মিস মার্পলের মাথার আকাশে বিদ্যুৎ চমক। তিনি চকিতে বলে ওঠেন–তার মানে তুমি অনুমান করছ ওই ভদ্রমহিলা সত্যি সত্যি ওই মৃত মানুষটির বোন নন, তাই তো?
এই ব্যাপারে আমি ঠিক স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। কিন্তু ওনার হাবভাব দেখে আমার কেবলই মনে হয়েছে, উনি ওনার ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা আরোপিত সত্তা আনতে চেষ্টা করছিলেন। শুধু ওনাকে বলব কেন, ওনার স্বামীকেও আমি একইভাবে দোষী সাব্যস্ত করতে পারি। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, ওঁরা ভিকারিজে এসেছিলেন কোনো জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে এবং জানতে মৃত্যুর আগেই ভদ্রলোকের মুখ থেকে কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়েছে কিনা। তারা এ ব্যাপারে বারবার প্রশ্ন করেছিলেন। আমি যখন শেষ পর্যন্ত বললাম যে, উনি মৃত্যুর আগে কোনো কথা বলতে পারেননি, তখন ওনাদের মুখমণ্ডলে একটা অদ্ভুত প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠল। প্রশান্তি বললে ভুল হবে, মনে হল উদ্বিগ্ন অবস্থা থেকে ওনারা মুক্তি পেয়েছেন। ব্যাপারটা আমার চোখ এড়ায়নি।
বাঞ্চ তার বক্তব্য শেষ করলেন–আমার স্থির সিদ্ধান্ত, একলেসই ওই ভদ্রলোককে গুলি করে হত্যা করেছেন।
মিস মার্পল বলে উঠলেন–সেকী? তুমি বলছ, এটা আত্মহত্যার ঘটনা নয়, এটা হল ঠাণ্ডা মাথায় খুন?
বাঞ্চ বললেন–হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তাই তো ডার্লিং, আমি তোমার কাছে এসেছি, তোমার বুদ্ধিমত্তার প্রতি আমার অগাধ আস্থা। তুমি এর আগে একটা জায়গায় বসে কত রহস্যের যবনিকা উত্তোলন করেছ। প্লীজ, তুমি এই ব্যাপারটার তদন্ত ভার গ্রহণ করো। না হলে আমার আর অনুশোচনার অন্ত থাকবে না।
বাঞ্চের এইসব কথাবার্তা মিস মার্পলের মনের ভেতর কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে। সেটা জানার কোনো উপায় আমাদের নেই। মাঝে মধ্যে মিস মার্পলকে এমন প্রশংসার বাক্য শুনতে হয়। তিনি নিস্পৃহচিত্তে এসব শুনতে বাধ্য হন। আসলে খুনের ঘটনার তদন্ত করে ইতিমধ্যে বেশ নাম করেছেন মিস মার্পল। বলা যেতে পারে, তার অনেক স্তাবক জুটে গেছে।
বাঞ্চ আবার বলতে থাকলেন–ওই ভদ্রলোক মৃত্যুর আগে প্লীজ-এই শব্দটা বলতে পেরেছিলেন। আমার বেশ মনে হচ্ছে উনি বোধহয় আরও কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভগবান ওনার এই শেষ আশা পূর্ণ করেননি। সেই কথাগুলো জানতে পারলে আজ আমাকে তোমার কাছে ছুটে আসতে হত না। তাই সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে। তুমি না থাকলে এই সমস্যার সমাধান আর কেউ করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। পুলিশের ওপর আমার খুব একটা আস্থা নেই। ওরা সাধারণত মাথা মোটা স্বভাবের হয়ে থাকে। অবশ্য এর জন্য আমি ওদের খুব একটা দোষ দিতে পারছি না। ওদেরকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে তদন্ত চালাতে হয়। বলতে পারো, ওদের হাত পা একেবারে বাঁধা।
মিস মার্পল এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে বাঞ্চের মুখ থেকে ঠিকরে ছুটে আসা এই শব্দগুলো শুনছিলেন। যদিও তার অভিব্যক্তিতে সেই মনোযোগী আচরণের কোনো পরিচয় নেই। এটাই হল মিস মার্পলের চরিত্রের সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য। ইতিমধ্যে একাধিক খুনের ঘটনাকে ইতিবাচক তদন্ত করে যথেষ্ট নাম এবং প্রশংসা অর্জন করেছেন তিনি।
বাঞ্চ বলতে থাকেন–ওই ভদ্রলোক মৃত্যুর ঠিক আগে প্লীজ শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন কিন্তু এর পর তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন, সেটা আমার পক্ষে আর জানা সম্ভব হল না। যদি ঈশ্বর ওনাকে আর কয়েক মুহূর্ত বেঁচে থাকার ছাড়পত্র দিতেন, আমি সুনিশ্চিত, তাহলে খুনির নামটাও উনি উচ্চারণ করতেন। এই ব্যাপারটা আমাকে খুবই অনুশোচনার মধ্যে রেখেছে।
মিস মার্পল চুপ করে ভাবনার জগতে পৌঁছে গেলেন। তারপর তিনি বাঞ্চের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন–আচ্ছা, ওই ভদ্রলোক শেষ অব্দি তোমাদের চার্চে এলেন কেন, সেই ব্যাপারটা তো আমার কাছে এখনও পর্যন্ত পরিষ্কার হচ্ছে না।
বাঞ্চ বললেন–এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে একমত পোষণ করছি। তুমি যদি স্যাংচুয়ারি শব্দটার ওপর বেশি জোর দাও, তাহলে উনি তো যে কোনো একটা চার্চের মধ্যেই ঢুকতে পারতেন। মোটামুটি সব চার্চেই এমন একটি গোপন প্রকোষ্ঠ থাকে। তিনি কেন বাসে করে অত দূরের একটা জায়গাতে যাবেন, যে বাসটা সারা দিনের মধ্যে মাত্র চারবার আমাদের এই শহরতলীতে আসে, তারপর তুমি কেন এমন একটা নির্জন জায়গা বেছে নেবে? না, রহস্যের জট ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে আমার কাছে।
মিস মার্পল মন্তব্য করলেন–তিনি নিশ্চয়ই কোনো একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে ওই চার্চে এসেছিলেন। আমার মনে হচ্ছে, উনি বোধহয় কারো সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আসলে চিপিং লেক হর্নটা তো খুব একটা বড়ো জায়গা নয়, বাঞ্চ। সকলে সেখানে সকলের সাথে পরিচিত দেখতো, তিনি কার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন বলে তোমার মনে হয়?
ওই ব্যাপারটা নিয়ে এতক্ষণ এইভাবে ভাবতে পারেন নি বাঞ্চ। মনে মনে আরও একবার মিস মার্পলের অগাধ বুদ্ধির তারিফ করলেন তিনি। তিনি ওই ছোট্ট শহরতলির বাসিন্দাদের মুখচ্ছবিগুলি ভাববার চেষ্টা করলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন–না আমি তো কাউকেই সম্ভাব্য মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করতে পারছি না। আমাদের ওই ছোট্ট পল্লীতে এমন কে-ইবা আছেন, যাঁর সাথে ওই ভদ্রলোকের জরুরী দরকার ছিল?