কর্নেল ড্রেসলারও বললেন,–ঠিকই তো! এই আনন্দের সময় ক্যাভিয়ারই উপযুক্ত খাবার।।
মহিলারাও সকলে ক্যাভিয়ার খেতে চাইলেন।
ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রফেসর মার্সারের জন্য কিছু জিনিস এসেছিল। তার মধ্যে ছিল এক জার ক্যাভিয়ার আর তিন বোতল দামি ওয়াইন। সবাই ঠিক করেছিলেন যে বিপদ কেটে গেলে এগুলি সদ্ব্যবহার করা হবে। বাইরের গুলির আওয়াজ এখন সঙ্গীতের মতো মধুর লাগছিল–কেন না গুলি চালাচ্ছিল উদ্ধারকারীরা। সুতরাং বাসি রুটির সঙ্গে সেই মহার্ঘ ক্যাভিয়ার খাওয়ার এই তো উপযুক্ত সময়।
কিন্তু প্রফেসর মাথা নাড়লেন, মুখে রহস্যময় হাসি। বললেন,–ওটা পরে খাওয়া যাবে। উদ্ধারকারী দলের এখানে পৌঁছতে আরও অনেক সময় লাগবে।
তখন রেলওয়ে কর্মচারী, ছোটখাটো চেহারা র্যালস্টন বললেন,–ওরা এখন মাত্র দশ মাইল দূরে আছে। ডিনারের আগেই এখানে এসে পড়বে।
এইসব আলোচনার মধ্যে এইন্সলি বলে উঠল, বিদ্রোহীদের তো আগ্নেয়াস্ত্র বলতে কিছু নেই। আমাদের সৈন্যরা ওদের উড়িয়ে দিয়ে এক্ষুনি চলে আসবে। সুতরাং, প্রফেসর, ক্যাভিয়ারটা বের করুন না!
কিন্তু প্রফেসর তার সিদ্ধান্তে অনড়। বললেন, না। অন্তত ডিনার পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক।
মিঃ প্যাটারসনও বললেন, উদ্ধারকারীদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে তাদের ভালোভাবে আপ্যায়ন করা উচিত। ডিনারের সময় তাদের সঙ্গে সবাই মিলে ক্যাভিয়ারটা খাওয়া যাবে।
এই সিদ্ধান্ত সবাইয়েরই মনঃপূত হল। কেউ আর তারপর ক্যাভিয়ারের কথা তুললেন না।
প্যাটারসন বললেন,–আচ্ছা প্রফেসার, আপনি তো আগেও এইরকমভাবে একবার আটকে পড়েছিলেন। বলুন না সেই অভিজ্ঞতার কথা!
গম্ভীরভাবে প্রফেসর বললেন,–সেটা আঠারোশো উননব্বই সালের কথা। তখন আমি দক্ষিণ চিনের সুং-টোং এ ছিলাম।
ফাদার পিয়ের জিগ্যেস করলেন, কীভাবে আপনারা মুক্ত হয়েছিলেন?
প্রফেসরের ক্লান্ত মুখের ওপর যেন কালো ছায়া পড়ল, আমরা মুক্তি পাইনি।
–তার মানে বিদ্রোহীরা জায়গাটা দখল করে নেয়?
–হ্যাঁ।
–আর আপনি বেঁচে রইলেন?
–কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করা ছাড়াও পেশায় আমি ডাক্তার। অনেকেই আহত হয়েছিল তাদের চিকিৎসা করার জন্য ওরা আমায় প্রাণে মারেনি।
–আর সকলের কী হল? প্রফেসর উত্তর দিলেন না, কিন্তু তার নিষ্প্রভ চোখের ওপর বিভীষিকার ছায়া দেখে মহিলারাও অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলেন।
ফাদার পিয়ের বললেন,-থাক! থাক! কিছু বলতে হবে না। আমাদের ওই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার ব্যাপারে জানতে চাওয়া ঠিক হয়নি।
প্রফেসর ধীরে-ধীরে বললেন,–এসব কথা না জানাই ভালো।…ওই শুনুন, খুব কাছেই মনে হয় বন্দুক চালানো হচ্ছে।
সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে চলে গেলেন ব্যাপারটা কী হচ্ছে দেখতে। ভৃত্যেরা এসে খাওয়ার টেবিল পরিষ্কার করে দিল। কিন্তু বৃদ্ধ প্রফেসর টেবিলের কাছেই বসে রইলেন–সাদা চুলে ঢাকা মাথাটা দু-হাতে ধরে। অতীতের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞাতর স্মৃতি তাকে বোধহয় গ্রাস করেছে। বাইরে বন্দুকের আওয়াজ থেমে গেলেও তিনি তা বুঝতে পারলেন না।
সেই সময় মুখে নিশ্চিন্ত হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন কর্নেল ড্রেসলার। দু-হাত ঘষতে-ঘষতে বললেন, জার্মানির কাইজার নিশ্চয়ই খুশি হবেন। অবশ্যই আমি একটা বীরচক্র পাব। বার্লিনের কাগজে লেখা হবে-কর্নেল ড্রেসলারের নেতৃত্বে অল্প কয়েকজনের একটা ছোট্ট দল কীভাবে এই ভয়ঙ্কর বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করেছে।
প্রফেসর নিরাসক্তভাবে বললেন, আমার দীর্ঘ জীবনে আমি ভাগ্যের এত অদ্ভুত খেলা দেখেছি যে, প্রকৃত পরিস্থিতি না জেনে আমি খুশিও হই না, দুঃখিতও হই না। কিন্তু আপনি বলুন ব্যাপারটা কী।
পাইপ ধরিয়ে বেতের চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে কর্নেল বললেন,–উদ্ধারকারীরা এসে পড়ল বলে। গুলির আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না। তার মানে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ শেষ। এইন্সলিকে বলে রেখেছি, উদ্ধারকারীদের দেখতে পেলেই ও তিনবার গুলি ছুড়বে; তখন আমরা বেরিয়ে আসব।
একটু পরে কর্নেল বললেন,–আচ্ছা প্রফেসর এখন তো এখানে মহিলারা বা অন্য কেউ নেই। সুং-টাং-এর ঘটনাটা বলুন না আমাকে।
–সে অভিজ্ঞতা বিভীষিকায় ভরা।
–না, আমি অন্য কারণে জানতে চাইছি। এই যে এখানে আমরা শত্রুদের কোনওরকমে আটকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছি, সুং-টোং-এ কি এরকম কিছু করা যেত না?
–সবকিছুই করা হয়েছিল। খালি ভুল হয়েছিল একটা ব্যাপারে। বিদ্রোহীদের হাতে মহিলাদের পড়ে যাওয়া। আগে বুঝতে পারলে ওদের হাতে ধরা পড়ার আগে আমি নিজেই মহিলাদের হত্যা করতাম। জানেন, ওই ঘটনার পরে আমি আজ পর্যন্ত কোনও রাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারিনি। আমাকে ওরা একটা পোল-এ বেঁধে রেখে আমার চোখের আশেপাশে এমনভাবে কাটা বিঁধিয়ে দিয়েছিল যে আমি যেন চোখ বন্ধ না করতে পারি। মহিলাদের ওপর সেই অমানুষিক অত্যাচার নিরুপায়ভাবে দেখতে-দেখতে আমি ভাবছিলাম যে মাত্র কয়েকটা ট্যাবলেটের সাহায্যে সম্পূর্ণ বেদনাহীন মৃত্যু উপহার দিয়ে ওই মহিলাদের সেই অত্যাচার থেকে বাঁচাতে পারিনি কেন। এই পাপের জন্য ভগবানের কাছে জবাবদিহি করতে আমি প্রস্তুত। এইরকম ঘটনা আবার হলে যদি মহিলাদের হত্যা না করে বিদ্রোহীদের হাতে ছেড়ে দিই, তা হলে নরকেও আমার স্থান হবে না।