কর্নেল প্রফেসারের হাত চেপে ধরে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। এখানেও যদি আমরা শত্রুদের কবলে পড়তাম, তা হলে আপনারই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই ব্যবস্থা করতে হত।…কিন্তু এইন্সলির বন্দুকের আওয়াজ এখনও শুনতে পাচ্ছি না কেন? দেখে আসি কী ব্যাপার।
এরপর অনেকক্ষণ কেটে গেল। প্রফেসর চুপচাপ বসে আছেন। না কোনও বন্দুকের আওয়াজ, না উদ্ধারকারীদের আগমনবার্তা। বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই উঠে বাইরে দেখতে যাবেন, এমনসময় ঘরে ঢুকলেন কর্নেল ড্রেসলার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা। বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। কয়েক ঢোক ব্র্যান্ডি খেয়ে কর্নেল বললেন,–সর্বনাশ হয়েছে। বিদ্রোহীরা উদ্ধারকারীদের আটকে দিয়েছে। উদ্ধারকারীদের গোলাবারুদও প্রায় শেষ। আগামী তিনদিনের মধ্যে ওদের এখানে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। ব্রিটিশ কমোডোর ওয়াইন্ডহ্যাম একজন স্থানীয় সেপাইকে দিয়ে এই খবর পাঠিয়েছেন। গুরুতর আহত ওই সেপাই আমায় সবকিছু বলল। আপাতত আমি আর আপনি ছাড়া এই ব্যাপারটি কেউ জানে না।
–সেই সেপাইটা কোথায়?
–অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য সে এইমাত্র মারা গেল। লাশটা গেটের কাছেই পড়ে আছে।
–কেউ ওকে দেখেছে কি?
–এইন্সলি হয়তো দেখে থাকবে। সেক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটাই আমাদের দলের সবাই জেনে যাবে। আমাদের হাতে দু-এক ঘণ্টার বেশি সময় নেই। বিদ্রোহীরা তার মধ্যেই এসে এই ঘাঁটি দখল করে নেবে আর আমরা বন্দি হব।
–আমাদের কি কোনও আশাই নেই?
–বিন্দুমাত্র না।
হঠাৎ তখন ঘরের মধ্যে দলের পুরুষেরা সকলে ঢুকে পড়লেন। সবায়ের এক প্রশ্ন, কর্নেল, আপনার কাছে কি কিছু খবর আছে?
কর্নেল জবাব দেওয়ার আগেই প্রফেসর বললেন, সবকিছু ঠিক আছে। উদ্ধারকারীরা আপাতত একটু আটকে পড়েছে কাল ভোরেই পৌঁছে যাবে। বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই।
খুশিতে ঝলমল করে উঠল সকলের মুখ। কর্নেল তবুও প্রত্যেককে সাবধান থাকতে ও নিজের নিজের পাহারার জায়গায় ফিরে যেতে বললেন। সবাই চলে গেলে কর্নেল প্রফেসারের দিকে তাকালেন। দৃষ্টির অর্থ পরিষ্কার : এখন সবকিছুই আপনার হাতে। প্রফেসরের মুখে সামান্য হাসি– কিছুটা বিষাদের, কিছুটা কাঠিন্যের।
পুরো দুপুরটা কাটল নিস্তব্ধতায়। কর্নেল বুঝতে পারলেন যে, বিদ্রোহীরা চুপচাপ তৈরি হয়ে এখন অন্তিম আক্রমণের অপেক্ষায়। কিন্তু দলের আর সকলে ভাবল যে, বিদ্রোহীরা এতক্ষণে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত হয়েছে।
সান্ধ্য আহারের জন্যে দলের সবাই টেবিলে এলেন। সবাই খুশিতে ডগমগ। প্রথমেই দামি ওয়াইনের তিনটে বোতল খোলা হল। তারপরে সেই বিখ্যাত, মহার্ঘ ক্যাভিয়ারের জারটা। জারটা বেশ বড়–সবাই বড় এক চামচ করে ক্যাভিয়ার নেওয়ার পরেও অনেকটা ক্যাভিয়ার রইল। র্যালস্টন আর এইন্সলি আরও এক চামচ করে নিলেন। প্রফেসর ও কর্নেল পরস্পরের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে এক চামচ করে ক্যাভিয়ার নিলেন। মহিলারাও আনন্দ করে খেতে লাগলেন। নিল না খালি মিস প্যাটারসন–ক্যাভিয়ারের নোনতা ঋজালো স্বাদ তার ভালো লাগে না।
প্রফেসরের অনেক অনুরোধেও মিস প্যাটারসন যখন ক্যাভিয়ার খেল না, তখন হঠাৎ খানিকটা উত্তেজিত হয়ে প্রফেসর বললেন,–আজ রাতে ক্যাভিয়ার না খাওয়াটা স্রেফ বোকামি।
পরিস্থিতি সামলালেন মা মিসেস প্যাটারসন। উনি মেয়ের প্লেটের ক্যাভিয়ারটুকু ছুরি দিয়ে চেঁছে নিজের প্লেটে তুলে নিলেন। বললেন,–প্রফেসর, এবার তো আপনি খুশি?
প্রফেসর কিন্তু মোটেই খুশি হলেন না। হঠাৎ কোনও বাধার সম্মুখীন হলে মানুষের মনে যে বিরক্তি মেশানো হতাশার অনুভূতি হয়, তাঁর মুখের ভাব অনেকটা সেইরকম।
সবাই জমিয়ে গল্প করতে লাগলেন। এখান থেকে মুক্তির পরে কে কী করবেন–সেই নিয়ে আলোচনা চলতে লাগল। ফাদার পিয়ের চিনের অন্য শহরে যাবেন আর একটা মিশন গড়তে। মিঃ প্যাটারসন মাস তিনেকের জন্য ফিরবেন স্কটল্যান্ডে-মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে।
নার্স মিস সিনক্লেয়ার বললেন,–এই ধকলের পর সকলেরই একটু বিশ্রাম দরকার। দেখুন না, আমার শরীরটা কীরকম করছে কানের মধ্যে যেন অসংখ্য ঝিঁঝি পোকা ডাকছে।
এইন্সলি বলল, আরে! আমারও তো তাই হচ্ছে। যেন বড় একটা নীল মাছি কানের মধ্যে ঢুকে দাপাদাপি করছে। যাই হোক, এখান থেকে আমি পিকিং-এ চলে যাব ভাবছি। র্যালস্টন, তোমার কী প্ল্যান?
–আমি তো মৃত্যু নিশ্চিত জেনে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের চিঠি লিখে ফেলেছিলাম। শুধু চিঠিগুলো ডাকে দেওয়া হয়নি। ওগুলোকে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নিজের কাছে রাখব-মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে আসার স্মৃতি। আর ভাবছি। কোনও রৌদ্রোজুল জায়গায় গিয়ে কিছুদিন ছুটি কাটাব।
এইন্সলি বলল, কী হল কর্নেল? আপনাকে কেমন যেন স্রিয়মাণ লাগছে!
–না, না, আমি ঠিক আছি।
–আসুন, আমরা সকলে কর্নেলের স্বাস্থ্য কামনা করি। ওঁর জন্যেই আমরা আজ এই পরীক্ষায় সফল হয়েছি।
সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াইনের গ্লাস উঁচু করে কর্নেলকে ধন্যবাদ জানালেন।
কর্নেল বললেন, আমি যথাসাধ্য করেছি। আজকে যদি আমরা নিজেদের বাঁচাতে ব্যর্থ হতাম, তা হলেও আপনারা আমাকে দোষ দিতে পারতেন না।
মিঃ প্যাটারসন বললেন,-কর্নেল, আমাদের সকলের পক্ষ থেকেও কী! র্যালস্টনের কী হল?
হাতদুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন ব্যালস্টন।