মিনিট দশেকের মধ্যেই রাদারফোর্ড হলের মিস ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে লুসির টেলিফোনে যোগাযোগ ঘটে গেল। কাজের কথাবার্তাও পাকা হয়ে গেল।
দুদিন পর লুসি লন্ডন থেকে ব্রাহ্যাম্পটন রওনা হল।
.
০৪.
বিরাট গেট পার হয়ে আঁকাবাঁকা পথ, দুপাশে রডোডেনড্রন ফুলের ঝাড়। তারপর সেই ছোট্ট বাড়িটি। সময়ের ভারে বিধ্বস্ত। বসবাসের জন্য তৈরি করা বাড়িটি এখন পোড়ো দুর্গের চেহারা নিয়েছে।
গাড়ি থেকে নেমে লুসি বেল বাজাল। একটি স্ত্রীলোক বসার ঘরে নিয়ে বসাল তাকে। চমৎকার সাজানো ঘর। সেলফ ভর্তি বইয়ের সারি।
-তোমারই তো আসার কথা, বস খবর দিচ্ছি।
স্ত্রীলোকটি চলে যাবার কয়েক মিনিট পরে এমা ক্রাকেনথর্প দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।
বাড়ির মালিকের কনিষ্ঠা কন্যা সে। প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে ভালো লেগে গেল লুসির। বয়স ত্রিশ ছাড়িয়েছে। সুশ্রী, কালো চুল, কটা চোখ।
পরিচয় পর্ব, করমর্দন শেষ হলে এমা তাদের বাড়ির কাজের একটা সংক্ষিপ্ত আভাস লুসিকে দিল। সে জানাল, বাড়িটা বড় হলেও স্থায়ী বাসিন্দা বলতে সে আর তার বৃদ্ধ অথর্ব বাবা। তার ভাইয়েরা বাইরে থাকে। অবশ্য প্রায়ই এখানে আসে। বাইরে থেকে দুজন মহিলা ঠিকে কাজ করতে আসেন। মিসেস কিডার আসেন সকালবেলা। মিসেস হার্ট সপ্তাহে তিনদিন আসেন, পুরনো জিনিসপত্র পরিষ্কার করতে।
কাজের ধরনটা মোটামুটি আঁচ করতে পারল লুসি। সব কাজই তার ধারণার মধ্যে রয়েছে।
লুসি বলল, আমার এক বৃদ্ধা মাসী কাছেই থাকেন। তার যাতে দেখাশোনা করতে পারি সেজন্য ব্র্যাকহ্যাম্পটনেই আমি থাকতে চাই। তাই টাকার অঙ্ক নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাইনি। যাইহোক, মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য আমার ছুটি পেলেই যথেষ্ট।
বিকেলের দিকে ছটা অবধি প্রতিদিনই তোমার ছুটি থাকবে। বলল এমা।
–আমি খুশি। লুসি বলল।
–একটা বিষয় কেবল তোমাকে বিশেষ ভাবে বলার আছে, সেটা হল, আমার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে কষ্ট হলেও তোমাকে তার সঙ্গে একটু মানিয়ে চলতে হবে।
-ওটা কোনো ব্যাপার নয়, সব বয়সের মানুষের সঙ্গে মিশতে আমি অভ্যস্ত।
লুসিকে তার থাকার ঘরটা দেখিয়ে দেওয়া হল। নিয়ে আসা হল বৃদ্ধ লুথার ক্রাকেনথর্পের ঘরে। তারপরে রান্নাঘর। বাড়ির লোকের খাওয়াদাওয়ার সময়টা জেনে নিল লুসি।
বলল, মোটামুটি সবকিছুই জেনে নিলাম আমি। এবার থেকে আমিই সবদিক সামাল দেব। ভাববেন না।
.
পরদিন সকাল ছটা থেকেই কাজে হাত লাগাল লুসি। বাড়িঘর পরিষ্কার করা, আনাজ কাটাকুটি, রান্নার আয়োজন সংগ্রহ ইত্যাদি সব সেরে নিয়ে ক্ষিপ্রহাতে প্রাতঃরাশ সরবরাহ করল।
বেলা এগারোটা নাগাদ একটু অবকাশ মিলল। এই সুযোগে মিসেস কিডারের সঙ্গে গল্পচ্ছলে কিছু মূল্যবান তথ্য জেনে নিল সে।
ভালো একজন শ্রোতা পাওয়া গেছে বুঝতে পেরে মিসেস কিন্ডার গড়গড় করে বলে গেলেন, বাড়িটা যেমন মস্ত, পরিবারটিও তেমনি। এনতার লোকজন। বড় ছেলে এডমান্ড লড়াইতে মারা গেছে, তার পরে কেড্রিক, কি সব ছবিটবি আঁকে। এখনো বে-থা করেনি।
তৃতীয় ছেলে হারল্ড, লন্ডনে থাকে। বনেদী ঘরের মেয়েকে বিয়ে করেছে-ব্যবসা করে নামডাক হয়েছে।
ছোট ছেলে আলফ্রেড–বিশেষ সুবিধার নয়। নানান অপকর্ম করে বেড়ায়। পুরুষ মানুষ আর একজন আছে।
কর্তার বড় মেয়ে এডিথের স্বামী ব্রায়ান ইস্টালি। কয়েক বছর আগে এডিথ মারা গেছে। কিন্তু ব্রায়ান এখনো এবাড়ির ছেলের মতোই যাওয়া-আসা করে।
তাদের একটি বাচ্চা ছেলে আলেকজান্ডার-স্কুলে পড়ে। ছুটিছাটায় এবাড়িতে আসে। এমাকে খুব ভালোবাসে।
যথাসময়ে লাঞ্চের খাবার রান্নার কাজও চুকল। ধোয়ামোছা শেষ করে, রান্নাবান্না যথাস্থানে পৌঁছে দিল। দুটো ত্রিশের মধ্যে কাজকর্ম চুকিয়ে লুসি তার আসল কাজ আরম্ভ করতে পারল।
কারোর চোখে অস্বাভাবিক না ঠেকে সেভাবে সে প্রথম বাগানের চারপাশে ঘুরল, শাকসবজি দেখল। পথগুলো আগাছায় ঢেকে ফেলেছে। সর্বত্র অযত্নের ছাপ।
বাড়ির পাশেই আস্তাবল। বৃদ্ধ মালিটি আস্তাবলের উঠোনের পাশে একটা কুঁড়ে ঘরে থাকে। আস্তাবল পাশ কাটিয়ে লুসি ধীরে ধীরে বাড়ি সংলগ্ন পার্কে চলে এল। পার্কের দুদিকেই প্রাচীর ঘেরা। সেখান থেকে রেলপথের খিলানের নিচে দিয়ে গিয়ে একটা সরু গলিতে এসে পড়ল।
মেন লাইনের গাড়ি অনবরত খিলানের ওপর দিয়ে ঝমাঝম শব্দে ছুটে যাচ্ছে। লুসি লক্ষ্য করল, ক্রাকেনথর্পের বাড়ির সীমানা ঘিরে বেঁকে যাওয়া রেলের ওপর দিয়ে চলার সময় গাড়িগুলোর গতি বেশ কমে যায়।
ছোট্ট গলিটার একপাশে রেলের বাঁধ, অন্য পাশে উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের ওপাশে কয়েকটা কারখানা বাড়ি।
গলিপথে এগিয়ে গিয়ে লুসি একটা অপেক্ষাকৃত বড় রাস্তা পেল। অল্পদূরে ছোট ছোট বাড়িঘর।
একজন মহিলাকে আসতে দেখা গেল। লুসি তার কাছ থেকে পোস্ট অফিসটা কোথায় জেনে নিল। সেখানে গিয়ে মিস মারপলকে টেলিফোন করল। তিনি বিশ্রাম করছিলেন, ফ্লোরেন্স টেলিফোন ধরল।
লুসি তাকে নিজের পরিচয় জানিয়ে বলে দিল, সে নির্দিষ্ট জায়গায় উপস্থিত হয়ে যথানিয়মে কাজ শুরু করেছে, এই খবরটা যেন মিস মারপলকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে লুসি রাদারফোর্ড হলে ফিরে এল।
.
০৫.
কর্মস্থলে আসার আগেই নিজের ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করেছিল লুসি আইলেসব্যারো। দূরদৃষ্টি প্রয়োগ করে সে একসেট গলফ ক্লাব ছড়ি সঙ্গে এনেছিল। মিস মাথার অনুমতি নিয়ে সে পার্কের মধ্যে পরদিন থেকে গলফ ক্লাব দিয়ে বল মারা অনুশীলন শুরু করল।