কখনো ইংরাজি, কখনো ফরাসী বা জার্মান ভাষা বেরিয়ে আসছ তার মুখ থেকে। মেদবহুল ভুরুর মানুষটি একই ভাবে নানা ভাষায় সঙ্গীর কথার জবাব দিয়ে চলেছেন।
আকার-আকৃতি দেখে মিস মারপলের ধারণা হল মেদবহুল ভদ্রলোক নিশ্চয় প্রফেসর ওয়ানস্টেড হবেন। আর অদ্ভুত বিদেশীটি মিঃ ক্যাসপার। ওই দুজনের সামনে ষাট বছর বয়সী মহিলাটি বেশ দীর্ঘাঙ্গী। এ বয়সেও যথেষ্ট সুন্দরী। বেশ লক্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। নিচু কণ্ঠে কথা বলছেন।
কোচে দুজোড়া দম্পতি রয়েছেন। একজন আমেরিকান, মধ্যবয়স্ক, স্ত্রীর অনুগত বোঝা যাচ্ছে। স্ত্রীটি বেশ বাঁচাল।
অন্য দম্পতি ইংরাজ। মধ্যবয়স্ক। ভদ্রলোককে একজন সেনাবাহিনীর মানুষ বলেই মনে হল মিস মারপলের। তিনি তাঁর নোটবইতে এই দুজনকে কর্ণেল আর মিসেস ওয়াকার বলে দাগ দিলেন।
এদের পেছনে দীর্ঘ কৃশ আকৃতির একজন প্রযুক্তিবিদ্যা বিষয়ে কথা বলে চলেছিলেন। ইনি একজন স্থপতি হওয়া সম্ভব।
কোচের শেষপ্রান্তে বসেছিলেন দুজন মধ্যবয়স্কা মহিলা–তারা একসঙ্গে ভ্রমণ করছেন। একজনের বেশ আটোসাঁটো চেহারা। এই মহিলাটিকে মিস মারপলের কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল। কোথায় দেখেছেন, মনে করতে পারছিলেন না।
অবশিষ্ট যাত্রীটি একজন তরুণ। বয়স কুড়ির বেশি হবে না। ছেলেটি সেই ভাইঝি তরুণীকে আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করছিল। ভাইঝিটির চোখেও সমান আগ্রহ লক্ষ্য করলেন মিস মারপল।
মধ্যাহ্ন ভোজ সারার জন্য নদীর কাছাকাছি একটা সুন্দর হোটেলে যাত্রার বিরতি ঘটল। বিকেলের ভ্রমণসূচীতে রয়েছে ব্লেনহীম।
হোটেলে পৌঁছনোর পরে যাত্রীরা পরস্পরের কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলেন।
মিস মারপল ইতিমধ্যে যাত্রীদের নাম জেনে নিয়েছেন। মেদবহুল লোমশভুরুর মানুষটি প্রফেসর ওয়ানস্টেড–যেরকম তিনি ভেবেছিলেন। বিদেশীটি হলেন মিঃ ক্যাসপার।
কর্তৃত্বব্যঞ্জক চেহারার মহিলাটি মিসেস রাইজেল পোর্টার। আর ভাইঝিটি জোয়ানা ক্রফোর্ড। তরুণটির নাম এমলিন প্রাইস।
ইতিমধ্যে এই দুই তরুণ-তরুণী তাদের পছন্দ অপছন্দ, রাজনীতি, শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে মতামত বিনিময় করে পরস্পরের কাছাকাছি হয়ে পড়েছে।
মধ্যবয়স্কা যে দুই মহিলা একসঙ্গে ভ্রমণে এসেছিলেন তারা হলেন মিস কুক আর মিস ব্যারো। ওই মিস কুককেই মিস মারপলের পরিচিত মনে হয়েছে। কিন্তু ঠিক কোথায় তাকে দেখেছেন তিনি তা মনে করতে পারছিলেন না।
তিনি লক্ষ্য করলেন, মিস কুকও যেন তাকে কেমন এড়িয়ে চলতে চাইছেন। তবে এটা তাঁর কল্পনাও হতে পারে।
এই পনেরো জন অপরিচিত মানুষের, মিস মারপল ভাবলেন, অন্তত একজন অবশ্যই কোন ব্যাপারে জড়িত।
সুন্দরী মহিলটির পরিচয় জানা গেল, মিস এলিজাবেথ টেম্পল বলে। তিনি এক বিখ্যাত মেয়েদের স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা।
আর কৃশ চেহারার তরুণটি রিচার্ড জেনসন, একজন স্থপতি।
মিস মারপলের মনে হলো একমাত্র বিদেশী ভদ্রলোক মিঃ ক্যাসপারই এখানে স্বাভাবিক হাসিখুশি মানুষ। অন্য সকলের মুখেই যেন অজ্ঞাত কিছুর অদৃশ্য ক্ষীণ ছায়া লেগে রয়েছে।
.
রাতে শুতে যাবার আগে যাত্রীদের যাচাই করে তার যা যা মনে হয়েছে তা নোটবুকে টুকে নিলেন।
মিস রাইজেল পোর্টার–অতন্ত আত্মকেন্দ্রিক। খুনের সঙ্গে জড়িত থাকা অসম্ভব। তবে কোন সূত্রের সন্ধান তার কাছে থাকা সম্ভব।
ভাইঝি, জোয়ানা ক্রফোর্ড–অত্যন্ত চৌখস।
মিস এলিজাবেথ টেম্পল–আগ্রহ জাগানো ব্যক্তিত্ব। অত্যন্ত সৎ বলেই মনে হয়। এমন একজনের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ ঘটুক–হয়তো মিঃ র্যাফায়েলের তাই ইচ্ছা ছিল।
প্রফেসর ওয়ানস্টেড–কোন বিজ্ঞানী হওয়াই সম্ভব। অথবা ডাক্তার।
মিঃ ও মিসেস বাৰ্টলার–চমৎকার আমেরিকার মানুষ। এদের নাম দুটি কেটে দিলেন তিনি। ওয়েস্ট ইণ্ডিজের কারও সঙ্গে এদের কোন যোগসূত্র থাকা সম্ভব মনে হল না তার।
রিচার্ড জেনসন-স্থপতি। এর মধ্যে স্থপতি বিদ্যার স্থান কিভাবে হতে পারে বুঝতে পারলেন না মিস মারপল। কোন গোপন সুড়ঙ্গের অবস্থানের ইঙ্গিত কি পাওয়া সম্ভব তার কাছ থেকে? হয়তো সেটা খুঁজে পেতে তিনি সাহায্য করতে পারেন।
মিস বুক ও মিস ব্যারো–অতি সাধারণ দুজন মানুষ। কিন্তু মিস কুককে আগে কোথাও দেখা গেছে। একসময় ঠিক মনে পড়ে যাবে।
কর্ণেল আর মিসেস ওয়াকার–অবসরপ্রাপ্ত সামরিক মানুষ। এদের কাছে কিছু নেই। মিস বেন্থাম আর মিস মলি–এই দুই বুড়ীকে অপরাধী হিসেবে ভাবা যায় না। তবে বয়স এদের প্রচুর ঘটনার কথা বা বিষয় নিশ্চয় জানিয়েছে। কোন দরকারী সূত্র এদের কাছ থেকে পাওয়া অসম্ভব নয়।
মিঃ ক্যাসপার–অত্যন্ত উত্তেজনাপ্রবণ এক মানুষ। মারাত্মক চরিত্র বলেই মনে হয়। মিস মারপল এই মানুষটিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে রাখলেন।
এমলিন প্রাইস–সম্ভবতঃ এখনো ছাত্রজীবন কাটেনি। সময় বিশেষে ছাত্ররাও হিংস্র হতে পারে।
পর্যালোচনার ফাঁকে ফাঁকে কোন হত্যাকারীর কথাই মাথায় ঘুরছিল মিস মারপলের। সম্ভাব্য নিহত ব্যক্তিটি কে হওয়া সম্ভব বা তার ব্যাপার কি হতে পারে–এই কোচের মানুষদের মধ্যে কার পক্ষে সম্ভাব্য শিকার হওয়া সম্ভব?
কাউকেই সেভাবে বেছে নিতে পারলেন না মিস মারপল।
তবে মিস পোর্টার হওয়া অসম্ভব না। তিনি অর্থবতী, ফলে কিছুটা অপ্রিয়ও। ভাইঝিটি উত্তরাধিকার পেতে পারে। কিন্তু তবু খুনের কোন সূত্রের আভাস তাঁর চোখে পড়ল না।