Site icon BnBoi.Com

নেমেসিস – আগাথা ক্রিস্টি

নেমেসিস - আগাথা ক্রিস্টি

নেমেসিস

১. সেন্ট মেরী মিডে

নেমেসিস (১৯৭১) – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

সেন্ট মেরী মিডে মিস মারপলের বাড়িতে প্রতিদিন সকালে দুটো খবরের কাগজ আসে।

সকালের চায়ে চুমুক দিতে দিতে একটা কাগজে তিনি চোখ বোলান। দ্বিতীয় কাগজটা নিয়ে বসেন বিকেলের দিকে।

পিঠে বাতের জন্য বিশেষ ভাবে বানানো সোজা একটা আরাম কেদারা বারান্দায় রাখা আছে। দুপুরের আহারের পর এখানে বসেই তিনি মিনিট কুড়ি ঘুমিয়ে নেন।

সেদিনও টাইমস পত্রিকা হাতে নিয়ে নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে পাতা ওল্টাচ্ছিলেন।

একে একে জম্ম, বিবাহ আর মৃত্যুর কলম দেখে নিয়ে তিনি চিঠিপত্রগুলো পড়লেন।

পরে আবার মৃত্যুর কলমে চোখ বোলাতে গিয়ে একটা নাম পড়ে একটু থমকে গেলেন।

র‍্যাফায়েল। জ্যাকসন র‍্যাফায়েল। বেলফোর্ড পার্ক, মেইডস্টোন।

নামটা কেমন পরিচিত লাগছে। মিস মারপলের মনে হল কোথাও আগে শুনেছেন নামটা।

আজকাল বয়স হয়েছে। সবকিছু ঠিক সময়ে মনে পড়ে না। অনেক কিছু মনেও করতে পারেন না।

কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু র‍্যাফায়েল নামটা কোন্ সূত্রে পরিচিত মনে হয়েছে কিছুতেই মনে করতে পারলেন না।

অন্যমনস্ক ভাবে জানালা দিয়ে বাগানের দিকে তাকালেন তিনি। তার কাছে বড় আনন্দের ছিল এই বাগান। একসময় এর পেছনে অনেক পরিশ্রম করেছেন।

ডাক্তারদের নির্দেশ মানতে হয় এখন। চেয়ারে বসেই কেবল তাকিয়ে দেখেন।

অন্যমনস্ক ভাবটা কাটতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল-নীল সমুদ্র-ক্যারিবিয়ান সাগর। হা…মনে পড়ে গেছে…মিঃ র‍্যাফায়েল। ভাইপোর কল্যাণে ক্যারিবিয়ানে তিনি ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেন্ট অনরে দ্বীপ।

সেখানেও খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই বয়স্ক মেজর, তার একটা চোখ ছিল কাচের। বিরক্তিকর গল্প শোনাতেন আর সেই সূত্রেই ক্যারিবিয়ানের দিনগুলো অন্যরকম হয়ে উঠেছিল।

বেচারা মেজর…মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তার নামটা মনে করতে পারলেন না মিস মারপল। কিন্তু মিঃ র‍্যাফায়েল, তার সেক্রেটারী মিসেস–মিসেস ওয়াল্টার্স…এসথার ওয়াল্টার্স আর তার অঙ্গসংবাহক সেই ছোকরা…কি নাম যেন..হা জ্যাকসন…সবই মনে পড়ছে।

বেচারা মিঃ র‍্যাফায়েল…হুইল চেয়ারে ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না। তাহলে তিনি মারা গেছেন। অবশ্য তিনি জানতেন যে খুব বেশি দিন তার আয়ু নেই। কথাটা মিঃ র‍্যাফায়েল তাকে জানিয়েও ছিলেন।

অসম্ভব ধনী ছিলেন মিঃ র‍্যাফায়েল। আর একগুঁয়ে। ধনী বলে অবশ্য সকলেই মানিয়ে নিত। অমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষকে সহজে ভোলা যায় না। এক বছরের মধ্যেই তিনি বিদায় নিলেন।

মিস মারপলের মন এবারে ক্যারিবিয়ানের সেই দ্বীপেই ঘুরে ফিরতে লাগল। সেই আর্থার জ্যাকসন…সে কি শেষ পর্যন্ত ছিল মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে?

আর এসথার–এসথার ওয়াল্টার্স…তার কি হল? তার তো কিছু অর্থ পাওয়ার কথা ছিল। এত দিনে তা তার পাওয়া হয়ে গেছে নিশ্চয়।

মিস মারপলের মনে পড়ল, এক আঁধার ঘেরা রাতে ছুটে গিয়েছিলেন মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে। তিনি সেই মুহূর্তে নিয়তি বলে সম্বোধন করেছিলেন তাঁকে।

নিজের মনেই স্বগতোক্তি করলেন তিনি, আশা করি মিঃ রাফায়েল বেশি যন্ত্রণা ভোগ করেননি।

সেদিন বিকেলে চেয়ারে বসে বহুক্ষণ মিঃ র‍্যাফায়েলের কথা ভাবলেন মিস মারগল। ইংল্যাণ্ডে ফিরে তাঁর সঙ্গে দেখা হবে, এমনটি অবশ্য তিনি ভাবেননি। দেখাও হয়নি। অথচ প্রায়ই মনে হতো ভদ্রলোকের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। কোথায় যেন একটা অদৃশ্য যোগসূত্র অনুভব করতেন।

আরো কিছু পরে ধীর পায়ে বাগানে গিয়ে ঢুকলেন মিস মারপল। নিজের মনেই বকবক করছেন। জর্জ আজকাল ঠিকঠিক যত্ন নেয় না ফুলগাছগুলোর। তাকে আবার একটু ধমকে দিতে হবে।

হঠাৎ রেলিঙের বাইরে গলি থেকে কেউ বলে উঠল, আপনার বাগানটা খুব সুন্দর।

বক্তাকে চোখে দেখলেও চিনতে পারলেন না তিনি। মেদবহুল চেহারার এক ভদ্রমহিলা। মজবুত টুইডের স্কার্ট পরা। সবুজ পুলওভার স্কার্ফও আছে।

সেন্ট মেরী মিডের প্রায় সকলকেই চেনেন মিস মারপল। এই মহিলাকে কখনো দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না।

এখন আর তেমন নেই। জবাব দিলেন মিস মারপল, আজকাল নিজে আর দেখাশোনা করতে পারি না।

–আমি নিজেও বাগান ভালবাসি। নিশ্চয় সবজান্তা বয়স্ক কেউ আপনার বাগান দেখাশোনা করে? জানতে চাইলেন বাগানের বাইরে দাঁড়ানো মহিলা।

আপনি এখানেই থাকেন?

–মিস হেস্টিংস নামে একজনের বাড়িতে আছি। মনে হয় তার কাছেই আপনার কথা শুনেছি। আপনিই তো মিস মারপল, তাই না?

-হ্যাঁ।

-আমি বাগান দেখাশোনা করি। আমার নাম বার্টলেট, মিস বার্টলেট। এখানে বিশেষ কিছু করার নেই বলে মাঝে মাঝে কেনা কাটার কাজও করি। আপনার বাগানের কাজে দরকার হলে দু ঘন্টা করে সময় দিতে পারি।

মিস হেস্টিংসকে মনে করতে পারলেন না মিস মারপল। জিব্রাল্টার রোডের নতুন বাড়িগুলোর কেউ হবে হয়তো মনে করলেন।

তিনি আর কথা বাড়ালেন না। আরও খানিকক্ষণ বাগানে ঘুরে বাড়িতে ফিরে এলেন।

টাইমসের খবরটা আবার মনে পড়ল। মিঃ র‍্যাফায়েলকে নিয়েই মন ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

.

০২.

মিঃ র‍্যাফায়েলের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে মিস মারপল একটা চিঠি পেলেন। চিঠিটা এসেছে ব্লুমসবারীর সলিসিটর কোম্পানি মেসার্স ব্রডরিব ও সুস্টারের কাছ থেকে।

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তারা অনুরোধ জানিয়েছে আগামী সপ্তাহের যে কোন দিন মিস মারপল যেন তাদের অফিসে সাক্ষাৎ করেন।

বিষয়টা নাকি তাঁরই অনুকূলে। অবশ্য বিশেষ ভাবে একটা দিনের কথাও তারা উল্লেখ করেছে–আগামী বৃহস্পতিবার, ৪ঠা তারিখে।

এই চিঠির যোগসূত্র উদ্ধার করতে পারলেন না মিস মারপল। কপালে কুঞ্চন রেখা জাগিয়ে অনেকক্ষণ বসে ভাবলেন। সলিসিটরের চিঠি মানেই মামলাটামলা কিছুর ব্যাপার হবে–এরকম অনুমান করলেন। আবার এমনও হতে পারে, মিঃ র‍্যাফায়েল তাকে স্মৃতি হিসেবে কিছু দান করে গেছেন তার উইলে। বই বা এই জাতীয় কিছু। তবে সেসব ডাকে পাঠিয়ে দেওয়াই তো সম্ভব ছিল।

কিন্তু আগামী বৃহস্পতিবার তার পক্ষে লণ্ডনে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখানে মহিলা সমিতির একটা সভায় যোগ দিতে হবে। তিনি পরের সপ্তাহে একটা তারিখ জানিয়ে চিঠি লিখে দিলেন এবং তাদের জবাবে সম্মতিও পেয়ে গেলেন।

জবাবী চিঠিতে সই করেছেন জে. আর. ব্রডরিব। মিস মারপল অনুমান করলেন, সম্ভবত তিনিই কোম্পানির প্রধান অংশীদার।

.

নিজেদের অফিসে বসেছিলেন মিঃ ব্রডরিব আর মিঃ সুস্টার। আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই তারা মিস মারপলকে আশা করছেন। সেরকমই চিঠিতে জানিয়েছিলেন তিনি।

ভদ্রমহিলা কেমন হবেন, মিঃ র‍্যাফায়েলের সঙ্গে তিনি কোন্ সূত্রে পরিচিত এসব কোন কথাই তারা মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছ থেকে শোনেন নি।

নির্দিষ্ট সময়েই মধ্যবয়স্ক কৃশ চেহারার মিঃ ব্রডরিব অভ্যর্থনা জানালেন মিস মারপলকে।

-ইনি আমার অংশীদার মিঃ সুস্টার।

মেদবহুল চেহারার তরুণ ভদ্রলোকের সঙ্গে ব্রডরিব পরিচয় করিয়ে দিলেন।

মিঃ সুস্টার একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে আসন গ্রহণ করলেন মিস মারপল।

সৌজন্যমূলক প্রাথমিক কিছু কথাবার্তার পর মিঃ ব্রডরিব আসল প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন।

–মিঃ র‍্যাফায়েলের মৃত্যুসংবাদ সম্ভবত কাগজে দেখেছেন আপনি?

–হ্যাঁ, কাগজেই দেখেছি।

–আমাদের ধারণা তিনি আপনার বন্ধু।

–ওয়েস্ট ইণ্ডিজে প্রথম দেখা হয়েছিল, প্রায় বছরখানেক আগে।

নিশ্চয় ভালভাবেই চিনতেন তাঁকে।

–সেভাবে বলা যাবে না। দুজনে একই হোটেলে উঠেছিলাম। মাঝে মাঝে কথা হতো। আমি থাকি গ্রামের দিকে। কাজেই ইংলণ্ডে ফিরে এসে দেখাসাক্ষাতের প্রশ্ন ছিল না। তিনি খুবই অসাধারণ মানুষ ছিলেন।

-আপনার সম্পর্কে তার খুব উচ্চ ধারণা ছিল, বললেন ব্রডরিব, তার উইলে আপনার জন্য কিছু টাকা রাখা আছে। একবছর পরে তার মালিকানা আপনার হবে। অবশ্য তা হবে তার একটা প্রস্তাবে আপনার সম্মতি-অসম্মতি শর্তসাপেক্ষে।

কথা শেষ করে মিঃ ব্রডরিব টেবিলের ওপর থেকে শীলমোহর আঁটা একটা দীর্ঘ খাম মিস মারপলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

–এটা পড়লেই আপনি সব জানতে পারবেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, আপনি মনস্থির করার জন্য সময় নিতে পারেন।

সযত্নে খামটা খুলে টাইপ করা কাগজটা বার করলেন তিনি।

–এটা আপনার হাতে তুলে দিয়ে প্রাপ্য অর্থের কথা জানিয়ে দেওয়ার নির্দেশ আমাকে দেওয়া আছে। অর্থের পরিমাণ হল বিশ হাজার পাউণ্ড ।

-বিশ হাজার পাউণ্ড। এত টাকা।

প্রবল বিস্ময়ে প্রায় চোখ কপালে উঠল মিস.মারপলের।

এবারে তিনি কাগজের লেখায় চোখ বোলালেন। তারপর মিঃ ব্রডরিবকে লক্ষ্য করে বললেন, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। শর্তের কথাটা আপনার নিশ্চয় জানা আছে?

-হ্যাঁ, মিঃ র‍্যাফায়েল আমাকে বলেছিলেন।

–এর ব্যাখ্যা কিছু ।

–আমি তাকে জানিয়েছিলাম, তিনি ঠিক কি বলতে চাইছেন তা বুঝে ওঠা আপনার পক্ষে হয়তো কঠিন হবে। কিন্তু তিনি কোন ব্যাখ্যা করেননি।

–আমাকে এ নিয়ে একটু ভাবতে হবে। বললেন মিস মারপল। আমার বয়স হয়েছে, এক বছর পরে টাকাটা নেবার জন্য আমি বেঁচে না-ও থাকতে পারি। বুঝতে পারছি না এ ধরনের তদন্তের ব্যাপারে আরও যোগ্য লোকের কথা না ভেবে আমার মত একজন মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধার কথা তিনি কেন ভাবলেন?

–তিনি আপনাকেই মনোনীত করে গেছেন। যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কোন অপরাধ বা অপরাধের তদন্তের ব্যাপারে আপনি কি কখনো জড়িয়ে পড়েছিলেন?

–সত্যি কথা বলতে গেলে সেটা পেশাদারী কোন ব্যাপার নয়। কোন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কোন কালেই আমি যুক্ত ছিলাম না।

ওয়েস্ট ইণ্ডিজে থাকবার সময় ওখানে ঘটে যাওয়া একটা ব্যাপারের সঙ্গে মিঃ র‍্যাফায়েল ও আমার যোগাযোগ ঘটে গিয়েছিল।

–আপনারা দুজনে সেটার সমাধান করেছিলেন?

-ঠিক সেরকম বলা চলেনা। কয়েকটা যোগসূত্র আমার নজরে এসেছিল, মিঃ র‍্যাফায়েলের ব্যক্তিত্বের সহায়তায় আমি একটা খুনের ব্যাপার রুখে দিতে পেরেছিলাম। বয়স ও শরীরের কারণে কাজটা আমার একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। মিঃ র‍্যাফায়েলও ছিলেন পঙ্গু মানুষ। তার একার পক্ষেও সম্ভব ছিল না। বন্ধুর মত আমরা একসঙ্গে কাজটা করেছিলাম।

বক্তব্য শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন মিস মারপল। বললেন, এসম্পর্কে আর কোন নির্দেশ পেলে আমাকে জানাবার অনুরোধ করছি কেন না আমাকে ঠিক কি করবার কথা বলে গেছেন তা এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয়।

অবশ্যই। আচ্ছা, মিঃ র‍্যাফায়েলের পরিবারের কারো সঙ্গে কি আপনি পরিচিত?

–না, তেমন সুযোগ ছিল না। আকস্মিকভাবেই বিদেশে আমরা একটা রহস্যময় ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম।

মিসেস এসথার ওয়াল্টার্স নামে তার একজন সেক্রেটারী ছিলেন, আমার জানা ছিল, মিঃ র‍্যাফায়েল তার দলিলে তাকে পঞ্চাশ হাজার পাউণ্ড দিয়ে গেছেন।

-হ্যাঁ, তা তিনি পেয়েছেন। তবে মিসেস ওয়াল্টার্স আবার বিয়ে করেছেন। তিনি এখন মিসেস অ্যাণ্ডারসন।

-শুনে খুব খুশি হলাম। বেচারী এক মেয়ে নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন। চমৎকার মহিলা। নিজের বাড়িতে ফিরে এসে সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর নিজস্ব চেয়ারে বসে চিঠিটা খুলে নিয়ে বসলেন।

মিস জেন, মারপল,
সেন্ট মেরী মিড,
আমার মৃত্যুর পর আমার সলিসিটর মিঃ জেমস ব্রডরিবের কাছ থেকে এই চিঠি আপনি পাবেন। তিনি বিশ্বস্ত আইনজ্ঞ। আমার অফিস এবং ব্যক্তিগত আইন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্ব তার হাতে।

তবে বিশেষ কারণে অনেক ব্যাপারেই মিঃ ব্রডরিবের অনুসন্ধিৎসা মেটাইনি। কোন কোন ব্যাপারে বোঝাঁপড়া কেবল আমার আর আপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। নিয়তি, আমাদের মধ্যের কাজ হবে সাঙ্কেতিক।

কি অবস্থায় সম্বোধনটা আমি প্রয়োগ করেছিলাম, নিশ্চয় আপনার মনে পড়ছে।

যে মানুষ অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানে সমৃদ্ধ, কাজের প্রতি স্বাভাবিক প্রবণতা যার রয়েছে, দীর্ঘ কর্মময় জীবনে আমি তেমন লোককে দিয়েই কাজ করতে চেয়েছি।

হ্যাঁ, সব যোগ্যতাই আপনার মধ্যে রয়েছে। আর আছে, ন্যায়ের প্রতি স্বভাবজাত আকর্ষণ। সেকারণে আপনাকে দিয়ে আমি একটা বিশেষ অপরাধের তদন্ত করাতে চাই।

আমি জানিয়ে রেখেছি, যদি আপনি আমার এই অনুরোধ অনুমোদন করেন আর আপনার তদন্তের ফলে ওই বিশেষ অপরাধের মীমাংসা হয়, তাহলে আপনার জন্য নির্দিষ্ট কিছু টাকা সম্পূর্ণভাবেই আপনার হবে।

আমার এই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ করার জন্য একবছর সময় নির্দিষ্ট রেখেছি। অবশ্যই স্বীকার করব যে আপনার বয়সের কথাটা আমি বিস্মৃত হইনি।

যতদূর দেখেছি, আমার ধারণা, তরুণী না হলেও আপনি যথেষ্ট শক্ত ধাতের। আমার বিশ্বাস, ভাগ্য আপনাকে এক বছর অন্তত বাঁচিয়ে রাখবে।

অপরাধ তদন্তের ব্যাপারে আপনার স্বাভাবিক প্রবণতা ও দক্ষতা রয়েছে। কাজ করবার সময় প্রয়োজনীয় অর্থ আপনাকে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থাও করা রয়েছে। আশা করি আমার প্রস্তাব আপনার রুচিবিরুদ্ধ মনে হবে না।

চোখ বুজলে আপনাকে এখনো সেই উলবোনা অবস্থায় অবিকল দেখতে পাই। বিশেষ করে সেই দিনের কথা আমি ভুলতে পারি না, যেদিন আপনার তাড়ায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল, আপনার মাথার দিকে গোলাপী রঙের একরাশ পশম জড়ানো ছিল। পশম বোনাটা আপনার প্রাত্যহিক জীবনে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে আমি জানি। যদি এই বোনার কাজ চালিয়ে যেতে চান, স্বচ্ছন্দে তা করতে পারেন।

আর যদি ন্যায় ও সত্যের জন্য কাজ করতে উৎসুক হন তাহলে আমার প্রস্তাবিত কাজে নিশ্চয় উৎসাহ পাবেন। —

আপনার প্রিয় বন্ধু
জে. বি. র‍্যাফায়েল

.

০৩.

পর পর তিনবার বেশ উচ্চস্বরে চিঠিটা পড়লেন মিস মারপল। কাজের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট কোন সূত্র বা তথ্য কোথাও পেলেন না। তার মনে হল, মিঃ ব্রডরিবের কাছ থেকে এর পর কিছু খবর আসা উচিত। অবশ্য যদি না মিঃ র‍্যাফায়েল ইচ্ছে করে ব্যাপারটাকে গোলমেলে করে রাখেন এটাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

সবকিছুতে মজা উপভোগ করতেই চাইতেন তিনি। একারণেই মিঃ ব্রডরিবের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসাও তিনি মেটাননি।

মিঃ র‍্যাফায়েল কোন সূত্রের উল্লেখ না করলেও, মিস মারপল ভাবলেন, তাকে সূত্র আবিষ্কার করতেই হবে। তাকে জানতে হবে কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, বা কোন সমস্যার সমাধান করতে হবে।

কাজের খরচের ব্যবস্থা যখন রাখা হয়েছে, অনুমান করা যায়, মিঃ র‍্যাফায়েল চেয়েছেন, ওয়েস্ট ইণ্ডিজ বা দক্ষিণ আমেরিকা বা অন্য কোথাও তিনি যাবেন।

মিস মারপল নিজের মনেই বলে উঠলেন, মিঃ র‍্যাফায়েল, আমি চিরন্তন জীবনে বিশ্বাসী। আমি বিশ্বাস করি, কোথাও আপনি নিশ্চয় রয়েছেন, আমি জানতে না পারলেও নিশ্চয়ই আপনি আছেন–আমি আপনার ইচ্ছাপূরণের চেষ্টা যথাসাধ্য করব।

তিনদিন পরে মিঃ ব্রডরিব মিস মারপলের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলেন। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল–

প্রিয় মিঃ ব্রডরিব,
মিঃ র‍্যাফায়েলের যে প্রস্তাব আপনি আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, সেসম্পর্কে জানাচ্ছি, তার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করছি। জানি না কতটা সফল হব, তার ইচ্ছাপূরণের চেষ্টা যথাসাধ্য করব। যদিও জানি না, সফলতা কিভাবে আসবে। কোন সূত্র বা তথ্যই তিনি রেখে যাননি। আপনার কাছেও রেখে গেছেন বলে মনে হয় না। বাস্তবিকই যদি তেমন কিছু থেকে থাকে। আমাকে পাঠাতে অনুরোধ করছি।

একটা বিষয়ে আমার কৌতূহল নিশ্চয়ই অসঙ্গত মনে হবে না। জীবনের শেষ দিকে ব্যবসায় বা ব্যক্তিগত জীবনে মিঃ র‍্যাফায়েলের কোন অপরাধমূলক ঘটনা কি ঘটেছিল? কোন অন্যায় বিচার বা এই ধরনের কিছু? তার কোন আত্মীয় কি ইদানীংকালে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত বা উৎপীড়িত হয়েছিলেন?

আমার বিশ্বাস, আপনি বুঝতে পারবেন, এই সব কেন আমি জানতে চাইছি।..

চিঠিটা পড়ে খুশি হলেন মিঃ ব্রডরিব। সেটা এগিয়ে দিলেন সুস্টারকে।

–মনে হয় ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছু জানেন ভদ্রমহিলা। বেশ উৎসাহের সঙ্গেই এটা গ্রহণ করেছেন বলে মনে হচ্ছে।

চিঠি পড়া শেষ করে মন্তব্য করলেন সুস্টার। মনে হয় না জানতেন। সবকিছু এমনি জটিল করে তোলাই স্বভাব ছিল ভদ্রলোকের।

–কিন্তু আমাদের তাহলে করণীয় কি হবে?

–অপেক্ষা করব। কিছু একটা ঘটবে নিশ্চিত। বললেন ব্রডরিব।

–আচ্ছা, সীলআঁটা কোন নির্দেশ কি কোথাও আছে?

–তেমন হলে আমার অজানা থাকতো না। আমার সততা এবং আইনজ্ঞ হিসেবে আমার দক্ষতার কথা মিঃ র‍্যাফায়েল সর্বদা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেন। যথেষ্ট আস্থা ছিল তার আমার ওপর। বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সীলআঁটা নির্দেশ খুলে দেখতে আমার বাধা নেই। কিন্তু সে অবস্থা এখনো আসেনি।

.

ট্রে থেকে কফির কাপ তুলে নিতে নিতে মিস মারপল জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস হেস্টিংস নামে একজন এখানে কোন বাড়িতে থাকেন জানো? মিস বার্টলেট নামে একজন বোধহয় তার সঙ্গে থাকে।

–হ্যাঁ, গ্রামের শেষে নতুন যে বাড়িতে রঙ হলো, ওখানেই নতুন এসেছেন দুই মহিলা। ওদের নাম জানি না। কেন কি হয়েছে? বলল চেরি।

–ওরা কি আত্মীয়?

-না মনে হয়। বন্ধু হবেন

–ওহ আচ্ছা। একটা চিঠি লিখব। আমার ডেস্কটা পরিষ্কার করে দাও।

–কাকে লিখবেন? কি ব্যাপার?

–এক পাদ্রীর বোন মিস ক্যানন প্রেসকটকে।

–অ, তার সঙ্গেই তো ওয়েস্ট ইণ্ডিজে আপনার পরিচয় হয়েছিল তাই না? মনে হয় অ্যালবামে ছবি দেখেছি।

-হ্যাঁ। একটা কাজে হাত দিচ্ছি। বোনের সাহায্য দরকার হতে পারে।

চেরি আর কিছু জানতে চাইল না। সে চলে গেলে মিস মারপল চিঠিটা লিখতে বসলেন। প্রিয় মিস প্রেসকট,

আশা করি আমাকে মনে পড়বে। ওয়েস্ট ইণ্ডিজের অনরোতে আপনাদের দুই ভাইবোনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

বিশেষ প্রয়োজনে আপনাকে চিঠি লিখছি। মিসেস ওয়াল্টার্স অর্থাৎ এসথার ওয়াল্টার্সের ঠিকানাটা আমার দরকার। তিনি মিঃ র‍্যাফায়েলের সেক্রেটারী ছিলেন। ক্যারিবিয়ানেই দেখেছিলেন তাকে।

বাগানের ব্যাপারে উৎসাহী জেনে তিনি কিছু গাছগাছড়ার ঠিকানা আমার কাছে চেয়েছিলেন। তখন সেটা দিতে পারিনি।

শুনেছি এসথার ওয়াল্টার্স আবার বিয়ে করেছেন। আপনি তার বিষয়ে নিশ্চয় খবর রাখেন? তার ঠিকানা জানালে বাধিত হব।

আশা করি বিরক্তির কারণ ঘটালাম না।

প্রীতিসহ
আপনার একান্ত
জেন মারপল

চিঠিটা ডাকে দেবার পর চটজলদি উত্তরও পেয়ে গেলেন মিস মারপল। সুন্দর একটা চিঠির সঙ্গে ঠিকানাটাও জানালেন তিনি।

মিস প্রেসকট জানালেন–

এসথার ওয়াল্টার্স সম্পর্কে বিশেষ কিছু শুনিনি। এক বান্ধবীর কাছে শুনেছিলাম তার নাম এখন মিসেস স্যাণ্ডারসন বা অ্যাণ্ডারসন। তার ঠিকানা এই সঙ্গে পাঠালাম। অ্যাল্টনের কাছে উইনস্লো লজে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

আমরা ইংলণ্ডের দুই প্রান্তের অধিবাসী। উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের দূরত্ব এমনই যে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ ভাগ্যের দাক্ষিণ্য ছাড়া সম্ভব হবার নয়। আশা করি ভবিষ্যতে একদিন অবশ্যই দেখা হবে।

অ্যাল্টন খুব বেশি দূরে নয়। তবে ট্যাক্সিতে গেলে বেশ খরচ পড়বে। মিস মারপল ঠিক করলেন, চিঠি আর লিখবেন না। হয়তো এতদিনে মনেই করতে পারবে না। ওর সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়াই বরং ভালো।

অবশ্য এটা ঠিক যে, ক্যারিবিয়ানে এসথারকে খুন হওয়া থেকে তিনি রক্ষা করেছিলেন। যদিও এসথার তা বিশ্বাস করেনি। এখন তার কাছ থেকে কোন খবর বার করাও নিশ্চয় কষ্টকর হবে। অন্যভাবে সেই চেষ্টা করতে হবে।

.

পরদিন সকালেই ট্যাক্সিকে খবর দিয়ে রাখা হল। সাড়ে এগারটা নাগাদ ট্যাক্সি উপস্থিত হলে মিস মারপল চেরিকে বললেন, একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। তুমি এই নম্বরে ফোন করে দেখ মিসেস অ্যাণ্ডারসন আছেন কিনা। তিনি নিজে যদি ফোন ধরেন বলবে এক মিঃ ব্রডরিব তার সঙ্গে কথা বলতে চান। তোমাকে তার সেক্রেটারী বলে পরিচয় দেবে। আর যদি বাড়িতে না থাকেন, কখন ফিরবেন জেনে নিও।

নির্দেশ মতো ফোন করলো চেরি। জানা গেল, মিসেস অ্যাণ্ডারসন বাড়ি নেই। তবে দুপুরে খাওয়ার সময় ফিরে আসবেন।

মিস মারপল বললেন, ব্যাপারটা তাহলে সহজ হয়ে গেল। যাক..আমি ঘুরে আসি। কথা শেষ করে ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলেন তিনি।

.

০৪.

সুপারবাজার থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়ির দিকে যাবার সময় এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আচমকা ধাক্কা লেগে গেল এসথার অ্যাণ্ডারসনের।

–মাপ করবেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইলেন তিনি। অন্য মহিলা সবিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন।

–মিসেস ওয়াল্টার্স না? কি আশ্চর্য। আমি জেন মারপল। ক্যারিবিয়ানে এক হোটেলে আমাদের দেখা হয়েছিল। বছর দেড়েক হবে

মিস মারপল, তাই তো আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল…আশ্চর্য।

খুব আনন্দ হলো দেখে। এদিকে এক বান্ধবীর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারতে এসেছি। বিকেলে বাড়িতে থাকবেন তো কথা বলে আনন্দ করা যেত।

–খুব ভাল কথা–তিনটের পর চলে আসুন না।

.

এভাবে দেখা হয়ে যাবার নাটকীয় ব্যাপারটাতে এসথারের সন্দেহ করার কিছু ছিল না। এমন আকস্মিক দেখাসাক্ষাৎ তো পরিচিতদের মধ্যে যে কোন সময় হতেই পারে।

কাঁটায় কাঁটায় বিকেল তিনটেয় মিস মারপল উইনস্লো লজে উপস্থিত হলেন।

–পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কী যে ভাল লাগে। আপনার সঙ্গে লণ্ডনে বা হারডেও তো দেখা হতে পারতো। বললেন মিস মারপল।

-তাই তো। এটা তো আপনার এলাকা নয়–এখানে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে আশাই করিনি।

–এখান থেকে সেন্ট মেরী মিড বেশ দূর নয় অবশ্য, মাত্র পঁচিশ মাইল। আপনি এখানে থাকেন আমার ধারণাই ছিল না।

–বিয়ের পর অল্পদিন হল এখানে এসেছি।

–বিয়ে করেছেন কবে? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

–পাঁচ মাস হল। আমার বর্তমান নাম অ্যাণ্ডারসন।

মিসেস অ্যাণ্ডারসন? আপনার স্বামী?

–একজন ইঞ্জিনীয়ার…আমার চেয়ে বয়স একটু কম। বললেন এসথার।

–তাই ভালো। চমৎকার লাগছে আপনাকে। বাড়িটাও চমৎকার।

মিস মারপল চারদিকে তাকিয়ে প্রাচুর্যের ছাপ উপলব্ধি করলেন। ঘরে দামী আসবাব, পরদা। মিস মারপল উপলব্ধি করলেন, মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছ থেকে পাওয়া অর্থই নিশ্চয় এই প্রাচুর্যের কারণ।

এসথার জিজ্ঞেস করল, মিঃ র‍্যাফায়েলের মৃত্যুর খবর নিশ্চয় কাগজে দেখেছেন?

–হ্যাঁ, মাসখানেক আগে দেখেছিলাম। খুবই দুঃখ পাই। অসাধারণ মানুষ ছিলেন।

-সত্যিই এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। যথেষ্ট ভালো মাইনে আমাকে দিতেন। তবু বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ আমাকে দিয়ে যান।

–ওরকম মনুষই ছিলেন তিনি, বললেন মিস মারপল, তাঁর সেই লোকটি…কি যেন নাম…

–মিঃ জ্যাকসনের কথা বলছেন।

–হ্যাঁ, হা,–মিঃ র‍্যাফায়েল তাকেও কিছু দিয়ে গেছেন নাকি?

-না, জ্যাকসনকে কিছু দিয়ে যাননি। তবে গতবছর তাকে কিছু চমৎকার উপহার দিয়েছিলেন।

-জ্যাকসনের সঙ্গে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়?

–দ্বীপ থেকে আসার পর হয়নি। মনে হয় ইংলণ্ডে ফিরে মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে ছিল না। শুনেছিলাম জার্সি বা গুয়ের্নসির এক লর্ডের কাছে কাজ করছেন।

–মিঃ র‍্যাফায়েলের সঙ্গে একবার দেখা হলে খুব খুশি হতাম। একটা সময় আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি অথচ কিছুই জানি না তার সম্বন্ধে। তিনি মস্ত ধনী ছিলেন, সকলের মত কেবল একথাই আমিও জানি। ওর ছেলেমেয়ে স্ত্রী এঁরা…

হাসলেন এসথার অ্যাণ্ডারসন। বললেন, উনি বিপত্নীক ছিলেন। সম্ভবত বিয়ের কিছুকাল পরেই তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়েছিল।

-খুবই দুঃখের কথা। ওঁর ছেলেমেয়ে ছিল?

–হ্যাঁ, দুই মেয়ে এক ছেলে। এক মেয়ে বিবাহিত, এখন আমেরিকায় আছে। অন্যটি অল্প বয়সেই মারা যায়। ছেলের প্রসঙ্গ মিঃ র‍্যাফায়েল কখনো তুলতেন না। মনে হয় বড় রকমের কোন গোলমাল ছিল। শুনেছি সে বছর কয় আগে মারা গেছে।

-ওহ–খুবই দুঃখের কথা। –

-আমার ধারণা ছেলেটি বিদেশে কোথাও চলে গিয়েছিল…সেখানেই মারা যায়।

–ছেলের সম্বন্ধে তিনি কিছুই বলতেন না? আপনি তো বহুদিন তার সেক্রেটারী ছিলেন

–অদ্ভুত মানুষ ছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত কোন কথাই প্রায় বলতেন না। সর্বক্ষণের ধ্যানজ্ঞান ছিল কেবল ব্যবসা আর অর্থ। এডমণ্ডের সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েক মাস পরেই আমি তার কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম।

-আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় অপরাধ বিষয়ে মিঃ র‍্যাফায়েলের কোন আগ্রহ ছিল?

ক্যারিবিয়ানে যা ঘটেছিল, সেজন্য আপনার কথাটা মনে হয়েছে নিশ্চয়ই?

–ঠিক তা নয়, বললেন মিস মারপল, আমার ধারণা হয়েছিল ন্যায়-অন্যায় বিষয় নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন।

–ওসব বিষয়ে তার মাথা ঘামাবার সময় কোথায়। সেই অনরের ঘটনা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না।

-আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি শুধু তার আগ্রহের বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম।

–অর্থকরী বিষয় ছাড়া কোন বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল না।

আরও দু-চার কথার পর মিস মারপল তার ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

–আবার চাকরির কথা ভাবছেন না তো? বললেন তিনি।

–তার প্রয়োজন মিঃ র‍্যাফায়েলই মিটিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি আমাকে যা দিয়ে গেছেন তা আমি উপভোগ করতে চাই।

এরপর বিদায় নিয়ে মিস মারপল রাস্তায় নেমে এলেন। চলতে চলতে সব ব্যাপারটা নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন।

মিঃ র‍্যাফায়েল অদ্ভুত একটা ছকের মধ্যে তাকে গেঁথে ফেলেছেন। তার এই পরিকল্পনা ছকবার সময়ে মনের অবস্থা কেমন ছিল তা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি।

ওয়েস্ট ইণ্ডিজে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথাও তার মনে পড়ল। সেখানকার কেউ অথবা কিছু কি এর সঙ্গে জড়িত? কিংবা এখানেই কি কোন যোগসূত্র আছে। নইলে এসথারের কথাই বা হঠাৎ তার মনে হবে কেন? মিঃ রাফায়েল যে তাকে নিয়ে কোন তামাশা করতে চেয়েছেন, এমন মনে হল না তার।

পাম হোটেলের সঙ্গে কোন যোগসূত্রের সম্ভাবনা যাচাই করার উদ্দেশ্যেই এসথার ওয়াল্টার্সের কথা মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না এখানে।…কাজ শুরু করার মত কোন সূত্রই এখনও পর্যন্ত পাননি তিনি।

বাড়ি ফিরে রাতে বিছানায় আশ্রয় নেবার আগে তিনি স্বগতোক্তি করলেন–মিঃ রাফায়েল, আমার ক্ষমতার মধ্যে যা আছে তাই আমি করবার চেষ্টা করছি। অবশিষ্ট যা করণীয় তা আপনার।

.

০৫.

চারদিন পরে দ্বিতীয় খাম এল মিস মারপলের নামে।

খাম খুলে তিনি চিঠিটা পড়লেন–

প্রিয় মিস মারপল,
আমি নিশ্চিত, এই চিঠি যখন আপনি পড়বেন আমি তখন করবে শায়িত। ভস্মীভূত হলে যে সম্ভাবনা থাকে না অর্থাৎ ছাইয়ের মধ্য থেকে উঠে এসে কাউকে ভয় দেখানো সম্ভব হয় না। কিন্তু সমাধিক্ষেত্র থেকে উঠে এসে ভয় দেখানো খুবই সম্ভব। তা না করতে চাইলেও, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছা আমার হতে পারে।

ইতিমধ্যে আমার সলিসিটরের মাধ্যমে আপনি নিশ্চয় আমার বিশেষ প্রস্তাব পেয়ে থাকবেন। আমার বিশ্বাস, আপনি সেটা গ্রহণ করেছেন। অবশ্য এব্যাপারটা আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরেই সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছি।

আমার সলিসিটরদের যেভাবে নির্দেশ দেওয়া আছে যদি তারা তা যথাযথ সম্পাদন করে তাহলে এই চিঠি আপনার হাতে পৌঁছবার কথা এমাসের ১১ তারিখে। আজ থেকে দুদিন পরে আপনি লণ্ডনের কোন ভ্রমণসংস্থার কাছ থেকে সংবাদ পাবেন। আমার ধারণা ওদের প্রস্তাব আপনার খারাপ লাগবে না। এব্যাপারে আপনি নিশ্চয়ই ভোলা মন রাখবেন। তবে, এটুকুই কেবল আমার বলার যে, নিজের সম্বন্ধে সতর্ক থাকবেন। আপনি বিচক্ষণ, আমি জানি আপনি তা পারবেন।

আপনার শুভ হোক। আর শুভ দেবদূতেরা পাশে থেকে আপনাকে রক্ষা করুন। তা আপনার প্রয়োজন হতে পারে। —
আপনার প্রিয় বন্ধু
জে. বি. র‍্যাফায়েল

এই চিঠি পাবার ঠিক দুদিন পরেই ডাক বিভাগ গ্রেট ব্রিটেনের ফেমাস হাউসেস অ্যাণ্ড গার্ডেনস-এর একটি চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছে দিল।

চিঠিটি এরকম :

প্রিয় মিস মারপল,
প্রয়াত মিঃ র‍্যাফায়েলের কৃত ব্যবস্থা অনুযায়ী আমাদের ৩৭ নং ভ্রমণ সূচীর বিবরণ আপনাকে পাঠালাম। আগামী বৃহস্পতিবার ১৭ই তারিখে লণ্ডন থেকে এই ভ্রমণযাত্রা শুরু হবে।

আপনার পক্ষে যদি আমাদের লণ্ডন অফিসে আসা সম্ভব হয়, এই ভ্রমণের সহযোগী মিসেস স্যাণ্ডবার্ন সকল বিবরণ জানাতে পেরে সুখী হবেন।

আমাদের ভ্রমণের সময়কাল দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যে স্থায়ী হয়। মিঃ র‍্যাফায়েলের মতে এই বিশেষ ভ্রমণ আপনার কাছে খুবই গ্রহণীয় হবে। কেননা ইংলণ্ডের যে এলাকা দেখানো হবে সম্ভবতঃ তা আপনার অদেখা। চমৎকার দৃশ্য ও বাগান দেখবার সুযোগ রয়েছে। তিনি আমাদের পক্ষে আনুষঙ্গিক সর্বোত্তম ব্যবস্থারই বন্দোবস্ত করে গেছেন।

আমাদের বার্কলে স্ট্রিটের অফিসে কবে আপনার পক্ষে আসা সম্ভব জানালে বাধিত হব।

চিঠিটা সযত্নে ভাঁজ করে রেখে মিস মারপল সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর দুই বান্ধবীকে ফোন করলেন। তিনি জানতেন তারা আগে ফেমাস হাউসেস অ্যাণ্ড গার্ডেনসের সঙ্গে ভ্রমণে গেছিলেন।

বন্ধুদের দুজনেই জানিয়ে দিলেন এই ভ্রমণসংস্থার ব্যবস্থাদি খুবই ভাল তবে যথেষ্ট ব্যয়বহুল।

এরপর তিনি বার্কলে স্ট্রিটে ফোন করে জানিয়ে দিলেন, সামনের মঙ্গলবারে তিনি তাদের দেখা সঙ্গে করবেন।

.

মঙ্গলবারে নিজের সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে চেরিকে সব বুঝিয়ে দিয়ে মিস মারপল লণ্ডনে গেলেন। সেখানে এক সাধারণ হোটেলে ঘর নিলেন। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে ট্যাক্সি ধরে বার্কলে স্ট্রিটের অফিসে পৌঁছলেন।

বছর পঁয়ত্রিশ বয়সের এক সুদর্শনা মহিলা তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। মহিলার নাম মিসেস স্যাণ্ডবার্ন। বিশেষ ভ্রমণ তারই তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হবে।

প্রাসঙ্গিক দুচার কথার পরে মিসেস স্যাণ্ডবার্ন জানালেন, মিঃ র‍্যাফায়েল এই বিশেষ ভ্রমণের সমস্ত খরচ মেটানোর ব্যবস্থা করে গেছেন।

-আপনারা জানেন যে তিনি মারা গেছেন? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

-হ্যাঁ। কিন্তু এ ব্যবস্থা তিনি মৃত্যুর আগেই করে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, তার শরীরের অবস্থা ভাল নয়, তাই বন্ধুর জন্য একটু ভ্রমণের ব্যবস্থা করে যেতে চান।

.

বৃহস্পতিবার দিনে বিশেষ ভ্রমণযাত্রা শুরু হল। খুব আরামপ্রদ আর বিলাসবহুল এক গাড়িতে ভ্রমণার্থীরা উঠে বসলেন। লণ্ডনের বাইরের উত্তর-পশ্চিম দিকের পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চলল।

নিজের সিটে বসে মিস মারপল যাত্রী তালিকায় চোখ বুলিয়ে নিতে লাগলেন। ভ্রমণের দর্শনীয় স্থান ও দৈনন্দিন খুঁটিনাটিও তাতে লেখা ছিল।

মিসেস রাইজেল পোর্টার
মিস জোয়ানা ক্রফোর্ড
কর্নেল ও মিসেস ওয়াকার
মিঃ ও মিসেস এইচ. টি. বাৰ্টলার
মিস এলিজাবেথ টেম্পল
প্রফেসর ওয়ানস্টেড
মিঃ রিচার্ড জেমসন
মিস লুমলি
মিস বেন্থাম
মিঃ ক্যাসপার
মিস কুক
মিস ব্যারো
মিঃ এমলিন প্রাইস
মিস জেন মারপল

এই হল ভ্রমণার্থী তালিকা। তাদের মধ্যে তাকে নিয়ে চারজন বয়স্ক মহিলা। মিস স্যাণ্ডবার্ন আর তাকে বাদ দিয়ে মোট পনেরো জন যাত্রী।

মিস মারপল ভাবলেন, এই পনেরো জন যাত্রীর কোন ব্যাপারে অবশ্যই গুরুত্ব আছে। সেই কারণেই এই কোচে তার ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হয়তো কোন খবরের যোগসূত্র কিংবা অপরাধের সূত্র এখানে পেয়ে যেতে পারেন।

খোদ খুনীকে পাওয়াও অসম্ভব নয়। এই হত্যাকারী হয়তো ইতিমধ্যে কোন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কিংবা সম্ভাব্য খুনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে। মিঃ র‍্যাফায়েল হয়তো এভাবে তার বুদ্ধিবৃত্তির পরীক্ষা করে থাকবেন–অসম্ভব নয় কিছু।

মিস মারপল ভাবলেন, এই লোকগুলো সম্পর্কে তার খাতায় টুকে রাখবেন।

অন্য যে দুজন ভদ্রমহিলা আলাদা ভাবে ভ্রমণ করছেন, তাদের দুজনেরই বয়স ষাটের কাছাকাছি। একজন বেশ সুবেশা। তার সঙ্গে রয়েছে আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়ে। মহিলার ভাইঝি। মেয়েটি মহিলাটিকে ডেরালডাইন পিসি বলে সম্বোধন করছে। মেয়েটি সুদর্শনা আর বেশ স্মার্ট।

মিস মারপলের সামনে বসেছিলেন মেদবহুল বড়সড় চেহারার একজন মানুষ। মুখখানা গোলাকৃতি হতে হতে কেমন চৌকো হয়ে গেছে। মাথায় ধূসর ঘন চুল, ঘন লোমশ ভ্র।

ভদ্রলোকের পাশেই বসেছিলেন একজন দীর্ঘাকৃতি বিদেশী। অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাত মুখ নেড়ে অনর্গল কথা বলে চলেছেন সহযাত্রীর সঙ্গে।

কখনো ইংরাজি, কখনো ফরাসী বা জার্মান ভাষা বেরিয়ে আসছ তার মুখ থেকে। মেদবহুল ভুরুর মানুষটি একই ভাবে নানা ভাষায় সঙ্গীর কথার জবাব দিয়ে চলেছেন।

আকার-আকৃতি দেখে মিস মারপলের ধারণা হল মেদবহুল ভদ্রলোক নিশ্চয় প্রফেসর ওয়ানস্টেড হবেন। আর অদ্ভুত বিদেশীটি মিঃ ক্যাসপার। ওই দুজনের সামনে ষাট বছর বয়সী মহিলাটি বেশ দীর্ঘাঙ্গী। এ বয়সেও যথেষ্ট সুন্দরী। বেশ লক্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। নিচু কণ্ঠে কথা বলছেন।

কোচে দুজোড়া দম্পতি রয়েছেন। একজন আমেরিকান, মধ্যবয়স্ক, স্ত্রীর অনুগত বোঝা যাচ্ছে। স্ত্রীটি বেশ বাঁচাল।

অন্য দম্পতি ইংরাজ। মধ্যবয়স্ক। ভদ্রলোককে একজন সেনাবাহিনীর মানুষ বলেই মনে হল মিস মারপলের। তিনি তাঁর নোটবইতে এই দুজনকে কর্ণেল আর মিসেস ওয়াকার বলে দাগ দিলেন।

এদের পেছনে দীর্ঘ কৃশ আকৃতির একজন প্রযুক্তিবিদ্যা বিষয়ে কথা বলে চলেছিলেন। ইনি একজন স্থপতি হওয়া সম্ভব।

কোচের শেষপ্রান্তে বসেছিলেন দুজন মধ্যবয়স্কা মহিলা–তারা একসঙ্গে ভ্রমণ করছেন। একজনের বেশ আটোসাঁটো চেহারা। এই মহিলাটিকে মিস মারপলের কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল। কোথায় দেখেছেন, মনে করতে পারছিলেন না।

অবশিষ্ট যাত্রীটি একজন তরুণ। বয়স কুড়ির বেশি হবে না। ছেলেটি সেই ভাইঝি তরুণীকে আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করছিল। ভাইঝিটির চোখেও সমান আগ্রহ লক্ষ্য করলেন মিস মারপল।

মধ্যাহ্ন ভোজ সারার জন্য নদীর কাছাকাছি একটা সুন্দর হোটেলে যাত্রার বিরতি ঘটল। বিকেলের ভ্রমণসূচীতে রয়েছে ব্লেনহীম।

হোটেলে পৌঁছনোর পরে যাত্রীরা পরস্পরের কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলেন।

মিস মারপল ইতিমধ্যে যাত্রীদের নাম জেনে নিয়েছেন। মেদবহুল লোমশভুরুর মানুষটি প্রফেসর ওয়ানস্টেড–যেরকম তিনি ভেবেছিলেন। বিদেশীটি হলেন মিঃ ক্যাসপার।

কর্তৃত্বব্যঞ্জক চেহারার মহিলাটি মিসেস রাইজেল পোর্টার। আর ভাইঝিটি জোয়ানা ক্রফোর্ড। তরুণটির নাম এমলিন প্রাইস।

ইতিমধ্যে এই দুই তরুণ-তরুণী তাদের পছন্দ অপছন্দ, রাজনীতি, শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে মতামত বিনিময় করে পরস্পরের কাছাকাছি হয়ে পড়েছে।

মধ্যবয়স্কা যে দুই মহিলা একসঙ্গে ভ্রমণে এসেছিলেন তারা হলেন মিস কুক আর মিস ব্যারো। ওই মিস কুককেই মিস মারপলের পরিচিত মনে হয়েছে। কিন্তু ঠিক কোথায় তাকে দেখেছেন তিনি তা মনে করতে পারছিলেন না।

তিনি লক্ষ্য করলেন, মিস কুকও যেন তাকে কেমন এড়িয়ে চলতে চাইছেন। তবে এটা তাঁর কল্পনাও হতে পারে।

এই পনেরো জন অপরিচিত মানুষের, মিস মারপল ভাবলেন, অন্তত একজন অবশ্যই কোন ব্যাপারে জড়িত।

সুন্দরী মহিলটির পরিচয় জানা গেল, মিস এলিজাবেথ টেম্পল বলে। তিনি এক বিখ্যাত মেয়েদের স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা।

আর কৃশ চেহারার তরুণটি রিচার্ড জেনসন, একজন স্থপতি।

মিস মারপলের মনে হলো একমাত্র বিদেশী ভদ্রলোক মিঃ ক্যাসপারই এখানে স্বাভাবিক হাসিখুশি মানুষ। অন্য সকলের মুখেই যেন অজ্ঞাত কিছুর অদৃশ্য ক্ষীণ ছায়া লেগে রয়েছে।

.

রাতে শুতে যাবার আগে যাত্রীদের যাচাই করে তার যা যা মনে হয়েছে তা নোটবুকে টুকে নিলেন।

মিস রাইজেল পোর্টার–অতন্ত আত্মকেন্দ্রিক। খুনের সঙ্গে জড়িত থাকা অসম্ভব। তবে কোন সূত্রের সন্ধান তার কাছে থাকা সম্ভব।

ভাইঝি, জোয়ানা ক্রফোর্ড–অত্যন্ত চৌখস।

মিস এলিজাবেথ টেম্পল–আগ্রহ জাগানো ব্যক্তিত্ব। অত্যন্ত সৎ বলেই মনে হয়। এমন একজনের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ ঘটুক–হয়তো মিঃ র‍্যাফায়েলের তাই ইচ্ছা ছিল।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড–কোন বিজ্ঞানী হওয়াই সম্ভব। অথবা ডাক্তার।

মিঃ ও মিসেস বাৰ্টলার–চমৎকার আমেরিকার মানুষ। এদের নাম দুটি কেটে দিলেন তিনি। ওয়েস্ট ইণ্ডিজের কারও সঙ্গে এদের কোন যোগসূত্র থাকা সম্ভব মনে হল না তার।

রিচার্ড জেনসন-স্থপতি। এর মধ্যে স্থপতি বিদ্যার স্থান কিভাবে হতে পারে বুঝতে পারলেন না মিস মারপল। কোন গোপন সুড়ঙ্গের অবস্থানের ইঙ্গিত কি পাওয়া সম্ভব তার কাছ থেকে? হয়তো সেটা খুঁজে পেতে তিনি সাহায্য করতে পারেন।

মিস বুক ও মিস ব্যারো–অতি সাধারণ দুজন মানুষ। কিন্তু মিস কুককে আগে কোথাও দেখা গেছে। একসময় ঠিক মনে পড়ে যাবে।

কর্ণেল আর মিসেস ওয়াকার–অবসরপ্রাপ্ত সামরিক মানুষ। এদের কাছে কিছু নেই। মিস বেন্থাম আর মিস মলি–এই দুই বুড়ীকে অপরাধী হিসেবে ভাবা যায় না। তবে বয়স এদের প্রচুর ঘটনার কথা বা বিষয় নিশ্চয় জানিয়েছে। কোন দরকারী সূত্র এদের কাছ থেকে পাওয়া অসম্ভব নয়।

মিঃ ক্যাসপার–অত্যন্ত উত্তেজনাপ্রবণ এক মানুষ। মারাত্মক চরিত্র বলেই মনে হয়। মিস মারপল এই মানুষটিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে রাখলেন।

এমলিন প্রাইস–সম্ভবতঃ এখনো ছাত্রজীবন কাটেনি। সময় বিশেষে ছাত্ররাও হিংস্র হতে পারে।

পর্যালোচনার ফাঁকে ফাঁকে কোন হত্যাকারীর কথাই মাথায় ঘুরছিল মিস মারপলের। সম্ভাব্য নিহত ব্যক্তিটি কে হওয়া সম্ভব বা তার ব্যাপার কি হতে পারে–এই কোচের মানুষদের মধ্যে কার পক্ষে সম্ভাব্য শিকার হওয়া সম্ভব?

কাউকেই সেভাবে বেছে নিতে পারলেন না মিস মারপল।

তবে মিস পোর্টার হওয়া অসম্ভব না। তিনি অর্থবতী, ফলে কিছুটা অপ্রিয়ও। ভাইঝিটি উত্তরাধিকার পেতে পারে। কিন্তু তবু খুনের কোন সূত্রের আভাস তাঁর চোখে পড়ল না।

চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল। আর বসে থাকতে পারলেন না মিস মারপল। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

 ২. রানি অ্যানের জমিদারী ভবন

০৬.

পরদিন সকালে সকলে গেলেন রানি অ্যানের জমিদারী ভবন দেখতে। ইতিহাস জড়ানো সুন্দর বাড়িটির সঙ্গে একটি অপূর্ব বাগানও রয়েছে।

বাড়িটির স্থাপত্যের নিদর্শন দেখে স্থপতি রিচার্ড জেনসন খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। আবেগে তিনি ঘুরে ঘুরে প্রতিটি ঘরের নানা বর্ণনা সকলকে শোনাতে শুরু করলেন। অনেকেই ভিড় করে তার বক্তৃতা শুনতে লাগলেন।

মিস মারপল সিঁড়ি বেয়ে নিচের তলায় চলে গেলেন। তার পেছন পেছন এলেন মিস কুক আর মিস ব্যারো।

নিচে নেমে একটা খুনের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে লাগলেন তারা। খুনটা হয়েছিল এই বাড়িতেই। সতেরোশো সালের কোন বছর।

কথিত আছে সেই সময় লেডি মোফাটের এক প্রেমিক ছিল। সে গোপন দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতো আবার গোপন দরজা দিয়েই বেরিয়ে যেতো।

স্যার রিচার্ড মোফাট সাগরপাড়ে কোথাও ছিলেন। তিনি ফিরে এসে স্ত্রী আর তার প্রেমিককে ঘনিষ্ঠ ভাবে আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। তার পরেই সেই তরুণকে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় কার্পেটের ওপর পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।

কথা বলতে বলতে মিস কুককে লক্ষ্য করছিলেন মিস মারপল আর মনে করবার চেষ্টা করছিলেন কোথায় তাকে দেখেছেন।

ঠিক মনে পড়ে গেল। কিন্তু যখন তাকে দেখেছেন তখন মিস কুকের চুলের রঙ ছিল কালো। এখন তা গাঢ় হলুদ। ব্যাপারটা চিন্তায় ফেলে দিল তাকে।

নিচ তলা থেকে ডাইনিং হল পার হয়ে সকলে একসময় চলে এলেন সংলগ্ন বাগানে। মিস মারপল বাগানে একটি আসনে আরাম করে বসে পড়লেন।

ইতিমধ্যে মিস এলিজাবেথ টেম্পল এবং মিসেস রাইজেল পোর্টারও বাগানে নেমে এসেছেন।

মিস এলিজাবেথ টেম্পল মিস মারপলের পাশে এসে বসলেন।

দুজন কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকার পর এলিজাবেথ এই বাগান সম্পর্কে কথা বলতে আরম্ভ করলেন।

–এই চমৎকার বাগানের পরিকল্পনা করেছিলেন হেলম্যান সম্ভবত ১৭৯৮ কিংবা ১৮০০ খ্রিঃ। খুব প্রতিভাধর ছিলেন তিনি। খুব অল্প বয়সেই মারা যান।

–অল্প বয়সে মৃত্যু হয়েছে শুনলে বড় দুঃখ হয়। বললেন মিস মারপল। যে কোন জীবনই অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি মাঝপথে তার গতি স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।

–আপনি এই ভ্রমণে এসেছেন কি বাড়ি দেখতে না বাগান? এলিজাবেথ টেম্পল বললেন।

–বাড়ি দেখতেই এসেছি, বললেন মিস মারপল, এক দয়ালু বন্ধু আমার জন্য এই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেরকম বিখ্যাত বাড়ি দেখার সুযোগ জীবনে পাইনি।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আপনি প্রায় ভ্রমণে বের হন?

প্রায়ই না। এবারে অবশ্য শুধু ঘুরে বেড়াব বলেই আসা নয়। আপনি নিশ্চয় ভাববেন, তাহলে কি উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছি ভেবে, তাই না?

মিস মারপল সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তীক্ষ্ণ নজরে তিনি যেন তার সঙ্গিনীকে জরীপ করতে লাগলেন।

পরে তিনি বললেন, আমি জানি আপনি একজন বিখ্যাত মানুষ। আপনার স্কুলেরও খুব নামডাক আছে। আপনাকে দেখে মনে হয়, আপনি তীর্থযাত্রায় এসেছেন। তীর্থযাত্রী বলেই মনে হয় আপনাকে।

–চমৎকার বলেছেন। হ্যাঁ, আমি তীর্থযাত্রাতেই বেরিয়েছি।

মিস পারপল দু-এক মুহূর্ত নীরব থাকার পরে বললেন, যে বন্ধু আমার জন্য এই ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তিনি মারা গেছেন। তার নাম আপনিও নিশ্চয় শুনে থাকবেন মিঃ র‍্যাফায়েল।

জ্যাকসন র‍্যাফায়েল? হ্যাঁ, তার নাম আমার পরিচিত। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনি না বা দেখিনি। আমাদের এক শিক্ষা প্রকল্পে তিনি প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ আগে কাগজে তার মৃত্যু-সংবাদ পড়েছি। তিনি তাহলে আপনার পুরনো বন্ধু ছিলেন।

–না, বললেন মিস মারপল, একবছর আগে ওয়েস্ট ইণ্ডিজে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার আগে তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতাম না। আপনি তার পরিবারের কাউকে চিনতেন?

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন এলিজাবেথ। পরে বললেন, একটি মেয়ে একসময় আমার স্কুলে পড়ত, সে মিঃ রাফায়েলের ছেলের বাগদত্তা ছিল।

–ছেলেটি ওকে বিয়ে করেনি? জানতে চান মিস মারপল।

–না।

–কিন্তু কেন?

–আমি ঠিক জানি না। ছেলেটির আগ্রহ জাগাবার মতই চেহারা ছিল। মেয়েটি অত্যন্ত সুন্দর ছিল দেখতে। তবু কেন যে ওদের বিয়ে হয়নি…মেয়েটি মারা যায়…

–মারা যায়…কিন্তু কেন?

এলিজাবেথ অন্যদিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলেন, ভালোবাসা।

–ভালোবাসা? মিস মারপল যেন কথাটার প্রতিধ্বনি করলেন।

–হ্যা…পৃথিবীর সবচেয়ে ভয় জাগানো কথা–ভালোবাসা।

.

 ০৭.

বিকেলে চতুর্দশ শতাব্দীর একটা প্রাচীন গীর্জা দেখতে গিয়েছিল সকলে। মিস মারপল ইচ্ছে করেই বিরতি দিয়েছিলেন। তিনি একটু বিশ্রাম করে বড় রাস্তার ধারে চা-ঘরে হাজির হলেন।

একটা আরামপ্রদ আসনে বসে তিনি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে ভাবতে লাগলেন।

ইতিমধ্যে অন্যরাও ফিরে এসেছে। মিস মারপলের পাশের দুটি চেয়ারে এসে বসলেন মিস কুক আর মিস ব্যারো। চতুর্থ চেয়ারটিতে বসলেন মিঃ ক্যাসপার।

মিস মারপল মিস কুককে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কেমন মনে হচ্ছে, আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি।

মিস কুক তার বান্ধবী মিস ব্যারোর দিকে তাকালেন। যেন একথার জবাবটা তিনিই দেবেন। মিস মারপলও মিস ব্যারোর দিকে তাকালেন। পরে বললেন, আমি সেন্ট মেরী মিডে থাকি। মাচ বেনহ্যাম থেকে বেশিদূরে নয়। আমার কাছাকাছি কোথাও আপনি ছিলেন কিনা মনে করতে পারছি না।

–মাচ বেনহ্যাম, লুমাউথ আমি ভালই চিনি। সম্ভবত

আচমকা খুশি হওয়ার মত শব্দ করে মিস মারপল বলে উঠলেন, মনে পড়েছে হা–সেন্ট মেরী মিডে আমার বাগানে একদিন আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, আপনি ফুটপাথ দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আমার মনে পড়ছে, আপনি বলেছিলেন, ওখানেই কোন বান্ধবীর সঙ্গে…।

–ঠিক! এবারে আমারও মনে পড়েছে। আমরা বাগানের বিষয়ে কথা বলেছিলাম।

–হ্যাঁ, আপনি কোন বান্ধবীর ওখানে গিয়েছিলেন সম্ভবত।

–হ্যাঁ,.. আমার একজন বান্ধবী…

মিস কুক কেমন ইতস্তত করতে লাগলেন যেন বান্ধবীর নামটা মনে করতে পারছেন না।

–হেস্টিংস। বললেন মিস ব্যারো।–

হ্যাঁ হ্যাঁ…নতুন বাড়িগুলোর কোন একটায়…মিস মারপল বললেন।

–আমরা সকলেই দেখছি বাগান ভালোবাসি।

.

রাতের খাওয়া সেরে মিস মারপল ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মিস কুকের ব্যাপারটা তার মাথায় গেঁথেছিল। তিনি স্বীকার করেছেন সেন্ট মেরী মিডে ছিলেন…তার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।

মিস মারপল চিন্তা করলেন তার ওখানে আসার বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছিল কি? তাকে কি ওখানে পাঠানো হয়েছিল? কিন্তু তার উদ্দেশ্য কি ছিল?

একটু পরে নিজের চিন্তার গতি উপলব্ধি করে তিনি নিজের মনেই হেসে উঠলেন। এসব কি ভাবছেন তিনি। মিস কুক আর মিস ব্যারোকে দুজন স্বাভাবিক মানুষ বলেই মনে হয়। দেখে বেশ হাসিখুশি বলেই মনে হয়।

কিন্তু…কিন্তু মিস কুক যেন মনে হল প্রথমে সেন্ট মেরী মিডে থাকার কথা অস্বীকার করতে চাইছিলেন। তিনি তাঁর বান্ধবী মিস ব্যারোর দিকে তাকিয়েছিলেন কেন? কোন নির্দেশ চাইছিলেন কি?

আচমকা মিস মারপলের মনে বিপদ কথাটা ছায়া ফেলল। প্রথম চিঠিতে মিঃ র‍্যাফায়েল কথাটা উল্লেখ করেছিলেন।

এই সূত্রেই দ্বিতীয় চিঠিতে দেবদূতের সাহায্যে কথা বলেছিলেন।

তিনি এই ব্যাপারে বিপদে পড়তে পারেন…কিন্তু কেন….কোন দিক থেকে?

নিশ্চয় মিস কুক বা মিস ব্যারোর কাছ থেকে নয়? খুবই সাধারণদর্শন দুই বান্ধবী।

কিন্তু এটাও তো ঠিক যে মিস কুক তার চুল রঙ করে, চুলের বিন্যাস বদলে চেহারার আদল পাল্টাতে চেয়েছেন।

একে নিশ্চয় ছদ্মবেশই বলতে হবে। ব্যাপারটা নিশ্চয় অদ্ভুত।

মিঃ ক্যাসপার–মানুষটিকে সহজেই বিপজ্জনক বলে মেনে নেওয়া যায়। তিনিও পাশে বসেছিলেন। দু-একবার কথায় অংশ নিতেও চেষ্টা করেছেন।

বিদেশীদের সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না। মিস মারপল বিদেশী যাত্রীদের বিষয়ে না ভেবে পারলেন না।

.

গোল্ডেন বোরো নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য নিচে নামছিলেন। এই সময় টুইডের কোট পরিহিতা একজন মহিলা ব্যস্তসমস্ত ভাবে সামনে এসে দাঁড়াল।

–মাপ করবেন, আপনিই কি মিস জেন মারপল?

–হ্যাঁ, ওটাই আমার নাম। একটু অবাক হলেন মিস মারপল।

-আমার নাম মিসেস গ্লাইন-ল্যাভিনিয়া গ্লাইন। আমি আর আমার দুই বোন কাছেই থাকি। আমরা শুনেছিলাম আপনি আসছেন–

–আপনারা শুনেছেন আমি আসছি

অবাক হয়ে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করলেন মিস মারপল।

–হ্যাঁ। আমাদের এক পুরনো বন্ধু লিখেছিলেন। তিনি বিখ্যাত হাউজেন অ্যাণ্ড গার্ডেনসের ভ্ৰমণতারিখ জানিয়ে বলেছিলেন তার এক নামী বন্ধু এই ভ্রমণে থাকবেন। আমরা যেন তারিখটা মনে রাখি।

মিস মারপল ঘটনার আকস্মিকতায় কথা হারিয়ে ফেলেছিলেন।

-ওঃ! মিঃ র‍্যাফায়েল, মিস মারপল বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু আপনারা জানেন, তিনি…

–হ্যাঁ, তিনি মারা গেছেন। খুবই দুঃখের কথা। মনে হয়, আমাদের কাছে লেখার কিছু পরেই তার মৃত্যু ঘটে। তিনি যা বলেছেন তা হল, আপনি হয়তো দু-এক রাত আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে যেতে পছন্দ করবেন।

ভ্রমণের পরবর্তী অংশ আপনার পক্ষে খুবই কষ্টকর হবে। বহু মাইল হেঁটে খাড়াই বেয়ে ওপরে ওঠার দরকার হবে।

আমরা তিনবোন খুবই খুশি হব যদি আপনি কয়েকটা দিন আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে যান। হোটেল থেকে আমাদের বাড়ি মাত্র দশ মিনিটের পথ। এই কদিন স্থানীয় ভাবে অনেক সুন্দর জিনিস আপনাকে দেখিয়ে দিতে পারব।

মিস মারপল নীরবে মিসেস গ্লাইনকে পর্যবেক্ষণ করলেন। হৃষ্টপুষ্ট চেহারার মানুষটিকে বেশ বন্ধুভাবাপন্ন বলেই মনে হলো তার।

দু-এক মিনিট ভাবলেন তিনি। এটা কি মিঃ র‍্যাফায়েলেরই নির্দেশ…তার পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে! তিনি মিসেস গ্লাইনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ধন্যবাদ, আপনাদের ওখানে যেতে পারলে সত্যিই খুশি হব।

.

০৮.

প্রাচীন এক জমিদার ভবন। তার একটি ঘরে বিছানায় বসে আছেন মিস মারপল। পাশেই পড়েছিল তার সুটকেস।

জানলা দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, খুবই অযত্নে লালিত। সম্ভবত কয়েক বছর পরিচর্যা হয়নি। বাড়িটিও অবহেলিত। ঘরের আসবাবপত্রও খুবই মূল্যবান, কিন্তু তাতে বহুকাল পালিশ পড়েনি।

এই ভবনের লোকজনেরা হয়তো অন্য কোথাও চলে যাওয়ার পরে মিসেস গ্লাইনরা এখানে বাস করতে এসেছেন। তার মুখেই তিনি শুনেছেন, বাড়িটি উত্তরাধিকার সূত্রে মিসেস গ্লাইন তার কোন কাকার কাছ থেকে পেয়েছেন। স্বামী মারা যাবার পরে বোনেদের নিয়ে এখানে বাস করতে আসেন।

অন্য দুই বোন অবিবাহিতই রয়ে গেছেন। তারা হলেন মিস ব্র্যাডবেরি ও মিস স্কটস।

বাড়িতে কেবল তিন বোনই থাকেন। কোথাও কোথাও এমন কিছু নেই যা থেকে কোন শিশুর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এরা রুশীয়–শেখভ বা দস্তয়ভস্কি এরকম কিছু হবেন, মনে হল তার।

গ্লাইন তাকে অন্য দুই বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তাদের হাবভাব বেশ মার্জিত।

বাগানের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, এই ক্ষয়িষ্ণু পরিবারটির সঙ্গে মিঃ র‍্যাফায়েলের সম্পর্ক কি রকম? বুঝতে পারছিলেন, তার এখানে আসার সকল ব্যবস্থা তিনিই করে গেছেন। মৃত্যুর কয়েকমাস আগেই সম্ভবত সবকিছু করেছেন।

মিস মারপলের মনে হল তার ওপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে, তিনি যেন ধীরে ধীরে তা বুঝে নিতে পারছেন।

সুন্দর এক পরিকল্পনা বেশ অনেকদিন ধরে চিন্তার পর, ছকে ছিলেন মিঃ র‍্যাফায়েল। কিন্তু কী এমন সমস্যায় পড়েছিলেন তিনি যার জন্য এমন বিস্তৃত এক পরিকল্পনা নিতে হয়েছিল তাকে?

এ সমস্যা এমনই যে মিঃ র‍্যাফায়েল নিজে সমাধান করতে পারেননি। সময়ও ছিল না, শয্যাশায়ী হয়ে তিনি মৃত্যুর দিন গুণছিলেন।

নিশ্চয় এমন কিছু ব্যাপার ছিল বা কেউ যার কোন ব্যবস্থা তিনি করে যেতে পারেন নি। নিশ্চয় অর্থের বিনিময়ে এই সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব ছিল না। ব্যবসায়িক চাল বা আইনজ্ঞের সাহায্যেরও বাইরে ছিল না।

তবে, মিস মারপলের মনে হল, বিষয়টা নিশ্চয়ই অপরাধমূলক কিছু বা অপরাধের সঙ্গে তার যোগসূত্র রয়েছে।

ওয়েস্ট ইণ্ডিজে, তার এলাকায় ঘটে যাওয়া কোন অপরাধ হওয়াও বিচিত্র নয়।

যাই হোক, ভাগ্যের কিছু আনুকূল্য, সঙ্গে কঠিন শ্রম আর চিন্তা, সেই সঙ্গে কিছু পরিমাণে বিপদ–এই দুজ্ঞেয় বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশেষ সেই কাজের জন্য তাকে সেন্ট মেরী মিডের বাড়ি থেকে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। জোসেলিন সেন্ট মেরীর এই প্রাচীন জমিদার ভবনে বাস করছেন মিসেস গ্লাইন, মিস ক্লোটিলডা ব্র্যাডবেরি স্কট আর মিসেস অ্যানথিয়া ব্র্যাডবেরি স্কট। তার এখানে আসার ব্যবস্থা মিঃ র‍্যাফায়েলই করে গেছেন মৃত্যুর আগে। তার আইনজ্ঞদের নির্দেশ দিয়ে নিশ্চয় ভ্রমণ সংস্থার আসন সংরক্ষণ করেছিলেন। বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছাড়া–কেবল দুটি রাতের জন্য, এমন বন্দোবস্ত করা তার মত লোক কখনোই করেননি।

মিস মারপলের ধারণা হল, মিসেস গ্লাইন আর তার দুটি বোন নিশ্চিত সেই ব্যাপারটির সঙ্গে জড়িত। তাকে তা বের করতে হবে।

খুব সতর্ক হয়ে তাকে পদক্ষেপ করতে হবে। কোন ভাবেই, কোন সংবাদেই উত্তেজনা বা কৌতূহল প্রকাশ করা তার ঠিক হবে না।

সচেতন থেকে তাকে বের করতে হবে কোন আত্মীয়তা বা ঘটনা বা জীবনের ঘটনার কথা যা এই তিন বোনের সঙ্গে জড়িত নয় অথচ এদের কাছাকাছিই ঘটে থাকবে সেই ঘটনা।

যাই হোক, দুদিন এখানে থাকবেন স্থির করলেন তিনি। তারপরে আবার ভ্রমণে যোগ দেবেন। হয়তো তিনি যা চাইছেন, তা ওই কোচেই রয়েছে।

একজন বা বহুজন, কোন নির্দোষ বা নির্দোষ নন, হয়তো দীর্ঘ অতীতের কোন কাহিনী।

এই সময় দরজায় শব্দ করে মিসেস গ্লাইন ঘরে প্রবেশ করলেন।

আশা করি আরাম বোধ করছেন এখানে। আপনার জিনিসপত্র বের করে দেব?

–ওঃ ধন্যবাদ। টুকিটাকি সামান্য জিনিসটা আমিই বার করে নিয়েছি।

এরপর বাড়ির নিচতলাটা দেখাবেন বলে মিসেস গ্লাইন মিস মারপলকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন।

–বাড়িটা সত্যিই চমৎকার, বললেন মিস মারপল, ১৭০০ সালে তৈরি মনে হয়।

–১৭৮০ সালে। বললেন মিসেস গ্লাইন।

চমৎকার বড় একখানা ঘরে এনে বসানো হলো মিস মারপলকে। অন্য দুই বোন সেই সময় ঘরেই ছিলেন।

তিন বোন। ল্যাভেনিয়া গ্লাইন। ক্লোটিলডা ব্র্যাডবেরি স্কট। অ্যানথিয়া ব্র্যাডবেরি স্কট।

মিস মারপল তিন বোনকে কথার ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ্য করতে লাগলেন।

ক্লোটিলডা সুন্দরী। ল্যাভেনিয়া সরল। অ্যানথিয়া আকর্ষণীয়া। তার একটি চোখের পাতা মাঝে মাঝেই কেমন কেঁপে ওঠে। আচমকা পেছনে ফিরে তাকায়। এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যেন কেউ তাকে সব সময় লক্ষ্য করছে। অ্যানথিয়ার এই অভ্যাসটা খুবই অদ্ভুত মনে হল মিস মারপলের।

.

০৯.

মাত্র তিনদিন হয়েছে। মিস মারপল ভ্রমণে বেরিয়েছেন। ভ্রমণের বিষয়ে বিবরণ দেবার তেমন কিছু ছিল না।

–মিঃ র‍্যাফায়েল নিশ্চয় আপনার পুরনো বন্ধু ছিলেন? জ্যেষ্ঠ বোন ব্র্যাডবেরি স্কট প্রশ্ন করলেন।

–ঠিক তা নয়, বললেন মিস মারপল, তাঁকে প্রথম দেখি–যখন ওয়েস্ট ইণ্ডিজে যাই। সম্ভবত তিনিও সেখানে স্বাস্থ্য ফেরাতে গিয়েছিলেন।

-হ্যাঁ। শেষ দিকে তিনি অক্ষম হয়ে গিয়েছিলেন, অ্যানথিয়া বললেন, আপনি লণ্ডনে থাকেন?

-না, গ্রামের দিকে থাকি। লুমাউথ আর মার্কেট বেসিংয়ের মাঝামাঝি আমাদের গ্রামটা। লণ্ডন থেকে পঁচিশ মাইল। মিঃ র‍্যাফায়েল মনে হয় লণ্ডনেই থাকতেন?

–কেন্টে তাঁর এক বাগানবাড়ি ছিল ক্লোটিলডা বললেন, কালেভদ্রে লণ্ডনে গেলে তার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হত।

-আপনারা আমাকে যে অনুগ্রহ করে নিমন্ত্রণ জানালেন এটা তার সদাশয়তা।

এর আগে তাঁর অনেক বন্ধুকেই ভ্রমণের ফাঁকে আমরা নিমন্ত্রণ করে এনেছিলাম, বললেন ক্লোটিলডা, আগামীকাল সেন্ট বোনাভেঞ্চারে আপনাদের ভ্রমণ খুবই ক্লান্তিকর হবে।

-আপনি বাগান ভালবাসেন? অ্যানথিয়া বললেন।

–হ্যাঁ। এদের তালিকায় ঐতিহাসিক ভবন আর সংলগ্ন চমৎকার বাগান দেখতে পাব বলে উদগ্রীব হয় আছি।

এইরকম কথোপকথন ছিল খুবই সাধারণ আর নীরস। সবই স্বাভাবিক মনে হলেও মিস মারপলের মনে হল এখানে অস্বাভাবিক কিছু আছে।

মধ্যহ্নভোজের পরে মিস মারপলকে বাগানে নিয়ে যাওয়া হল। বাগানটি হতশ্রীই বলা যায়। কিছু গুল্ম আর কিছু লতা গাছ। একদিকে বিস্তর ঝোপ গজিয়ে উঠেছে।

অ্যানথিয়া সঙ্গী হয়েছিল তার। ঘাসের ওপর দিয়ে চলতে চলতে দেয়ালের পাশে একটা ঢিবির কাছে এসে দাঁড়ালেন।

–এটা আমাদের কাচ-ঘর। বললেন অ্যানথিয়া। চারদিকটা ভাঙ্গাচোরা। লতাগুল্ম জড়িয়ে আছে।

একটা ফুল দেখিয়ে মিস মারপল জিজ্ঞেস করলেন, এ তলার নাম কি?

-খুব সাধারণ লতাগাছ। বললেন অ্যানথিয়া, নামটা পি দিয়ে…ঠিক মনে পড়ছে না।

–নামটা আমার জানা আছে, বললেন মিস মারপল, পলিগোনাম বল্ডস্কৃয়ানিকাম। খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। কাচ-ঘরটি বেশ বড় ছিল বোঝা যায়।

অ্যানথিয়া তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে এসে দেওয়ালের পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলতে লাগল।

মিস মারপলের মনে হল, ইচ্ছাকৃত ভাবেই পলিগোনামের ঢিবি থেকে তাকে সরিয়ে নিতে চাইছে অ্যানথিয়া।

হঠাৎ একটা ভাঙ্গা শুয়োরের খোঁয়াড়ের ওপর নজর পড়ল তার। সেটার চারপাশে কয়েকটা গোলাপ চারা গজিয়ে উঠেছে।

চলতে চলতে আচমকাই অ্যানথিয়া প্রশ্ন করল,আপনি প্রায়ই এরকম ভ্রমণে আসেন?

-খুব খরচের ব্যাপার তো। হয়ে ওঠে না। একজনের দয়ায়—

ওয়েস্ট ইণ্ডিজ বা এরকম জায়গায় যান—

আমার ভাইপোর কল্যাণে যাওয়া হয়েছিল।

–ওঃ বুঝেছি।

–আপনার বোন মিসেস গ্লাইনের কোন ছেলেমেয়ে নেই? জিজ্ঞেস করলেন মিস মারপল।

–না ওদের কোন সন্তান হয়নি। একদিকে সেটা ভালই হয়েছে।

কথাটা কেমন খট করে কানে গেঁথে গেল। এরকম কেন বলল, ভাবলেন মিস মারপল

.

 ১০.

পরদিন সকালের চা-খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল একটি স্ত্রীলোক।

হাতের ট্রে টেবিলে রাখতে রাখতে সে বলল, বোনাভেঞ্চার পাহাড়ে না গিয়ে ভালই করেছেন। পায়ে খুব ব্যথা হতো।

–এখানে এসে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি, বললেন মিস মারপল।

–বাড়িতে কেউ এলে আমাদেরও খুব ভাল লাগে। এ বাড়িটা আজকাল খুবই দুঃখের হয়ে উঠেছে।

-তুমি এ বাড়িতে অনেকদিন আছ?

–খুব ছোট বয়সে এসেছিলাম–পরিচারিকা হয়ে। সেই বুড়ো কর্নেলের আমলে। কর্নেলের দুর্ভাগ্য নিজের চোখেই দেখেছি। অল্পবয়সে স্ত্রীকে হারালেন, যুদ্ধে ছেলেটাও মারা গেল। এক মেয়ে ছিল সেও নিউজিল্যাণ্ডের একজনকে বিয়ে করে বিদেশে চলে যায়। একাই তিনি এখানে বাস করে গেছেন। মারা যাবার সময় ভাইঝি ক্লোটিলডাকে আর তার অন্য দুই বোনকে এ বাড়ি দিয়ে যান। তিনি আর মিস অ্যানথিয়া বাস করতে থাকেন। পরে স্বামী মারা গেলে ল্যাভিনিয়াও চলে আসে। তারপর থেকে, ওদের ক্ষমতা ছিল না, দিনে দিনে বাড়িটা, বাগানটাও নষ্ট হতে থাকে।

-খুবই দুঃখের কথা। বললেন মিস মারপল।

–তবে ওরা সবাই খুব ভাল। কেবল অ্যানথিয়া যেন কেমন কেমন। জানেন, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বাড়িটায় কোন দোষ আছে।

মিস মারপল স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন পরিচারিকার দিকে।

-একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। স্পেনে যুদ্ধ লাগল–সবাই মারা গেল। মিস ক্লোটিলডার দুই বন্ধু মারা গেলেন। তারা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। একটা মেয়ে সৌভাগ্যবশত স্কুলে ছিল বলে সে বেঁচে যায়। তবে মিস ক্লোটিলডা তাকে এখানে নিয়ে এসে সবই করেছিলেন তার জন্য। খুব হাসিখুশি, মিষ্টি স্বভাব ছিল মেয়েটির। কী ভয়ানক ব্যাপার যে ঘটল, আপনি ভাবতেও পারবেন না।

–কি হয়েছিল? ভয়ানক কিছু ঘটেছিল এখানে?

–তা এখানেই ঘটেছিল বলতে পারেন। সে তাকে এখানেই প্রথম দেখে। কাছাকাছিই থাকতো। তিন বোনই তার বাবাকে চিনতেন–দারুণ পয়সাওয়ালা লোক। ছেলেটি এখানে বেড়াতে এসেছিল–আর তখন থেকেই শুরু হয়–

–ওরা প্রেমে পড়েছিল?

–হ্যাঁ। ছেলেটির চমৎকার চেহারা ছিল। আপনি ভাবতে পারবেন না কী সাংঘাতিক –

মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল?

–বৃদ্ধা আশ্চর্য হয়ে তাকাল মিস মারপলের দিকে।

-ওঃ ওসব নয়–খুন–একেবারে খুন। গলা টিপে মেরে তার মাথাটা একেবারে খেলে দেওয়া হয়েছিল। মিস ক্লোটিলডাকে গিয়ে সনাক্ত করতে হয়েছিল। তার পর থেকেই তিনি কেমন হয়ে গেলেন।

একটু থামল সে। পরে আবার বলতে শুরু করল, এখান থেকে ত্রিশ মাইল দূরে একটা পরিত্যক্ত খনির পাশে ঝোপের মধ্যে তার দেহটা পাওয়া গিয়েছিল। এরা সবাই বলে, এরকম অনেক মেয়েই নাকি সে খুন করেছিল। ছমাস ধরে মেয়েটা নিরুদ্দেশ ছিল। পুলিসও খুঁজে পায়নি।

ওরা বলে আজকাল যারা এরকম মেয়েদের মারে, তাদের নাকি মাথার ঠিক নেই। তাদের ফাঁসিও দেয় না। আমি ওসব বিশ্বাস করি না। ওই ছেলেটা…পাকা শয়তান ছিল।

-ওরা তাকে কি করেছিল?

–ওর বয়স কম ছিল। ঠিক মনে নেই আমার, ফাঁসি দিয়েছিল না, বোস্টল বা ব্রডম্যাণ্ড এমনি কোন একটা জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।

–ছেলেটির নাম কি ছিল বলতো।

দশ বছর আগের ঘটনা–সব মনেও নেই। কি যেন মাইকেল–তারপর মনে হয় র‍্যাফল

–মাইকেল র‍্যাফায়েল?

–ঠিক বলেছেন।

মিস মারপল নিঃশ্বাস ফেললেন। তাহলে এখন বোঝা যাচ্ছে এই খুনের কারণটাকেই এলিজাবেথ টেম্পল বলেছিলেন ভালবাসা।

এক তরুণী কোন খুনীর প্রেমে পড়েছিল। সেই প্রেমেই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ঘটনাটা ভাবতে গিয়ে শিহরিত হলেন মিস মারপল।

সেদিন সকালেই নিচে নেমে গৃহকর্ত্রীকে দেখতে পেলেন না কোথাও। তিনি বাগানে এসে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একটা অদ্ভুত অনুভূতি তার সারা মন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার মনে হতে লাগল, এই বাগানে এমন কিছু আছে যা তার প্রয়োজন–যা তাঁর লক্ষ্য করা দরকার। জেনেটের বলা ঘটনাটা লক্ষ্য করবেন স্থির করলেন।

দেয়ালের গায়ে একটা ভোলা দরজা দিয়ে মিস মারপল রাস্তায় এসে পড়লেন। কিছু দোকানপাট পার হয়ে একটা গীর্জার চত্বরে ঢুকলেন। কয়েকটি সমাধির কাছে ঘুরে বেড়ালেন।

পুরনো দিনের সব সমাধি। কয়েকটির গায়ে কয়েকজন প্রিন্সের নাম চোখে পড়ল। আর কয়েকজন ব্রড।

ফিরে আসার পথে একজন বয়স্ক মহিলার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হল। তাকে সুপ্রভাত জানিয়ে কথা শুরু করলেন তিনি।

কথার মাঝখানে সেই মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ওই পুরনো জমিদার বাড়িতে আছেন, তাই না?

–হ্যাঁ বললেন মিস মারপল, আমার এক পুরনো বন্ধু মিঃ র‍্যাফায়েল এখানে তার কজন বন্ধুকে লিখেছিলেন, তারাই কয়েকটা রাত কাটাবার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মিসেস গ্লাইন আর তার দুই বোন খুব যত্ন করেছেন। তারা সম্ভবত অনেককাল এখানে আছেন?

–তেমন বেশিদিন নয়–বছর কুড়ি হবে। বাড়িটা ছিল কর্নেল ব্র্যাডবেরি স্কটের।

কর্নেলের কোন ছেলেমেয়ে ছিল না?

–এক ছেলে ছিল, সে যুদ্ধে মারা গিয়েছিল। সেজন্যই তো বুড়ো ভাইঝিকে বাড়িটা দিয়ে গেছেন।

কথা শেষ করে বৃদ্ধাটি কবরের সারির দিকে চলে গেল। মিস মারপল গির্জায় প্রবেশ করলেন।

একটা ছোট আসনে বসে মিস মারপল নানা কথা চিন্তা করতে লাগলেন।

দশ-বারো বছর আগের ঘটনা। নতুন করে কোন সমস্যার সমাধান করার কিছু নেই। এতে তার কিই বা করার আছে। মিঃ র‍্যাফায়েল কি আশা করেছিলেন তার কাছে?

এলিজাবেথ টেম্পল নিশ্চয় আরো কিছু বলতে পারেন। তিনি তার এক ছাত্রীর কথা জানিয়েছিলেন, সে মাইকেল র‍্যাফায়েলের বাগদত্তা ছিল। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

তার গ্রামেও এমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল। বিয়ের আগেই সে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল। এরপর মেয়েটি ছেলেটিকে বিয়ের কথা বলে। ছেলেটির ততদিনে মেয়েটিকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তার অন্য সঙ্গিনী জুটেছিল। নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে সে মেয়েটিকে। তারপর যাতে আত্মীয়স্বজন সনাক্ত করতে না পারে তার জন্য মেয়েটির মুখ গুঁড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল। সব যেন একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি।

ওরা তিন বোন কি কিছু জানে? এলিজাবেথ টেম্পল? কালতো আবার সকলের সঙ্গে তিনি ভ্রমণে যোগ দেবেন। তখন তার কাছ থেকে আরও কিছু জানার চেষ্টা করবেন।

কিছুক্ষণ পরে উঠে দাঁড়ালেন মিস মারপল। ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

গেটের কাছে আসতেই দেখলেন দুজন স্ত্রীলোক দাঁড়িয়ে আছে। একজন এগিয়ে এলো–মিসেস গ্লাইন।

-আপনি এখানে? আমরা চিন্তা করছিলাম।

–প্রাচীন গির্জাটা একটু ঘুরে দেখছিলাম। বললেন মিস মারপল, এটা মনে হয় ভিক্টোরিয়ার আমলের।

-হ্যাঁ।

আপনারা এখানে আগাগোড়াই আছেন?

–না। মাইল ত্রিশেক দূরে আমরা থাকতাম। লিটল হার্ডসনেতে। আমার বাবা ছিলেন অশ্বারোহী বাহিনীর মেজর। কাকাকে দেখতে প্রায়ই আমরা এখানে আসতাম। তারও আগে আসতাম ঠাকুর্দাকে দেখতে। আমার বোনেরা কাকার মৃত্যুর পর এখানে চলে আসে। সেসময় আমি স্বামীর সঙ্গে বিদেশে ছিলাম। বছর পাঁচ আগে তিনি মারা গেছেন। ওরাই আমাকে আগ্রহ করে এখানে নিয়ে আসে। স্বামীর মৃত্যুর আগে আমি স্বামীর সঙ্গে কয়েকবছর ভারতবর্ষেও ছিলাম।

-ওহ আচ্ছা

লণ্ডনের কাছে আমি ছোট একটা কটেজও কিনেছি–হ্যাম্পটন কোর্টে। মাঝে মাঝে লণ্ডনের দু-একটা দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করতে হয়, সেজন্য বোনেদের কাছে বেশি থাকা হয় না। ওদের নিয়ে আজকাল খুব চিন্তা হয়। বিশেষ করে অ্যানথিয়ার জন্য ভাবনা হয়। মাঝে মাঝে যেন কেমন হয়ে যায়। দেখেছেন তো

-হ্যাঁ। খুব ভাবনাচিন্তা করলে মানুষের এরকম হয়।

–কিন্তু, ওর চিন্তাভাবনার কি কারণ থাকতে পারে বুঝতে তো পারি না। বাগানটা নিয়ে খুব চিন্তা করে অবশ্য। কাচঘর, পীচ, আঙুরলতা এসবের কথা খুব বলে

–দেওয়ালের গায়ে চেরি পাই-এর কথাও–এছাড়াও সেই ফুলের বেড়া

–আপনি দেখছি মনে রেখেছেন। সেই ফুলের বেড়া আবার ও লাগাতে চায়। অনেক কিছুই নতুন করে লাগাতে চায়। ক্লোটিলডা অবশ্য ওকে বলে এখন আর অত খরচ সম্ভব নয়। তবু কি শোনে, কদিন আগে এক নামী কোম্পানিকে বাগানটা সাজিয়ে তোলার জন্য বায়না দিয়েছে। কাচঘর নাকি আবার আগের মত করে তুলবে।

আজকাল সবেতেই খুব খরচ। কিছু করা কঠিন। বললেন মিস মারপল।

একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, কাল সকালেই তো আমাকে যেতে হবে। গোল্ডেনবোরে খোঁজ নিয়েছিলাম। সকাল নটায় ওখানেই যাত্রীরা ফিরে এসে আবার যাত্রা করবেন। শুনেছি এবারে আমাদের দেখানো হবে স্টারলিং সেন্ট মেরী-গির্জা আর কেল্লা

-বেশ। আজ বিকালটা বিশ্রাম নিয়ে নিন। কথা বলতে বলতে ওরা দুজন বাড়িতে ঢুকলেন।

৩. প্রাতঃকালীন চা পান

১১.

পরদিন সকালে মিস মারপল প্রাতঃকালীন চা পান করছেন। একটু পরেই তাঁকে গুছিয়ে নিতে হবে।

এমনি সময় উদ্বিগ্ন মুখে ক্লোটিলডা ঘরে ঢুকলেন।

–এমলিন প্রাইস বলে একটি ছেলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। ওদের নাকি কি একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।

–দুর্ঘটনা! আমাদের কোচে কিছু হয়েছে? অবাক হয়ে তাকালেন মিস মারপল।

–কোচে নয়। বোনাভেঞ্চারের খাড়াই পথ বেয়ে সকলে উঠছিলেন। সেই সময় পাথর গড়িয়ে পড়ে কাউকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে–

-ওঃ! খুব দুঃখ পেলাম। কিন্তু কে আঘাত পেলেন কিছু বলেছে?

–কে একজন মিস টেম্পল বা টেণ্ডারটন বলল–

-এলিজাবেথ টেম্পল, বললেন মিস মারপল, কোচে ওঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। একজন অবসরপ্রাপ্তা স্কুল শিক্ষিকা–খুবই নামী মানুষ ছিলেন।

–আমি তাকে চিনতাম, বললেন, ক্লোটিলডা। ব্যাপারটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সবকথা এখনো শুনিনি।

সুটকেসের ঢাকনা আটকে মিস মারপল উঠে দাঁড়ালেন।

–যাওয়া যাক। নিচে গিয়ে মিঃ প্রাইসের সঙ্গে কথা বলি।

ক্লোটিলডা সুটকেসটি তুলে নিয়ে মিস মারপলের সঙ্গে নিচে নেমে এলেন।

এমলিন প্রাইস তার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। তাকে খুবই এলোমেলো দেখাচ্ছিল।

–ওরা আপনাকে খবরটা দিতে পাঠিয়ে দিলেন। মিস টেম্পলের দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওপর থেকে পাথরের চাই গড়িয়ে পড়েছিল। মাথায় আঘাত পেয়েছেন মিস টেম্পল–গতরাতেই তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আজকের ভ্রমণ বন্ধ থাকছে। আগামীকালের গ্র্যাং-মেরিং যাওয়াও হবে না।

-মিসেস স্যাণ্ডবার্ন কোথায়? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

–তিনি সকালেই হাসপাতালে চলে গেছেন। এগারোটায় গোল্ডেনবোরে আমাদের সঙ্গে কফি পানে যোগ দেবেন।

ক্লোটিলডা আর মিসেস গ্লাইনকে বিদায় জানিয়ে এমলিন প্রাইসের সঙ্গে গোল্ডেনবোরে এসে উঠলেন।

যাত্রীরা সকলেই তখন কফি ঘরে উপস্থিত ছিল। কফি আর প্যাস্ট্রি দেওয়া চলছিল।

মিস টেম্পলের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার ব্যাপার নিয়েই সকলে আলোচনা করছিলেন। মস্তিষ্কের আঘাত খুবই গুরুতর। বিশেষ ডাক্তার তার দেখাশোনা করছেন। সকলেই এখন সংবাদ শোনার আশায় রয়েছে।

অনেকেই সকালের দিকে সময়টা একটু ঘুরে আসার কথা ভাবলেন। কিছুক্ষণ পরেই সকলেই দল বেঁধে বেরিয়ে গেলেন। কেবল রয়ে গেলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড আর মিস মারপল।

–চলুন, হোটেলের বাইরে কোথাও গিয়ে বসা যাক। মিস মারপলকে বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

দুজনে হোটেলের দরজা অতিক্রম করে কোণের দিকের বাগানে পেতে রাখা বাস্কেট চেয়ারে বসলেন।

–আপনি নিশ্চয়ই মিস জেন মারপল? বললেন প্রফেসর।

–হ্যাঁ, আমিই জেন মারপল। অবাক হলেন মিস মারপল, কিন্তু

–আপনার কথা শুনেছিলাম মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে। বলে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রফেসর ওয়ানস্টেড যেন পর্যবেক্ষণ করতে চাইলেন মিস মারপলকে।

–আমার সম্পর্কে কবে তার সঙ্গে আপনার কথা হয়েছিল?

তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে।

তিনি জানতেন, এই ভ্রমণদলে আপনি থাকবেন?

–হ্যাঁ। আপনার জন্য এই ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছেন তিনি একথাও জানিয়েছিলেন।

–এটা তাঁর সদাশয়তা। এমন খরচসাপেক্ষ ভ্রমণ আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব হত না। আর তাতেই এমন করে বাধা পড়ল।

–হ্যাঁ, খুবই দুঃখের কথা।

একটু থেমে প্রফেসর ওয়ানস্টেড পুনরায় বললেন, মিঃ র‍্যাফায়েল আপনার সম্পর্কে আমার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। এই ভ্রমণে আমি আপনার সঙ্গে থাকি এটাই তার ইচ্ছা ছিল। অর্থাৎ আপনার ওপর যেন একটু নজর রাখি।

-একথার অর্থ?

–আমি যেন লক্ষ্য রাখি আপনার যাতে কোন কিছু না ঘটে।

–আমার কি ঘটবে?

–সম্ভবত মিস এলিজাবেথ টেম্পলের যা ঘটেছে–আপনার কি মনে হয়, ওটা দুর্ঘটনা?

–আমি এর কিছুই বলতে গেলে জানি না। বললেন মিস মারপল। আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।

–আমার বক্তব্য হল, আপনি নিজের সম্পর্কে সাবধান থাকবেন। বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

–আপনার সম্পর্কে আমি এখনো কোন সূত্র পাইনি। আপনি কি মৃত মিঃ র‍্যাফায়েলের একজন বন্ধুস্থানীয়?

-না, তার সঙ্গে আমার দু-একবারই দেখা হয়েছে। আমি নিজের সম্পর্কে এটুকু বলতে পারি, আমার কাজের জগতে আমি একজন খ্যাতিমান মানুষ।

–খুব সম্ভব আপনি একজন চিকিৎসক।

-হ্যাঁ, আপনার অনুমান যথার্থ। আমি একজন মনোবিজ্ঞানী। বিশেষ বিশেষ অপরাধী মস্তিষ্ক সম্পর্কে আমি আগ্রহী। এ নিয়েই বহুবছর গবেষণা করে চলেছি।

বুঝতে পেরেছি, বললেন মিস মারপল, মিঃ র‍্যাফায়েল আমাকে এমন একটা কাজে নামতে বলে গেছেন যার সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা রেখে যাননি।

–আপনি সে কাজ গ্রহণ করেছেন?

–হ্যাঁ, আমি গ্রহণ করেছি। ওয়েস্ট ইণ্ডিজে আমরা দুজনে ওখানে একটা কাজ করেছিলাম।

-হ্যাঁ, আমাকে সেকথা বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, অপরাধমূলক ব্যাপারে সমাধানে আপনার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে। আমি মনে করি মিঃ র‍্যাফায়েল অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন।

একটু থেমে তিনি বললেন, এখানে আপনার সঙ্গে বিশেষ আলোচনার জন্যই আমি মিলিত হয়েছি। এখন আশপাশে আড়ি পাতবার মত কেউ নেই। করলেও আমাদের কথা শুনবার সুবিধা নেই। অতএব আমরা নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারি।

মিস মারপল বললেন, মিঃ র‍্যাফায়েল আমার কাজের ব্যাপারটা কি চেয়েছিলেন এ ব্যাপারে আমি এখনো অন্ধকারে।

–তিনি চেয়েছিলেন, নির্দিষ্ট ঘটনার দিকে আপনি এগিয়ে যাবেন। এসম্পর্কে অন্য কোন লোকের মতামত গ্রাহ্যে আনবেন না।

-এ কোন ব্যাখ্যা হলো বলে মনে হয় না।

-আপনার সঙ্গে আমি একমত। তবে আমি কতগুলো ঘটনার কথা আপনাকে জানাবো, তাতে ব্যাপারটা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর এসম্পর্কে আপনার জানা তথ্যও আমাকে জানাতে পারবেন।

–বেশ, কিছু বলুন তাহলে।

-সংক্ষেপেই আমার কথা বলবার চেষ্টা করব। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের হয়ে আমাকে মাঝে মাঝে উপদেষ্টার কাজ করতে হয়। তাছাড়া বাইরের কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আমি জড়িত। এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা যাদের বিশেষ ধরনের অপরাধী বলে সন্দেহ করা হয় অথচ তাদের বয়স কোন বিশেষ বয়সের কম, তাদের বেশ কিছু সময়ের জন্য নিজেদের তত্ত্বাবধানে রাখে।

-হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। বললেন মিস মারপল।

–সাধারণতঃ অপরাধ সংঘটিত হবার পর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়–রোগ নির্ণয় করা, নিরাময়ের সম্ভাব্যতা বিচার করা–এসবই আমাকে করতে হয়। এই ব্যাপারে আমার কাছে আহ্বান আসে স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে।

এমনি এক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আমার বন্ধু। তিনি বিশেষ একজন তরুণ অপরাধী সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছিলেন। ঘটনাটা বেশ কয়েকবছর আগেকার। ছেলেটি তার কৈশোরকাল থেকেই সম্পূর্ণ অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। সে ডাকাত দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, ডাকাতি, চুরি, জালিয়াতি সবকিছুতেই সে অংশ নেয়।

-বুঝতে পেরেছি, আপনি মিঃ র‍্যাফায়েলের ছেলের কথাই বলছেন।

–হ্যাঁ, তার সম্পর্কে আপনি কি জেনেছেন?

–বিশেষ কিছুই না। মাত্র গতকালই শুনেছি মিঃ র‍্যাফায়েলের এক অযোগ্য ছেলে আছে যে অপরাধী তালিকাভুক্ত।

–সে মিঃ রাফায়েলের একমাত্র পুত্র। তাঁর আরও দুটি মেয়ে ছিল। একজন চোদ্দ বছর বয়সে মারা যায়, অন্য মেয়েটি বিয়ে করে সুখেই আছে। ওঁর স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন অল্প বয়সেই।

ছেলের জন্য সবরকম করণীয়ই তিনি করেছিলেন। স্কুলে থাকাকালীনই ছেলেটি তার যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছিল। তবু তিনি সবরকম গোলমাল থেকে ছেলেকে বাঁচিয়েছেন। আদালতের ঝামেলাও সামলেছেন। একটি ধর্ষণের অভিযোগে ছেলেটিকে জেল খাটতেও হয়েছিল। পরে যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল তা খুবই গুরুতর

–সে একটি মেয়েকে খুন করেছিল শুনেছি। বললেন মিস মারপল।

–মেয়েটিকে বাড়ি থেকে ফুসলে নিয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন পরে মেয়েটির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। তাকে গলা টিপে মেরে ভারি পাথর বা লোহা দিয়ে মুখ মাথায় আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়। সম্ভবত মেয়েটির পরিচয় গোপন করার জন্যই এরকম করা হয়েছিল।

–এরকম অপরাধী মানসিকতার কাউকে আমি সহ্য করতে পারি না। বললেন মিস মারপল।

-ওটাকে বংশানুক্রম বলেই আমি মনে করি। জন্মের সঙ্গেই যে চরিত্র বা বংশধারা নিয়ে তারা জন্মায় তার ওপর তাদের কোন হাত থাকে না।

যাইহোক, ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বন্ধুটি—অত্যন্ত অভিজ্ঞ মানুষ তিনি। তার বিশ্বাস হয়েছিল–ছেলেটি আদৌ খুনী নয়। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, ছেলেটি কোন মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তার মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল।

তিনি দৃঢ় নিশ্চিত হয়েছিলেন যে তার সম্পর্কে যে রায় দেওয়া হয়েছিল, তা ভুল ছিল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখেছিলেন, ছেলেটির সব অপরাধই সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ প্রমাণিত।

স্বভাবতঃই আমার বন্ধুটি খুবই অসুখী হয়ে পড়েছিলেন। প্রকৃত সত্য জানার জন্য তিনি উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, ছেলেটিকে দেখে, পেশাদারী পদ্ধতিতে ব্যাপারটা অনুধাবন করে আমার মতামত জানাই।

–আপনার ওই পরিচালক বন্ধুটি যথার্থই অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তার ন্যায়ের প্রতি আগ্রহ প্রশংসনীয়। বললেন মিস মারপল। আপনি নিশ্চয় তার অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন?

–হ্যাঁ। আমি ছেলেটির কাছে বন্ধুর মত গিয়েছিলাম এবং আমার সাধ্যমত বাস্তব পরীক্ষাও করি। একটু থেমে প্রফেসর ওয়ানস্টেড আবার বললেন, মাইকেল র‍্যাফায়েল একজন খুনী একথা আমি মানতে পারিনি।

আগ্রহ বশে আমি নিজেও কিছু অনুসন্ধান চালাই। সে একটি মেয়ের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল সত্য কথা, কিন্তু সে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেনি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত মেয়েটির আরও অনেক ছেলেবন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের বাইরেও তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

তবে ওই খুনের ঘটনাটি–ধর্ষণ করে হত্যা–শারীরিক, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক–সবরকম পরীক্ষা করেই দেখেছি, কোনদিক থেকেই খুনের ঘটনাটির সমর্থন পাইনি।

-আপনি আপনার বন্ধুকে সেকথা জানিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ। তার মতামতের সঙ্গে যে আমিও একমত সেকথা জানিয়েছিলাম। আবেদন করার মত কোন প্রমাণ আমাদের হাতে ছিল না। অথচ আমরা দুজনেই বুঝতে পেরেছিলাম বিচারে কোথাও বড় রকমের ফাঁক থেকে গিয়েছিল। এটাও বুঝতে পেরেছিলাম, প্রমাণ হয়তো কোথাও পাওয়া যেতে পারে, তবে তা বার করে আনা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এবং খরচসাপেক্ষ।

–মিঃ র‍্যাফায়েল তার ছেলের সম্বন্ধে কি ভেবেছিলেন?

এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আমার খোলাখুলি আলোচনা হয়েছিল। তিনি ন্যায়পরায়ণ মানুষ ছিলেন সত্য, তবে বলব, নির্মমও ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমার ছেলেটি বিকৃত–সংশোধনের অযোগ্য। তবু, অসুস্থ মৃগী রোগাক্রান্ত ভেবে তার জন্য যা দরকার তাই করব। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, আমি তাকে কি করতে বলছি।

ছেলেটির অপরাধের যথার্থ দিকটারই বিচার হোক, আন্তরিকভাবেই তিনি তা চেয়েছিলেন। বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এসে সে তার নিজের পছন্দমত জীবনযাপন করুক তা-ও তিনি চাইছিলেন।

আমাকে স্পষ্টই বলেছিলেন, অন্য কেউ যদি মেয়েটিকে হত্যা করে থাকে, তাহলে আমি চাই সে ঘটনা প্রকাশিত হয়ে সকলে জানুক। আমি একজন অশক্ত মানুষ-জীবনের মেয়াদও ফুরিয়ে এসেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমার পক্ষে যা ব্যবস্থা করা সম্ভব তা করে যাব। এজন্য খরচের কোন বাধা আমি রাখব না।

সবশেষে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আপনাকেই আমার প্রধান সাহায্যকারী বলে আমি মনে করছি। আর আপনাকে সাহায্য করবার জন্য একজনকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করব।

পরে তিনি মিস জেন মারপল নামটি আমাকে লিখে দেন। তবে ঠিকানা দেননি। বলেছিলেন, আমি চাই আমার পছন্দমত পারিপার্শ্বিক অবস্থায় আপনার সঙ্গে তার স্বাভাবিকভাবে দেখা হোক।

এরপর তিনি এই ভ্রমণের কথা উল্লেখ করেন। এই ভ্রমণে আপনাকে আমি সহযাত্রী হিসেবে পাব একথা জানিয়েছিলেন।

আপনার সম্বন্ধে মিঃ রাফায়েল কেবল জানিয়েছিলেন, আপনি বয়স্ক, আর মানুষ সম্পর্কে আপনার ধারণা অতি স্বচ্ছ। আর…আর…অশুভ কিছু অনুধাবন করার অসাধারণ ক্ষমতা আপনার আছে। নিশ্চয়ই তিনি ভুল বলেননি?

–সম্ভবতঃ তাই। চারপাশের গণ্ডির মধ্যে কাছাকাছি অশুভ কিছু বা কেউ থাকলে আমি অনুভব করতে পেরেছি–এমন ঘটনা নানা সময়ে ঘটেছে বটে।

–এটা হলো অশুভ জানার শক্তি। যদি তেমন কিছুর আভাস পান তাহলে আমাকে জানাবেন। আমার বক্তব্য এখানেই শেষ। এবার আপনার কথা আমি শুনতে চাই।

মিস মারপল বললেন, কিভাবে এব্যাপারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম আপনাকে সংক্ষেপে জানাচ্ছি।

এরপর, মিঃ র‍্যাফায়েলের মৃত্যুর সংবাদ জানা, তার আইনজ্ঞদের চিঠি–সাক্ষাৎকার, তাদের দেওয়া প্রস্তাব…মিঃ র‍্যাফায়েলের চিঠি…ভ্রমণসংস্থার চিঠি প্রভৃতি সব ঘটনা খুলে জানালেন।

পরে বললেন, ভ্রমণের আসন সংরক্ষণের সংবাদ জানবার পরেই আমি বুঝতে পারি আমাকে যে কাজ করার প্রস্তাব মিঃ র‍্যাফায়েল করেছেন, ভ্রমণের ব্যাপারটা তার প্রথম পদক্ষেপ। এই ভ্রমণের মধ্যেই নিশ্চয় কোন সূত্র আমার দৃষ্টিগোচর হবে। আমার ধারণা তা হয়েছে।

একমুহূর্ত থেমে পুনরায় তিনি বললেন, গতকালের আগের দিন, এখানে পৌঁছবার পরেই তিনজন মহিলা এসেছিলেন আমাকে অভ্যর্থনা করতে। কাছেই পুরনো জমিদার ভবনে তারা থাকেন। তারা তাদের গৃহে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন।

–তারা কি মিঃ র‍্যাফায়েলের পরিচিত? জানতে চাইলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

-হ্যাঁ। তারা জানালেন, মিঃ র‍্যাফায়েলের কাছে শুনেছিলেন তার এক পুরনো বন্ধু ভ্রমণে আসবেন, তারা যেন তাকে দুই বা তিনদিন বাড়িতে আশ্রয় দেন। কারণ তার পক্ষে পাহাড়ে চড়া সম্ভব হবে না। আমাদের গতকালের ভ্রমণ সেখানেই ছিল।

–এটাকে আপনি কিভাবে গ্রহণ করছেন?

–এই যোগাযোগ আমার করণীয় কাজের সঙ্গেই যুক্ত বলে আমি মনে করি। মিঃ র‍্যাফায়েল চেয়েছিলেন আমি ওখানে যাই।

-আপনি সেখানে গিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, তবে তিন বোনকে দেখে খুবই সাধারণ বলেই মনে হলো। তারা যে বাড়িতে বসবাস করছে তার মালিক ছিলেন তাদের এক কাকা। তার মৃত্যুর পর বছর কয়েক আগে সেখানে এসেছে। তাদের অবস্থা খুব ভাল নয়, তবে খুবই অমায়িক।

ওদের দেখে মিঃ রাফায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিল বলে মনে হল না। তিন বোনের মধ্যে তফাতও যথেষ্ট।

-ওখানে থাকার সময়ে কিছু জানতে পেরেছেন?

–আপনি যে ঘটনা শোনালেন কিছুক্ষণ আগে সেই ঘটনাই শুনেছি। ওদের এক বয়স্ক পরিচারিকার কাছ থেকে। সে তাদের কাকার আমল থেকে ওই বাড়িতে আছে। মিঃ র‍্যাফায়েলের নামটাই শুধু সে শুনেছে।

মিঃ র‍্যাফায়েলের ছেলে মাইকেল এখানে বেড়াতে আসার সময় থেকে ব্যাপারটার সূত্রপাত হয়। খুবই খারাপ ছেলে ছিল সে। মেয়েটি তার প্রেমে পড়েছিল, সে তাকে গলা টিপে মেরেছিল।

আরও কি সব ও বলেছিল। জানিয়েছিল, পুলিসের ধারণা ছেলেটি এরকম খুন আগে আরও করেছে।

-এই ঘটনার সঙ্গে ওই তিন বোনের কোন যোগ আছে বলে মনে হয়নি আপনার?

–না। যোগাযোগ এটুকুই কেবল, মেয়েটি ওদের কাছেই প্রতিপালিত হয়েছিল। তারা মেয়েটিকে ভালবাসতো।

–অন্য কোন মানুষের কথা ওদের জানা অসম্ভব মনে হয় না। বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

-হ্যাঁ, এটাই জানতে হবে আমাদের। এমন একজন মানুষ যে ঈর্ষায় উন্মাদ হয়ে মেয়েটিকে হত্যা করে মুখ ক্ষতবিক্ষত করেছে।

-পুরনো ওই ম্যানর হাউসে আর কোন ঘটনা

–তেমন কিছু না। নজরে পড়ার মত কেবল ছোট বোনটি-বারবার বাগান সম্বন্ধে কথা বলতে চায়। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি, বাগান বা গাছলতা সম্পর্কে ও কিছুই জানে না।

-ওই বাগানের ব্যাপারটাই আপনার কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে?

-হ্যাঁ। ঠিক তাই। আচ্ছা, এই ভ্রমণে দুজন মাঝবয়সী মহিলাকে আপনার নজরে পড়েছে। মিস ব্যারো আর মিস কুক?

–হ্যাঁ, দুজন একসঙ্গেই ভ্রমণ করছেন।

–ওই মিস কুক–ভ্রমণের তালিকায় দেখলাম ওই নামই রয়েছে। কিন্তু আমার সন্দেহ এই মহিলাই-সেন্ট মেরী মিডে আমি যে গ্রামে থাকি সেখানে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি আমার বাগান দেখে খুশি হয়ে কথা বলেছিলেন। নাম বলেছিলেন বার্টলেট-বলেছিলেন ওই গ্রামেই নতুন এক বাড়িতে বাগানের কাজ করতে এসেছেন। আমার মনে হয়, সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেছিলেন।

কেন না, তখন তার চুল অন্যভাবে আঁচড়ানো ছিল, রঙও আলাদা ছিল। পোশাকের ধরনও অন্যরকম ছিল। ভ্রমণের প্রথম দিনেই দেখে চিনতে পেরেছিলাম। কোথায় দেখেছি বলাতে, না চেনার ভান করেছিলেন।

এখন বুঝতে পারছি, এই মিস কুক সেন্ট মেরী মিডে গিয়েছিলেন আমাকে দেখে নিতে যাতে পরে আমাকে চিনতে পারেন,

–আপনার এরকম মনে হল কেন?

-তা ঠিক বলতে পারব না। তবে ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না।

আমারও সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। এলিজাবেথ টেম্পলের যা ঘটেছে তা-ও ভাল ঠেকছে না। ওঁর সঙ্গে আপনি কথা বলেছিলেন?

-হ্যাঁ। ওই নিহত মেয়েটি সম্পর্কে তিনি আমাকে কিছু বলেছিলেন। মেয়েটি ওরই স্কুলের ছাত্রী ছিল।

মাইকেল র‍্যাফায়েল মেয়েটিকে বিয়ে করবে ঠিক হয়েছিল কিন্তু বিয়ে করেনি। মেয়েটি মারা গিয়েছিল।

মেয়েটির মারা যাবার কারণ আমি জানতে চেয়েছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন ভালবাসা। স্রেফ একটি শব্দ প্রয়োগ করেছিল। প্রথমে আমার ধারণা হয়েছিল আত্মহত্যা। কিন্তু এটা ছিল হত্যা।

ঈর্ষা বশে হত্যা–এবং দ্বিতীয় একজনের উপস্থিতিও স্পষ্ট। আমাদের এখন সেই মানুষটিকেই খুঁজে বার করতে হবে। মিস টেম্পল ভাল হয়ে উঠলেই তার সঙ্গে এনিয়ে আবার কথা বলব, তিনি সম্ভবত সেই অজানা লোকটি সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন।

–আর কোন সম্ভাবনা কোথাও আছে বলে আপনার মনে হয়?

–সম্ভাবনা কোচের যাত্রীদের মধ্যেও থাকা অসম্ভব নয়। আবার পুরনো ম্যানর বাড়িতে কারোরও থাকা সম্ভব। ওই তিন বোনের কেউ ওই মেয়েটি বা মাইকেলের বলা কথা হয়তো মনে রাখতে পারে।

ক্লোটিলডা মেয়েটিকে নিয়ে বিদেশেও গেছেন। বিদেশে কোথাও কিছু ঘটে থাকলে, সেটা তার পক্ষে জানা সম্ভব।

ওদের দ্বিতীয় বোন মিসেস গ্লাইন, বিয়ের পরে স্বামীর সঙ্গে বহুদিন ভারতবর্ষ ও আফ্রিকায় ছিলেন। তিনিও তার স্বামী বা আত্মীয়স্বজণের কারো কাছ থেকে নিহত মেয়েটির বিষয়ে কিছু শুনে থাকতে পারেন।

তৃতীয় বোনটি, যার বাগান সম্পর্কে খুব আগ্রহ, সে একটু বেশিমাত্রায় চঞ্চল। তবু আশা করা যেতে পারে নিহত মেয়েটির সম্ভাব্য প্রেমিক বা ছেলেবন্ধুর কথা জেনে থাকতে পারে।

কথা বলতে বলতে সামনের দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ওই যে সেই মেয়েটি হোটেলের পাশ দিয়ে চলেছে। একটা বড় পার্শেল দেখছি হাতে-মনে হয় মোড়ের মাথায় ডাকঘরে যাচ্ছে।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড মেয়েটিকে দেখলেন।

–কেমন একটু ক্ষ্যাপা ধরনের মনে হচ্ছে।

–আমারও তাই মনে হয়েছিল প্রথম যখন দেখি। আমার কথা এই পর্যন্তই। এখন আমি এক সমস্যায় পড়েছি–দুদিন এই হোটেলেই থাকবো না কোচে চেপে ভ্রমণে যাব–বুঝতে পারছি না।

.

১২.

মধ্যাহ্নভোজের আগে মিসেস স্যাণ্ডবার্ন হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে জানা গেল, মিস টেম্পলের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। তার সুস্থ হয়ে উঠতে কয়েকদিন লাগবে।

এই পরিস্থিতিতে তিনি ভ্রমণার্থীদের জানিয়ে দিলেন, দু-এক দিন পরে কাছাকাছি দ্রষ্টব্য ভাড়া গাড়িতে দেখানো হবে। ইতিমধ্যে যদি কেউ লণ্ডনে ফিরতে চান তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেবেন।

ডাইনিং হল থেকে বেরুবার মুখে প্রফেসর ওয়ানস্টেড মিস মারপলকে একপাশে ডেকে এনে বললেন, কাছাকাছি একটা গির্জা আছে, যদি বিকেলে যেতে চান আমার সঙ্গে আসতে পারেন।

–ভালই তো হয়। বললেন মিস মারপল।

.

বিকেলের আগেই ভাড়াগাড়িতে করে দুজনে বেরিয়ে পড়লেন। গ্রাম ছেড়ে গাড়ি অন্য রাস্তায় ঢুকলে প্রফেসর ওয়ানস্টেড বললেন, আমরা কিন্তু কোন গির্জা দেখতে যাচ্ছি না মিস মারপল।

–হ্যাঁ, আমি তা অনুমান করেছিলাম। বললেন মিস মারপল। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি আমরা?

–ক্যারিসটাউনের এক হাসপাতালে। মিস টেম্পল ওখানেই আছেন। মিসেস স্যাণ্ডবার্নের হাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার নামে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ আগেই আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম।

–তাঁর অবস্থা এখন কেমন?

-খুব ভাল নয়। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে আসছে–সেই সময় তিনি আপনার খোঁজ করছেন।

-বুঝতে পারছি না, তিনি কেন আমাকে ভাবছেন। তিনি মেয়েদের বিখ্যাত স্কুল ফেলোফিল্ডের প্রধান শিক্ষিকা-খুবই নামী মহিলা। তিনি যদি মারা যান সেটা খুবই দুঃখের হবে। কিন্তু ওই দুর্ঘটনার বিষয়ে আমাদের কিছু আলোচনা করা দরকার।

–হ্যাঁ, আমারও তাই ইচ্ছে। দুর্ঘটনার কথাটা আমাকে প্রথম জানিয়েছিল দুজন তরুণ-তরুণী। যোয়ান ক্রফোর্ড আর এমলিন প্রাইস।

তারা কি বলেছিল?

–যোয়ান জানাল সে আর এমলিন নিচের পথ ধরে পাহাড়ে উঠছিল। সেই সময় তারা কাউকে দেখেছিল। তবে মানুষটা পুরুষ বা স্ত্রীলোক বুঝতে পারেনি। সে বিরাট একখণ্ড পাথর ঠেলে দিতে চেষ্টা করছিল। সেই পাথরেই আহত হয়েছিলেন মিস টেম্পল।

-লোকটার সম্পর্কে যোয়ান আর কি জানিয়েছিল?

–জিনস বা ট্রাউজার পরা ছিল লোকটার। আর ছিল গলাবন্ধ লালকালো নক্সাআঁকা পুলওভার। মূর্তিটি সঙ্গে সঙ্গেই সরে যায়।

–তাহলে কি ইচ্ছাকৃতভাবেই মিস টেম্পলের ওপর আক্রমণ হয়েছিল?

-বুঝতে পারা যাচ্ছে না। আমাদের কোন সহযাত্রী অথবা অজানা কেউ সুযোগ বুঝে জায়গাটা বেছে নিয়ে থাকতে পারে।

–প্রচ্ছন্ন শত্রুর কথা বলছেন?

-হ্যাঁ। কিন্তু এমন একজন প্রখ্যাত শিক্ষয়িত্রীকে কে হত্যা করতে চাইবে? মিস টেম্পল মূর্তিটিকে চিনতে পেরেছিলেন কিনা তার কাছ থেকে জানা যেতে পারে।

–আপনি কি কোন বিশেষ ঘটনার কথা ভাবছেন?

–না, শুধু সম্ভাবনার কথাই ভাবছি। কোন ব্যক্তিগত শত্রুর কথা আমি বাদ দিচ্ছি। এমন হতে পারে মিস টেম্পল এমন কোন কিছু হয়তো জানতেন, যা প্রকাশ হয়ে পড়লে কারও পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।

-হ্যাঁ। আমার বিশ্বাস ব্যাপারটা তাই। আমাদের কোচেও এমন কেউ থাকা সম্ভব যে মিস টেম্পলকে চিনতে পেরেছিল, অথচ তিনি তাকে চিনতে পারেননি।

–কিন্তু ওই পুলওভার, যোয়ান যা উল্লেখ করেছিল–

টকটকে লাল-কালো রঙ-যা সহজেই চোখে পড়বার কথা…সেটা ইচ্ছাকৃতভাবেই দেখানো হয়েছিল বলে আমার ধারণা। সেই ব্যক্তি, পুরুষই হোক আর স্ত্রীলোকই হোক, ওই পোশাক খুলে যদি ডাক মারফত পার্সেল করে কোন ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়, কিংবা ফেলে দেয় বা পুড়িয়ে ফেলে নষ্ট করে ফেলে আর সাধারণ পোশাকে থাকে তাহলে কারোর সন্দেহের দৃষ্টিই তার দিকে পড়বে না।

–হ্যাঁ। অসাধারণ চাতুরি বলতে হবে।

–এমন হতে পারে মিস টেম্পলের কোন প্রাক্তন ছাত্রী বা তার অভিভাবক শ্রেণীর কেউ, মিস টেম্পল তার সম্পর্কে মারাত্মক কিছু জানতেন, তা প্রকাশ হবার সম্ভাবনা সে স্তব্ধ করতে চেয়েছে। বললেন মিস মারপল।

-হ্যাঁ, আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন, বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড, এখন দেখা যাচ্ছে মিঃ র‍্যাফায়েল ইচ্ছাকৃতভাবেই আপনার ভ্রমণের বিরতি ঘটিয়েছিলেন যাতে এখানেই আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে। আর–

আর আমাদের অজানা এমন কোন তথ্য জানতে পারি।

–অনেককাল আগে কয়েকটা খুনের ঘটনা পর পর ঘটে গিয়েছিল। জেসলিন সেন্ট মেরী থেকে দুটি মেয়ে অদৃশ্য হয় জানানো হয়েছিল। ছমাস পরে বেশ কয়েক মাইল দূরে একজনের দেহ পাওয়া যায়। তাকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল মাইকেল র‍্যাফায়েলের সঙ্গে।

–দ্বিতীয়জন?

–মেয়েটির নাম নোরা ব্রড। তার অনেক ছেলেবন্ধু ছিল শোনা যায়। তার দেহ পাওয়া যায়নি। কথা বলতে বলতে ক্যারিসটাউনের হাসপাতালের সামনে গাড়ি পৌঁছে গেল। গাড়ি থেকে নেমে প্রফেসরের সঙ্গে ভেতরে ঢুকলেন মিস মারপল। একজন তাকে সিস্টার বার্কারের ঘরে নিয়ে গেল। তাঁর সঙ্গেই প্রফেসর ফোনে কথা বলেছিলেন।

লম্বা কৃশকায় মহিলা সিস্টার বার্কার। মিস মারপলের সঙ্গে পরিচিত হবার পরে বললেন, হ্যাঁ, আপনার কথাই আমি জানিয়েছিলাম। কি ব্যবস্থা করা হয়েছে আপনাকে জানাচ্ছি।

এরপরে তিনি জানালেন, মিস টেম্পল প্রায় কোমার অবস্থায় রয়েছেন। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরলে তিনি আপনার নাম করছেন–প্রফেসর ওয়ানস্টেড নিশ্চয় আপনাকে বলেছেন। এবারে একটু ধৈর্য ধরে তার ঘরে একটু অপেক্ষা করতে হবে। জ্ঞান ফিরে উনি কিছু বললে আপনি তা লিখে নেবেন। অবশ্য এমনও হতে পারে জ্ঞান না ফিরে তিনি মারাও যেতে পারেন। একজন নার্স কাছাকাছিই পর্দার আড়ালে থাকবে। মিস টেম্পলের কথা লিখে নেবার জন্য একজন পুলিস অফিসারও ওখানে আছেন। তাকেও যাতে মিস টেম্পল দেখতে না পান ডাক্তার সেভাবেই ব্যবস্থা করেছেন। মিস টেম্পল আপনাকে যা বলতে চান নিশ্চয়ই তা বলবেন। আশা করি আপনার এতে অসুবিধা হবে না।

মিস মারপলকে নিয়ে সিস্টার বার্কার একটা ছোট কামরায় এলেন। ঘরে মৃদু আলো, জানালার পর্দা টানা। খাটে মিস টেম্পল শায়িতা।

সিস্টার বার্কার রোগিনীকে পরীক্ষা করে মিস মারপলকে পাশে একটা চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করলেন।

পর্দার আড়াল থেকে নোটবুক হাতে এক তরুণ এগিয়ে এল। সিস্টার বার্কার বললেন, ডাক্তার এরকমই বলেছেন মিঃ কেকিট।

একজন নার্সও এগিয়ে এল। সিস্টার বার্তার বললেন, দরকার হলে আমাকে ডেকো। আর মিস মারপলের দিকেও খেয়াল রেখো।

সিস্টার বার্কার চলে গেলেন। মিস মারপল চেয়ারেই বসে রইলেন। তার চোখ মিস টেম্পলের দিকে। মনে মনে বললেন, যথার্থ সুন্দরী মহিলা।

দশ, কুড়ি, ত্রিশ করে মিনিট এগিয়ে চলল। প্রায় একঘণ্টা পর আচমকা একটা শব্দ শোনা গেল–মিস পারপল।

চোখ খুলে এলিজাবেথ টেম্পল মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে আছেন। সম্পূর্ণ সুস্থ সে দৃষ্টি।

মিস মারপল। আপনি জেন মারপল?

আবার শোনা গেল সেই কণ্ঠস্বর।

–হ্যাঁ, আমিই জেন মারপল?

–হেনরি আপনার কথা প্রায়ই বলত।

–হেনরি?

–হেনরি ক্লিদারিং, আমার পুরনো বন্ধু।

–হেনরি ক্লিদারিং আমারও পুরনো বন্ধু। বললেন মিস মারপল।

-হেনরি থাকলেও একই কথা বলতো–আপনি অনুসন্ধান করতে পারেন। খুব জরুরী অনেক দিন আগের

মিস টেম্পলের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল। নার্স উঠে এসে তাঁকে এক চুমুক জল খাইয়ে দিয়ে চলে গেল।

–সম্ভব হলে আমি সাহায্য করব। বললেন মিস মারপল।

–এক মিনিট চোখ বুজে রইলেন মিস টেম্পল। তারপর আবার বললেন, দুজন–দুজনের মধ্যে কে তাই খুঁজে দেখতে হবে।

–একজন নোরা ব্রড–যে মারা গেছে?

-না না, অন্য মেয়েটি–ভেরিটি হান্ট। চুপ করলেন মিস টেম্পল। খানিক পরে আবার বললেন, মিস মারপল, আপনি…আপনার বয়স হয়েছে, তবুও আপনি পারবেন খুঁজে পার করতে।

আবার একটু থামলেন তিনি। এক মিনিট নীরবতা।

-বলুন, আপনি পারেন, তাই না? আমার আর বেশি সময় নেই…বুঝতে পারছি। ওদের দুজনের মধ্যে একজন তাকেই খুঁজে বার করতে হবে। আপনার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে–

–আমি করবো…অবশ্যই করবো…ঈশ্বর আমার সহায় হবেন।

–আঃ।

শান্তিতে দুচোখ বুজলেন মিস টেম্পল। মলিন ঠোঁটে যেন একটু হাসির রেখা ফুটল।

–ওপর থেকে এলো বিরাট পাথরের চাঙর।

–কে ঠেলে দেয় পাথরটা?

–বলতে পারব না। ওসব যাক–কেবল ভেরিটি–সত্যের আরেক নাম ভেরিটি। মিস টেম্পলের শরীর কেমন শ্লথ হয়ে এলো। অস্পষ্ট স্বর শোনা গেল–বিদায়…যতটুকু পারেন করবেন…

নার্স উঠে এলো। নাড়ি দেখলো। মিস মারপলকে ইঙ্গিত করলো। তিনি উঠে বাইরে চলে এলেন।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড এগিয়ে এলেন। দুজনে পায়ে পায়ে গাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন।

-কিছু পেলেন?

–পেলাম একটা নাম, বললেন মিস মারপল, ভেরিটি–মেয়েটির কি ওই নাম ছিল?

–হ্যাঁ, ভেরিটি হান্ট।

এলিজাবেথ টেম্পল জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তাঁর জ্ঞান আর ফেরেনি। দেড় ঘণ্টা পরেই তিনি মারা গেলেন।

.

১৩.

ভ্রমণে বেরুবার আগে তাদের বাড়িতে দুদিন থাকার জন্য মিস মারপলকে অনুরোধ করে নিয়ে এসেছিলেন মিসেস গ্লাইন।

কোচ ভ্রমণ শুরু হবে মিস টেম্পলের স্মৃতি অনুষ্ঠানের পরে। পরদিন হবে ইনকোয়েস্ট। কোচের যাত্রীরা তাতে অংশ নিতে রাজি হয়েছেন।

মিস মারপল সেই প্রাচীন ম্যানর হাউসের বসবাস ঘরে বসে একটা স্কার্ফ বুনছিলেন।

বোনার কাঁটা নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় নিজের মনেই তিনি বলে উঠলেন–ভেরিটি

নামটা শুনে তার গৃহকর্ত্রীদের কার কি প্রতিক্রিয়া হয়, তা লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যেই তিনি ওই নামটি অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন।

এলিজাবেথ টেম্পলের সর্বশেষ কথা ছিল এটাই–ভেরিটি।

-এরপর যখন তিনি কোচের যাত্রীদের সঙ্গে সান্ধ্যভোজে মিলিত হবেন, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া একবার দেখবেন ঠিক করেছেন।

সামনেই বসেছিলেন তিন বোন। চশমার আড়াল থেকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তিন বোনকে লক্ষ্য করছিল।

মিসেস গ্লাইনের হাতে একটা বই ছিল। বইটা সহসা তার হাত থেকে পড়ে গেল। তিনি অবাক হয়ে মিস মারপলের দিকে তাকালেন।

ক্লোটিলডা কিন্তু মিস মারপলের দিকে না তাকিয়ে মাথা উঁচিয়ে জানালার দিকে তাকাল। তার দুহাত মুষ্ঠিবদ্ধ হল।

চোখের কোণে মিস মারপল দেখলেন, ক্লোটিলডার চোখ জলে ভরে উঠেছে। গাল বেয়ে অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে নামছে।

অ্যানথিয়ার প্রতিক্রিয়া হল সম্পূর্ণ অন্য রকম। সে খুশিভরা গলায় বলে উঠল, ভেরিটি? আপনি তাকে জানতেন? ভেরিটি হান্টকে?

মিস মারপল বললেন, এ নামে আমি কাউকে জানতাম না। আমি দুঃখিত…আপনারা দুঃখ পাবেন জানলে আমি বলতাম না।

-না তা নয়, মিসেস গ্লাইন বললেন, নামটা আমাদের জানা, ওর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল।

হঠাৎ মনে এসে গেল, বললেন মিস মারপল, গতকাল বিকালে দেখা করতে গেলে মিস টেম্পল নামটা বলেছিলেন। নামটা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। হয়তো ওই নামের কথা তিনি ভেবেছিলেন। আবার হয়তো তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন সত্য–ভেরিটির অর্থও তো মনে হয় তাই, তাই না?

মিস মারপলের সতর্ক দৃষ্টি পর পর তিন বোনের মুখভাব ছুঁয়ে গেল।

-নামটা আমাদের পরিচিত এক মেয়ের, তাই চমকে গিয়েছিলাম। বললেন মিসেস গ্লাইন।

–ওর মৃত্যুটা ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। অ্যানথিয়া বললেন।

–অ্যানথিয়া, অত বর্ণনা দেবার কি আছে? ধরা গলায় বললেন ক্লোটিলডা।

–সকলেই তো জানে, বললেন অ্যানথিয়া, মিঃ র‍্যাফায়েল নিশ্চয়ই আপনাকে তার সম্বন্ধে বলেছেন, তাই না?

–কোন ব্যাপারটা বলছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বললেন মিস মারপল।

–ওর দেহটা ওরা একটা নালায় পড়ে থাকতে দেখেছিল। বললেন অ্যানথিয়া।

ক্লোটিলডা রুমাল বের করে চোখের জল মুছলেন। তার দুচোখে গভীর বিষাদ মাখানো।

–ভেরিটিকে আমরা খুবই ভালবেসেছিলাম, বললেন ক্লোটিলডা, সে এখানেই কিছুদিন ছিল।

–সেও তোমাকে খুব ভালবাসতো। বললেন ল্যাভিনিয়া।

–ওর বাবা-মা আমার বন্ধু ছিলেন। তারা এক প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গেলে আমি তাকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলাম।

–ভেরিটি ফেলোফিল্ডের স্কুলে পড়ত। সেই জন্যেই হয়তো মিস মারপল তাকে মনে রেখেছিলেন। বললেন ল্যাভিনিয়া।

মিস টেম্পল শুনেছি সেখানে প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। বললেন মিস মারপল।

হ্যাঁ আমার কাছেই মানুষ হয়েছিল। বললেন ক্লোটিলডা, খুব ভাল মেয়ে ছিল। পড়াশুনায়ও চমৎকার মাথা ছিল। মিস টেম্পল ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা বলেছিলেন। ওর কথা বলতে আমার বড় কষ্ট হচ্ছে।

-না না, থাক, বললেন মিস মারপল, আমি দুঃখিত, না জেনে দুঃখ জাগিয়ে তুলেছি, আমি অত সব শুনিনি…

.

সেইদিনই সন্ধ্যায় মিস মারপল হোটেলের সকলের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য পোশাক পরিবর্তন করছিলেন। এমন সময় মিসেস গ্লাইন ঘরে ঢুকলেন।

দু-একটা অন্য কথার পর বললেন, ভেরিটি হান্টকে আমার বোন ক্লোটিলডা দারুণ ভালবাসতো। তার মৃত্যুতে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।

মিস মারপল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন।

–আসলে বছর ষোল বয়সে ভেরিটি একটা বদ ছেলের পাল্লায় পড়েছিল। ছেলেটা ছিল অপরাধী। আপনাকে সব কথাই বলছি…আসলে মিঃ র‍্যাফায়েলের ছেলে…

-ওঃ হ্যাঁ, মনে পড়ছে একবার শুনেছিলাম তার একটি ছিল ছিল…তেমন ভাল নয়…

–খুবই বদ ছেলে-খুব অল্প বয়সেই একটা মেয়েকে অত্যাচারের জন্য জেল খেটেছিল…। চেক জাল করা, চুরি কোন কিছুই বাদ ছিল না তার। ওর মায়ের বন্ধু ছিলাম আমরা।

মিঃ র‍্যাফায়েল ছেলের জন্য সবই করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ছেলেটি তার কাছে একটা বড় আঘাত হয়ে উঠেছিল।

এখান দিয়ে যাবার সময় একবার সে এখানে আসে। সেই সময় এই জেলায় পর পর অনেকগুলো খুনের ঘটনা ঘটেছিল।

ভেরিটি একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যায়। কিন্তু আর ফিরে আসেনি। আমরা পুলিসকে জানিয়েছিলাম। কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলাম। পুলিস জানতে পেরেছিল তাকে মাইকেল র‍্যাফায়েলের সঙ্গে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল।

আগে থেকেই কিছু অপরাধের জন্য মাইকেলের ওপর পুলিসের নজর ছিল। অবশ্য সেসবের তেমন প্রমাণ ছিল না।

দুমাস পরে একটা জঙ্গলের কাছে নালায় ভেরিটির দেহ পাওয়া গিয়েছিল। ক্লোটিলডাকেই সনাক্ত করতে যেতে হয়েছিল। বেচারী ভেরিটি। তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওর কাপড়জামা, হাতব্যাগ সবই ছিল। মিস টেম্পল ভেরিটিকে খুবই স্নেহ করতেন, তাই মৃত্যুর আগে তার কথাই ভেবেছিলেন।

গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন মিস মারপল।

–আমি সত্যই দুঃখিত। আপনার বোনকে বলবেন, আমি কিছুই জানতাম না।

.

১৪.

ইনকোয়েস্ট বসবে মার্কেট প্লেসের কাছে একটা পুরনো জর্জিয়ান আমলের বাড়িতে। কারফিউ আর্মস বাড়িটার নাম।

মিস মারপল গ্রামের রাস্তা ধরে সেদিকে চলেছিলেন। এখনো কুড়ি মিনিট বাকি…তাই ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন তিনি।

পথের পাশে দোকানের সারি। একটা পশমের দোকান দেখতে পেয়ে দাঁড়ালেন। কাউন্টারের সামনে একজন বয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন।

মিস মারপল ব্যাগ থেকে একটুকরো পশম বার করে পশমের রঙ মেলাতে মেলাতে বয়স্ক মহিলার সঙ্গে কথা শুরু করলেন।

জানা গেল মহিলার নাম মিসেস মেরীপিট। মিস টেম্পলের দুর্ঘটনার খবরও জানেন। জানালেন একবছরে ওরকম তিনটে পাথর গড়িয়ে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

-খুবই দুঃখের কথা। বললেন মিস মারপল।

-আজ করোনার হয়তো এসব বিষয়ে কিছু বলবেন। রাস্তা সারাবার ব্যাপারে করোনারের কোন দায়িত্ববোধই নেই।

মিস মারপল পুলওভার নিয়ে কথা বললেন। খুব উজ্জ্বল রঙের। মিথ্যা করে জানালেন, তাঁর এক নাতির জন্য।

বিদায় নেবার আগে মিস মারপল এ অঞ্চলের আগের খুনের ঘটনাগুলোর প্রসঙ্গ তুললেন।

–পুলিস সেই খুনে লোকটিকে গ্রেপ্তার করেছে, বললেন মিসেস মেরীপিট, চমৎকার সুন্দর ছেলে, ওর বাবা নাকি মস্ত ধনী। দুটি মেয়েকে নাকি খুন করেছিল। আমার মনে হয় ও মানসিক রোগগ্রস্ত। চুরিডাকাতি, চেক জালকরা এমনি অনেক অভিযোগই ছিল তার নামে।

-একটা মেয়ের দেহ তো শুনেছি পাওয়া গিয়েছিল।

–হ্যাঁ। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ওটা নোরা ব্রড। সে হল মিসেস ব্রডের ভাইঝি। ছেলে পাগল মেয়ে। একইরকম ভাবে বাড়ি থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তাই ছমাস পরে যখন দেহটা পাওয়া গেল সকলে নোরা ব্রড বলেই মনে করেছিল।

–তবে কি অন্য কেউ

-হ্যাঁ, অন্য একজন। ওর কোন সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। ওরা বলে ওর মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে, নয়তো মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। কে বলবে কি হয়েছে।

–যে মেয়েটি খুন হয়েছে সে তো এই অঞ্চলেই থাকতো শুনেছি। বললেন মিস মারপল।

-ও হ্যাঁ, যার দেহ প্রথমে নোরা ব্রডের মনে করেছিল পুলিস? মেয়েটার নামটা ভুলে গেছি…হোপে না ভেরিটি…এমনি কিছু হবে। ম্যানর হাউসে থাকতো।

–ওর বাবা-মা দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল?

-হ্যাঁ। মেয়েটি ওখানেই থাকতো। সম্ভবত মিসেস গ্লাইন মেয়েটির মায়ের বন্ধু ছিলেন। সবচেয়ে বড় বোন ক্লোটিলডা মেয়েটিকে খুব ভালবাসতেন। সে উধাও হলে তিনিই খুব ভেঙ্গে পড়েন।

–তিন বোনের ছোট সম্ভবত অ্যানথিয়া তাই না।

-হ্যাঁ, উনি একটু অন্যরকম। লোকে বলে কেমন নাকি একা একা ঘুরে বেড়ান…কথা বলতে বলতে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকান হঠাৎ হঠাৎ। আমি অবশ্য জানি না। গ্রামের লোকের মুখেই শোনা যায়। ওই মেয়েটির মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে নাকি ওর মধ্যে খুশির ভাব জেগেছিল। অদ্ভুত কাণ্ড।

বিদায় জানিয়ে মিস মারপল পথে নামলেন। এখনো দশ মিনিট হাতে আছে। তিনি ডাকঘরের দিকে চললেন। সেটা মার্কেট স্কোয়ারের পাশেই।

মধ্যবয়স্কা এক মহিলা কাউন্টারের পেছনে ছিলেন তাঁর কাছ থেকে কিছু ডাকটিকিট কিনলেন মিস মারপল।

দু-একজন আরো লোক ছিল। তারা কাজ সেরে চলে গেল। মিস মারপল তাকিয়ে দেখলেন, চারদিক খালি। তিনি সন্তর্পণে জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন।

–মাপ করবেন, একটু বিরক্ত করব আপনাকে। আমি মস্ত একটা ভুল করে ফেলেছি। আসলে যত বয়স বাড়ছে ততই সব কেমন ভুলভাল হয়ে যাচ্ছে দেখছি। দানের জন্য কিছু কাপড় পার্সেল করে পাঠিয়েছিলাম…ঠিকানাও লিখেছিলাম…আজ সকালেই দেখলাম ভুল ঠিকানা লেখা হয়ে গিয়েছিল।

আপনারা পাঠানো পার্শ্বেলের তালিকা রাখেন কিনা জানি না…তবে ঠিকানাটা যদি মনে থেকে থাকে। আসলে আমি লিখতে চেয়েছিলাম দি ডকইয়ার্ড অ্যাণ্ড টেমসসাইড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন।

পোস্ট মিস্ট্রেস মিসেস ভিনিগার সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালেন মিস মারপলের দিকে। বয়স্ক মানুষের ভুলভ্রান্তির ব্যাপারটা তার অজানা নয়।

–আপনি নিজে এসেছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন।

-না, ওদের একজন কেউ এসেছিল। আমি ম্যানর হাউসে আছি। মিসেস গ্লাইন বলেছিলেন, তার এক বোনকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন।

-ও, হ্যাঁ, আচ্ছা…মঙ্গলবারে, তাই না? মনে পড়েছে…ওদের সবচেয়ে ছোট বোনটি মিস অ্যানথিয়া নিয়ে এসেছিল পার্সেলটি।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই দিনই হবে।

–আমার মনে পড়ছে। বেশ ভারিই ছিল…কিন্তু যেরকম বললেন ঠিকানা তো তা ছিল না। ওতে লেখা ছিল রেভারেণ্ড ম্যাথুজ-দি ইস্টহ্যাম উইমেন অ্যাণ্ড চিলড্রেন উলেন ক্লোদীং অ্যাপীল।

–হ্যাঁ, হা, দু হাত জড়ো করে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মিস মারপল এমনি ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ঠিক মনে রেখেছেন দেখছি, বড়দিনের সময় কিছু জামাকাপড় আমি ওদের পাঠিয়েছিলাম। ওদের ঠিকানাটাই ভুল করে লিখে ফেলেছিলাম। দয়া করে ঠিকানাটা আর একবার বলুন।

মিস মারপল তাঁর নোটবই বার করে ঠিকানাটা টুকে নিলেন।

মিসেস ভিনিগার বললেন, কিন্তু পার্সেলটা তো পাঠানো হয়ে গেছে।

-আমি ওদের ভুলের কথা লিখে পার্সেলটা ডকইয়ার্ড অ্যাসোসিয়েশনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে বলতে পারব। ওঃ অনেক উপকার করলেন…অজস্র ধন্যবাদ।

মিস মারপল ডাকঘর থেকে বেরিয়ে পথে নামলেন।

.

ইনকোয়েস্টে ডঃ স্টোকস একে একে সকলের সাক্ষ্য নিলেন। মস্তিষ্কের আঘাতের ফলেই মিসেস টেম্পেলের মৃত্যু হয়েছিল পুলিসের ও ডাক্তারি সাক্ষ্যে একথা জানানো হলো। মিসেস স্যাণ্ডবার্ন কোচ ভ্রমণের সব ব্যবস্থা, আর বিকেলে কিভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেকথা জানালেন।

এরপর যোয়ান ক্রফোর্ডের আহ্বান এলো। তার নাম বয়স জেনে নেবার পর ডাঃ স্টোকস তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি দলের সকলের সঙ্গে হাঁটছিলেন।

-না, আমরা রাস্তা ছেড়ে অন্য দিকে ঘুরে ওপরে উঠছিলাম।

–আপনার একজন সঙ্গী ছিল?

–হ্যাঁ, মিস এমলিন প্রাইস।

–আপনারা মিস টেম্পলকে দেখতে পেয়েছিলেন?

-বাঁক ঘোরার সময় মনে হয় তাকে দেখেছিলাম। এরপর পাহাড়ের আড়ালে চলে যাওয়ায় আর দেখতে পাইনি।

–আপনাদের সামনে পাহাড়ের উঁচুতে কাউকে দেখেছিলেন?

–হ্যাঁ, পাহাড়ের ওদিকে অনেক পাথরের চাঁই ছিল।

–আপনি ওখানে কাউকে দেখেছিলেন?

–হ্যাঁ, কেউ পাথরের চাঁই ঠেলছিল।

–যাকে আপনি দেখেছিলেন সেকি পুরুষ ছিল?

–অত উঁচুতে ঠিক বুঝতে পারা যায়নি। তবে পুরুষ বা স্ত্রীলোক যেই ঠেলে থাকুক, পাথরটা আলগা হয়েছিল।

–আসলে ওখানে কে ছিল ভাবছেন, কোন পুরুষ না স্ত্রীলোক?

–যেই হোক, তার গায়ে ট্রাউজার আর পুলওভার ছিল। পোশাকটা পুরুষেরই যোগ্য।

–পুলওভারের রঙ কি রকম ছিল?

–গাঢ় লাল আর কালো নকশা। লম্বা কিছু দাগও ছিল–ওরকম পুলওভার পুরুষেরই হওয়া সম্ভব।

-এরপর কি হলো?

-এরপর পাথরটা গড়াতে শুরু করল। আমি আর এমলিন একটা আর্তনাদ শুনতে পেলাম।

-তারপর?

–আমরা বাঁকটা ঘুরে ছুটে গেলাম কি হল দেখতে।

–কি দেখলেন?

–পাথরের নিচে একটা দেহ–আর অন্য সকলে ছুটে আসছে।

–আর্তনাদ কি মিস টেম্পলই করেছিলেন?

–আমার ধারণা তাই। তবে বাঁক ঘুরে যারা এসেছিলেন তাদের কেউও হতে পারেন। ওঃ কী মর্মান্তিক।

–সেই লাল আর কালো পুলওভার পরা ওপরের মূর্তির কি হল? সে কি তখনও ওই পাথরের চাঁইগুলোর কাছেই ছিল?

–তা বলতে পারিনি। সেদিকে আর তাকাইনি মনে হয়।

–ওই মূর্তি আপনাদের যাত্রীদলের কেউ হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

–ওঃ না, আমি নিশ্চিত। আমাদের মধ্যে ওরকম লাল-কালো পুলওভার পরা কেউ ছিলেন না।

-ধন্যবাদ মিস ক্রফোর্ড।

এরপর সাক্ষ্য দিতে উঠল এমলিন প্রাইস। তার কাহিনী যোয়ানারই মত।

সবার সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হলে করোনার ঘোষণা করলেন মিস টেম্পলের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হবার মত যথেষ্ট প্রমাণ নেই। তাই ইনকোয়েস্ট মুলতবী রইল।

.

১৫.

ইনকোয়েস্ট থেকে সকলে গোল্ডেনবোর হোটেলে ফেরার পথে চলতে চলতে মিস মারপল প্রফেসর ওয়ানস্টেডকে জিজ্ঞেস করলেন, এরপর কি হবে?

পুলিসের তদন্ত হবে আরো। ওই দুজনের সাক্ষ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

-হ্যাঁ।

করোনার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তদন্ত চলবে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে এমন রায় করোনার দিতে পারবেন না আশা করি।

–সেটা কেউই আশা করে না। ওদের দুজনের সাক্ষ্য সম্বন্ধে আপনার কি মনে হল?

প্রফেসার ওয়ানস্টেড পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালেন মিস মারপলের দিকে। বললেন, এব্যাপারে আপনার কি কোন ধারণা আছে? ওরা কি বলবে তা অবশ্য আগেই আমরা জানতাম।

–ওদের বলা ওই লাল-কালো পুলওভার ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বললেন মিস মারপল।

–আমারও তাই ধারণা।

–আমি মনে করছি, একটা মূল্যবান সূত্রের সন্ধান এ থেকে আমরা পেতে পারি।

কথা বলতে বলতে ওঁরা হোটেলে পৌঁছে গেলেন। ততক্ষণে অন্যান্যরাও পৌঁছে গিয়েছিলেন। মধ্যাহ্নভোজের আগে সকলকেই টম্যাটোর রস, শেরী ও অন্যান্য সুরা পরিবেশন করা হয়েছিল।

মিসেস স্যাণ্ডবার্ন সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি করোনার এবং পুলিস ইনপেক্টরের পরামর্শ নিয়েছি, আপনাদের সেকথা জানাচ্ছি। মেডিক্যাল সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সেইকারণে আগামীকাল সকাল এগারোটায় গির্জায় স্মৃতিবাসর অনুষ্ঠিত হবে।

একটু পরেই আমি স্থানীয় ভিকার মিঃ কোর্টনির সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি। স্মৃতিবাসরের পরদিনই আমাদের ভ্রমণ শুরু করতে চাই।

ইতিমধ্যে দু একজন লণ্ডন ফিরে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সন্দেহ নেই এই মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি বিশ্বাস করি, মিস টেম্পলের মৃত্যু দুর্ঘটনার ফলেই ঘটেছে। অবশ্য এব্যাপারে এখনো পুলিসি তদন্ত হবে।

কোন ভ্রমণকারী খেলাচ্ছলেও ওই পাথরটা ঠেলে থাকতে পারেন। সেকথা তার এগিয়ে এসে বলা উচিত। এটা আমরা সকলেই বিশ্বাস করি যে মিস টেম্পলের মত মহিলার কোন শত্রু ছিল না। যাইহোক, এই দুঃখজনক ঘটনা নিয়ে আমরা আর কোন আলোচনা করব না…আমাদের মন ভাল রাখার জন্যই।

কিছুক্ষণ পরেই মধ্যাহ্নভোজ শেষ হল। মিস টেম্পলের মৃত্যু নিয়ে কেউই আর কোন কথা বললেন না।

–আপনি কি ভ্রমণে যাবেন?

প্রফেসার ওয়ানস্টেড মিস মারপলকে জিজ্ঞেস করলেন।

-না। এখানেই আরও কয়েকদিন থাকা দরকার বলে আমি মনে করছি। বললেন মিস মারপল।

–থাকবেন কোথায়? গোল্ডেনবোরে না ওই জমিদার বাড়িতে?

-সেই সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমি অপেক্ষা করছি ম্যানর হাউস থেকে আর কোন আমন্ত্রণ পাই কিনা। আগে আমাকে দুদিনের জন্য নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। অবস্থা বুঝে দরকার মত গোল্ডেনবোরেই থেকে যাব না হয়।

–সেন্ট মেরী মিডে আপাতত ফিরতে চাইছেন না?

–এখানে থেকে দু-একটা কাজ আমাকে করতে হবে। একটা অবশ্য ইতিমধ্যে করেও ফেলেছি। আপনি কি সকলের সঙ্গেই যাচ্ছেন?

–আপনার কোন প্রয়োজনে লাগতে পারি বলে মনে করছেন আপনি?

–যদি যান তাহলে আপনাকে একটা তদন্তের কথা বলব। তাতে আমার খুবই উপকার হবে। এখানে আমার থাকার বিশেষ কারণ হল স্থানীয়ভাবে কিছু খোঁজখবর নিতে চাই। ফলাফল কি হবে তা অনিশ্চিত বলেই এখন কিছু বলতে চাইছি না আপনাকে।

-লণ্ডনে কিছু জরুরী কাজের জন্য আমার ফিরে যাওয়া দরকার। তবে এখানে আপনার কোন কাজে লাগলে থেকে যাবো।

–এখনই কোন সাহায্যের দরকার পড়বে মনে করছি না। এদিকে আপনারও নিজস্ব কোন কাজ আছে আমার মনে হয়।

–আমি কেবল আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যই এই ভ্রমণে এসেছিলাম।

-আমার সঙ্গে তো দেখা হল আপনার। আমি যা জানি তা-ও এখন আপনার আর অজানা নেই। আপনার নিজের ক্ষেত্রেও যে কিছু খোঁজ করার রয়েছে তা আমি বুঝতে পারি। তবে এখান থেকে যাওয়ার আগে মনে হয় আপনাকে দিয়ে কিছু সাহায্য হতে পারে।

–আপনার কি কিছু ধারণা হয়েছে? সেই অশুভ কিছুর গন্ধ পেয়েছেন?

–এখনও স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা খুব সুবিধার মনে হচ্ছে না।

–আর মিস টেম্পলের মৃত্যুও যে দুর্ঘটনা নয় তাও বুঝতে পারছেন?

–এটা দুর্ঘটনা নয়। একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছেন।

–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। তীর্থযাত্রা কোথায় বা কার কাছে, আপনাকে কি তা জানিয়েছিলেন?

-না, মিস মারপল বললেন, আমার বিশ্বাস দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু না হলে তিনি আমাকে বলতেন।

–কিছু কি অনুমান করতে পেরেছেন?

–না। তবে বুঝতে পারছি তার এই তীর্থযাত্রা মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি যেখানে যেতে চেয়েছিলেন বা যার সঙ্গে দেখা করতে চলেছিলেন, তা তাঁকে করতে দেওয়া হয়নি। দৈবানুগ্রহ না হলে তা আর জানার উপায় নেই।

এজন্যেই কি এখানে থেকে যাচ্ছেন?

–আরও একটি বিষয় আছে। নোরা ব্রড নামে একটি মেয়ের সম্পর্কেও খোঁজখবর নিতে হবে।

–নোরা ব্রড! চিন্তিত হলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

-হ্যাঁ, এই মেয়েটি ভেরিটি হান্টের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে অদৃশ্য হয়। কথাটা আপনিই আমাকে বলেছিলেন, নিশ্চয় আপনার মনে আছে। মেয়েটির অনেক ছেলেবন্ধু ছিল। ওর সম্পর্কে আরও কিছু জানতে পারলে আমার তদন্তের সুবিধা হতে পারে।

–বেশ, তাহলে নিজের পথেই চলুন। বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

.

পরদিন যথাযযাগ্য মর্যাদা সহকারে মিস টেম্পলের স্মৃতিবাসর অনুষ্ঠিত হল। ভ্রমণ দলের সকলেই উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অনেকের সঙ্গে মিসেস গ্লাইন ও তার বোন মিস ক্লোটিলডাও ছিলেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন একজন শুভ্রকেশ বয়স্ক পাদ্রী।

গির্জা ছেড়ে বেরিয়ে আসার পথে মিস মারপল জানতে পারলেন অনেকে ফিরে যাওয়া মনস্থ করলেও যেকজন থাকবেন তাদের নিয়েই ভ্রমণ-কর্মসূচী চলবে।

মিস মারপল নিজের মনেই গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চললেন। তিনি হাতব্যাগ থেকে একটুকরো কাগজ বার করে দেখে নিলেন। তাতে দুটো ঠিকানা লেখা ছিল।

প্রথম ঠিকানা হল এক মিসেস ব্ল্যাকেটের রাস্তার শেষে ছোট বাগানবাড়িতে তিনি থাকেন।

তাকে বাড়িতে পাওয়া গেল। মিস মারপলকে সাদরে বসার ঘরে নিয়ে বসলেন মিসেস ব্ল্যাকেট।

মিসেস মারপল একগ্লাস জল চেয়েছিলেন। স্মৃতিবাসর থেকে ফেরার পথে অসুস্থ বোধ করছেন বলে তিনি জানান।

একগ্লাস জল অতিথির দিকে এগিয়ে দিয়ে মিসেস ব্ল্যাকেট বললেন, মহিলাটি তাহলে দুর্ঘটনায় মারা গেলেন? আমারও তাই ধারণা অবশ্য। করোনার সবকিছুর মধ্যেই অপরাধের গন্ধ পায়।

–হ্যাঁ, বরাবরই এরকম হয়। আমি একটা মেয়ের কথা শুনেছিলাম, নোরা ব্রড

-হ্যাঁ, নোরা! সে আমার পিসতুতো বোনের মেয়ে। বড় উছুঙ্খল–আমি বারবার বলেছি। আমার বোন ন্যানসি ব্রডকে। অমন করে ছেলেদের পেছনে লেগে থাকলে গণ্ডগোল না হয়ে পারে? শেষে হলও তাই।

–আপনি বলতে চাইছেন

–হ্যাঁ, ছেলেটি এখানেই বাস করছিল। নোরা চলে গেলে বেচারি খুবই ভেঙ্গে পড়েছিল।

–নোরা চলে গিয়েছিল?

–একজন অচেনা লোকের গাড়িতে তাকে দেখা গিয়েছিল। লোকে বলে ওই গাড়িতে চড়ার পরেই সে খুন হয়। আমার মনে হয় না এরকম কিছু ঘটেছে, তাহলে এতদিনে তার দেহ পাওয়া যেত।

–তাই মনে হয়। বললেন মিস মারপল।

–অনেকদিন হয়ে গেল, সাত আট বছর প্রায়, আমার ধারণা ও ফিরে আসবে।

–আপনার বোন ছাড়া সে কি আর কোথাও যেত?

-হ্যাঁ, ওই পুরনো জমিদার বাড়ির বোনেদের কাছে যেত। মিস ক্লোটিলডা তাকে খুব ভালবাসতেন। পড়াশুনায় মনোযোগী হবার জন্য অনেক বোঝাতেন। সে কোন কথাই কানে তোলেনি। তবু ভাল বলব, ম্যানর বাড়ির সেই…নামটা ভুলে গেছি, মেয়েটির মতো তাকে খুন হতে হয়নি।

এমনি আর দু-চার কথা বলার পর মারপল শরীর ঠিক হয়ে গেছে বুঝতে পেরে মিসেস ব্ল্যাকেটকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন।

মিস মারপলের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ওঃ নোরা ব্রড, সে তো অনেক দিন গ্রামে নেই। কারও সঙ্গে চলে গিয়েছে–ছেলেদের সঙ্গেই তো রাতদিন ঘুরে বেড়াতো। আপনি কি কোন দরকারে ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন?

-হ্যাঁ, আমার এক বন্ধুর চিঠি পেয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। তুমি ওর সঙ্গেই স্কুলে পড়তে, তাই না?

-হ্যাঁ, আমরা এক ক্লাসেই পড়তাম। কিন্তু বরাবর ছেলেপাগল ছিল। যে-ই ওকে ডাকতো, তার সঙ্গেই গাড়িতে উঠত। ওরকম একটা গাড়িতে ওঠার পরেই তাকে আর দেখা যায়নি। তবে রক্ষা এটাই যে ওকেও খুন হতে হয়নি।

যাইহোক, তাহলে আর দেখা হল না।

নিজের মনে বলতে বলতে বিদায় নিলেন মিস মারপল।

৪. আর্চডিকন ব্রাবাজন

১৬.

আর্চডিকন ব্রাবাজন। গোল্ডেনবোরের লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করছিলেন মিস মারপলের সঙ্গে দেখা করবেন বলে।

মিস মারপল দেখেই চিনতে পারলেন। এই পাদ্রীকেই স্মৃতিবাসরে দেখেছিলেন।

প্রাথমিক আলাপ পরিচয় সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর দুজন পাশাপাশি চেয়ারে বসলেন।

–আপনার কাছে আমি সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ, বললেন ব্রাবাজন, ক্যারিসটাউনের হাসপাতাল হয়ে এসেছি আমি। এলিজাবেথ টেম্পল আমার এক পুরনো বন্ধু ছিলেন। মেট্রন জানালেন, মৃত্যুর আগে এলিজাবেথ আপনার সঙ্গেই শেষবারের মত কথা বলেছেন।

–হ্যাঁ। আমাকে ডেকে পাঠানোতে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। বললেন মিস মারপল। ভ্রমণের সময়েই তার সঙ্গে দেখা হয়।

–তিনি আমার সঙ্গেই দেখা করতে আসছিলেন। আমি ফিলমিনস্টারে বাস করি–আপনাদের কোচ আগামী পরশুদিন সেখানে পৌঁছবে। তিনি আমার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা বলতে চেয়েছিলেন।

বুঝতে পেরেছি। বললেন মিস মারপল, আমার ভেরিটি নামে একটি মেয়ের সম্পর্কে কথা বলছিলাম।

-হ্যাঁ, ভেরিটি হান্ট। বেশ কয়েক বছর আগেই সে মারা গেছে। আপনি জানতেন? বললেন আর্চডিকন।

-হ্যাঁ। ভেরিটি মিঃ র‍্যাফায়েলের ছেলের সঙ্গে বিয়ের জন্য বাগদত্তা ছিল। আপনি কি তার সম্পর্কে কোন খবর দিতে পারেন?

আর্চডিকন গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলেন মিস মারপলকে। পরে বললেন, আপনি মনে হচ্ছে কোন ভাবে এর সঙ্গে জড়িত।

-হ্যাঁ জড়িত। মিঃ র‍্যাফায়েলের মৃত্যুকালীন ইচ্ছা অনুযায়ীই আমি মাইকেলের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে বেরিয়েছি।

এক মিনিট নীরব হয়ে রইলেন বৃদ্ধ আর্চডিকন।

–এলিজাবেথ আমার কাছে যা জানবার জন্য আসছিলেন, আপনাকে তা জানাতে কোন বাধা নেই। ধীরে ধীরে বললেন আর্চডিকন, ওই দুই তরুণ-তরুণী পরস্পরকে বিবাহ করবে স্থির করেছিল। আমি ওদের দুজনকেই চিনতাম। ওরা আমার কাছেই এসেছিল।

–আপনি তাদের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন? জানতে চাইলেন মিস মারপল।

-হ্যাঁ। ওরা গোপনে আমার কাছে এসেছিল। কেননা ক্লোটিলডা-ব্র্যাডবেরি স্কট ওদের মেলামেশা বন্ধ করতে চেয়েছিল। মাইকেল র‍্যাফায়েল অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। সে ছিল পথভ্রষ্ট। মেয়েদের সঙ্গে তার ব্যবহার খুবই খারাপ ছিল।

এতসব সত্ত্বেও আমি তাদের বিয়ে দিতে রাজি হই। ভেরিটি আমাকে বলেছিল, সে মাইকেলের স্বভাব ভালই জানে। তার বিশ্বাস ছিল তাকে সে ভাল হতে সাহায্য করতে পারবে।

যাইহোক, তাদের বিয়ের দিনক্ষণ সবই স্থির হয়ে গিয়েছিল। ভেরিটি তার বিয়ের কথা কাউকে জানাতে চাইনি। সম্ভবত সে ছেলেটির হাত ধরে পালাতে চেয়েছিল। সে জানতে ক্লোটিলডা কিছুতেই মাইকেলের সঙ্গে তার বিয়েটা মেনে নিতে চাইবেন না। অবশ্য এটাও সত্যি, মাইকেল কোন দিক দিয়েই ভেরিটির যোগ্য ছিল না। ক্লোটিলডা সেকথা অনেকবার ভেরিটিকে বলেও ছিলেন।

-তারপর কি হল বলুন। বললেন মিস মারপল।

–নির্দিষ্ট দিনে আমি প্রস্তুত হয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছি–কিন্তু তারা এলো না। কোন সংবাদও আমাকে পাঠালো না। সবকিছু স্থির করে কেন এল না, আমি তার কিছুই জানতে পারলাম না।

এলিজাবেথের দুঃসংবাদটা পাবার পর এখানে এসে মেট্রনের কাছে আপনার কথা শুনে আমার মনে হল, তিনি মৃত্যুর আগে আপনাকে কিছু বলে গেছেন।

-তাহলে এসব কথাবার্তার জন্যই মনে হয় তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছিলেন–যেটা ছিল তাঁর কাছে তীর্থযাত্রার মত। বললেন মিস মারপল।

–আমারও তাই বিশ্বাস। ভেরিটির বিয়েতে বাধা দেবার মত ছিলেন ক্লোটিলডা আর অ্যানথিয়া ব্র্যাডবেরি স্কট। ভেরিটি তার স্কুলের শিক্ষিকা এলিজাবেথের প্রতিও খুবই অনুরক্ত ছিল। ব্র্যাডবেরি স্কট বোনেদের কিছু জানাতে না পারলেও আমার মনে হয় ভেরিটি এলিজাবেথকে কিছু খবর দিতে পারে বা লিখে থাকতে পারে।

-আমারও তাই ধারণা। বললেন মিস মারপল। মিস টেম্পল নিজেই আমাকে বলেছেন যে তিনি জানতেন ভেরিটি মাইকেলকে বিয়ে করতে চলেছে। কিন্তু কেন বিয়ে করেনি, আমার এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জবাব দিয়েছিলেন সে মারা গিয়েছিল।

কিন্তু, আর্চডিকন বললেন, আমি বিশ্বাস করি না ভেরিটি বা মাইকেল নিজে থেকে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে আলাদা হয়ে যায়। মাইকেলের চরিত্র সম্পর্কে যদি ভেরিটির মনে কোন দ্বিধা উপস্থিত হত তাহলে সে নিশ্চয় আমাকে জানিয়ে দিত। সে ছিল চমৎকার মেয়ে।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আমার ভয় হয়, একটা মাত্র ব্যাপারই ঘটে থাকতে পারে।

–মৃত্যু? বললেন মিস মারপল।

–হ্যাঁ। মৃত্যু। থেমে থেমে উচ্চারণ করলেন আর্চডিকন।

–ভালবাসা!

আর্চডিকন চোখ তুলে তাকালেন মিস মারপলের মুখের দিকে।

–আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? বললেন তিনি।

–এই কথাটা মিস টেম্পল আমাকে বলেছিলেন। বললেন মিস মারপল। বলেছিলেন, ভালবাসাই পৃথিবীর সবচেয়ে ভীতিকর শব্দ।

-মনে হচ্ছে বুঝতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি। মাথা দুলিয়ে বললেন আর্চডিকন। সেই চিরাচরিত জেকিল আর হাইড। বিযুক্ত ব্যক্তিত্ব। মাইকেল র‍্যাফায়েল–মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ–ওর মধ্যে দুটি সত্ত্বা ছিল। সে ভেরিটিকে খুন করেছিল।…একদিন হয়তো সব জানা যাবে।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন আর্চডিকন। ব্রাবাজন।

–তাহলে এই আপনার বিশ্বাস? আমিও অবশ্য তাই মনে করি। বললেন মিস মারপল।

–কিন্তু তারপর?

–এখনও তা জানি না। আমার ধারণা আসলে কি ঘটেছিল মিস টেম্পল তা জানতে শুরু করেছিলেন বা জানতেন।

এরপর আত্মগতভাবেই তিনি বলে ওঠেন–ভালোবাসা–ভালোবাসা–বড় ভয়ঙ্কর এক

.

১৭.

পরদিন সকালে ভ্রমণ দলের কোচ গোল্ডেনবোরের সামনে এসে থেমেছে। মিস মারপল নিচে নেমে একে একে ভ্রমণসঙ্গীদের বিদায় জানালেন।

সকলেই চলে গেলেন। ওই দলের কেবল এমলিন প্রাইস আর যোয়ানা। ইতিমধ্যে তারা দুজন খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যোয়ানা তাই অজুহাত খাড়া করে তার পিসি মিসেস রাইজেল পোর্টারের কাছ থেকে ছাড়ান নিয়েছে।

সকলে কোচে উঠে গেলেন, মিস মারপল প্রফেসর ওয়ানস্টেডের দিকে তাকালেন।

–আপনার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই। বললেন মিস মারপল।

তারা হোটেলের কোণের দিকে চলে এলেন।

–বাকি সকলের সঙ্গে কোচে চলে গেলেই মনে হয় ভাল করতেন আপনি। অবশ্য আমি আপনার ওপর নজর রাখতে পারব। বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

-না। তার দরকার হবে না।

–কোন ধারণা কি পেয়েছেন?

মনে হয় পেয়েছি। আর এমন কিছু ব্যাপার আছে তাতে আপনার সাহায্য দরকার। কারণ স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে।

-হ্যাঁ। কিন্তু আমাকে কি করতে হবে?

মিস মারপল একটা ঠিকানা লেখা কাগজ ব্যাগ থেকে বার করে প্রফেসরের দিকে এগিয়ে দিলেন।

–একটা নামকরা দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান। সকলে এখানে শিশুদের আর মেয়েদের পোশাক, কোট, পুলওভার ইত্যাদি পাঠিয়ে থাকে। দুদিন আগে এখানকার ডাকঘর থেকে পাঠানো একটা পার্সেল সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে হবে আপনাকে।

–কে পাঠিয়েছিল সেটা?

–পার্সেলটা গিয়েছিল অ্যানথিয়া ব্রাডবেরি স্কটের কাছ থেকে।

–আপনি তাকে সেটা নিয়ে যেতে বলেছিলেন?

–না। গোল্ডেনবারের বাগানে সেদিন আমি আর আপনি বসে কথা বলার সময় তাকে পার্সেলটা নিয়ে যেতে দেখেছিলাম।

-হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কিন্তু ওই পার্সেলের সঙ্গে

–ধীরে বন্ধু ধীরে। আমি পরে ডাকঘরে গিয়ে মিথ্যে করে গল্প ফেঁদে সদাশয়া পোস্ট মিসট্রেসের কাছ থেকে ঠিকানাটা সংগ্রহ করে এনেছিলাম। অবশ্য জানি পার্সেলে প্রেরকের ভুয়ো নামঠিকানাই দেওয়া থাকবে।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড ঠিকানা লেখা কাগজটা নিলেন।

–ঠিক আছে। স্বচ্ছন্দেই এটা করা যাবে। আপনি আশা করছেন এই পার্সেল আপনাকে সাহায্য করতে পারে?

–হ্যাঁ। এর ভেতরের জিনিসগুলো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে আপনাকে কিছু এখনই বলতে চাইছি না।

–বেশ, আর কিছু?

হ্যাঁ। এব্যাপারে যিনি ভারপ্রাপ্ত তাঁকে আগে থেকে একটু সতর্ক করে রাখা দরকার–একটা মৃতদেহ হয়তো আবিষ্কার হতে পারে

আমরা যেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি তার সঙ্গে জড়িত? সেই দশ বছর আগেকার ঘটনা–

-হ্যাঁ, বললেন মিস মারপল, এব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমি জানি সেটা কোথায় আছে।

–আশ্চর্য! কার দেহ

–যে মেয়েটি একই সঙ্গে উধাও হয়ে আর ফিরে আসেনি–নোরা ব্রড। কোন বিশেষ জায়গায় তার দেহটা রয়েছে বলে আমার ধারণা।

–কিন্তু তাহলে তো দেখছি আপনি খুবই বিপজ্জনক পথের মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার এখানে থেকে যাওয়াই উচিত–আমার ওপর নজর রাখার জন্য।

-না, তার দরকার হবে না। আপনাকে লণ্ডনে গিয়ে দশ বছর পুরনো হয়ে যাওয়া কিছু জিনিস আবার চালু করে তুলতে হবে।

–কিন্তু…এই পরিস্থিতিতে যে কোন মুহূর্তে আপনার বিপদ ঘটতে পারে–কোন এক বিশেষ ব্যক্তি কি আপনার সন্দেহের আওতায় রয়েছে?

-মনে হয় একজন সম্পর্কে কিছু কিছু জানি। সেকারণেই আমাকে এখানে থাকতে হবে। তবে আমার মতো বৃদ্ধার বিশেষ কোন বিপদের আশঙ্কা তার কাছ থেকে নেই।

–তাহলে এখন আপনি কি করতে চাইছেন? উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চাইলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

–ভেরিটি হান্টের মৃত্যু ও এলিজাবেথ টেম্পলের মৃত্যুর মধ্যে একটা যোগসূত্র আমি খুঁজে পেয়েছি। মিঃ র‍্যাফায়েল এই উদ্দেশ্যেই যে আমাকে ম্যানর হাউসে পাঠিয়েছিলেন তা আমার কাছে এখন স্পষ্ট। এখন আমি অপেক্ষা করছি একজন মানুষের কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য। সেজন্যই আমার এখানে থাকা। আপনি আর দেরি করবেন না–তাহলে এই ট্রেনটা ধরতে পারবেন না।

–বেশ আর কি বলব–নিজের সম্পর্কে সাবধান থাকবেন।

এইসময় লাউঞ্জের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মিস কুক ও মিস ব্যারো।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড ও মিস মারপল অবাক হলেন তাঁদের দেখে।

কোচের সঙ্গে তাঁদেরও যাবার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মত বদল করেছেন জানালেন তারা। দু-একদিন থেকে স্থানীয় কিছু দর্শনীয় দেখে যাবার ইচ্ছা তাদের। আপাতত গোল্ডেনবোরেই থাকবেন।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে ট্রেন ধরতে চলে গেলেন। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে মিস মারপল বললেন, বড় দয়ালু মানুষ। আমি ওঁর কোন আত্মীয় নই…তবু আমার জন্য এত ভাবেন–

-হ্যাঁ এমন হয়, মিস কুক বললেন, কাল আমরা গ্রোভে সেন্ট মার্টিন গির্জা দেখতে যাব-আশাকরি আপনি আমাদের সঙ্গী হবেন?

–আপনাদের সদাশয়তার জন্য ধন্যবাদ। শরীর কোনরকম বাধা না দিলে যেতে পারি।

.

১৮.

মধ্যাহ্নভোজের পর মিস মারপল বারান্দায় বসে কফি পান করছিলেন।

এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন অ্যানথিয়া ব্র্যাডবেরি স্কটের দীর্ঘ কৃশ মূর্তি সিঁড়ি বেয়ে উঠে তার দিকে এগিয়ে আসছে। খুব বাস্তবতার সঙ্গেই হাঁপাতে হাঁপাতে আসছিল মেয়েটি।

–ওঃ মিস মারপল, আপনি এখানে। আপনি কোচে সকলের সঙ্গে যাননি জানতে পেরে ক্লোটিলডা আর ল্যাভিনিয়া আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে পাঠিয়ে দিল। যে কদিন এখানে আছেন, আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। আমরা সবাই খুশি হব।

-ওঃ আপনারা বড়ই সদাশয়। আপনাদের সবকিছুই সুন্দর।

–আমি আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছি–এখুনি চলুন আমার সঙ্গে।

মিস মারপল আর আপত্তি করলেন না। তিনি তো এরকমই একটা আমন্ত্রণের প্রতীক্ষা করবেন বলে এখানে থেকে গিয়েছিলেন।

কুলির মাথায় সুটকেস চাপিয়ে দিয়ে তিনি অ্যানথিয়ার সঙ্গে আবার ম্যানর হাউসে এসে উঠলেন।

অন্য দুই বোন বসার ঘরেই ছিল। মিস মারপল তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।

তার মাথায় নানান চিন্তা জট পাকাচ্ছিল। ক্লোটিলডা মেয়েটিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। ভেরিটির নাম উচ্চারিত হলেই তাঁর চোখে জলের ধারা নেমে আসে।

যাকে তিনি এতো ভালবাসতেন তাকে তার পক্ষে কি মারা সম্ভব?

অ্যানথিয়ার চালচলন গতিবিধিও সন্দেহজনক। সে পার্সেলটা নিয়ে ডাকঘরে গিয়েছিল। তার চোখের দৃষ্টি-বারবার পেছনে ফিরে তাকানো–এসবই অদ্ভুত। ও কি ভয় পেয়েছে, কোন কিছু সম্পর্কে ভয়? নাকি বোনেদের সম্পর্কে ভীত?

তারাও কি তাই? অ্যানথিয়া কি বলে বা করে বসে এই ভেবে তারাও কি ভীত?

ইতিমধ্যে মিসেস গ্লাইন চা নিয়ে এসেছিলেন! চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে মিস মারপলের মনে পড়ল মিস কুক আর মিস ব্যারোর কথা। তারা এখন কি করছে? মিস কুক সেন্ট মেরী মিডে গিয়ে তাকে দেখে এসেছিল…অথচ পরে তা অস্বীকার করে।

চা পান শেষ হলে মিসেস গ্লাইন চায়ের ট্রে নিয়ে উঠে গেল। অ্যানথিয়াও বাগানে চলে গেল। ঘরে রইলেন কেবল মিসেস মারপল আর মিস ক্লোটিলডা।

কথা শুরু করলেন মিস মারপল–আপনি আর্চডিকন ব্রাবাজনকে চেনেন মনে হয়?

–ও হ্যাঁ। গতকাল তিনি গির্জায় এসেছিলেন।

–তিনি পরে আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য হোটেলে এসেছিলেন। মিস টেম্পলের খোঁজে হাসপাতালেও তিনি গিয়েছিলেন। বললেন মিস মারুপল।

–কি ঘটেছিল এ সম্পর্কে তিনি কোন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন?

–তেমন কিছু না। মিসেস পোর্টারের ভাইঝি কাউকে পাথর ঠেলতে দেখেছিল এটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার ধারণা ওরা অদ্ভুত এক কাহিনী বলেছে।

এই সময় মিসেস গ্লাইন ঘরে ঢুকলেন।–কি অদ্ভুত কাহিনী

–আমরা পাহাড়ের দুর্ঘটনার কথা বলছিলাম। বললেন ক্লোটিলডা। ভেরিটির মৃত্যুর পর থেকেই জায়গাটার আবহাওয়া কেমন ছমছমে হয়ে উঠেছে। একটা ছায়া…আপনি অনুভব করছেন মিস মারপল?

এই সময় একগুচ্ছ লিলিফুল হাতে নিয়ে অ্যানথিয়া বাগান থেকে ঘরে ঢুকল।

–অন্ত্যেষ্টির ফুল…এগুলো জলে ভিজিয়ে রাখব। বলল অ্যানথিয়া।

–ওসব করো না অ্যানাথিয়া-ওটা ঠিক নয়। বললেন ক্লোটিলডা।

মিসেস গ্লাইন অ্যানথিয়াকে অনুসরণ করে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।

–ও মাঝে মাঝে কেমন হয়ে যায়…হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত। বললেন ক্লোটিলডা, আমারও যেন কেমন বোধ হয় মাঝে মাঝে, ভেবেছি বাড়ি বিক্রি করে চলে যাব।

–হ্যাঁ, দুঃখের স্মৃতি নিয়ে বাস করা—

ও আমার মেয়ের মতই ছিল…আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুও…ওই মানসিক রোগগ্রস্ত ছেলেটিই—

মিঃ র‍্যাফায়েলের ছেলে মাইকেল?

-হ্যাঁ। ভাবতে পারিনি অমন ফুলের মত নিষ্পাপ ভেরিটি ওই বদ ছেলের প্রেমে পড়বে। অনেক বারণ করেছিলাম, কিছুতেই শুনতে চায়নি।

-ভেরিটি তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল? বললেন মিস মারপল।

–না, অতদূর গড়ায়নি মনে হয়। ছেলেটা তো এসব ভাবতেই পারে না।

–ওহ বড়ই মর্মান্তিক।

–আমার পক্ষে সবচেয়ে মারাত্মক হয়েছিল মৃতদেহ সনাক্ত করা। মর্গে গিয়ে…উঃ কী ভয়ঙ্কর

মিস ক্লোটিলডা আতঙ্কে ভয়ে চোখ বুজলেন।

একটু পরে চোখ খুলে বললেন, অ্যানথিয়াও আমার ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল সেই সময়।

–অ্যানথিয়া-কেন? বললেন মিস মারপল।

–ও কেমন ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ ভেরিটিকে ঘৃণা করতে শুরু করে। নিজের বোন…তবু মাঝে মাঝে মনে হয়…আমাদের একটা কথাবলা টিয়াকেও একবার গলা ছিঁড়ে মেরে ফেলেছিল। উঃ…উঃ…ভাবতে পারি না।

-ওসব কথা থাক মিস ক্লোটিলডা। বেদনার্ত স্বরে বললেন মিস মারপল।

-ভেরিটি এভাবে মারা গেলো বলে অন্য মেয়েরা অবশ্য ছেলেটির হাত থেকে বেঁচে গেল…যাবজ্জীবন কারাবাস হয়েছে তার। অবশ্য মানসিক রোগগ্রস্ত হিসাবেই তাকে দেখা উচিত ছিল।

কথা শেষ করে চোখ মুছতে মুছতে ক্লোটিলডা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ল্যাভিনিয়া গ্লাইন ঘরে ঢুকল। বললেন, ক্লোটিলডা সেই মেয়েটির মৃত্যুর পর থেকে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। ভেরিটিকে দারুণ ভালবাসত ও।

-উনি আপনাদের ছোট বোনটির জন্যেও চিন্তিত মনে হয়।

–অ্যানথিয়া? কে…জানালার কাছে কে গেল? চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ল্যাভিনিয়া।

-ওঃ আমাদের ক্ষমা করবেন, ঘরে ঢুকলেন দুই মূর্তি, মিস কুক আর মিস ব্যারো, মিস মারপল, আমরা আপনাকেই বলতে এসেছিলাম গির্জা দেখতে যাওয়া হয়নি আমাদের।…ঘণ্টা বাজলেও কাউকে বেরতে না দেখে ঢুকে পড়েছিলাম আমরা।

ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে কথা শেষ করে মিসেস গ্লাইনের দিকে তাকালেন মিস ব্যারো।

-বসুন, একটু শেরী আনছি বলে মিসেস গ্লাইন উঠে গেলেন।

একটু পরেই তিনি ফিরে এলেন শেরী নিয়ে। সঙ্গে এল অ্যানথিয়া। বললেন, মিস টেম্পলের ব্যাপারটা কি হবে বুঝতে পারছি না।

মিস ব্যারো বললেন, পুলিস ওই পাথরটার ব্যাপার নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। ওটা কেউ ঠেলে দিয়েছিল না, আপনা থেকেই পড়েছিল।

-পাথর কে ঠেলতে যাবে, বললেন মিস কুক, তবে কোন গুণ্ডা বা বিদেশী কেউ হলেও হতে পারে।

–কোচের সহযাত্রীদের কেউ বলতে চাইছেন? বললেন মিস মারপল।

-না, না, তা ঠিক বলিনি, ক্লোটিলডা বললেন, মিস মারপল, সম্ভাবনার কথাই আমি ভাবছিলাম।

–অনেক সম্ভাবনার কথাই ভাবা যায়। অ্যানথিয়া বলে উঠল, এমনও হতে পারে মিস টেম্পল একজন অপরাধী। কেউ তাকে অনুসরণ করে এসেছিল হয়তো।

–অসম্ভব, ক্লোটিলডা বললেন, তিনি একজন বিখ্যাত শিক্ষয়িত্রী। তাকে কে অনুসরণ করবে?

মনে হয় মিস মারপল কিছু ধারণা দিতে পারবেন, বললেন মিসেস গ্লাইন।

–আমার ধারণা, বললেন মিস মারপল, সত্যি কথা বলত কি, আসলে ওরা কাউকেই দেখেনি।

–মানে বলছেন, ওরা যা বলছে, তা ঠিক নয়? বলল অ্যানথিয়া।

–হ্যাঁ। আসলে অল্প বয়স তো, ওই বয়সে মজা করার একটা প্রবণতা থাকে। তাই করতে চেয়ে থাকবে—

-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। ক্লোটিলডা বললেন, হতে পারে, বিচিত্র নয়।

–দুজনে মিলেই ব্যাপারটা করে থাকবে। মিস কুক বললেন।

-হ্যাঁ, ওরা দুজনে একই কাহিনী বলেছে, বললেন মিস মারপল, মিস টেম্পলকে হত্যা করার উদ্দেশ্য হয়তো তাদের ছিল না, পাথরটা গড়িয়ে দিয়ে মজা দেখতে চেয়েছিল হয়তো। আমার এরকমই মনে হয়।

–এরকম হওয়া অসম্ভব না। তবে আগে ব্যাপারটা মাথায় আসেনি। ক্লোটিলডা বলল।

মিস কুক উঠে দাঁড়ালেন। মিস মারপলের উদ্দেশ্যে বললেন, এবারে ওঠা যাক, গোল্ডেনবোরে ফিরতে হবে। মিস মারপল

-ওহো, আপনারা জানেন না, বললেন মিস মারপল, মিস ব্র্যাডবেরি স্কট একটা রাত তাদের সঙ্গে কাটিয়ে যাবার অনুরোধ করেছেন আমাকে।

-খুব ভাল কথা। আপনার পক্ষে ভালই হবে।

ক্লোটিলডা বললেন, আপনারাও আসুন না, নৈশ ভোজের পরে কফি পান করবেন আমাদের সঙ্গে।

মিস কুক সহাস্যে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং যথাসময়ে আতিথ্য গ্রহণ করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সকলকে বিদায় জানালেন।

.

–মিস কুক আর মিস ব্যাপোর কথা বলছি, ওরা থেকে গেলেন কেন বুঝলাম না। নৈশ ভোজের টেবিলে মিস মারপলকে বললেন অ্যানথিয়া।

-ওদের নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা থেকে থাকবে। বললেন মিস মারপল।

পরিকল্পনা কেন? জানতে চাইলেন মিসেস গ্লাইন।

–খুনের ব্যাপারটাতে ওরা আগ্রহী হয়ে পড়েছেন বলছেন? মিসেস গ্লাইন।

–কেন নয়, অ্যানথিয়া বলল, খুন অবশ্যই। কেউ নিশ্চয়ই ঘৃণা করত, সুযোগ পেয়ে

-ঘৃণার জের কি এতবছর থাকে? বললেন মিস মারপল। এটা ঘৃণা নয়–ঘৃণার চেয়েও যা জোরালো তা হল ভালবাসা।

অ্যানথিয়া বলল, মিস কুক বা মিস ব্যারো এদের দুজনকে আপনার সন্দেহ হয়?

–না, না, ওরা এমন হতে পারেন না। বললেন মিসেস গ্লাইন।

কিন্তু ওদের কেমন রহস্যময় মনে হয়। অ্যানথিয়া বলল।

ক্লোটিলডা তাকে সমর্থন জানিয়ে বলল, আমারও যেন কেমন মনে হয় ওদের।

ঠিক সেই সময়েই, রাত তখন ৮:৪৫, অতিথিরা উপস্থিত হলেন। তারা আসন গ্রহণ করলে ক্লোটিলডা কাপে কফি ঢেলে ওদের পরিবেশন করলেন। পরে এককাপ মিস মারপলকে দিলেন।

মিস মারপলের দিকে ঝুঁকে মিস কুক নিচুস্বরে বললেন, এত রাতে, মাপ করবেন মিস মারপল, ঠিক মতো ঘুম হবে না। এ কফি আপনার পান করা উচিত না।

–তাই বলছেন, বললেন মিস মারপল, কিন্তু আমি তো এসময় কফি পান করি।

-কিন্তু এ খুব কড়া কফি। বলে মিস কুক, মিস মারপলের দিকে তাকালেন। দুজনের চোখাচোখি হল।

–আপনার কথা বুঝতে পেরেছি, বললেন মিস মারপল, তারপর কাপটা সামান্য সরিয়ে দিলেন, বললেন আর্চডিকন মেয়েটিকে, খুবই স্নেহ করতেন। তার কোন ছবি নেই?

-হ্যাঁ, আছে।

ক্লোটিলডা উঠে গিয়ে ওপরের ডেস্ক খুলে একটা ফোটোগ্রাফ এনে মিস মারপলের হাতে দিলেন।

এই ভেরিটি।

-বেচারি মেয়েটা; কি সুন্দর দেখতে। বললেন মিস মারপল। দেখা হলে তিনি হাত বাড়িয়ে ছবিটা ক্লোটিলডার হাতে দিতে গেলেন। সেই সময় ক্লোটিলডার হাতের ধাক্কা লেগে কফির কাপটা মেঝেয় ছিটকে পড়ল।

–ওহ্, কুঁকড়ে গেলেন মিস মারপল, কাপটা ফেলে দিলাম।

-না, আমার হাত লেগেই পড়ল, ক্লোটিলডা বলল, কড়া কফি বরং থাক, আপনাকে এককাপ দুধ দিচ্ছি।

-দুধ পান করা যেতে পারে। ঘুমটাও ভাল হবে তাহলে। বললেন মিস মারপল।

নানান প্রসঙ্গের আলোচনায় সকলে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটলেন। একসময় মিস কুক আর মিস ব্যারো ব্যস্তভাবে বিদায় নিলেন। কিন্তু কিছু একটা ফেলে গিয়েছিলেন। আবার ফিরে এসে সেটা নিয়ে গেলেন।

ক্লোটিলডা মিস মারপলকে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। পরে তার জন্য এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসে টেবিলে রাখলেন।

-ওহ, আপনাদের আতিথেয়তার কথা কখনো ভুলব না। বললেন মিস মারপল।

–মিঃ র‍্যাফায়েল যে চিঠিতে আমাদের সেভাবেই নির্দেশ দিয়েছিলেন। সব দিকেই তার সতর্ক নজর ছিল। বললেন ক্লোটিলডা।

–হ্যাঁ, তিনি খুবই বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। বললেন মিস মারপল।

তাকে শুভরাত্রি জানাবার আগে ক্লোটিলডা জিজ্ঞেস করলেন, সকালে কি এখানেই আপনার প্রাতঃরাশ পাঠিয়ে দেব?

-না, তার দরকার নেই, বললেন মিস মারপল, আমি নিচেই নামব-বাগানটা চমৎকার, ওই ফুলে ঢাকা ঢিবিটা ঘুরে ঘুরে দেখতে ভাল লাগবে। ঠিক আছে, শুভরাত্রি মিস ব্র্যাডবেরি স্কট।

প্রাচীন জমিদার বাড়ির দেয়াল ঘড়িতে রাত দুটোর ঘোষণা শুনতে পেলেন মিস মারপল। ঝিম ধরা অন্ধকারে সব ডুবে আছে।

ঢং ঢং শব্দে রাত তিনটের ঘোষণা হল। বাইরে হালকা পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। দরজাটাও যেন ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছিল। মিস মারপল বিছানায় উঠে বসলেন। সুইচ টিপে ঘরের আলো জ্বালালেন।

দেখা গেল ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন ক্লোটিলডা।

-ওহ, মিস ব্র্যাডবেরি স্কট, বলে উঠলেন মিস মারপল, কিছু বলবেন?

–আপনার কিছু দরকার কিনা জানতে এসেছিলাম।

ক্লোটিলডার মুখ থমথমে, বিষণ্ণ, গোলাপি দীর্ঘ পোশাকে শরীর আবৃত। তার দিকে তাকিয়ে মিস মারপলের মনে হল, যেন বিষাদের প্রতিমূর্তি।

-ওহ, ধন্যবাদ, আমার কিছু চাই না। দুধটা আমি পান করিনি।

–কি আশ্চর্য, কেন? অবাক হল ক্লোটিলডা। সে বিছানার পাশে এগিয়ে গেল।

–ওটা পান করা ঠিক হবে না, মনে হল। বললেন মিস মারপল।

–ঠিক হবে না–আপনার একথার অর্থ?

ক্লোটিলডার কণ্ঠস্বর, চোখের দৃষ্টি পাল্টে গেল। মিস মারপল ধীরে ধীরে বললেন, আমি কি বলছি, আপনার বুঝতে না পারার কথা নয় মিস ব্র্যাডবেরি স্কট।

–ওহো, দুধটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই, আমি এখুনি গরম দুধ নিয়ে আসছি। ক্লোটিলডা দুধের গ্লাসটা তুলে নিলেন।

–মিছে আর কেন কষ্ট করবে। আমি ওই দুধ পান করতে পারি না, বুঝতেই পারছেন।

–অদ্ভুত সব কথা বলছেন। এভাবে কথা বলছেন কেন? কে আপনি?

–আমি, মৃদু হাসলেন মিস মারপল, আমি হচ্ছি নিয়তি।

–নিয়তি? একথার মানে?

–আমার ধারণা, মানেটা আপনার অজানা নয়। আপনি শিক্ষিত মহিলা। দেরি হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু নিয়তি নেমে আসে।

–আপনি

-হ্যাঁ, আমি বলছি একটি সুন্দরী ফুটফুটে মেয়ের কথা, যাকে আপনি নিজের হাতে মেরেছিলেন।

-কী বলছেন? কাকে আমি মেরেছিলাম?

–আপনার প্রিয় ভেরিটির কথা বলছি আমি।

–তাকে আমি মারব কেন?

কারণ আপনি ভেরিটিকে ভালবাসতেন। বড় ভয়ানক সে ভালবাসা। ওই চার অক্ষরের শব্দটি সম্পর্কে এরকম কথাই কদিন আগে আপনি আমাকে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। অন্য এক ভালবাসা মেয়েটির জীবনেও এসেছিল, একটি তরুণকে ভালবেসেছিল সে, চেয়েছিল নারীর স্বাভাবিক জীবন। অবশ্য যাকে বিয়ে করে ঘরসংসার পাতবার স্বপ্ন সে দেখেছিল, সেই ছেলেটি ভাল ছিল না।

ক্লোটিলডা যন্ত্রচালিতের মত এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসলেন। অপলক চোখে মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তাহলে সবই জেনেছেন–

-হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি।

–অস্বীকার করব না, আপনার কথা সবই সত্যি। কিন্তু সত্যি-মিথ্যেয়, আজ আর কি এসে যায়?

–ঠিকই বলেছেন, এতে কিছু যাবে আসবে না।

–কিন্তু আপনি যদি বুঝতেন, কী নিদারুণ যন্ত্রণা আমি সয়েছি। বুকের সবটুকু ভালবাসা স্নেহ উজাড় করে দিয়েছিলাম যাকে, এক অযোগ্য অপদার্থ মানুষের কাছে হারাতে বসেছিলাম তাকে–এ যে কী অসহ্য যন্ত্রণা

–আমি অনুভব করতে পারছি

–আমি তা হতে দিতে চাইনি–আমি পারি না–

-হ্যাঁ, আমি জানি, তারা বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আপনি তাকে খুন করেন। ভালবাসতেন বলেই আপনি তা করেছিলেন।

-আপনি বিশ্বাস করেন একথা? যাকে অন্তর উজাড় করে ভালবেসেছি তার মাথা এভাবে চূর্ণ করে খুন করা সম্ভব?

–আমি জানি, আপনাকে তা করতে হয়নি।

–তাহলে বলছেন কেন আমি খুন করেছি?

–আপনি ভেরিটির মাথা চূর্ণ করেননি। সেটা হয়েছে অন্য মেয়ের। ভেরিটি এখনো এখানে বাগানেই আছে। আমার ধারণা তাকে কফি বা দুধের সঙ্গে বেশিমাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন। সে মারা গেলে, বাগানের কাচঘরের নিচেই ইট পাথরের তলায় চাপা দিয়েছিলেন। তারপর সেখানে লাগানো হয় পলিগোনাম। বছর বছর সেই গাছের ফুলেই ঢেকে থাকে কাচঘর। এভাবেই ভেরিটিকে আপনি আপনার কাছে রেখে দিয়েছেন।

–মূর্খ! বাইরে গিয়ে এ কাহিনী বলার সুযোগ আপনাকে আমি দেব না।

–তা জানি, আপনার অনেক কম বয়স, আমার চেয়ে শক্তিও অনেক বেশি। আর

–আর কি?

-আপনার এখন হিতাহিত জ্ঞান থাকার কথা নয়। আপনি থেমে থাকতে পারেন না। দুদুটো মেয়েকে খুন করেছেন। যাকে ভালবাসতেন তাকে আর অন্য একজনকে।

সে একটা বাজে নোংরা মেয়ে। কিন্তু নোরা ব্রডকে আমি খুন করেছি আপনি জানলেন কি করে?

ওকে যেভাবে মেরেছেন, ভেরিটিকে সেভাবে মাথা গুঁড়িয়ে দিয়ে মারা আপনার পক্ষে সম্ভব হত না। ঘটনাক্রমে, ওই সময়েই মেয়েটি হারিয়ে গিয়েছিল। তাকে যখন পাওয়া গেল, তার দেহে ছিল ভেরিটির পোশাক। আপনি তাকে ভেরিটি বলে সনাক্ত করলেন। লোকে তাই জানল। কিন্তু আপনি জানতেন মৃতদেহটা ছিল নোরা ব্রডেরই, ভেরিটির নয়। হ্যাঁ, আপনি জানতেন।

–এসব আমি করতে চাইব কেন?

–কারণ, যে ছেলেটি ভেরিটিকে আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল, আপনি চেয়েছিলেন, খুনের অপরাধে তাকে সাজা দিতে। নোরার মৃতদেহ আপনি লুকিয়ে রেখেছিলেন। তার মুখ বিকৃত করেছিলেন যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। তার গায়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন ভেরিটির পোশাক, পাশে রেখেছিলেন তার ব্যাগ, বালা। তারপর আপনি তাকে সনাক্ত করেন ভেরিটি বলে।

একটু থামলেন মিস মারপল। পরে বললেন, তৃতীয় খুনটা আপনি করেছেন একসপ্তাহ আগে। বেচারা মিস এলিজাবেথ টেম্পল। তিনি এ অঞ্চলে আসায় আপনি ভয় পেয়েছিলেন। আপনার ভয় ছিল, ভেরিটি তাকে কিছু জানিয়ে থাকতে পারে। তাই আর্চডিকন ব্রাবাজনের সঙ্গে যাতে মিস টেম্পলের সাক্ষাৎ হয় আপনি তা চাননি। পাছে সত্য উদঘাটিত হয়ে পড়ে। এই সম্ভাবনা বন্ধ করার জন্য আপনাকে কেবল একটা পাথর ঠেলে দিতে হয়েছিল। সেই শক্তি আপনার যথেষ্ট আছে।

-আপনার উপযুক্ত ব্যবস্থা করার মত শক্তিও আমার আছে। কর্কশ কণ্ঠে বললেন ক্লোটিলডা।

-তা মনে হয় আপনি পারবেন না। নিরাসক্ত গলায় বললেন মিস মারপল।

–পারব না…একটা দুর্বল বুড়ি..আপনাকে কেউ বাঁচাতে আসবে না এখানে।

–আমি সত্য পথের পথিক-আমাকে রক্ষা করবার জন্য তৈরি রয়েছে দেবদূত।

–দেবদূত। হিংস্র হাসি হাসলেন ক্লোটিলডা, দাঁড়িয়ে উঠে বিছানার দিকে এগোলেন।

–আমার রক্ষাকারী সম্ভবতঃ দুজন দেবদূত। বললেন মিস মারপল, মিঃ র‍্যাফায়েল তার কাজে কোন ত্রুটি রাখতেন না।

কথা শেষ করে তিনি বালিশের নিচে থেকে বের করে আনলেন একটা ছোট্ট বাঁশি। ঠোঁটের মাঝখানে রেখে ফুঁ দিলেন। সেই তীব্র জোরালো শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন মিস ব্যারো। বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মত ঘুরে দাঁড়ালেন ক্লোটিলডা। সেই মুহূর্তে দেয়ালের পাশে বড় আলমারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন মিস কুক। তাদের অন্য মানুষ মনে হচ্ছিল। সেই সন্ধ্যার সামাজিক ব্যবহারের ছিটেফোঁটাও তাদের হাবভাবে ছিল না।

–দুজন দেবদূত, বললেন মিস মারপল, মিঃ র‍্যাফায়েল তার যোগ্য কাজই করে গেছেন।

.

লণ্ডনের একটা সরকারী ভবন। সেই ঘরে উপস্থিত রয়েছেন প্রফেসার ওয়ানস্টেড ও মিস মারপল ছাড়াও একজন সরকারী উকিল, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সহকারী কমিশনার স্যার জেমস লয়েড, মেন্সটোন জেলের অধ্যক্ষ স্যার আন্ডু ম্যাকনীল এবং স্বরাষ্ট্র সচিব স্বয়ং।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড মিস মারপলের উদ্দেশ্যে বললেন, ওই দুজন বেসরকারী মহিলা গোয়েন্দা যে আপনাকে রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত হয়েছেন, আপনি কখন বুঝতে পারলেন?

–গতকাল সন্ধ্যার আগে আমার কোন ধারণা ছিল না, বললেন মিস মারপল, মিস কুক সেন্টমেরী মিডে এসেছিলেন। কোচে তাকে অন্য বেশে দেখেই মনে হয়েছিল, আমাকে দেখে মনে রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আমার রক্ষক কি শত্রুপক্ষের কেউ তা নিয়ে ধাঁধায় ছিলাম। গতকাল সন্ধ্যাতেই আমি নিশ্চিত হলাম, যখন তিনি ক্লোটিলডার আনা কফি পান না করার ইঙ্গিত করলেন আমাকে। তার কৌশল ছিল অনবদ্য। তারপর বিদায় নেওয়ার সময় করমর্দন করার ফাঁকে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে যান একটা বাঁশি। ওটা গোপনে বালিশের তলায় রেখে দিই। মিস ব্র্যাডবেরি স্কট যাতে কিছু সন্দেহ করতে না পারে তার জন্য যথাযোগ্য সৌজন্য বজায় রাখি। তার দেওয়া দুধের গ্লাস গ্রহণ করি। কিন্তু ওই দুধ পান করা যে বিপজ্জনক তা জানতাম। তাই স্পর্শ করিনি।

–কিন্তু দরজা খোলা রেখেছিলেন কেন? জানতে চাইলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

–আমি জানতাম দুধটা পান করার পর আমি কি অবস্থায় আছি তা জানার জন্য মিস ব্র্যাডবেরি স্কট একটু পরেই আসবেন। তাই দরজা বন্ধ করিনি। আমি তার কথা শুনতে চাইছিলাম।

–মিস কুক যে আলমারির ভেতরে লুকিয়ে আছেন, আপনি তা জানতেন?

–একদম না। তাকে দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হই।

–ওই দুজন বাড়িতে আছেন, আপনি জানতেন?

–বাঁশিটা পাবার পর বুঝতে পেরেছিলাম তারা কাছাকাছি থাকবেন। বাড়ির সবাই যখন শুতে যান সেই সময় সম্ভবত তারা ভেতরে ঢোকেন।

-ওহ, এই অবস্থায় মারাত্মক ঝুঁকি আপনি নিয়েছিলেন, মিস মারপল।

–আমি বাধ্য ছিলাম। কারণ আমি সত্য উদঘাটনে বদ্ধপরিকর ছিলাম।

-ডাকঘরের ওই পার্সেলটার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। ওর ভেতরে পুরুষদের উপযোগী লালকালো ডোরাকাটা একটা গলাবন্ধ জাম্পার ছিল। কিন্তু পার্সেলটার কথা আপনি ভেবেছিলেন কেন?

–ওরকম একটা জাম্পারের কথা যোয়ানা আর এমলিন বলেছিল। ওদের নজরে পড়েছিল। ওরকম রঙচঙে জিনিস সহজে ফেলা যায়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তাই জানতাম পোশাকটা কাছাকাছি কোথাও পাওয়া যাবে না। ওটা নাগালের বাইরে সরিয়ে দেবার সহজ পথ ছিল ডাক মারফত কোন দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেওয়া। কোথায় পাঠানো হয়েছে সেই ঠিকানাটা আমি জানতাম না।

–ঠিকানাটা পেলেন কি ভাবে?

–ডাকঘর থেকে। তবে একটু কৌশল করতে হয়েছিল। পোস্টমিস্ট্রেস ভালমানুষ ছিলেন। তাকে জানালাম ঠিকানাটা ভুল লিখে ফেলেছি। বয়স হয়েছে, মনে রাখতে পারি না সব। তিনি আমাকে ঠিকানাটা জানাল।

-একেবারে পাকা অভিনেত্রীর মত কাজ, বললেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড, কিন্তু একটা কথা, দশ বছর আগে যে ঘটনা ঘটল, তার হদিশ আপনি পেলেন কি ভাবে?

এরকম একটা তথ্য ছাড়া কাজে জড়িত হওয়ায় প্রথমে খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু মিঃ র‍্যাফায়েল বিচক্ষণ ব্যক্তি, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছিল তার প্রতিটি কাজে। তিনি এমন ব্যবস্থা করেছিলেন। তার সরবরাহ করা তথ্য প্যাকেটের মাধ্যমে মাঝেমাঝেই আমি পেয়ে গেছি। তাতে আমার পথ সহজ হয়েছে।

–কোথাও বাধার মুখে পড়তে হয়নি?

-না, তেমন কিছু ঘটেনি। তবে মিস এলিজাবেথ টেম্পলের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত মূল ঘটনার কোন আভাসই পাইনি। তার সঙ্গে আলাপ হবার পরেই বুঝতে পারি আমাকে একটা গ্রন্থি মোচন করতে হবে। সেই গ্রন্থিতে রয়েছে একজন হত্যাকারী আর একজন মিথ্যার শিকার।

ওয়েস্ট ইণ্ডিজে মিঃ র‍্যাফায়েলের সঙ্গে আমার যোগাযোগের সূত্র ছিল একটা খুন। সেই খুন আর খুনীকে কেন্দ্র করেই আমরা একসঙ্গে মিলিত হই। সেই সুবাদেই, আমি বুঝতে পারি এখানেও নিশ্চয়ই কেউ খুন হয়েছে আর অন্যায় ভাবে সাজা পাচ্ছে কেউ।

মিস টেম্পল আমাকে জানিয়েছিলেন, একটি মেয়েকে তিনি চিনতেন, সে মিঃ র‍্যাফায়েলের ছেলেকে বিয়ে করতে বাগদত্তা ছিল। কিন্তু তারা বিয়ে করবার আগেই মেয়েটি মারা যায়।

আমি জানতে চাইলাম, কিভাবে মারা যায় মেয়েটি। তিনি উত্তরে কেবল বলেছিলেন, ভালবাসা। তার কথার সঠিক অর্থ তখন আমি ধরতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম বিয়ে করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। তিনি আরও একটা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা আমাকে বলেছিলেন। বলেছিলেন তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছেন। পরে জানতে পেরেছিলাম আসলে তিনি কোন জায়গায় কার কাছে যাচ্ছিলেন। আর্চডিকন ব্রাবাজন সম্পর্কে কোন ধারণাই আমার ছিল না।

যাইহোক, কোচের যাত্রীদের মধ্যে খুনী হিসেবে সন্দেহভাজন কাউকে মনে হয়নি। তবে নজর রেখেছিলাম দুই তরুণ-তরুণীর ওপর। তারা হল যোয়ানা আর এমলিন প্রাইস।

–মিস এলিজাবেথ টেম্পলের মৃত্যুর আগে আর কোন ঘটনা ঘটেনি?

–হ্যাঁ, ঘটেছে। আমার ম্যানর হাউসে অতিথি হওয়া। সে ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন মিঃ র‍্যাফায়েল। ওখানেই তার পরবর্তী নির্দেশ পাওয়া যাবে, এমন ধারণা হয়েছিল আমার। কিন্তু জানতাম না যে খোদ অকুস্থলেই আমাকে পৌঁছে দিয়েছেন মিঃ র‍্যাফায়েল।

ম্যানর হাউসে গিয়ে সাক্ষাৎ পেলাম তিন বোনের। প্রাচীন আমলের জমিদার ভবন, তার পরিবেশ, বাগান সব মিলিয়ে কেমন একটা গা শিরশিরানো অবস্থা হল আমার। মনে হল বাড়ির আনাচে-কানাচে যেন ভয় জমাট বেঁধে আছে।

তিন বোনের মধ্যে ক্লোটিলডার ওপরেই আমার প্রথমে নজর পড়ল। যথার্থ ব্যক্তিত্বময়ী চরিত্র। বোনদের মধ্যে বৈশিষ্টপূর্ণ। মনে হল খুন করার মতো মানসিক জোর যদি কারোর থাকে, তিন জনের মধ্যে এরই থাকা সম্ভব। যদিও, খুন বা খুনীর বিষয়ে স্পষ্ট কোন ধারণাই এখনো পর্যন্ত আমার ছিল না।

অ্যানথিয়াকে দেখে মনে হল, সারাক্ষণ সে কেমন ভীত হয়ে রয়েছে। থেকে থেকে পেছন ফিরে তাকায়–যেন পেছনে কারো পদশব্দ শুনে চমকে উঠছে।

দ্বিতীয় দিনে তাকে নিয়ে বাগানে গেলাম। কাচঘরের ধ্বংসস্তূপের ওপরে পলিগোনামের লতা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই লতা এমনই অদ্ভুত যে দ্রুত বেড়ে উঠে সবকিছু গ্রাস করে ফেলে।

স্তূপের কাছে গিয়ে আনথিয়া কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তার চোখেমুখের ভীত ভাব আমার চোখ এড়াল না। সবই কেমন রহস্যময় হয়ে উঠতে লাগল–আমিও আগ্রহী হয়ে উঠতে লাগলাম।

ইতিমধ্যে ঘটল সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এলিজাবেথ টেম্পল মারা গেলেন। তার পরেই আমার চোখের ওপর থেকে যেন প্রহেলিকার যবনিকা সরে গেল। আমি বুঝতে পারলাম তিনটে খুন হয়েছে।

মিঃ র‍্যাফায়েলের ছেলের কথা শুনলাম। ভেরিটি হান্ট নামের মেয়েটাকে সে খুন করেছে, সেকথা সকলেই জানে। একমাত্র আর্চডিকন ব্রাবাজন জানতেন ওরা দুজন পরস্পরকে ভালবাসত। সেই ভালবাসার পরিণতি খুন হতে পারে না। কিন্তু খুনের কারণ তিনিও ভেবে পাননি।

এলিজাবেথ টেম্পলের সেই আশ্চর্য কথাটি-ভেরিটির মৃত্যুর কারণ ভালবাসা আমাকে পথ দেখিয়ে দিল এবারে। ভালবাসা–মেয়েটির প্রতি ক্লোটিলডার সর্বগ্রাসী ভালবাসাই খুনের ঘটনার মূল কারণ, বুঝতে পারলাম।

ভেরিটি এই উন্মত্ত ভালবাসার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চাইছিল। পুরুষের ভালবাসা, সংসার সন্তান তার কাম্য ছিল। মাইকেলকে বিয়ে করার সংকল্পের কথা সম্ভবত সে তার প্রাক্তন শিক্ষয়িত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল।

আর্চডিকন ব্রাবাজন ওদের নির্দিষ্ট করা সময়ে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ভেরিটি এলো না। মাইকেলও জানতে পারল না কিছু। অনুমান করতে পারি, ভেরিটির হাতের লেখা নকল করে তাকে হয়তো জানানো হয়েছিল, সে শেষ মুহূর্তে মন পরিবর্তন করেছে।

ক্লোটিলডা মেয়েটিকে ছেলেটির কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তার উন্মত্ত ভালবাসা তাকে বুঝিয়েছিল, ওরকম একটি বদ স্বভাবের ছেলের কাছ থেকে মেয়েটিকে বাঁচাতে হলে তাকে খুন করেই তা করতে হবে। তিনি তাকে তার অজান্তে পানীয়ের সঙ্গে বিষপান করান। তারপর তার মৃতদেহটা কাচঘরের ইট পাথরের তলায় কবর দিয়ে দেন।

–অন্য বোনেরা কি কিছুই সন্দেহ করেনি?

–বোনেদের মধ্যে মিসেস গ্লাইন তখন ওখানে ছিলেন না। অ্যানথিয়া ছিল, সে স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও একেবারে কিছু আন্দাজ করতে পারেনি তা নয়। ক্লোটিলডার ধ্বংস্তূপ সম্পর্কে হঠাৎ আগ্রহ বৃদ্ধি, পলিগোনাম লতা লাগানো, তারপর অ্যানথিয়া কাচঘর তৈরি করার কথা বললে অসন্তোষ প্রকাশ করা–এসব তাকে সন্দিহান করে তুলেছিল।

এরপর ক্লোটিলডা নোরা ব্রড নামের মেয়েটির দিকে হাত বাড়াল। পিকনিকের নাম করে তাকে একদিন গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করেন। তারপর মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দেহটা প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে নালায় ফেলে আসে। আর গুজব ছড়াতে থাকে ভেরিটিকে সর্বশেষ দেখা গেছে, মাইকেলের গাড়ি করে যেতে।

অ্যানথিয়া বুঝতে পেরেছিল, সে যে কিছু কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে ক্লোটিলডা তা জেনেছে। তাই সে সারাক্ষণ ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত, ক্লোটিলডা আবার কি করে বসে। হাওয়ার শব্দে থেকে থেকে পেছন ফিরে তাকানোর অদ্ভুত এক মানসিকতার রোগী হয়ে উঠেছিল সে। আমার ধারণা.সে-ও রেহাই পেত না। তাকেও একদিন মরতে হতো। হয়তো বিষপ্রয়োগেই। একইভাবে ক্লোটিলডা আবার কোন একটা অজুহাত রটনা করে দিত।

প্রফেসর ওয়ানস্টেড বললেন, সেই পুরনো থিওরি, অপরাধ অপরাধকে টেনে আনে। আচ্ছা, সে রাতে আর কি হয়েছিল জানেন?

ক্লোটিলডার কথা বলছেন? দুধের গ্লাস হাতে নিয়েই তো তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। দুধটা কি উনি পান করেছিলেন?

-হ্যাঁ। ওতে যে বিষ মেশানো থাকতে পারে কেউ ভাবেনি। তাই বাধাও দেয়নি।

বিষ মেশানো দুধ পান করেই শেষ পর্যন্ত তাকেও পালাতে হল। তার পক্ষে এই পরিণতিই স্বাভাবিক ছিল। দশবছর ধরে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছেন তিনি। ভালবাসার দাহ–শেষ পর্যন্ত নিজেই নিজের ওপর প্রতিশোধ নিলেন। বেচারি ভেরিটি নারীর স্বাভাবিক ও সাধারণ চাওয়া স্বামী সংসার সে চেয়েছিল, কিন্তু পেল না। তার সব চাওয়া-পাওয়া সমাহিত হয়ে রইল কাচঘরের ধ্বংসস্তূপের নিচে–এ দুঃখ সওয়া যায় না।

বত্রিশ বছরের যুবক মাইকেল র‍্যাফায়েলের সঙ্গে মিস মারপলের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন প্রফেসর ওয়ানস্টেড।

-মাইকেল, ইনি মিস মারপল, তোমার ব্যাপারে ইনিই সবকিছু করেছেন।

–সুদর্শন তরুণ মুখ তুলে তাকাল। স্মিত হাসল।

–ওঃ, হ্যাঁ, নামটা শুনেছি। অনেক ঝামেলা সয়েছেন আপনি, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

প্রফেসর ওয়ানডেকে উদ্দেশ্য করে বলল সে, শুনেছি, ওরা নাকি আমাকে ছেড়ে দেবার কথা ভাবছে?

–হ্যাঁ, বললেন ওয়ানস্টেড, তুমি শিগগিরই মুক্তি পাবে।

–এবার তুমি স্বাধীনভাবে নিজের জীবন তৈরি করার সুযোগ পাবে, স্নেহার্দ কণ্ঠে বললেন মিস মারপল, সবকিছুই করেছেন তোমার বাবা।

–আমার বাবা? তিনি কি আমার সম্পর্কে ভেবেছিলেন?

–হ্যাঁ। বললেন মিস মারপল, মৃত্যুশয্যায় থেকেও তিনি চেয়েছিলেন তুমি যাতে অন্যায়ের শিকার না হও। তিনি নিজেও ন্যায়বান মানুষ ছিলেন। আমাকে চিঠিতে সেকথাই লিখেছিলেন।

মাইকেল অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকল শুভ্রকেশ বৃদ্ধার মুখের দিকে।

–বিদায়, তোমার জন্য অন্তরের শুভকামনা রইল।

.

অদ্ভুত মহিলা। যেমন বলেছিলেন, কাচঘরের মেঝের নিচে মৃতদেহটা পাওয়া গেছে। মিঃ সুস্টার বললেন।

–উনি আসবেন এখনই। বললেন মিঃ ব্রডরিব।

–সবই কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। বললেন মিঃ সুস্টার।

এই সময় ঘরে ঢুকলেন মিস মারপল। ওরা দুজন তাকে অভ্যর্থনা জানালেন।

–আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।

–আমি আমার শর্ত পালন করতে পেরেছি, এটাই আমার আনন্দ, বললেন মিস মারপল।

–মিঃ র‍্যাফায়েলের নির্দেশ অনুযায়ী এবারে বিশ হাজার পাউণ্ড আপনার–ওটা কি আপনার ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেব? বললেন মিঃ ব্রডরিব।

–তাই করুন। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।

বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন মিস মারপল।

Exit mobile version