠে জড়িয়ে-জড়িয়ে বললেন,–জেসি, তোমাকে এসব কিছুই দেখতে হত না। শরীর বা মনে কোনও বেদনা বা যন্ত্রণা হত না। সায়ানাইড! ক্যাভিয়ারে মিশিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি কিছুতেই খেলে না।
আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে পিছোতে-পিছোতে জেসি বলল, শয়তান! রাক্ষস! তুমি ওদের সবাইকে বিষ খাইয়েছ!
–না, না, আমি ওদের বাঁচিয়েছি। তুমি তো বিদ্রোহীদের জানো না–তারা কী ভয়ানক! আর এক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা ওদের হাতে ধরা পড়তাম। এসো, এখন খেয়ে নাও একটু ক্যাভিয়ার।
ঘরের জানলার বাইরেই এমন সময় গুলির আওয়াজ শোনা গেল।
–ওই শোনো! ওরা এসে পড়েছে। তাড়াতাড়ি করো। এখনও ওদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারো।
কিন্তু প্রফেসরের পুরো কথা শোনার আগেই জেসি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। বৃদ্ধ প্রফেসর কান পেতে বাইরের আওয়াজ শুনতে লাগলেন। কিন্তু, হে ভগবান, এ কীসের আওয়াজ শুনছি? আমি কি পাগল হয়ে গেলাম? না কি এ বিষক্রিয়ার ফল? এ তো ইউরোপিয়ানদের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে! ইংরেজিতে কেউ নির্দেশ দিচ্ছে। না, সন্দেহের আর কোনও অবকাশ নেই। কোনও অবিশ্বাস্য উপায়ে আশাতীতভাবে উদ্ধারকারীরা এসে পড়েছে। হতাশায় দু-হাত ওপরে তুলে প্রফেসর মার্সার আর্তনাদ করে উঠলেন,–হায় ঈশ্বর! এ আমি কী করলাম!
.
কমোডোর ওয়াইল্ডহ্যাম-ই প্রথম ঢুকলেন সেই মৃত্যুপুরীতে। খাওয়ার টেবিলের চারদিকে নিস্পন্দ সাদা চামড়ার কিছু মানুষ। কেবলমাত্র একটি মেয়ে সামান্য গোঙানির মতো আওয়াজ করছে আর একটু যেন নড়াচড়া করছে। ঘরের মধ্যে এমন একজনও নেই যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শেষ কাজটি করতে পারে। তখনই বাকরুদ্ধ কমোডোর দেখলেন যে পাকা চুলে ঢাকা মাথা টেবিল থেকে তুলে এক মুহূর্তের জন্য টলতে-টলতে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর মার্সার। তার গলা থেকে কোনওরকমে একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোল–সাবধান! ভগবানের দোহাই! ওই ক্যাভিয়ার ছোঁবেন না!
তার পরেই ঢলে পড়লেন প্রফেসর। সম্পূর্ণ হল মরণ বৃত্ত।
The Pot of Caviare গল্পের অনুবাদ
ঘটনাটি
পরলোকগত আত্মার সঙ্গে প্ল্যানচেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করার সময় এই ঘটনাটি শুনেছিলাম। প্ল্যানচেটের মিডিয়ম যে ভাবে ঘটনাটি বলে গেছল, হুবহু সেইভাবে বর্ণনা করছি :
সেদিন রাতের কিছু ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে আছে, আবার কিছু ঘটনা যেন অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো। তাই ঠিক কী হয়েছিল, তা গুছিয়ে বলা বেশ কঠিন। যেমন, কেন সেদিন লন্ডনে গিয়েছিলাম আর কেনই বা অত রাতে লন্ডন থেকে ফিরছিলাম, তা ঠিক মনে পড়ছে না। লন্ডনে আগে যতবার গেছি, সেদিনের লন্ডন যাত্রাটাও যেন সেগুলোর সঙ্গে মিশে তালগোল পাকিয়ে গেছে। তবে রাতে সেই ছোট্ট গ্রামের স্টেশনে নামার পর থেকে সবকিছু আমার স্পষ্ট মনে আছে—প্রতিটি মুহূর্ত।
ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের ঘড়িতে দেখলাম রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। ভাবলাম, বাড়ি যেতে যেতে হয়তো রাত বারোটা বেজে যাবে। স্টেশনের বাইরে এসে দেখলাম বড় মোটর গাড়িটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ঝকঝকে পেতলের পার্টস আর জোরালো হেডলাইটের জন্য অন্ধকারের মধ্যেও গাড়িটা সহজেই চোখে পড়ল। গাড়িটার ডেলিভারি পেয়েছি সেই দিনই। ত্রিশ অশ্বশক্তির ইঞ্জিনওয়ালা বরাবার গাড়ি। আমার ড্রাইভার পার্কিনসকে জিগ্যেস করলাম,গাড়িটা কেমন চলছে?