আমি জানতে চাইলাম, কিভাবে মারা যায় মেয়েটি। তিনি উত্তরে কেবল বলেছিলেন, ভালবাসা। তার কথার সঠিক অর্থ তখন আমি ধরতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম বিয়ে করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। তিনি আরও একটা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা আমাকে বলেছিলেন। বলেছিলেন তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছেন। পরে জানতে পেরেছিলাম আসলে তিনি কোন জায়গায় কার কাছে যাচ্ছিলেন। আর্চডিকন ব্রাবাজন সম্পর্কে কোন ধারণাই আমার ছিল না।
যাইহোক, কোচের যাত্রীদের মধ্যে খুনী হিসেবে সন্দেহভাজন কাউকে মনে হয়নি। তবে নজর রেখেছিলাম দুই তরুণ-তরুণীর ওপর। তারা হল যোয়ানা আর এমলিন প্রাইস।
–মিস এলিজাবেথ টেম্পলের মৃত্যুর আগে আর কোন ঘটনা ঘটেনি?
–হ্যাঁ, ঘটেছে। আমার ম্যানর হাউসে অতিথি হওয়া। সে ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন মিঃ র্যাফায়েল। ওখানেই তার পরবর্তী নির্দেশ পাওয়া যাবে, এমন ধারণা হয়েছিল আমার। কিন্তু জানতাম না যে খোদ অকুস্থলেই আমাকে পৌঁছে দিয়েছেন মিঃ র্যাফায়েল।
ম্যানর হাউসে গিয়ে সাক্ষাৎ পেলাম তিন বোনের। প্রাচীন আমলের জমিদার ভবন, তার পরিবেশ, বাগান সব মিলিয়ে কেমন একটা গা শিরশিরানো অবস্থা হল আমার। মনে হল বাড়ির আনাচে-কানাচে যেন ভয় জমাট বেঁধে আছে।
তিন বোনের মধ্যে ক্লোটিলডার ওপরেই আমার প্রথমে নজর পড়ল। যথার্থ ব্যক্তিত্বময়ী চরিত্র। বোনদের মধ্যে বৈশিষ্টপূর্ণ। মনে হল খুন করার মতো মানসিক জোর যদি কারোর থাকে, তিন জনের মধ্যে এরই থাকা সম্ভব। যদিও, খুন বা খুনীর বিষয়ে স্পষ্ট কোন ধারণাই এখনো পর্যন্ত আমার ছিল না।
অ্যানথিয়াকে দেখে মনে হল, সারাক্ষণ সে কেমন ভীত হয়ে রয়েছে। থেকে থেকে পেছন ফিরে তাকায়–যেন পেছনে কারো পদশব্দ শুনে চমকে উঠছে।
দ্বিতীয় দিনে তাকে নিয়ে বাগানে গেলাম। কাচঘরের ধ্বংসস্তূপের ওপরে পলিগোনামের লতা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই লতা এমনই অদ্ভুত যে দ্রুত বেড়ে উঠে সবকিছু গ্রাস করে ফেলে।
স্তূপের কাছে গিয়ে আনথিয়া কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তার চোখেমুখের ভীত ভাব আমার চোখ এড়াল না। সবই কেমন রহস্যময় হয়ে উঠতে লাগল–আমিও আগ্রহী হয়ে উঠতে লাগলাম।
ইতিমধ্যে ঘটল সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এলিজাবেথ টেম্পল মারা গেলেন। তার পরেই আমার চোখের ওপর থেকে যেন প্রহেলিকার যবনিকা সরে গেল। আমি বুঝতে পারলাম তিনটে খুন হয়েছে।
মিঃ র্যাফায়েলের ছেলের কথা শুনলাম। ভেরিটি হান্ট নামের মেয়েটাকে সে খুন করেছে, সেকথা সকলেই জানে। একমাত্র আর্চডিকন ব্রাবাজন জানতেন ওরা দুজন পরস্পরকে ভালবাসত। সেই ভালবাসার পরিণতি খুন হতে পারে না। কিন্তু খুনের কারণ তিনিও ভেবে পাননি।
এলিজাবেথ টেম্পলের সেই আশ্চর্য কথাটি-ভেরিটির মৃত্যুর কারণ ভালবাসা আমাকে পথ দেখিয়ে দিল এবারে। ভালবাসা–মেয়েটির প্রতি ক্লোটিলডার সর্বগ্রাসী ভালবাসাই খুনের ঘটনার মূল কারণ, বুঝতে পারলাম।
ভেরিটি এই উন্মত্ত ভালবাসার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চাইছিল। পুরুষের ভালবাসা, সংসার সন্তান তার কাম্য ছিল। মাইকেলকে বিয়ে করার সংকল্পের কথা সম্ভবত সে তার প্রাক্তন শিক্ষয়িত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল।
আর্চডিকন ব্রাবাজন ওদের নির্দিষ্ট করা সময়ে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ভেরিটি এলো না। মাইকেলও জানতে পারল না কিছু। অনুমান করতে পারি, ভেরিটির হাতের লেখা নকল করে তাকে হয়তো জানানো হয়েছিল, সে শেষ মুহূর্তে মন পরিবর্তন করেছে।
ক্লোটিলডা মেয়েটিকে ছেলেটির কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তার উন্মত্ত ভালবাসা তাকে বুঝিয়েছিল, ওরকম একটি বদ স্বভাবের ছেলের কাছ থেকে মেয়েটিকে বাঁচাতে হলে তাকে খুন করেই তা করতে হবে। তিনি তাকে তার অজান্তে পানীয়ের সঙ্গে বিষপান করান। তারপর তার মৃতদেহটা কাচঘরের ইট পাথরের তলায় কবর দিয়ে দেন।
–অন্য বোনেরা কি কিছুই সন্দেহ করেনি?
–বোনেদের মধ্যে মিসেস গ্লাইন তখন ওখানে ছিলেন না। অ্যানথিয়া ছিল, সে স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও একেবারে কিছু আন্দাজ করতে পারেনি তা নয়। ক্লোটিলডার ধ্বংস্তূপ সম্পর্কে হঠাৎ আগ্রহ বৃদ্ধি, পলিগোনাম লতা লাগানো, তারপর অ্যানথিয়া কাচঘর তৈরি করার কথা বললে অসন্তোষ প্রকাশ করা–এসব তাকে সন্দিহান করে তুলেছিল।
এরপর ক্লোটিলডা নোরা ব্রড নামের মেয়েটির দিকে হাত বাড়াল। পিকনিকের নাম করে তাকে একদিন গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করেন। তারপর মুখ ক্ষতবিক্ষত করে দেহটা প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে নালায় ফেলে আসে। আর গুজব ছড়াতে থাকে ভেরিটিকে সর্বশেষ দেখা গেছে, মাইকেলের গাড়ি করে যেতে।
অ্যানথিয়া বুঝতে পেরেছিল, সে যে কিছু কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে ক্লোটিলডা তা জেনেছে। তাই সে সারাক্ষণ ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত, ক্লোটিলডা আবার কি করে বসে। হাওয়ার শব্দে থেকে থেকে পেছন ফিরে তাকানোর অদ্ভুত এক মানসিকতার রোগী হয়ে উঠেছিল সে। আমার ধারণা.সে-ও রেহাই পেত না। তাকেও একদিন মরতে হতো। হয়তো বিষপ্রয়োগেই। একইভাবে ক্লোটিলডা আবার কোন একটা অজুহাত রটনা করে দিত।
প্রফেসর ওয়ানস্টেড বললেন, সেই পুরনো থিওরি, অপরাধ অপরাধকে টেনে আনে। আচ্ছা, সে রাতে আর কি হয়েছিল জানেন?