- বইয়ের নামঃ নতুন দশ রহস্য
- লেখকের নামঃ আর্থার কোনান ডয়েল
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, গল্পের বই
নতুন দশ রহস্য
অন্তর্ধান
লিভারপুল শহর থেকে মাইল দশেক দূরে বিশপস্ ক্রসিং নামে একটা ছোট গ্রামে এক ডাক্তার থাকতেন। তাঁর নাম ডাঃ অ্যালোইসিয়াস লানা। তিনি কেনই বা এই অখ্যাত গ্রামে এলেন বা তার পূর্বপরিচয় কী–এ ব্যাপারে কেউ বিশেষ কিছু জানত না। কেবল এটা সবাই জানত যে তিনি গ্লাসগো শহর থেকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে ডাক্তারি পাশ করেছিলেন। এও বোঝা যেত যে তিনি বিদেশি–সম্ভবত স্পেনের লোক। গায়ের রং প্রায় ভারতীয়দের মতো–ফ্যাকাশে ফরসা নয়। মাথার চুল কালো কুচকুচে। ঘন কালো ভ্র জোড়ার নীচে ঝকঝকে চোখে বুদ্ধির ছাপ। ব্যবহার ও চলাফেরায় যথেষ্ট আভিজাত্য। লোকে তাকে কালো ডাক্তার বলে উল্লেখ করত–প্রথমদিকে কৌতুকে, পরে সম্মানের সঙ্গে।
ডাঃ লানা মেডিসিন এবং সার্জারি–দুটোতেই ছিলেন সমান পারদর্শী। এমনকী লিভারপুলের মত বড় শহরের ডাক্তারদের থেকেও তাঁর খ্যাতি বেশি ছিল। লিভারপুলের এক লর্ড-এর ছেলেকে অস্ত্রোপচার করে সারিয়ে ডাঃ লানা বেশ নাম করেছিলেন। আর তার সুন্দর চেহারা ও বিনীত ব্যবহারের জন্যও সবাই তাকে পছন্দ করত। কেউ আর তার বংশপরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাত না।
এত গুণের অধিকারী ডঃ লানার বিরুদ্ধে সবাইয়ের একটাই অভিযোগ ছিল তিনি বিয়ে করছেন না কেন? ভালো পসারের জন্য প্রভূত অর্থের মালিক ডাঃ লানার বাড়িটা ছিল বিশাল। অনেকেই তার বিয়ের সম্বন্ধে এনেছিলেন, কিন্তু ডাক্তার বিয়ের ব্যাপারে কোনও উৎসাহ দেখাননি। যাই হোক, সবাই যখন ধরেই নিয়েছে যে ডাক্তার-পাকাপাকিভাবে অবিবাহিত থাকবেন, তখনই হঠাৎ জানা গেল যে, লি হল নামে একটা বাড়ির মেয়ে মিস ফ্রান্সেস মর্টনের সঙ্গে ডাঃ লানার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
ফ্রান্সেস-এর বাবা-মা দুজনের কেউই বেঁচে নেই। ও থাকে ভাই আর্থারের সঙ্গে। ওদের বিশাল সম্পত্তির দেখাশোনা করে আর্থারই। ফ্রান্সেসের চেহারার আভিজাত্য এবং ওর সংবেদনশীল স্বভাব দেখে ডাঃ লানা একটা পার্টিতে ওর সঙ্গে আলাপ করেন এবং তারপর কিছুদিন মেলামেশার পরে এই বিয়ের প্রস্তাব। ফেব্রুয়ারি মাসে ঠিক হল যে, অগাস্ট মাসে বিয়ে হবে। ডাক্তারের বয়স সাঁইত্রিশ ও ফ্রান্সেসের বয়স মাত্র চব্বিশ হলেও, সব মিলিয়ে ওদের জুড়িটা ভালোই হয়েছে বলে সবার ধারণা।
৩ জুন আর্জেন্টিনার বুয়েনস এয়ার্স থেকে ডাঃ লানার নামে একটা খামে ভরা চিঠি এল। খামের ওপর ঠিকানাটা কোনও পুরুষের হস্তাক্ষর বলেই মনে হল পোস্টমাস্টারের। এই প্রথম ডাঃ লানার নামে বিদেশ থেকে কোনও চিঠি এল।
পরের দিন, অর্থাৎ ৪ জুন ডাঃ লানা ফ্রান্সেসদের বাড়িতে গেলেন এবং মিস ফ্রান্সেসের সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর ডাক্তার বেশ উত্তেজিত অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন। এদিকে মিস ফ্রান্সেসও সারাদিন আর নিজের ঘর থেকে বেরোল না। বাড়ির পরিচারিকা বেশ কয়েকবার ফ্রান্সেসকে চোখের জল ফেলতে দেখেছিল।
এক সপ্তাহের মধ্যেই গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে ডাক্তার ও ফ্রান্সেসের বিয়ে হচ্ছে না। ডাক্তার নাকি ফ্রান্সেস-এর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন এবং ফ্রান্সেস-এর ভাই আর্থার ডাক্তারকে চাবুক দিয়ে মারবে বলে শাসিয়েছে।
ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছিল, তা কেউ বুঝতে পারছিল না। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে ডাক্তার লি হল-এর দিকের রাস্তায় যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, এমনকী চার্চে যাওয়াও। অর্থাৎ, ডাক্তার ফ্রান্সেসকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে লাগলেন। স্থানীয় খবরের কাগজে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন (বিজ্ঞাপনদাতার নাম ছিল না) থেকে অনেকেই অনুমান করলেন যে ডাক্তার তার প্র্যাকটিসটাও বিক্রি করে দিতে চাইছেন।
এরকম যখন পরিস্থিতি, তখন ২১ জুন সোমবার এমন একটা ঘটনা ঘটল যে পুরো ব্যাপারটা আর স্থানীয় গল্পগুজব কিংবা কানাঘুষোর পর্যায়ে রইল না। কী হয়েছিল, বলি।
ডাক্তারের বাড়িতে কাজ করতেন দুই মহিলা–মার্থা ও মেরি। প্রথমজন গৃহস্থালীর তত্ত্বাবধান করতেন, আর মেরি ছিল কাজের মেয়ে। এ ছাড়া ছিল আরও দুজন–একজন কম্পাউন্ডার আর অন্যজন ঘোড়াগাড়ির চালক। দুজনেই থাকত বাড়ির কম্পাউন্ডের আউটহাউসে।
ডাক্তারের অপারেশনের ঘরের পাশেই ছিল তার পড়ার ঘর। অনেক রাত অবধি ডাক্তার সেখানে পড়াশোনা করতেন। অপারেশনের ঘরের একটা দরজা ছিল বাইরের দিকে–এই দরজা দিয়ে কেউ যাওয়া আসা করলে বাড়ির লোকে কেউ কিছু জানতে পারত না। অনেক সময় রাতের দিকে কোনও রোগী এলে তারা বাড়ির প্রধান দরজায় না গিয়ে এই দরজা দিয়েই ডাক্তারের কাছে যেত।
২১ জুন রাত সাড়ে নটার সময় মাখা ডাক্তারের পড়ার ঘরে গিয়ে দেখেন, ডাক্তার পড়াশোনায় ব্যস্ত। মার্থা তখন ডাক্তারকে শুভরাত্রি জানিয়ে মেরিকেও শুয়ে পড়তে বলেন। তারপর মাথা রাত পৌনে এগারোটা পর্যন্ত বাড়ির টুকিটাকি কাজে ব্যস্ত থাকেন। হলঘরের ঘড়িটায় যখন এগারোটা বাজছে, তখন মাথা নিজের ঘরে যান। তার পনেরো-কুড়ি মিনিট পরে বাড়ির মধ্য থেকে একটা তীব্র চিৎকারের আওয়াজ তার কানে আসে। তক্ষুনি ড্রেসিং গাউন পরে মার্থা দৌড়ে যান ডাক্তারের পড়ার ঘরের দিকে। ঘরের দরজায় তিনি টোকা দিলে ভেতর থেকে আওয়াজ আসে–কে?