ক্যাপ্টেন বাউমগার্টেনের মুখ বিবর্ণ, কিন্তু তবুও তিনি শক্ত থাকার চেষ্টা করছিলেন। হাত দুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে নির্ভকিভাবে কাউন্টের দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন।
–আপনি এখন মৃত্যুর মুখোমুখি। আপনার ঠোঁট দেখেই বুঝতে পারছি যে আপনি প্রার্থনা করছেন। আমার ছেলেও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছিল। সেইসময় হঠাৎ এক পদস্থ জার্মান অফিসার এসে পড়েন। তিনি শুনতে পান যে আমার ছেলে ওর মায়ের জন্য প্রার্থনা করছে। অফিসার নিজেও সন্তানের পিতা। তিনি আর সবাইকে বাইরে যেতে বলে দুই বন্দির কাছে গেলেন। আমার ছেলে ওঁকে সবকিছু খুলে বলল। এও জানাল যে, সে তার বৃদ্ধ পিতামাতার একমাত্র সন্তান ও তার মা অসুস্থ।
স্নেহপ্রবণ মহান সেই জার্মান অফিসার তখনই ওর গলা থেকে ফাঁসির দড়িটা খুলে দিলেন–যেমন আপনার দড়িটাও আমি খুলে দিলাম। তারপর উনি আমার ছেলের দুই গালে পরম স্নেহভরে চুম্বন করলেন–আমিও, ক্যাপ্টেন, তোমাকে সেইভাবে চুম্বন করলাম। শেষে উনি আমার ছেলেকে চলে যেতে বললেন–যেমন আমিও তোমাকে এখন চলে যেতে বলছি। আমার ছেলে ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। কিন্তু ক্যাপ্টেন, সেই মহান জার্মান অফিসারের সমস্ত
আশীর্বাদ যেন তোমায় রক্ষা করে।
তারপরেই ক্যাপ্টেন বাউমগার্টেন আহত, রক্তাক্ত অবস্থায়, ক্ষতচিহ্ন আঁকা মুখ নিয়ে টলতে টলতে কালো প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এলেন–ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টিতে ভরা সেই দুরন্ত শীতের ভোরে।
The Lord of Chateau Noir গল্পের অনুবাদ
ক্যাভিয়ারের জার
উত্তর চিনে বক্সার বিদ্রোহ তখন শুকনো তৃণভূমিতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ইউরোপীয়রা ছোট-ছোট দলে তাদের বাসস্থানের কাছাকাছি কোনও শক্ত ঘাঁটিতে আশ্রয় নিচ্ছেন। উদ্দেশ্য, সীমিত সামর্থ্য দিয়ে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করে কোনওরকমে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা, যতক্ষণ না উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছোয়। বক্সার বিদ্রোহীদের অমানুষিক নিষ্ঠুরতার কাহিনি এতই প্রচলিত যে, তাদের হাতে জীবন্ত ধরা পড়লে ভয়ংকর পরিণতি অনিবার্য,–একথা সবাই জানে।
কয়েকজন ইউরোপীয়ের একটি ছোট দল উত্তর চিনে ইচাও বলে একটি জায়গায় একটা ঘাঁটিতে চারদিন হল আশ্রয় নিয়েছেন। খাদ্য, অস্ত্রশস্ত্র সবই প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। পঞ্চাশ মাইল দূরে সমুদ্রতট। সেখানে ইউরোপীয় সেনাদের একটা ছোট ঘাঁটি আছে। সেই সৈন্যদল এসে উদ্ধার করবে এই আশায় অবরুদ্ধ ইউরোপীয় কজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত।
অবরুদ্ধদের দলে আছেন কয়েকজন ইউরোপিয়ান, একজন আমেরিকান ও কয়েকজন রেলকর্মী যাঁরা দেশি খ্রিস্টান। এই ছোট দলের নেতা একজন জার্মান কর্নেল ড্রেসলার।
বিদ্রোহীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ঘাঁটির ভাঙা দেওয়ালের গায়ের ছোট-ঘোট ফোকরের মধ্য দিয়ে মাঝে মাঝেই গুলি চালাচ্ছে এই দলটি। এতক্ষণে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে। এঁদের কাছে যে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ আছে। তাতে হামলাকারীদের আর একদিনের বেশি ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। সুতরাং একদিনের মধ্যেই উদ্ধারকারীরা এসে পৌঁছবে, এই আশায় বেঁচে থাকা ছাড়া এঁদের আর কোনও উপায় ছিল না। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সকলেই মোটামুটি নিশ্চিত যে উদ্ধারের একটা ব্যবস্থা হবেই।
কিন্তু বুধবার সকাল থেকে তাদের আশায় ও বিশ্বাসে একটু চিড় ধরল। পাহাড় থেকে নীচে সমুদ্র অবধি ঢালু জমিতে কোনও ইউরোপীয় সেনার চিহ্ন নেই। অন্যদিকে বিদ্রোহীরা বিরামহীন চিৎকার করতে করতে ক্রমাগত এগিয়ে আসছে। তাদের মুখভঙ্গি ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর। ফরেন সার্ভিসের এক কর্মচারী এইন্সলি, তার শিকারের বন্দুক থেকে মাঝে মাঝেই বিদ্রোহীদের দিকে গুলি ছুড়ছে। যে-কোনও সময়ে বিদ্রোহীদের কেউ একজন নিঃশব্দে তরোয়াল হাতে ভাঙা দেওয়াল টপকে ঘাঁটিতে ঢুকে পড়তে পারে।
বুধবার সন্ধেবেলায় এই পরিস্থিতিতে দলের সকলেই একটু হতাশ হয়ে পড়লেন।
অবরুদ্ধ এই কটি মানুষের মতো কর্নেল ড্রেসলারের মুখে অবশ্য উদ্বেগের ছাপ নেই, কিন্তু তার মনে পাষাণের বোঝ। রেলওয়ের অফিসার র্যালস্টন আত্মীয়স্বজনকে বিদায়ী চিঠি লিখেছেন। কীট-পতঙ্গের বিষয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানী বৃদ্ধ প্রফেসর মার্সার নীরব ও চিন্তামগ্ন। যুবক এইন্সলি-ও তার সহজাত চপলতা হারিয়ে ফেলেছে। মহিলারাই কেবল শান্ত ও স্থির। তাদের মধ্যে আছেন স্কটিশ মিশনের নার্স মিস সিনক্লেয়ার, মিসেস প্যাটারসন ও তার মেয়ে জেসি। ফরাসি মিশনের ফাদার পিয়ের-ও শান্ত। আর আছেন স্কটিশ মিশনের মিঃ প্যাটারসন–খ্রিস্টধর্মের নীতিগত ব্যাপারে ফাদার পিয়ের-এর সঙ্গে যার সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। দুজনেই করিডোরে পায়চারি করছেন।
বুধবার রাতটা শেষ পর্যন্ত বিনা সমস্যায় কেটে গেল। বৃহস্পতিবারের সকালটা ছিল উজ্জ্বল ও মনোরম। দূরে একটা বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল। তার পরেই দূর থেকে কে যেন জোরে চেঁচিয়ে বলল–সবাই আনন্দে থাকো, সাহায্য আসতে আর দেরি নেই। মনে হল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সমুদ্রতটের সেই উদ্ধারকারী সেনাদল এসে পৌঁছবে। এদিকে কার্তুজ প্রায় শেষ। আধপেটা খাবারের বরাদ্দ আরও কম হওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু এখন আর উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। মেঘের ফাঁকে জীবনের এক ঝলক বিদ্যুৎ দেখা যাচ্ছে। সকলেই উৎফুল্ল আর প্রগলভ হয়ে উঠেছেন। সবাই জড় হলেন খাবার টেবিলে। এইন্সলি চেঁচিয়ে উঠল,–প্রফেসর, আপনার ক্যাভিয়ারের জারটা কোথায়? ওটা খুলুন, সবাই মিলে সেলিব্রেট করা যাক।