দেখা গেল ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন ক্লোটিলডা।
-ওহ, মিস ব্র্যাডবেরি স্কট, বলে উঠলেন মিস মারপল, কিছু বলবেন?
–আপনার কিছু দরকার কিনা জানতে এসেছিলাম।
ক্লোটিলডার মুখ থমথমে, বিষণ্ণ, গোলাপি দীর্ঘ পোশাকে শরীর আবৃত। তার দিকে তাকিয়ে মিস মারপলের মনে হল, যেন বিষাদের প্রতিমূর্তি।
-ওহ, ধন্যবাদ, আমার কিছু চাই না। দুধটা আমি পান করিনি।
–কি আশ্চর্য, কেন? অবাক হল ক্লোটিলডা। সে বিছানার পাশে এগিয়ে গেল।
–ওটা পান করা ঠিক হবে না, মনে হল। বললেন মিস মারপল।
–ঠিক হবে না–আপনার একথার অর্থ?
ক্লোটিলডার কণ্ঠস্বর, চোখের দৃষ্টি পাল্টে গেল। মিস মারপল ধীরে ধীরে বললেন, আমি কি বলছি, আপনার বুঝতে না পারার কথা নয় মিস ব্র্যাডবেরি স্কট।
–ওহো, দুধটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই, আমি এখুনি গরম দুধ নিয়ে আসছি। ক্লোটিলডা দুধের গ্লাসটা তুলে নিলেন।
–মিছে আর কেন কষ্ট করবে। আমি ওই দুধ পান করতে পারি না, বুঝতেই পারছেন।
–অদ্ভুত সব কথা বলছেন। এভাবে কথা বলছেন কেন? কে আপনি?
–আমি, মৃদু হাসলেন মিস মারপল, আমি হচ্ছি নিয়তি।
–নিয়তি? একথার মানে?
–আমার ধারণা, মানেটা আপনার অজানা নয়। আপনি শিক্ষিত মহিলা। দেরি হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু নিয়তি নেমে আসে।
–আপনি
-হ্যাঁ, আমি বলছি একটি সুন্দরী ফুটফুটে মেয়ের কথা, যাকে আপনি নিজের হাতে মেরেছিলেন।
-কী বলছেন? কাকে আমি মেরেছিলাম?
–আপনার প্রিয় ভেরিটির কথা বলছি আমি।
–তাকে আমি মারব কেন?
কারণ আপনি ভেরিটিকে ভালবাসতেন। বড় ভয়ানক সে ভালবাসা। ওই চার অক্ষরের শব্দটি সম্পর্কে এরকম কথাই কদিন আগে আপনি আমাকে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। অন্য এক ভালবাসা মেয়েটির জীবনেও এসেছিল, একটি তরুণকে ভালবেসেছিল সে, চেয়েছিল নারীর স্বাভাবিক জীবন। অবশ্য যাকে বিয়ে করে ঘরসংসার পাতবার স্বপ্ন সে দেখেছিল, সেই ছেলেটি ভাল ছিল না।
ক্লোটিলডা যন্ত্রচালিতের মত এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসলেন। অপলক চোখে মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তাহলে সবই জেনেছেন–
-হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি।
–অস্বীকার করব না, আপনার কথা সবই সত্যি। কিন্তু সত্যি-মিথ্যেয়, আজ আর কি এসে যায়?
–ঠিকই বলেছেন, এতে কিছু যাবে আসবে না।
–কিন্তু আপনি যদি বুঝতেন, কী নিদারুণ যন্ত্রণা আমি সয়েছি। বুকের সবটুকু ভালবাসা স্নেহ উজাড় করে দিয়েছিলাম যাকে, এক অযোগ্য অপদার্থ মানুষের কাছে হারাতে বসেছিলাম তাকে–এ যে কী অসহ্য যন্ত্রণা
–আমি অনুভব করতে পারছি
–আমি তা হতে দিতে চাইনি–আমি পারি না–
-হ্যাঁ, আমি জানি, তারা বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আপনি তাকে খুন করেন। ভালবাসতেন বলেই আপনি তা করেছিলেন।
-আপনি বিশ্বাস করেন একথা? যাকে অন্তর উজাড় করে ভালবেসেছি তার মাথা এভাবে চূর্ণ করে খুন করা সম্ভব?
–আমি জানি, আপনাকে তা করতে হয়নি।
–তাহলে বলছেন কেন আমি খুন করেছি?
–আপনি ভেরিটির মাথা চূর্ণ করেননি। সেটা হয়েছে অন্য মেয়ের। ভেরিটি এখনো এখানে বাগানেই আছে। আমার ধারণা তাকে কফি বা দুধের সঙ্গে বেশিমাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন। সে মারা গেলে, বাগানের কাচঘরের নিচেই ইট পাথরের তলায় চাপা দিয়েছিলেন। তারপর সেখানে লাগানো হয় পলিগোনাম। বছর বছর সেই গাছের ফুলেই ঢেকে থাকে কাচঘর। এভাবেই ভেরিটিকে আপনি আপনার কাছে রেখে দিয়েছেন।
–মূর্খ! বাইরে গিয়ে এ কাহিনী বলার সুযোগ আপনাকে আমি দেব না।
–তা জানি, আপনার অনেক কম বয়স, আমার চেয়ে শক্তিও অনেক বেশি। আর
–আর কি?
-আপনার এখন হিতাহিত জ্ঞান থাকার কথা নয়। আপনি থেমে থাকতে পারেন না। দুদুটো মেয়েকে খুন করেছেন। যাকে ভালবাসতেন তাকে আর অন্য একজনকে।
সে একটা বাজে নোংরা মেয়ে। কিন্তু নোরা ব্রডকে আমি খুন করেছি আপনি জানলেন কি করে?
ওকে যেভাবে মেরেছেন, ভেরিটিকে সেভাবে মাথা গুঁড়িয়ে দিয়ে মারা আপনার পক্ষে সম্ভব হত না। ঘটনাক্রমে, ওই সময়েই মেয়েটি হারিয়ে গিয়েছিল। তাকে যখন পাওয়া গেল, তার দেহে ছিল ভেরিটির পোশাক। আপনি তাকে ভেরিটি বলে সনাক্ত করলেন। লোকে তাই জানল। কিন্তু আপনি জানতেন মৃতদেহটা ছিল নোরা ব্রডেরই, ভেরিটির নয়। হ্যাঁ, আপনি জানতেন।
–এসব আমি করতে চাইব কেন?
–কারণ, যে ছেলেটি ভেরিটিকে আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল, আপনি চেয়েছিলেন, খুনের অপরাধে তাকে সাজা দিতে। নোরার মৃতদেহ আপনি লুকিয়ে রেখেছিলেন। তার মুখ বিকৃত করেছিলেন যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। তার গায়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন ভেরিটির পোশাক, পাশে রেখেছিলেন তার ব্যাগ, বালা। তারপর আপনি তাকে সনাক্ত করেন ভেরিটি বলে।
একটু থামলেন মিস মারপল। পরে বললেন, তৃতীয় খুনটা আপনি করেছেন একসপ্তাহ আগে। বেচারা মিস এলিজাবেথ টেম্পল। তিনি এ অঞ্চলে আসায় আপনি ভয় পেয়েছিলেন। আপনার ভয় ছিল, ভেরিটি তাকে কিছু জানিয়ে থাকতে পারে। তাই আর্চডিকন ব্রাবাজনের সঙ্গে যাতে মিস টেম্পলের সাক্ষাৎ হয় আপনি তা চাননি। পাছে সত্য উদঘাটিত হয়ে পড়ে। এই সম্ভাবনা বন্ধ করার জন্য আপনাকে কেবল একটা পাথর ঠেলে দিতে হয়েছিল। সেই শক্তি আপনার যথেষ্ট আছে।
-আপনার উপযুক্ত ব্যবস্থা করার মত শক্তিও আমার আছে। কর্কশ কণ্ঠে বললেন ক্লোটিলডা।