মধ্যহ্নভোজের পরে মিস মারপলকে বাগানে নিয়ে যাওয়া হল। বাগানটি হতশ্রীই বলা যায়। কিছু গুল্ম আর কিছু লতা গাছ। একদিকে বিস্তর ঝোপ গজিয়ে উঠেছে।
অ্যানথিয়া সঙ্গী হয়েছিল তার। ঘাসের ওপর দিয়ে চলতে চলতে দেয়ালের পাশে একটা ঢিবির কাছে এসে দাঁড়ালেন।
–এটা আমাদের কাচ-ঘর। বললেন অ্যানথিয়া। চারদিকটা ভাঙ্গাচোরা। লতাগুল্ম জড়িয়ে আছে।
একটা ফুল দেখিয়ে মিস মারপল জিজ্ঞেস করলেন, এ তলার নাম কি?
-খুব সাধারণ লতাগাছ। বললেন অ্যানথিয়া, নামটা পি দিয়ে…ঠিক মনে পড়ছে না।
–নামটা আমার জানা আছে, বললেন মিস মারপল, পলিগোনাম বল্ডস্কৃয়ানিকাম। খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। কাচ-ঘরটি বেশ বড় ছিল বোঝা যায়।
অ্যানথিয়া তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে এসে দেওয়ালের পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলতে লাগল।
মিস মারপলের মনে হল, ইচ্ছাকৃত ভাবেই পলিগোনামের ঢিবি থেকে তাকে সরিয়ে নিতে চাইছে অ্যানথিয়া।
হঠাৎ একটা ভাঙ্গা শুয়োরের খোঁয়াড়ের ওপর নজর পড়ল তার। সেটার চারপাশে কয়েকটা গোলাপ চারা গজিয়ে উঠেছে।
চলতে চলতে আচমকাই অ্যানথিয়া প্রশ্ন করল,আপনি প্রায়ই এরকম ভ্রমণে আসেন?
-খুব খরচের ব্যাপার তো। হয়ে ওঠে না। একজনের দয়ায়—
ওয়েস্ট ইণ্ডিজ বা এরকম জায়গায় যান—
আমার ভাইপোর কল্যাণে যাওয়া হয়েছিল।
–ওঃ বুঝেছি।
–আপনার বোন মিসেস গ্লাইনের কোন ছেলেমেয়ে নেই? জিজ্ঞেস করলেন মিস মারপল।
–না ওদের কোন সন্তান হয়নি। একদিকে সেটা ভালই হয়েছে।
কথাটা কেমন খট করে কানে গেঁথে গেল। এরকম কেন বলল, ভাবলেন মিস মারপল
.
১০.
পরদিন সকালের চা-খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল একটি স্ত্রীলোক।
হাতের ট্রে টেবিলে রাখতে রাখতে সে বলল, বোনাভেঞ্চার পাহাড়ে না গিয়ে ভালই করেছেন। পায়ে খুব ব্যথা হতো।
–এখানে এসে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি, বললেন মিস মারপল।
–বাড়িতে কেউ এলে আমাদেরও খুব ভাল লাগে। এ বাড়িটা আজকাল খুবই দুঃখের হয়ে উঠেছে।
-তুমি এ বাড়িতে অনেকদিন আছ?
–খুব ছোট বয়সে এসেছিলাম–পরিচারিকা হয়ে। সেই বুড়ো কর্নেলের আমলে। কর্নেলের দুর্ভাগ্য নিজের চোখেই দেখেছি। অল্পবয়সে স্ত্রীকে হারালেন, যুদ্ধে ছেলেটাও মারা গেল। এক মেয়ে ছিল সেও নিউজিল্যাণ্ডের একজনকে বিয়ে করে বিদেশে চলে যায়। একাই তিনি এখানে বাস করে গেছেন। মারা যাবার সময় ভাইঝি ক্লোটিলডাকে আর তার অন্য দুই বোনকে এ বাড়ি দিয়ে যান। তিনি আর মিস অ্যানথিয়া বাস করতে থাকেন। পরে স্বামী মারা গেলে ল্যাভিনিয়াও চলে আসে। তারপর থেকে, ওদের ক্ষমতা ছিল না, দিনে দিনে বাড়িটা, বাগানটাও নষ্ট হতে থাকে।
-খুবই দুঃখের কথা। বললেন মিস মারপল।
–তবে ওরা সবাই খুব ভাল। কেবল অ্যানথিয়া যেন কেমন কেমন। জানেন, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বাড়িটায় কোন দোষ আছে।
মিস মারপল স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন পরিচারিকার দিকে।
-একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। স্পেনে যুদ্ধ লাগল–সবাই মারা গেল। মিস ক্লোটিলডার দুই বন্ধু মারা গেলেন। তারা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। একটা মেয়ে সৌভাগ্যবশত স্কুলে ছিল বলে সে বেঁচে যায়। তবে মিস ক্লোটিলডা তাকে এখানে নিয়ে এসে সবই করেছিলেন তার জন্য। খুব হাসিখুশি, মিষ্টি স্বভাব ছিল মেয়েটির। কী ভয়ানক ব্যাপার যে ঘটল, আপনি ভাবতেও পারবেন না।
–কি হয়েছিল? ভয়ানক কিছু ঘটেছিল এখানে?
–তা এখানেই ঘটেছিল বলতে পারেন। সে তাকে এখানেই প্রথম দেখে। কাছাকাছিই থাকতো। তিন বোনই তার বাবাকে চিনতেন–দারুণ পয়সাওয়ালা লোক। ছেলেটি এখানে বেড়াতে এসেছিল–আর তখন থেকেই শুরু হয়–
–ওরা প্রেমে পড়েছিল?
–হ্যাঁ। ছেলেটির চমৎকার চেহারা ছিল। আপনি ভাবতে পারবেন না কী সাংঘাতিক –
মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল?
–বৃদ্ধা আশ্চর্য হয়ে তাকাল মিস মারপলের দিকে।
-ওঃ ওসব নয়–খুন–একেবারে খুন। গলা টিপে মেরে তার মাথাটা একেবারে খেলে দেওয়া হয়েছিল। মিস ক্লোটিলডাকে গিয়ে সনাক্ত করতে হয়েছিল। তার পর থেকেই তিনি কেমন হয়ে গেলেন।
একটু থামল সে। পরে আবার বলতে শুরু করল, এখান থেকে ত্রিশ মাইল দূরে একটা পরিত্যক্ত খনির পাশে ঝোপের মধ্যে তার দেহটা পাওয়া গিয়েছিল। এরা সবাই বলে, এরকম অনেক মেয়েই নাকি সে খুন করেছিল। ছমাস ধরে মেয়েটা নিরুদ্দেশ ছিল। পুলিসও খুঁজে পায়নি।
ওরা বলে আজকাল যারা এরকম মেয়েদের মারে, তাদের নাকি মাথার ঠিক নেই। তাদের ফাঁসিও দেয় না। আমি ওসব বিশ্বাস করি না। ওই ছেলেটা…পাকা শয়তান ছিল।
-ওরা তাকে কি করেছিল?
–ওর বয়স কম ছিল। ঠিক মনে নেই আমার, ফাঁসি দিয়েছিল না, বোস্টল বা ব্রডম্যাণ্ড এমনি কোন একটা জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।
–ছেলেটির নাম কি ছিল বলতো।
দশ বছর আগের ঘটনা–সব মনেও নেই। কি যেন মাইকেল–তারপর মনে হয় র্যাফল
–মাইকেল র্যাফায়েল?
–ঠিক বলেছেন।
মিস মারপল নিঃশ্বাস ফেললেন। তাহলে এখন বোঝা যাচ্ছে এই খুনের কারণটাকেই এলিজাবেথ টেম্পল বলেছিলেন ভালবাসা।
এক তরুণী কোন খুনীর প্রেমে পড়েছিল। সেই প্রেমেই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ঘটনাটা ভাবতে গিয়ে শিহরিত হলেন মিস মারপল।
সেদিন সকালেই নিচে নেমে গৃহকর্ত্রীকে দেখতে পেলেন না কোথাও। তিনি বাগানে এসে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একটা অদ্ভুত অনুভূতি তার সারা মন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার মনে হতে লাগল, এই বাগানে এমন কিছু আছে যা তার প্রয়োজন–যা তাঁর লক্ষ্য করা দরকার। জেনেটের বলা ঘটনাটা লক্ষ্য করবেন স্থির করলেন।