মিস মারপল সেই প্রাচীন ম্যানর হাউসের বসবাস ঘরে বসে একটা স্কার্ফ বুনছিলেন।
বোনার কাঁটা নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় নিজের মনেই তিনি বলে উঠলেন–ভেরিটি
নামটা শুনে তার গৃহকর্ত্রীদের কার কি প্রতিক্রিয়া হয়, তা লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যেই তিনি ওই নামটি অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন।
এলিজাবেথ টেম্পলের সর্বশেষ কথা ছিল এটাই–ভেরিটি।
-এরপর যখন তিনি কোচের যাত্রীদের সঙ্গে সান্ধ্যভোজে মিলিত হবেন, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া একবার দেখবেন ঠিক করেছেন।
সামনেই বসেছিলেন তিন বোন। চশমার আড়াল থেকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তিন বোনকে লক্ষ্য করছিল।
মিসেস গ্লাইনের হাতে একটা বই ছিল। বইটা সহসা তার হাত থেকে পড়ে গেল। তিনি অবাক হয়ে মিস মারপলের দিকে তাকালেন।
ক্লোটিলডা কিন্তু মিস মারপলের দিকে না তাকিয়ে মাথা উঁচিয়ে জানালার দিকে তাকাল। তার দুহাত মুষ্ঠিবদ্ধ হল।
চোখের কোণে মিস মারপল দেখলেন, ক্লোটিলডার চোখ জলে ভরে উঠেছে। গাল বেয়ে অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে নামছে।
অ্যানথিয়ার প্রতিক্রিয়া হল সম্পূর্ণ অন্য রকম। সে খুশিভরা গলায় বলে উঠল, ভেরিটি? আপনি তাকে জানতেন? ভেরিটি হান্টকে?
মিস মারপল বললেন, এ নামে আমি কাউকে জানতাম না। আমি দুঃখিত…আপনারা দুঃখ পাবেন জানলে আমি বলতাম না।
-না তা নয়, মিসেস গ্লাইন বললেন, নামটা আমাদের জানা, ওর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল।
হঠাৎ মনে এসে গেল, বললেন মিস মারপল, গতকাল বিকালে দেখা করতে গেলে মিস টেম্পল নামটা বলেছিলেন। নামটা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। হয়তো ওই নামের কথা তিনি ভেবেছিলেন। আবার হয়তো তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন সত্য–ভেরিটির অর্থও তো মনে হয় তাই, তাই না?
মিস মারপলের সতর্ক দৃষ্টি পর পর তিন বোনের মুখভাব ছুঁয়ে গেল।
-নামটা আমাদের পরিচিত এক মেয়ের, তাই চমকে গিয়েছিলাম। বললেন মিসেস গ্লাইন।
–ওর মৃত্যুটা ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। অ্যানথিয়া বললেন।
–অ্যানথিয়া, অত বর্ণনা দেবার কি আছে? ধরা গলায় বললেন ক্লোটিলডা।
–সকলেই তো জানে, বললেন অ্যানথিয়া, মিঃ র্যাফায়েল নিশ্চয়ই আপনাকে তার সম্বন্ধে বলেছেন, তাই না?
–কোন ব্যাপারটা বলছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বললেন মিস মারপল।
–ওর দেহটা ওরা একটা নালায় পড়ে থাকতে দেখেছিল। বললেন অ্যানথিয়া।
ক্লোটিলডা রুমাল বের করে চোখের জল মুছলেন। তার দুচোখে গভীর বিষাদ মাখানো।
–ভেরিটিকে আমরা খুবই ভালবেসেছিলাম, বললেন ক্লোটিলডা, সে এখানেই কিছুদিন ছিল।
–সেও তোমাকে খুব ভালবাসতো। বললেন ল্যাভিনিয়া।
–ওর বাবা-মা আমার বন্ধু ছিলেন। তারা এক প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গেলে আমি তাকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলাম।
–ভেরিটি ফেলোফিল্ডের স্কুলে পড়ত। সেই জন্যেই হয়তো মিস মারপল তাকে মনে রেখেছিলেন। বললেন ল্যাভিনিয়া।
মিস টেম্পল শুনেছি সেখানে প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। বললেন মিস মারপল।
হ্যাঁ আমার কাছেই মানুষ হয়েছিল। বললেন ক্লোটিলডা, খুব ভাল মেয়ে ছিল। পড়াশুনায়ও চমৎকার মাথা ছিল। মিস টেম্পল ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা বলেছিলেন। ওর কথা বলতে আমার বড় কষ্ট হচ্ছে।
-না না, থাক, বললেন মিস মারপল, আমি দুঃখিত, না জেনে দুঃখ জাগিয়ে তুলেছি, আমি অত সব শুনিনি…
.
সেইদিনই সন্ধ্যায় মিস মারপল হোটেলের সকলের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য পোশাক পরিবর্তন করছিলেন। এমন সময় মিসেস গ্লাইন ঘরে ঢুকলেন।
দু-একটা অন্য কথার পর বললেন, ভেরিটি হান্টকে আমার বোন ক্লোটিলডা দারুণ ভালবাসতো। তার মৃত্যুতে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।
মিস মারপল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন।
–আসলে বছর ষোল বয়সে ভেরিটি একটা বদ ছেলের পাল্লায় পড়েছিল। ছেলেটা ছিল অপরাধী। আপনাকে সব কথাই বলছি…আসলে মিঃ র্যাফায়েলের ছেলে…
-ওঃ হ্যাঁ, মনে পড়ছে একবার শুনেছিলাম তার একটি ছিল ছিল…তেমন ভাল নয়…
–খুবই বদ ছেলে-খুব অল্প বয়সেই একটা মেয়েকে অত্যাচারের জন্য জেল খেটেছিল…। চেক জাল করা, চুরি কোন কিছুই বাদ ছিল না তার। ওর মায়ের বন্ধু ছিলাম আমরা।
মিঃ র্যাফায়েল ছেলের জন্য সবই করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ছেলেটি তার কাছে একটা বড় আঘাত হয়ে উঠেছিল।
এখান দিয়ে যাবার সময় একবার সে এখানে আসে। সেই সময় এই জেলায় পর পর অনেকগুলো খুনের ঘটনা ঘটেছিল।
ভেরিটি একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যায়। কিন্তু আর ফিরে আসেনি। আমরা পুলিসকে জানিয়েছিলাম। কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলাম। পুলিস জানতে পেরেছিল তাকে মাইকেল র্যাফায়েলের সঙ্গে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল।
আগে থেকেই কিছু অপরাধের জন্য মাইকেলের ওপর পুলিসের নজর ছিল। অবশ্য সেসবের তেমন প্রমাণ ছিল না।
দুমাস পরে একটা জঙ্গলের কাছে নালায় ভেরিটির দেহ পাওয়া গিয়েছিল। ক্লোটিলডাকেই সনাক্ত করতে যেতে হয়েছিল। বেচারী ভেরিটি। তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওর কাপড়জামা, হাতব্যাগ সবই ছিল। মিস টেম্পল ভেরিটিকে খুবই স্নেহ করতেন, তাই মৃত্যুর আগে তার কথাই ভেবেছিলেন।
গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন মিস মারপল।
–আমি সত্যই দুঃখিত। আপনার বোনকে বলবেন, আমি কিছুই জানতাম না।
.
১৪.
ইনকোয়েস্ট বসবে মার্কেট প্লেসের কাছে একটা পুরনো জর্জিয়ান আমলের বাড়িতে। কারফিউ আর্মস বাড়িটার নাম।