চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল। আর বসে থাকতে পারলেন না মিস মারপল। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
২. রানি অ্যানের জমিদারী ভবন
০৬.
পরদিন সকালে সকলে গেলেন রানি অ্যানের জমিদারী ভবন দেখতে। ইতিহাস জড়ানো সুন্দর বাড়িটির সঙ্গে একটি অপূর্ব বাগানও রয়েছে।
বাড়িটির স্থাপত্যের নিদর্শন দেখে স্থপতি রিচার্ড জেনসন খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। আবেগে তিনি ঘুরে ঘুরে প্রতিটি ঘরের নানা বর্ণনা সকলকে শোনাতে শুরু করলেন। অনেকেই ভিড় করে তার বক্তৃতা শুনতে লাগলেন।
মিস মারপল সিঁড়ি বেয়ে নিচের তলায় চলে গেলেন। তার পেছন পেছন এলেন মিস কুক আর মিস ব্যারো।
নিচে নেমে একটা খুনের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে লাগলেন তারা। খুনটা হয়েছিল এই বাড়িতেই। সতেরোশো সালের কোন বছর।
কথিত আছে সেই সময় লেডি মোফাটের এক প্রেমিক ছিল। সে গোপন দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতো আবার গোপন দরজা দিয়েই বেরিয়ে যেতো।
স্যার রিচার্ড মোফাট সাগরপাড়ে কোথাও ছিলেন। তিনি ফিরে এসে স্ত্রী আর তার প্রেমিককে ঘনিষ্ঠ ভাবে আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। তার পরেই সেই তরুণকে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় কার্পেটের ওপর পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
কথা বলতে বলতে মিস কুককে লক্ষ্য করছিলেন মিস মারপল আর মনে করবার চেষ্টা করছিলেন কোথায় তাকে দেখেছেন।
ঠিক মনে পড়ে গেল। কিন্তু যখন তাকে দেখেছেন তখন মিস কুকের চুলের রঙ ছিল কালো। এখন তা গাঢ় হলুদ। ব্যাপারটা চিন্তায় ফেলে দিল তাকে।
নিচ তলা থেকে ডাইনিং হল পার হয়ে সকলে একসময় চলে এলেন সংলগ্ন বাগানে। মিস মারপল বাগানে একটি আসনে আরাম করে বসে পড়লেন।
ইতিমধ্যে মিস এলিজাবেথ টেম্পল এবং মিসেস রাইজেল পোর্টারও বাগানে নেমে এসেছেন।
মিস এলিজাবেথ টেম্পল মিস মারপলের পাশে এসে বসলেন।
দুজন কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকার পর এলিজাবেথ এই বাগান সম্পর্কে কথা বলতে আরম্ভ করলেন।
–এই চমৎকার বাগানের পরিকল্পনা করেছিলেন হেলম্যান সম্ভবত ১৭৯৮ কিংবা ১৮০০ খ্রিঃ। খুব প্রতিভাধর ছিলেন তিনি। খুব অল্প বয়সেই মারা যান।
–অল্প বয়সে মৃত্যু হয়েছে শুনলে বড় দুঃখ হয়। বললেন মিস মারপল। যে কোন জীবনই অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি মাঝপথে তার গতি স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।
–আপনি এই ভ্রমণে এসেছেন কি বাড়ি দেখতে না বাগান? এলিজাবেথ টেম্পল বললেন।
–বাড়ি দেখতেই এসেছি, বললেন মিস মারপল, এক দয়ালু বন্ধু আমার জন্য এই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেরকম বিখ্যাত বাড়ি দেখার সুযোগ জীবনে পাইনি।
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আপনি প্রায় ভ্রমণে বের হন?
প্রায়ই না। এবারে অবশ্য শুধু ঘুরে বেড়াব বলেই আসা নয়। আপনি নিশ্চয় ভাববেন, তাহলে কি উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছি ভেবে, তাই না?
মিস মারপল সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তীক্ষ্ণ নজরে তিনি যেন তার সঙ্গিনীকে জরীপ করতে লাগলেন।
পরে তিনি বললেন, আমি জানি আপনি একজন বিখ্যাত মানুষ। আপনার স্কুলেরও খুব নামডাক আছে। আপনাকে দেখে মনে হয়, আপনি তীর্থযাত্রায় এসেছেন। তীর্থযাত্রী বলেই মনে হয় আপনাকে।
–চমৎকার বলেছেন। হ্যাঁ, আমি তীর্থযাত্রাতেই বেরিয়েছি।
মিস পারপল দু-এক মুহূর্ত নীরব থাকার পরে বললেন, যে বন্ধু আমার জন্য এই ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তিনি মারা গেছেন। তার নাম আপনিও নিশ্চয় শুনে থাকবেন মিঃ র্যাফায়েল।
জ্যাকসন র্যাফায়েল? হ্যাঁ, তার নাম আমার পরিচিত। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনি না বা দেখিনি। আমাদের এক শিক্ষা প্রকল্পে তিনি প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ আগে কাগজে তার মৃত্যু-সংবাদ পড়েছি। তিনি তাহলে আপনার পুরনো বন্ধু ছিলেন।
–না, বললেন মিস মারপল, একবছর আগে ওয়েস্ট ইণ্ডিজে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার আগে তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতাম না। আপনি তার পরিবারের কাউকে চিনতেন?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন এলিজাবেথ। পরে বললেন, একটি মেয়ে একসময় আমার স্কুলে পড়ত, সে মিঃ রাফায়েলের ছেলের বাগদত্তা ছিল।
–ছেলেটি ওকে বিয়ে করেনি? জানতে চান মিস মারপল।
–না।
–কিন্তু কেন?
–আমি ঠিক জানি না। ছেলেটির আগ্রহ জাগাবার মতই চেহারা ছিল। মেয়েটি অত্যন্ত সুন্দর ছিল দেখতে। তবু কেন যে ওদের বিয়ে হয়নি…মেয়েটি মারা যায়…
–মারা যায়…কিন্তু কেন?
এলিজাবেথ অন্যদিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলেন, ভালোবাসা।
–ভালোবাসা? মিস মারপল যেন কথাটার প্রতিধ্বনি করলেন।
–হ্যা…পৃথিবীর সবচেয়ে ভয় জাগানো কথা–ভালোবাসা।
.
০৭.
বিকেলে চতুর্দশ শতাব্দীর একটা প্রাচীন গীর্জা দেখতে গিয়েছিল সকলে। মিস মারপল ইচ্ছে করেই বিরতি দিয়েছিলেন। তিনি একটু বিশ্রাম করে বড় রাস্তার ধারে চা-ঘরে হাজির হলেন।
একটা আরামপ্রদ আসনে বসে তিনি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে ভাবতে লাগলেন।
ইতিমধ্যে অন্যরাও ফিরে এসেছে। মিস মারপলের পাশের দুটি চেয়ারে এসে বসলেন মিস কুক আর মিস ব্যারো। চতুর্থ চেয়ারটিতে বসলেন মিঃ ক্যাসপার।
মিস মারপল মিস কুককে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কেমন মনে হচ্ছে, আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি।
মিস কুক তার বান্ধবী মিস ব্যারোর দিকে তাকালেন। যেন একথার জবাবটা তিনিই দেবেন। মিস মারপলও মিস ব্যারোর দিকে তাকালেন। পরে বললেন, আমি সেন্ট মেরী মিডে থাকি। মাচ বেনহ্যাম থেকে বেশিদূরে নয়। আমার কাছাকাছি কোথাও আপনি ছিলেন কিনা মনে করতে পারছি না।