- বইয়ের নামঃ ৪-৫০ ফ্রম প্যাডিংটন
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনী
৪-৫০ ফ্রম প্যাডিংটন
১. মিলচেস্টারগামী ট্রেনটা
৪-৫০ ফ্রম প্যাডিংটন (১৯৫৭) / আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ
০১.
ঘটনাটা ছিল এরকম–মিলচেস্টারগামী ট্রেনটা ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনের আগে একটা বাঁক অতিক্রম করছে, গতি ধীর মন্থর, সেই মুহূর্তে আর একটা গাড়ি অন্য লাইন থেকে বেঁকে সমান দূরত্বে আগের গাড়ির সমান্তরাল হয়ে চলতে লাগল।
মিসেস এলসপেথ ম্যাকগিলিকার্ডি ক্রিসমাসের বাজারে সওদা শেষ করে বন্ধুর বাড়ি রওনা–হয়েছেন। তিনি নিজের কামরায় জানলার ধারে বসে পাশের গাড়ির সমান্তরাল বগিটির জানলা দেখতে লাগলেন।
বেশির ভাগ কামরারই জানলার শার্সি নামানো। কোনো কোনো কামরার যাত্রীদের দেখা যাচ্ছিল।
সমান বেগে চলেছে গাড়ি দুটো। মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি দেখতে পেলেন, হঠাৎ একটা কামরার শার্সি উঠে গেল।
প্রথম শ্রেণীর কামরাটার আলোকিত অভ্যন্তরে যে দৃশ্য তাঁর চোখে পড়ল, উত্তেজনায় দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল।
.
জানলার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল একজন পুরুষ, তার মুখোমুখি দাঁড়ানো একটি মেয়ের গলা হিংস্রভাবে আঁকড়ে ধরেছে তার দুই হাত। মেয়েটির ঠিকরনো চোখজোড়া ঠেলে বেরিয়ে আসার অবস্থা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মেয়েটির নিপ্রাণ দেহ পুরুষটির দুই হাতের মধ্যে এলিয়ে পড়ল।
এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। যখন হুঁশ ফিরে এল, তিনি বুঝতে পারলেন অপর পাশের গাড়িটির গতিবেগ বেড়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
বিপদ জ্ঞাপক চেন টেনে কোনো লাভ নেই। ঘটনা তো ভিন্ন গাড়িতে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু একটা করতে না পারলে তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।
কি করা যায় ভাবছেন, এমন সময় একজন টিকিট কালেক্টর কামরার দরজায় এসে দাঁড়াল।
মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি অসাধারণ সেই অপরাধমূলক কথা ভদ্রলোককে জানালেন।
টিকিট কালেক্টর জানাল, আর মিনিট সাত পরেই আমরা ব্র্যাকহ্যাম্পটন পৌঁছচ্ছি। আপনি যা বললেন আমি যথাস্থানে রিপোর্ট করব।
লোকটি তার নাম, স্কটল্যান্ডের বাড়ির ঠিকানা টুকে নিল যথারীতি।
এতেও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি। তিনি একটা বাতিল বিলের উল্টোপিঠে দ্রুত হাতে একটা চিরকুট লিখে ফেললেন।
গাড়ি ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলে একজন কুলিকে ডেকে তার হাতে চিরকুটের খাম সেই সঙ্গে একটা সিলিং গুঁজে দিয়ে বললেন, খামখানা এখুনি স্টেশন মাস্টারের অফিসে পৌঁছে দেবে।
এর পর পঁয়ষট্টি মিনিটের মাথায় গাড়ি এসে থামল মিলচেস্টার স্টেশনে।
ট্রেন থেকে নেমে সেন্টমেরী মিডে যাবার জন্য একটা ট্যাক্সি ধরলেন। নমাইল পথ যেতে হবে। কিন্তু তাঁর যেন সবুর সইছিল না।
সেই সাংঘাতিক দৃশ্যটা যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলছিল। তখনো তিনি থেকে থেকে শিউরে উঠছিলেন।
.
ট্যাক্সি ড্রাইভার মালপত্রগুলো ঘরের ভেতরে পৌঁছে দিয়ে গেল। মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি হলঘর পার হয়ে সোজা বসার ঘরে প্রবেশ করলেন। মিস মারপল উষ্ণ চুম্বনে বন্ধুকে অভ্যর্থনা জানালেন।
মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি কোনো রকমে আসন নিয়ে বলে উঠলেন, জেন, সাংঘাতিক কাণ্ড। এই মাত্র একটা হত্যাকাণ্ড দেখে এলাম।
সমস্ত ঘটনা শোনার পর বৃদ্ধা মিস মারপল, বললেন, এলসপেথ, যা দেখেছ বলছ, হঠাৎ শুনলে বিশ্বাস্য বলে মনে হয় না। তবে ঘটনাটা অসাধারণ হলেও অসম্ভব নয়। এটা যে সত্যি আমার তাতে সন্দেহ নেই।
-সেই লোকটার মুখ নিশ্চয়ই তুমি দেখতে পাওনি?
–সম্ভব ছিল না, লোকটার পিঠ ছিল আমার দিকে।
–স্ত্রীলোকটিকে কতটা দেখেছ? যুবতী না বয়স্কা?
–মাত্র কয়েক ফুট দূরত্ব থেকে দেখা, তাতে মনে হল মেয়েটির বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে।
-সুন্দরী?
–বোঝার উপায় ছিল না। সাঁড়াশীর মতো আঙুলের চাপে তার মুখখানা সম্পূর্ণ বিকৃত দেখাচ্ছিল।
-তাই স্বাভাবিক, বললেন মিস মারপল, পোশাক কি ছিল?
ফ্যাকাসে রঙের ফারকোট, মাথায় টুপি ছিল না। একমাথা সোনালী চুল
–লোকটার চেহারা সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পার–
একমুহূর্ত চিন্তা করলেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি। পরে বললেন, বেশ লম্বা শরীর লোকটার, কালো। গায়ে ছিল ভারি কোট। এই সামান্য বিবরণ দিয়ে তাকে চেনা যাবে বলে মনে হয় না।
-না-কিছু থেকে এটুকুও ভালো। কাল সকালে এবিষয়ে আরো কিছু জানা যাবে আশা করছি।
–এরকম একটা ঘটনা খবরের কাগজে বেরুবে নিশ্চয়ই। আচ্ছা ভালো কথা, কামরাটা কি করিডরযুক্ত ছিল?
-না।
–তাহলে গাড়িটা দূরগামী নয়। সম্ভবতঃ ব্র্যাকহ্যাম্পটনেই যাত্রা শেষ হয়েছে।
সকালের খবরের কাগজ দেখে দুই বন্ধুই হতাশ হলেন। খবরটা প্রকাশিত হয়নি। চিন্তামগ্ন অবস্থায় দুজনেই প্রাতঃরাশ সারলেন।
কিছুক্ষণ পরে মিস মারপল বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় থানার সার্জেন্ট ফ্রাঙ্ক কার্নিশের সঙ্গে দেখা করলেন।
ঘটনার বিবরণ শুনে সার্জেন্ট কার্নিশ অন্তরঙ্গতা ও সম্ভ্রমের সঙ্গে জানালেন, আমি সমস্তই নথিবদ্ধ করে নিলাম। আমি যথাযোগ্য তদন্তের ব্যবস্থা করব। রেলওয়ে অফিসারও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেবেন বলেই আমি আশা করি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, নতুন কোনো খবর পেলেই আপনাকে জানাব। ঘটনাটা অনাবিষ্কৃত থাকতে পারে না, আগামীকাল খবরের কাগজেই হয়তো খবরটা পাওয়া যাবে।
কিন্তু পরের দিনেও কোনো খবর পাওয়া গেল না। সন্ধ্যা নাগাদ মিস মারপল সার্জেন্ট কার্নিশের পাঠানো একটা চিরকূট পেলেন। তিনি জানিয়েছেন, আগের দিনে রিপোর্ট করা ঘটনা সম্পর্কে হাসপাতাল ইত্যাদি সহ সকল সম্ভাব্য স্থানেই তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো মহিলার দেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
.
০২.
চিরকুটটা পড়ে চিন্তিত হলেন মিস মারপল। বন্ধুর বিমর্ষ চিন্তাভারাক্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার যা করার ছিল সবই করেছ এলসপেথ। রেল কর্মচারীর কাছে, পুলিসের কাছে রিপোর্ট করেছ। আর কিছু করার নেই।
-যথাযথ তদন্ত হয়েছে, এটুকু আমার সান্ত্বনা। কিন্তু মৃতদেহটা এভাবে সকলের চোখে আড়াল হল কি করে সেটাই বুঝতে পারছি না। ক্রিসমাসের পরেই আমি সিংহলে রোডারিকের কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকব। এদিকের প্রয়োজন বুঝলে ভ্রমণসূচী না হয় পিছিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা যেত। কিন্তু রওনা হয়ে যাবার পর
তুমি আর কি করবে। মৃতদেহটা খুঁজে বার করার দায়িত্ব পুলিসের। তারা যখন ব্যর্থ হয়েছে; বোঝা যাচ্ছে লোকটা চতুরতার সঙ্গেই কাজটা সামাল দিয়েছে। কাজটার পেছনে পূর্ব-পরিকল্পনা ছিল।
হঠাৎ করে উত্তেজনার বশে ঘটনাটা ঘটে যায়নি। ট্রেনের সিটে মৃতদেহটা পড়ে থাকলে সকলেরই নজরে পড়ত। একটা গাড়ি যখন স্টেশনে ঢোকার মুখে সেই সময় ঠান্ডা মাথায় স্ত্রীলোকটিকে খুন করা হয়েছিল এবং ট্রেন থেকে এমন কোনো জায়গায় ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল–যেখানে লোকের চোখে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এছাড়া বিকল্প সম্ভাবনাও ছিল।
–জেন, বললেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি, আগামীকাল বিকেলের ট্রেনে আমাকে লন্ডনে ফিরতে হবে।
মিস মারপল বললেন, ঘটনাস্থল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা নিজের চোখে একবার দেখব ভাবছি। আমিও তোমার সঙ্গে রওনা হব তাহলে।
–তুমি কি করতে চাইছ বলতো?
-তোমার সঙ্গে আমিও লন্ডন অবধি যাব। তারপর সেদিন তুমি যেই ট্রেনে ব্র্যাকহ্যাম্পটন এসেছিলে আমরাও সেই ট্রেন ধরে ব্র্যাকহ্যাম্পটন ফিরে আসব। সেখান থেকে তুমি ফের লন্ডন ফিরে যাবে, আর আমি এখানে ফিরে আসব।
মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি বললেন, এতে তুমি কতটা কি আর বুঝতে পারবে। বেশ তাই করা যাবে চল।
.
পরদিন লন্ডন থেকে চারটে পঞ্চাশের ট্রেনের একটা প্রথম শ্রেণীর কামরায় চেপে বসলেন মিস মারপল আর মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি।
ক্রিসমাসের আর দুদিন মাত্র বাকি। গাড়িতে ভিড়ের চাপ প্রচণ্ড।
আগের শুক্রবারেই সেই ভয়ঙ্কর অপরাধের দৃশটা দেখেছিলেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি। আজ কিন্তু ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশন অবধি পৌঁছনো পর্যন্ত কোনো গাড়ি সমদূরত্ব বজায় রেখে পাশাপাশি যেতে দেখা গেল না।
-কোনো লাভ হল না জেন। হতাশ ভাবে বললেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি।
অন্যমনস্কভাবে মিস মারপল জবাব দিলেন, তাই তো দেখছি।
কিন্তু তিনি তখন ভাবছিলেন, একটা মৃতদেহ কখনো শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে না। কোথাও না কোথাও অবশ্যই থাকবে।
মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। বারো মিনিট পরেই লন্ডনে যাবার ট্রেন তাকে এখান থেকে ধরতে হবে। জানলা দিয়ে দুই বন্ধু শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন।
বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। গাড়ির গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিস মারপল গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।
স্বভাবতই অদ্ভুত ঘটনাটা তাকে খুবই আগ্রহান্বিত করে তুলেছিল। তাই অবিলম্বেই তিনি তাঁর সন্ধানকর্ম শুরু করার জন্য মনস্থির করে নিলেন।
প্রস্তুতি হিসেবে আপাততঃ যে কাজগুলো তাকে করতে হবে, তার একটা তালিকাও তিনি মনে মনে ছকে নিলেন।
১. তাঁর বিশেষ বন্ধু স্যার হেনরি ক্লিদারিং ও তার ধর্মপুত্র ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ডারমট ক্রাডকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তারা দুজনেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে রয়েছে।
২. মিস মারপলের ভাগ্নের দ্বিতীয় ছেলে ডেভিড ব্রিটিশ রেলওয়েতে কাজ করে। তারও সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
৩. তাঁর বান্ধবী গ্রিসলডার ছেলে লেনার্ড মানচিত্রের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। তার কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়া যেতে পারে।
৪. প্রাক্তন পরিচারিকা ফ্লোরেন্সের সাহায্যও চাওয়া যেতে পার। সে বর্তমানে ব্র্যাকহ্যাম্পটনের বাড়িতেই আছে।
মিস মারপল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, তার বয়স হয়েছে, ছুটোছুটি করা আগের মতো সম্ভব নয় তার পক্ষে। কিন্তু যোগাযযাগগুলো ঠিক ভাবে কার্যকর করা গেলে প্রয়োজনীয় সূত্র আবিষ্কার অসম্ভব হবে না।
ইতিপূর্বে অনেক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত তিনি করেছেন। সেগুলো তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান ঘটনাটার অনুসন্ধান কার্য স্বেচ্ছায় হাতে তুলে নিয়েছেন তিনি। অনিশ্চিত জেনেও কেন এমন একটা উদ্যোগ তিনি নিতে চলেছেন, নিজেই জানেন না।
.
পরদিন সকাল থেকেই তাঁর পরিকল্পিত কাজে নেমে পড়লেন মিস মারপল।
প্রথমেই ভাগ্নের ছেলে ডেভিডকে চিঠি লিখলেন। ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা বিশেষ সংবাদ জানবার অনুরোধ জানিয়েছেন সেই চিঠিতে।
প্রতি বছরের মতো তিনি ভিকারের বাড়িতে ডিনারে অংশগ্রহণ করলেন। সেখানে লেনার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ হল। তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় অঞ্চলের মানচিত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন।
লেনার্ড তার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সুন্দরভাবে বলে বুঝিয়ে বেশ আগ্রহ সহকারে লিখেও দিল। পরে তার সংগ্রহ থেকে নির্দিষ্ট অঞ্চলের একটা মানচিত্র মিস মারপলকে ধার দিল।
.
ডেভিডের কাছে লেখা চিঠির জবাবও যথাসময়ে এসে পৌঁছল। অন্যান্য আনুষঙ্গিক কথার পর তার জরুরী বিষয়টা সম্পর্কে সে লিখেছে–দুটি ট্রেন সমদূরত্বে পাশাপাশি একই দিকে চলবে–মাত্র দুটি ট্রেনের ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। চারটে তেত্রিশ এবং পাঁচটার গাড়ি। প্রথম ট্রেনটা মার্কেট বেসিং অবধি যাত্রায় হেলিংব্রডওয়ে বারওয়েল, হীথ, ব্র্যাকহ্যাম্পটন প্রভৃতি স্টেশনে থামে।
এই ট্রেনটা ধীরগামী।
পাঁচটার গাড়িটা ওয়েলস এক্সপ্রেস। এই গাড়িতে কারণ্ডিফ নিউপোর্ট এবং সোয়ানসি যাওয়া যায়।
চারটে পঞ্চাশের গাড়িটা প্রথম গাড়িকে ব্র্যাকহ্যাম্পটন পৌঁছবার আগে যে কোনো জায়গায় ধরে ফেলতে পারে। পরের গাড়িটা চারটে পঞ্চাশের গাড়িকে ছাড়িয়ে যায় ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনের ঠিক আগে।
ডেভিডের পাঠানো খবরগুলো পর্যালোচনা করে মিস মারপল বুঝতে পারলেন, ম্যাকগিলিকার্ডি যে গাড়ির কথা বলেছে সেটা সোয়ানসি এক্সপ্রেস নয়। কেননা, সে বলেছিল গাড়িতে করিডর ছিল না। চারটে তেত্রিশের গাড়িতেই খুনের ঘটনাটা ঘটে থাকবে।
নির্দিষ্ট অঞ্চলের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হলে আরও দু-একবার যাওয়া-আসা করা দরকার।
এজন্য সময় নষ্ট করলেন না তিনি। বারোটা পনেরোর গাড়িতেই লন্ডন রওয়ানা হয়ে গেলেন।
এবারে ভ্রমণের সময় কিছু খুঁটিনাটি বিবরণ সংগ্রহ করতে পারলেন। ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনের কাছাকাছি এসে ট্রেনটা একটা দীর্ঘ বাঁক ঘুরল। গতিবেগও কমল। রাতের অন্ধকার থাকায় ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারলেন না।
দিনের আলোতে জায়গাটা দেখার উদ্দেশ্যে পরদিন ভোরেই তিনি লন্ডনের ট্রেনে প্রথম শ্রেণীর কামরায় চেপে বসলেন।
লেনার্ডের কাছ থেকে চেয়ে আনা মানচিত্রটা সঙ্গেই এনেছিলেন। ট্রেন ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনে পৌঁছবার পনেরো মিনিট আগে তিনি সেটা খুলে বসলেন।
সেই দীর্ঘ বাঁকটা এল। গাড়ির গতিবেগ কমে এলো। সঙ্গে তিনি গাড়ির সঠিক অবস্থান স্থানটি মানচিত্র চিহ্নিত করলেন।
গাড়িটা বেশ উঁচু একটা বাঁধের ওপর দিয়ে চলেছে তখন। নিচে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দৃশ্যের সঙ্গে মানচিত্র মিলিয়ে তাঁর ধারণা পরিষ্কার করে নিলেন।
পর্যবেক্ষণ শেষ করে বাড়ি ফিরে এলেন মিস মারপল। রাতে ফ্লোরেন্স হিলের কাছে একটা চিঠি লিখলেন। সে থাকে ৪, ম্যাসিডন রোড, ব্র্যাকহ্যাম্পটন।
পরদিন কাউন্টি লাইব্রেরীতে গিয়ে ব্র্যাকহ্যাম্পটনের আঞ্চলিক গেজেটিয়ার ইত্যাদি ঘেঁটে ইতিহাস জেনে নিলেন।
এভাবে তার অনুসন্ধান কার্যের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন।
ঘটনার বিষয়ে ইতিমধ্যেই একটা থিওরি ছকে নিয়েছিলেন। এবারে তার সত্যতা নিরূপণের ব্যবস্থা করতে হবে। এব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে পারে এমন একজনের কথা ভাবতে বসলেন তিনি। বুদ্ধি এবং সাহস দুই দরকার কাজটার জন্য। কে হলে ভালো হয়?
লুসি আইলেসব্যারোর কথা মনে পড়ে মিস মারপলের।
.
০৩.
মহিলা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত শাস্ত্রে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। বর্তমানে বয়স বত্রিশ। অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারিণী। শিক্ষাজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সে স্বেচ্ছায় অদ্ভুত এক পেশা বেছে নিয়েছিল।
লুসি লক্ষ্য করেছিল, গৃহস্থালীর সবরকম কাজে দক্ষ কর্মীর চাহিদা খুবই বেশি। উপযুক্ত কর্মীর খুবই অভাব। সকলকে আশ্চর্য করে এই ক্ষেত্রটাকেই তিনি তার কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন এবং অদ্ভুত কর্মদক্ষতা গুণে অল্পসময়ের মধ্যেই সাফল্য অর্জন করল। কাজের সুবাদে কোনো কোনো মহলে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সে।
সাধারণতঃ ছুটিছাটায় কেউ বাইরে গেলে, বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে কিংবা বাচ্চার দেখাশোনার দরকার হলে লুসির ডাক পড়ে।
যে বাড়ির কাজ সে হাতে নেবে, সেখানে কোথায় কখন কি দরকার সব সে বুঝে নেয় এবং কঠোর পরিশ্রমের তোয়াক্কা না করে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় সে সমস্ত সম্পন্ন করে। ঘরের শান্তি স্বস্তি ফিরে আসে।
এই কারণে পারিশ্রমিক তুলনায় বেশ মোটা রকমের গুণতে হলেও নির্দ্বিধায় এবং নির্ভাবনায় লুসির কথাই লোকে ভাবে।
তার কাজের খুব চাহিদা হওয়ার ফলে কাজ গ্রহণের ক্ষেত্রে তার কিছু স্বাধীনতা ছিল। পছন্দ হলে সে কাজ সে নিত না। দীর্ঘমেয়াদী কাজ সে গ্রহণ করত না। তার মেয়াদ ছিল দুই সপ্তাহ। বিশেষ ক্ষেত্রে সময়টা বাড়িয়ে একমাস পর্যন্ত করা চলত।
.
মিস মারপলের চিঠিটা পেয়ে বারকয়েক মনোযোগ দিয়ে পড়ল লুসি। দুবছর আগে উপন্যাস লেখক রেমন্ট ওয়েস্টের কাছে একটা কাজ নিয়েছিল সে। সেই সময় মিস মারপলের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। মহিলাকে তার খুব ভালো লেগেছিল। সেণ্টমেরী মিডে তার বাড়িতেও সে গিয়েছিল।
মিস মারপল লিখেছিলেন বিশেষ ধরনের একটা জরুরী কাজের ব্যাপারে তিনি লন্ডনের কোনো জায়গায় তার সঙ্গে আলোচনা করতে চান।
লুসি তখুনি টেলিফোন তুলে মিস মারপলের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরদিন তার ক্লাবেই সাক্ষাৎকারের সময় জানিয়ে দিল সে।
পরদিন যথাস্থানে একটা নিরিবিলি কক্ষে দুজনে আলোচনায় বসল।
মিস মারপল বললেন, আমি বলেছি কাজটা একটু অন্য ধরনের। আসলে একটা মৃতদেহ খুঁজে বার করার জন্য তোমার সাহায্য আমার দরকার হয়ে পড়েছে।
অন্য সাধারণ বয়স্কা কল্পনাপ্রবণ মহিলাদের মতো মিস মারপলকে মনে করে না লুসি। সে জানে তিনি পরিপূর্ণ সুস্থবুদ্ধির মহিলা। একারণে যথেষ্ট সম্মান শ্রদ্ধার মধ্যে তিনি বাস করেন।
লুসি শান্তভাবেই বলল, কোনো ধরনের মৃতদেহের কথা আপনি বলছেন?
–একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। একটা ট্রেনের কামরায় তাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। তারপর মিস মারপল ঘটনাটা খুলে বললেন। লুসি আগ্রহ নিয়ে শুনল।
-কাহিনীটাকে সত্য বলে ভাবতে অসুবিধা হয়, বলল লুসি, খুবই অসাধারণ। তবে অসম্ভব মনে করি না। তা এর মধ্যে আমার ভূমিকাটা কি হবে?
–মৃতদেহটা আমি খুঁজে বার করতে চাই। বুঝতেই পারছ, আমার বয়স হয়েছে, দৌড়ঝাঁপ করব, তেমন সামর্থ্য নেই। তোমাকে কাজের মেয়ে বলে মনে করি।
–অর্থাৎ আপনি চাইছেন আমি অনুসন্ধান করি। কিন্তু একাজটা পুলিস করছে না কেন?
–পুলিস যথাসাধ্য করে ব্যর্থ হয়েছে। বুঝতেই পারছ, আমি নিজের মতো করে একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছি। মৃতদেহটা ট্রেনের মধ্যে পাওয়া যায়নি। বোঝা যাচ্ছে ওটা ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু রেললাইনের আশপাশে অনুসন্ধান করে কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, লাইনের ধারে মৃতদেহটা ট্রেন থেকে ফেলে দিলে পরে সেটা সরিয়ে ফেলা যায়। ওই পথ ধরে আমি কয়েকবার ট্রেনে যাতায়াত করে এরকম একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছি।
ব্র্যাকহ্যাম্পটনে পৌঁছবার আগে একটা বড় বাঁধের কিনার ঘেঁষে ট্রেনটা বাঁক নেয়। সেই সময় একটা জায়গায় ট্রেনটা বেশ ঝাঁকুনি খায়, ঠিক সেই জায়গায় যদি মৃতদেহটা ঠেলে ফলে দেওয়া যায় তাহলে সেটা বাঁধের ঢালে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবে।
দেহটা সেখান থেকেই সরিয়ে ফেলা হয়ে থাকবে। জায়গাটা বোঝাবার জন্য আমি মানচিত্র নিয়ে এসেছি, তুমি সেটা দেখ।
মানচিত্রের যে জায়গাটা মিস মারপল চিহ্নিত করেছিলেন, লুসি আগ্রহ সহকারে সে জায়গাটা দেখল।
জায়গাটা ব্র্যাকহ্যাম্পটনের শহরতলীর অংশ, বললেন মিস মারপল, এখানে আছে একটা পুরনো বাড়ি, সঙ্গে বিস্তৃত মাঠ ও পার্ক। আশপাশে অবশ্য বর্তমানে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বাড়ি, বড় বড় হাউসিং এস্টেট।
পুরনো যে গাড়িটা রয়েছে, তার নাম রাদারফোর্ড হল। ক্রাকেনথর্প নামে একজন শিল্পপতি বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। সেটা ১৮৮২ সালের কথা।
বর্তমানে সেই ক্রাকেনথর্পের এক ছেলে তার এক মেয়েকে নিয়ে এই বাড়িতে বাস করে।
–এখানে দেখছি রেললাইন ওই বাড়ির সংলগ্ন জমির একটা অংশ বেস্টন করে চলে গেছে। এখানে তাহলে আমার কাজটা কি?
মিস মারপল বললেন, ওই বাড়িটাই আমার লক্ষ্য। আমি চাইছি তুমি ওখানে একটা চাকরি নাও। গৃহস্থালীর কাজে তোমার খুবই নাম যশ। চাহিদাও খুব। আমার ধারণা, একটা কাজ তুমি ঠিক জোগাড় করে নিতে পারবে।
আমি কিছুটা খোঁজখবর নিয়েছি। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প একটু কৃপণ স্বভাবের লোক। তোমাকে উপযুক্ত মাইনে দিতে না-ও চাইতে পারেন।
তবে আমার কাছ থেকে যে টাকার অঙ্কটা তুমি পাবে সেটা তোমার প্রচলিত মাইনের চেয়ে অনেক বেশিই হবে।
-তাহলে কাজটা কঠিনই বলছেন আপনি।
–কেবল কঠিনই নয়, বিপজ্জনকও। বুঝতেই পারছ, আগে থেকেই ইঙ্গিতটা তোমাকে আমি দিয়ে রাখছি।
–বিপদকে আমি ভয় পাই না–তবে আপনি কি মনে করছেন কাজটায় বিপদের সম্ভাবনা আছে?
–আছে তো বটেই। নিঃশব্দে একটা অপরাধ ঘটে গেছে। কেউ কিছু জানতে পারেনি, কোনো সন্দেহ না। কেবল আমাদের দুই বন্ধুর কাছেই পুলিস অদ্ভুত ঘটনাটার কথা শুনেছে। কর্তব্যের খাতিরে অনুসন্ধান করেছে পুলিস, কিন্তু কোনো সূত্রের হদিশ পায়নি। যে লোকটি অপরাধটি করল, সে যেই হোক, নিশ্চয়ই নিশ্চিন্তে রয়েছে। এই অবস্থায় তোমাকে রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করতে দেখলে সে তা করতে দেবে কেন?
-বুঝতে পারছি, বলল লুসি, তাহলে আমি কী অনুসন্ধান করব?
–আপাততঃ খুনের সূত্র। বাঁধের ধারেকাছে ঝোপঝাড়ে ভাঙাচোরা ডালপালা কিংবা কাটায় আটকে থাকা একটুকরো কাপড় এই ধরনের সন্দেহজনক কিছু তোমার নজরে পড়ে যেতে পারে।
–এরকম কিছু যদি সত্যিই পেয়ে যাই তাহলে আমি কি করব?
-আমাকে জানাবে। আমি তোমার নাগালের মধ্যেই থাকব। ব্র্যাকহ্যাম্পটনে আমার এক পুরনো পরিচারিকা থাকে। তার বাড়িতেই আমি থাকার ব্যবস্থা করেছি।
তুমি তোমার মনিবদের বলবে, এই বুড়ী মাসীমা কাছাকাছি থাকেন। তার দেখাশোনা করতে পারবে সেই কারণেই বলবে তুমি এমন জায়গায় কাজ চাইছ। আর আমার সঙ্গে যাতে দেখাসাক্ষাৎ করতে পার সেই মত একটা অবসর সময় রেখে দেবে।
-কিন্তু আমি তো একাজে তিন সপ্তাহের বেশি সময় দিতে পারব না। তারপর চুক্তিবদ্ধ।
-তিন সপ্তাহ যথেষ্ট সময়। এরমধ্যে যদি কিছু পাওয়া যায় ভালো, না পাওয়া গেলে মিছিমিছি ওর পেছনে আর সময় নষ্ট করব না।
লুসির সঙ্গে কথা পাকা করে মিস মারপল বিদায় নিলেন।
সে কিছুক্ষণ একা বসে সমস্ত ব্যাপারটা ভাবল। তারপর ব্র্যাকহ্যাম্পটনে তার এক পরিচিত রেজেস্ট্রি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে মহিলা ম্যানেজারকে জানাল, কাছাকাছি অঞ্চলে তার একটা কাজের দরকার। তার এক বৃদ্ধা মাসীমাকে তাহলে দেখাশোনা করার সুবিধা হয়।
মহিলাটি উৎসাহিত হয়ে অনেকগুলি পরিবারের নাম করল। তার মধ্যে রাদারফোর্ড হলের ক্রাকেনথর্প পরিবারের নামও ছিল।
মিনিট দশেকের মধ্যেই রাদারফোর্ড হলের মিস ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে লুসির টেলিফোনে যোগাযোগ ঘটে গেল। কাজের কথাবার্তাও পাকা হয়ে গেল।
দুদিন পর লুসি লন্ডন থেকে ব্রাহ্যাম্পটন রওনা হল।
.
০৪.
বিরাট গেট পার হয়ে আঁকাবাঁকা পথ, দুপাশে রডোডেনড্রন ফুলের ঝাড়। তারপর সেই ছোট্ট বাড়িটি। সময়ের ভারে বিধ্বস্ত। বসবাসের জন্য তৈরি করা বাড়িটি এখন পোড়ো দুর্গের চেহারা নিয়েছে।
গাড়ি থেকে নেমে লুসি বেল বাজাল। একটি স্ত্রীলোক বসার ঘরে নিয়ে বসাল তাকে। চমৎকার সাজানো ঘর। সেলফ ভর্তি বইয়ের সারি।
-তোমারই তো আসার কথা, বস খবর দিচ্ছি।
স্ত্রীলোকটি চলে যাবার কয়েক মিনিট পরে এমা ক্রাকেনথর্প দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।
বাড়ির মালিকের কনিষ্ঠা কন্যা সে। প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে ভালো লেগে গেল লুসির। বয়স ত্রিশ ছাড়িয়েছে। সুশ্রী, কালো চুল, কটা চোখ।
পরিচয় পর্ব, করমর্দন শেষ হলে এমা তাদের বাড়ির কাজের একটা সংক্ষিপ্ত আভাস লুসিকে দিল। সে জানাল, বাড়িটা বড় হলেও স্থায়ী বাসিন্দা বলতে সে আর তার বৃদ্ধ অথর্ব বাবা। তার ভাইয়েরা বাইরে থাকে। অবশ্য প্রায়ই এখানে আসে। বাইরে থেকে দুজন মহিলা ঠিকে কাজ করতে আসেন। মিসেস কিডার আসেন সকালবেলা। মিসেস হার্ট সপ্তাহে তিনদিন আসেন, পুরনো জিনিসপত্র পরিষ্কার করতে।
কাজের ধরনটা মোটামুটি আঁচ করতে পারল লুসি। সব কাজই তার ধারণার মধ্যে রয়েছে।
লুসি বলল, আমার এক বৃদ্ধা মাসী কাছেই থাকেন। তার যাতে দেখাশোনা করতে পারি সেজন্য ব্র্যাকহ্যাম্পটনেই আমি থাকতে চাই। তাই টাকার অঙ্ক নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাইনি। যাইহোক, মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য আমার ছুটি পেলেই যথেষ্ট।
বিকেলের দিকে ছটা অবধি প্রতিদিনই তোমার ছুটি থাকবে। বলল এমা।
–আমি খুশি। লুসি বলল।
–একটা বিষয় কেবল তোমাকে বিশেষ ভাবে বলার আছে, সেটা হল, আমার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে কষ্ট হলেও তোমাকে তার সঙ্গে একটু মানিয়ে চলতে হবে।
-ওটা কোনো ব্যাপার নয়, সব বয়সের মানুষের সঙ্গে মিশতে আমি অভ্যস্ত।
লুসিকে তার থাকার ঘরটা দেখিয়ে দেওয়া হল। নিয়ে আসা হল বৃদ্ধ লুথার ক্রাকেনথর্পের ঘরে। তারপরে রান্নাঘর। বাড়ির লোকের খাওয়াদাওয়ার সময়টা জেনে নিল লুসি।
বলল, মোটামুটি সবকিছুই জেনে নিলাম আমি। এবার থেকে আমিই সবদিক সামাল দেব। ভাববেন না।
.
পরদিন সকাল ছটা থেকেই কাজে হাত লাগাল লুসি। বাড়িঘর পরিষ্কার করা, আনাজ কাটাকুটি, রান্নার আয়োজন সংগ্রহ ইত্যাদি সব সেরে নিয়ে ক্ষিপ্রহাতে প্রাতঃরাশ সরবরাহ করল।
বেলা এগারোটা নাগাদ একটু অবকাশ মিলল। এই সুযোগে মিসেস কিডারের সঙ্গে গল্পচ্ছলে কিছু মূল্যবান তথ্য জেনে নিল সে।
ভালো একজন শ্রোতা পাওয়া গেছে বুঝতে পেরে মিসেস কিন্ডার গড়গড় করে বলে গেলেন, বাড়িটা যেমন মস্ত, পরিবারটিও তেমনি। এনতার লোকজন। বড় ছেলে এডমান্ড লড়াইতে মারা গেছে, তার পরে কেড্রিক, কি সব ছবিটবি আঁকে। এখনো বে-থা করেনি।
তৃতীয় ছেলে হারল্ড, লন্ডনে থাকে। বনেদী ঘরের মেয়েকে বিয়ে করেছে-ব্যবসা করে নামডাক হয়েছে।
ছোট ছেলে আলফ্রেড–বিশেষ সুবিধার নয়। নানান অপকর্ম করে বেড়ায়। পুরুষ মানুষ আর একজন আছে।
কর্তার বড় মেয়ে এডিথের স্বামী ব্রায়ান ইস্টালি। কয়েক বছর আগে এডিথ মারা গেছে। কিন্তু ব্রায়ান এখনো এবাড়ির ছেলের মতোই যাওয়া-আসা করে।
তাদের একটি বাচ্চা ছেলে আলেকজান্ডার-স্কুলে পড়ে। ছুটিছাটায় এবাড়িতে আসে। এমাকে খুব ভালোবাসে।
যথাসময়ে লাঞ্চের খাবার রান্নার কাজও চুকল। ধোয়ামোছা শেষ করে, রান্নাবান্না যথাস্থানে পৌঁছে দিল। দুটো ত্রিশের মধ্যে কাজকর্ম চুকিয়ে লুসি তার আসল কাজ আরম্ভ করতে পারল।
কারোর চোখে অস্বাভাবিক না ঠেকে সেভাবে সে প্রথম বাগানের চারপাশে ঘুরল, শাকসবজি দেখল। পথগুলো আগাছায় ঢেকে ফেলেছে। সর্বত্র অযত্নের ছাপ।
বাড়ির পাশেই আস্তাবল। বৃদ্ধ মালিটি আস্তাবলের উঠোনের পাশে একটা কুঁড়ে ঘরে থাকে। আস্তাবল পাশ কাটিয়ে লুসি ধীরে ধীরে বাড়ি সংলগ্ন পার্কে চলে এল। পার্কের দুদিকেই প্রাচীর ঘেরা। সেখান থেকে রেলপথের খিলানের নিচে দিয়ে গিয়ে একটা সরু গলিতে এসে পড়ল।
মেন লাইনের গাড়ি অনবরত খিলানের ওপর দিয়ে ঝমাঝম শব্দে ছুটে যাচ্ছে। লুসি লক্ষ্য করল, ক্রাকেনথর্পের বাড়ির সীমানা ঘিরে বেঁকে যাওয়া রেলের ওপর দিয়ে চলার সময় গাড়িগুলোর গতি বেশ কমে যায়।
ছোট্ট গলিটার একপাশে রেলের বাঁধ, অন্য পাশে উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের ওপাশে কয়েকটা কারখানা বাড়ি।
গলিপথে এগিয়ে গিয়ে লুসি একটা অপেক্ষাকৃত বড় রাস্তা পেল। অল্পদূরে ছোট ছোট বাড়িঘর।
একজন মহিলাকে আসতে দেখা গেল। লুসি তার কাছ থেকে পোস্ট অফিসটা কোথায় জেনে নিল। সেখানে গিয়ে মিস মারপলকে টেলিফোন করল। তিনি বিশ্রাম করছিলেন, ফ্লোরেন্স টেলিফোন ধরল।
লুসি তাকে নিজের পরিচয় জানিয়ে বলে দিল, সে নির্দিষ্ট জায়গায় উপস্থিত হয়ে যথানিয়মে কাজ শুরু করেছে, এই খবরটা যেন মিস মারপলকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে লুসি রাদারফোর্ড হলে ফিরে এল।
.
০৫.
কর্মস্থলে আসার আগেই নিজের ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করেছিল লুসি আইলেসব্যারো। দূরদৃষ্টি প্রয়োগ করে সে একসেট গলফ ক্লাব ছড়ি সঙ্গে এনেছিল। মিস মাথার অনুমতি নিয়ে সে পার্কের মধ্যে পরদিন থেকে গলফ ক্লাব দিয়ে বল মারা অনুশীলন শুরু করল।
পর পর কয়েকটা বল সে হিট করল। একটা বল রেলবাঁধের পাশে গিয়ে পড়ল। কয়েকটা পড়ল এপাশ ওপাশে ঘাসের মধ্যে।
বল খোঁজার অছিলায় বাঁধের অনেকটা অংশ অনুসন্ধান করার সুযোগ পেল লুসি। তবে সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়ল না।
পরদিনও একই কৌশলে সে বাঁধের নিচে খোঁজাখুঁজি করল। কাঁটাঝোপের মাথায় ফারের একটা ছেঁড়া টুকরো তার নজরে পড়ল। রঙটা ফ্যাকাসে বাদামী। পকেটে ছোট্ট কাঁচি নিয়ে এসেছিল। ফারের টুকরোটার অর্ধেকটা কাঁচি দিয়ে কেটে পকেটে পুরে নিল।
বাঁধের ঢাল বেয়ে নামার সময় নিচে লম্বা ঘাসের মধ্য দিয়ে একটা অস্পষ্ট পথের রেখা নজরে পড়ল। কিছুদিন আগে কেউ ঘাসের ওপর দিয়ে যাওয়ায় এমনটা হতে পারে, সে ভাবল।
বাঁধের নিচে এসে আর একটা জিনিস আবিষ্কার করল সে। এনামেলে জড়ানো খানিকটা জমানো পাউডার। জিনিসটা রুমালে জড়িয়ে পকেটে ঢোকাল সে।
উৎসাহিত হয়ে আরো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল লুসি। কিন্তু আর কিছু পাওয়া গেল না।
পরদিন বিকেলে মাসীমাকে দেখতে যাচ্ছে বলে গাড়ি নিয়ে বেরলো লুসি। মাসিডন রোডের পাশে চার নম্বর বাড়িটার সামনে এসে বেল বাজাল।
দীর্ঘাঙ্গী বিষণ্ণ চেহারা, মাথায় পাকা চুলের স্তূপ এক মহিলা দরজা খুলে তাকে মিস মারপলের ঘরে পৌঁছে দিল।
দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা চেয়ারে বসল লুসি। কিছু জিনিস পেয়েছি। মনে হচ্ছে আপনার অনুমান ঠিক।
বলতে বলতে লুসি পকেট থেকে আবিষ্কৃত জিনিসগুলো বার করল। কিভাবে এগুলো পাওয়া গেল সেই বিবরণ শোনাল।
ফারের টুকরোটা হাতে নিয়ে মিস মারপল বললেন, মেয়েটির গায়ে হালকা রঙের ফারকোট ছিল, বলেছিল এলসপেথ। সস্তা পাউডারের কৌটোটা সম্ভবত কোটের পকেটে ছিল। বাঁধের ঢালে দেহটা গড়িয়ে পড়ার সময় পকেট থেকে ছিটকে গিয়েছিল। সাধারণ জিনিস, তবে পরে কাজে লাগতে পারে। সবটুকু ফারই কি তুমি তুলে এনেছ?
–না, কাঁচি দিয়ে অর্ধেকটা কেটে এনেছি।
–বুদ্ধিমতী মেয়ে। প্রমাণ চাইলে পুলিসকে দেখানো যাবে।
–এই সূত্রগুলো নিয়ে পুলিসে যাবেন ভাবছেন?
–এখনই নয়। দেহটা খুঁজে বার করা দরকার।
-কিন্তু সেটা পাওয়া কি সম্ভব হবে? বোঝা যাচ্ছে দেহটা ট্রেন থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল আর লোকটা ব্র্যাকহ্যাম্পটনে নেমে পড়েছিল। পরে সেই রাত্রেই ঘটনাস্থলে ফিরে এসে মৃতদেহটা সে সরিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু সে তো দেহটা যে কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারে?
-না, মিস আইলেসব্যারো, অন্য কোথাও নিয়ে যায়নি। সেরকম উদ্দেশ্য থাকলে খুনটা সে যে কোনো নির্জন জায়গায়ই করতে পারত।
-তাহলে বলছেন এটা পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?
–নিশ্চয়ই। হঠাৎ করে উত্তেজনার বশে খুনের ঘটনাটা ঘটে গিয়ে থাকলে দেহটা এমন কোনো জায়গায় ধাক্কা দিয়ে ফেলা হত না, যেখান থেকে সেটা পরে সরিয়ে ফেল যায়। খুব সুকৌশল পরিকল্পনা বর্তমান অপরাধের পেছনে কাজ করেছে।
রাদারফোর্ড হলের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়, রেলের ধারে তার অবস্থান, সবকিছু লোকটির জানা ছিল। বাড়িটার অবস্থানই এমন যে বাইরের লোকজনের আনাগোনা থেকেও একরকম বিচ্ছিন্ন।
–ঠিকই বলেছেন, বলল লুসি, সকালের দিকে ব্যবসায়ীরা মালপত্র পৌঁছে দিয়ে যায়। ওইটুকুই যা শহরের সঙ্গে এবাড়ির সম্পর্ক। খুনী স্বচ্ছন্দেই রাদারফোর্ড হলে ফিরে এসে থাকতে পারে। মৃতদেহটা পরদিন সকালের আগে কারো নজরে পড়ার সম্ভাবনা ছিল না। সেটা সরিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট সময় পায়।
-হ্যাঁ। কোনো এক পথে খুনী রাদারফোর্ড হলেই ফিরে এসেছিল। তারপর দেহটা উদ্ধার করে একটা পূর্ব নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। আমার ধারণা রাদারফোর্ড হলের খুব কাছাকাছি কোথাও নিয়ে গিয়ে কবরস্থ করা হয়েছে। মনে রেখো, পার্কের মধ্যে কাজটা করার ঝুঁকি ছিল। সহজেই কারো চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কবরটা সে আগেই খুঁড়ে রেখে থাকবে–আচ্ছা বাড়িতে কি কুকুর আছে?
–না।
-তাহলে তোমার কি মনে হয় কোনো আস্তাবলে কিংবা অব্যবহৃত কোনো ঘরে কবর দিতে পারে? দ্রুত কাজ শেষ করার পক্ষে জায়গাগুলো নিরাপদ। অনেক পুরনো বাড়ি, অব্যবহৃত অনেক ঘর পড়ে আছে, শুয়োরের আস্তানা, কারখানা ঘর–এসব জায়গায় সচরাচর কেউ যায় না। এছাড়া কোনো রডোডেনড্রনের ঝোপ কিংবা অন্য কোনো ঝোপের মধ্যেও ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে।
.
পরদিন বিকেলে লুসি খুব সতর্কতার সঙ্গে তার অনুসন্ধান কাজ শুরু করল। কিন্তু বিশেষ কিছু সংগ্রহ করতে পারেনি পরিবারের কিছু পুরনো সংবাদ ছাড়া।
বাগানের বৃদ্ধশালী হিলম্যানের সঙ্গে বাগানে দেখা হয়েছিল লুসির। বয়স হয়েছে বলে অনর্গল বকবক করে। কথা বলতে পেলে খুব খুশি হয়। লুসি এটা, ওটা প্রসঙ্গ তুলে তাকে বকবক করার সুযোগ দেয়।
হিলম্যান একসময় অনুযোগের সুরে বলতে থাকে, কর্তা তো টাকার পাহাড়ের ওপরে বসে আছেন। কিন্তু এক কানা কড়িও তার নিজের রোজগার না। সম্পত্তি করেছিলেন মিঃ ক্রাকেনথর্পের বাবা। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়েছিলেন তিনি। এই বাড়িও তিনিই করেন। খরচের হাতও ছিল দরার। দুই ছেলের কোনোটিই তার মত করিৎকর্মা ছিল না। কিন্তু অক্সফোর্ডে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করেছিলেন তাদের। কিন্তু তারা কেউ বাপের ব্যবসার ধার দিয়েও গেল না। ছোটছেলে এক সুন্দরী অভিনেত্রীকে বিয়ে করেছিল। সারাক্ষণ মদে চুর হয়ে থাকত। পরে একদিন ওই অবস্থাতেই গাড়ির তলায় চাপা পড়ে কেঁসে গেল।
আমাদের কর্তা হলেন বড় ছেলে। বাপ বিশেষ পছন্দ করতেন না। তিনি বিদেশে বিদেশেই ঘুরে কাটাতেন আর নানান মূর্তি কিনে দেশে পাঠাতেন।
যুদ্ধের আগে বুড়ো বাপ মারা গেলে মিঃ ক্রাকেনথর্প এই বাড়িতে সপরিবারে এসে থিতু হলেন। ততদিনে ছেলেরা সবাই বড়সড় হয়ে গেছে।
সংবাদগুলো খুবই মূল্যবান বলে মনে হয়েছিল লুসির। তাই ধৈর্য ধরে সব শুনেছিল।
বাড়ি ফিরে এসে দেখতে পেয়েছিল বিকেলের ডাকে আসা একটা চিঠি পড়ছে এমা।
–আমার ভাইপো আলেকজান্ডার তার এক সহপাঠী বন্ধুকে নিয়ে কাল আসছে। ছেলেটির নাম জেমস স্টডার্ড। গাড়ি বারান্দার দোতলার পাশাপাশি ঘর দুটোতে ওরা থাকতে পারবে।
.
টগবগে কিশোর দুটি পরদিন সকালেই এলো। সুন্দর দেবদূতের মতো চেহারা তাদের। আলেকজান্ডার ইস্টালির কটা চুল, নীল চোখ। স্টান্ডার্ড ওয়েস্টের রঙ চাপা, চোখে চশমা। ওরা এসে হৈ হট্টগোলে বাড়ি মাতিয়ে তুলল।
লাঞ্চের পরে ধোয়ামোছার কাজ শেষ করে যথানিয়মে লুসি বেরিয়ে পড়ল। ছেলে দুটি তখন দূরের মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছিল।
লুসির হাতে গলফ ক্লাবের ছড়ি। আজ বিপরীত দিকের রাস্তায় এগিয়ে গিয়ে সে। একজায়গায় রডোডেনড্রন ঝোপ ফঁক করে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছিল।
লুসির হাতে গলফ ক্লাব দেখে ছেলেরাও উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল। তারাও বাড়ির বাগানে গলফ সেট বসানোর কাজে মেতে উঠল।
ঘোরাঘুরি শেষ করে লুসি যখন বাড়িতে ফিরে আসছে, তখন গর্তের সংখ্যা লেখা ফলকগুলো নিয়ে দুই বন্ধুতে সমস্যায় পড়েছে দেখতে পেল।
মরচে ধরে সংখ্যাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। লুসি সমাধান বাতলে দিল–তুলি দিয়ে সাদা রং বুলিয়ে দিলেই হবে। কাল খানিকটা রং সংগ্রহ করে নিও।
আলেকজান্ডার খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল, বড় গুদামঘরে রঙের পাত্র আছে আমি জানি। আগের ঈস্টারের আগে রঙের মিস্ত্রীরা কাজ করেছিল। ওখানে একবার দেখলে হয়।
বড় গুদোম ঘর কোনটা জানতে চাইলে আলেকজান্ডার তাকে বাড়ির পেছনে দিকের রাস্তার ধারে একটা বড় দালান দেখিয়ে দিল।
–ওই ঘরটায় বৃদ্ধের সংগ্রহ করা অনেক জিনিস ফেলে রাখা আছে। তিনি সব বিদেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। চলো না দেখবে।
কৌতূহলী হয়ে লুসি তার সঙ্গে চলল। বড় গুদোম ঘরে ঢোকার কাঠের দরজায় লোহার কাটা বসানো। দরজার মাথায় আইভি লতার ঝাড়। তার নিচে লোহার সঙ্গে চাবি ঝোলানো ছিল। আলেকজান্ডার চাবি নিয়ে তালা খুলে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। তার পেছনে অন্য দুজন ঢুকল।
লুসি একনজরে চারপাশটা দেখে নিল। নানান ধরনের পাথরের মূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। প্রাচীন শিল্প কর্মের নিদর্শন হলেও অবহেলা অযত্নে নিতান্ত বাজে জিনিসের পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে।
এসবের সঙ্গে রয়েছে অজস্র ভাঙ্গা টেবিল চেয়ার, ঘাসকাটার যত্ন, মোটর গাড়ির বাতিল আসন, মরচে ধরা বালতি, এমনি নানান টুকিটাকি।
আলেকজান্ডার কোণের দিকে এগিয়ে পর্দার ঢাকা সরিয়ে গুটি কয়েক রঙের টিন আর কয়েকটা ব্রাশ বার করে আনল।
লুসি দেখে বলল, রঙ গুলবার জন্য কিছু তারপিন তেল এবারে দরকার।
গুদোমঘরে তারপিন তেল খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু দুই কিশোর আনন্দের সঙ্গে জানাল এখুনি সাইকেলে গিয়ে তারা তারপিন তেল সংগ্রহ করে আনবে। প্রবল উৎসাহে তারা ব্রাশ আর রঙের কৌটো নিয়ে বেরিয়ে গেল।
লুসি একা গুদোমঘরে, সতর্ক দৃষ্টি ফেলে চারপাশ তাকিয়ে দেখতে লাগল। ঘরের বাতাস বেশ ভারি। বাইরের হাওয়া চলাচলের অভাবে এমনটা হয়েছে। কেমন একটা পচা গন্ধের আভাস পেল পুসি। নাক টেনে গন্ধটা চিনবার চেষ্টা করতে লাগল।
হঠাৎ বিরাট একটা পাথরের কফিনের ওপরে তার চোখ পড়ল। পায়ে পায়ে সেটার কাছে এগিয়ে গেল। কফিনের ঢাকানাটা ভারি আর আঁট করে লাগানো। লুসির কেমন সন্দেহ হল। চাড় দেওয়ার শক্ত কিছু পাওয়া গেলে ডালাটা খুলে ভেতরটা দেখা যেত।
গুদোমঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে এলো লুসি। একটা ভারি ক্রোবার নিয়ে আবার গুদোমঘরের ফিরে এলো। কিন্তু চেষ্টা করে বুঝতে পারল শক্তি দরকার।
জেদ চেপে গেল তার। ক্রোবার দিয়ে সর্বশক্তি নিয়ে ডালার ফাঁকে ক্রোবারে চাপ দিতে লাগল।
চেষ্টা ব্যর্থ হল না। ভারি ঢাকনাটা অবশেষে ধীরে ধীরে উঠতে লাগল। খানিকটা ফাঁক হলেই লুসি উবু হয়ে দেখতে পেল—কফিনের ভেতরে কি আছে।
২. বেরিয়ে এল লুসি
০৬.
প্রবল উত্তেজনায় ত্রস্ত পায়ে বড় গুদোম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল লুসি। তার হাত কাঁপছিল। তালা বন্ধ করে চাবিটা আগের জায়গায় রাখল। একরকম দৌড়েই যেন সে আস্তাবলে নিজের গাড়ির কাছে চলে এল।
বাড়ির পেছনের রাস্তা ধরে পোস্ট অফিসের সামনে থামল। টেলিফোন তুলে মিস মারপলের সঙ্গে যোগাযোগ করল।
-কি বলছ লুসি? ওপ্রান্ত থেকে জানতে চাইলেন মিস মারপল।
–আমি জিনিসটা পেয়েছি। হ্যাঁ স্ত্রীলোকের…ফারকোট পরা…একটা পাথরের কফিনের মধ্যে…হ্যাঁ, বাড়ির বাইরের দিকে একটা গুদোম ঘরের মধ্যে। এখন আমি কি পুলিসে খবর দেব?
-এক্ষুনি পুলিসে খবর দাও।
–আনুষঙ্গিক কথাগুলো কি পুলিসকে বলব?
–হ্যাঁ। কোনো কথা গোপন করার দরকার নেই। সত্যকথাটাই তুমি তাদের বলবে।
–আপনার সম্পর্কে?
লুসি রিসিভার নামিয়ে রাখল। একমিনিট অপেক্ষা করে আবার রিসিভার তুলে পুলিস দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করল।
.
এতক্ষণে উত্তেজনা থিতিয়েছে। গাড়ি নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো লুসি। কোনোরকম ভূমিকা না করেই সে এমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে সমস্ত ঘটনা খুলে জানাল। সে যে পুলিসেও খবরটা জানিয়েছে সেকথাও বাদ দিল না।
এমা ভয়ে বিস্ময়ে কথা হারিয়ে ফেলেছিল। পরে সামলে নিয়ে অনুযোগের স্বরে বলল, পুলিসকে খবর দেবার আগে আমাকে জানানো তোমার উচিত ছিল।
ঠিক এই সময়েই বাড়ির সামনে গাড়ি থামার শব্দ হল।
পরক্ষণেই দরজার ঘন্টা সশব্দে বেজে উঠল।
.
ইনসপেক্টর বেকনের হাত ধরে বড় গুদোমঘর থেকে বেরিয়ে এলো এমা ক্রাকেনথর্প। তার মুখ ফ্যাকাসে। চোখে উভ্রান্ত দৃষ্টি।
-না, ইনসপেক্টর, মেয়েটিকে চিনি না, জীবনে কখনো আগে দেখিনি।
–ধন্যবাদ মিস।
হলঘর অতিক্রম করে তারা পড়ার ঘরে ঢুকল। সেই সময় ডাক্তার কুইম্পার পড়ার ঘর ছেড়ে বেরচ্ছিলেন। ইনসপেক্টর মুখোমুখি হলে তারা পরস্পরকে অভিবাদন জানালেন।
এমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন, তুমি শক্ত মনের মেয়ে, সবকিছু সহজভাবে মেনে নেবে। তোমার বাবা সুস্থ আছেন। ভেতরে তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলল।
এমা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন, এমা একা এই পরিবার সামাল দিচ্ছে। ওর আগেরটি আগেই সরে পড়েছে। এমা এখনো অবিবাহিতা।
–বোধহয় খুবই পিতৃভক্ত। ইনসপেক্টর বললেন।
–ঠিক ততটা নয়, যতটা আপনি ভাবছেন। বাড়ির মেয়েদের সুখী করার দায়িত্ব যে মেয়েদের একথা সে জানে।
.
ইনসপেক্টর বেকন লুসির সঙ্গে গিয়ে আগে পাথরের কফিনে মৃতদেহটি দেখলেন। পরে দেখা দিল সনাক্তকরণের প্রশ্ন।
এমা ক্রাকেনথর্প আর মিঃ ক্রাকেনথর্প বাড়িতে আপাততঃ এই দুজনই মানুষ উপস্থিত। এমার টেলিফোন পেয়ে ডাঃ কুইম্পারও উপস্থিত হয়েছেন।
এমা মৃতদেহটি দেখল। সে পরিষ্কার জানাল, এর আগে মেয়েটিকে আমি জীবনে কখনো দেখিনি।
বৃদ্ধ মিঃ ক্রাকেনথর্পকে ডাঃ নিজে ওপর থেকে নিচে নিয়ে এলেন। বাড়ির কর্তা, তার মতামত স্বভাবতই ইনসপেক্টর বেকনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
কিন্তু তিনিও বড় গুদোমঘর থেকে ঘুরে এসে জানালেন, জীবনে এ মেয়ের মুখ আমি দেখিনি। কফিনটা আমি নেপলস কি ফ্লোরেন্স থেকে এনেছিলাম এখন আর ঠিক মনে নেই। কিন্তু এ কিরকম কথা কোথাকার কোনো মেয়ে এর ভেতরে খুন হয়ে পড়ে থাকবে?
ইতিপূর্বে পুলিসের সার্জন জনস্টেন মৃতদেহ দেখে রায় দিয়ে গেছেন, স্ত্রীলোকটি দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে মারা গেছে। ডাঃ কুইম্পার ইনসপেক্টর বেকনের কাছে এই বিবরণ জানতে পেরে নিজেই প্রস্তাব করলেন, আমিও একবার মৃতদেহটা দেখতে চাই।
আপনার মতামত জানতে পেলে আমি খুব খুশি সব স্যার। বললেন বেকন, স্ত্রীলোকটির পরিচয় আমাদের জানা দরকার।
কিন্তু পাথরের কফিনটার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরের মৃতদেহটা তিনি দেখলেন। পরে জানালেন, এ মেয়েকে কখনো আগে দেখিনি। আমার রোগীদের কেউ নয়। বোঝা যাচ্ছে একসময় বেশ সুন্দরী ছিল। কিন্তু ওরকম একটা জায়গায় কফিনটার ভেতরে ওটা আবিষ্কার হল কি করে?
–মিস আইলেসব্যারো আবিষ্কার করেছেন। বললেন বেকন।
–বাড়ির নতুন কাজের মেয়েটি? তা পাথরের কফিনের ভেতরে দেখার কি দরকার পড়েছিল ওর?
–একটু পরেই আমিও একথা তার কাছে জানতে চাইব।
এই সময় আলেকজান্ডার আর তার বন্ধু স্টডার্ড ওয়েস্ট সেখানে উপস্থিত হল।
–স্যার, দয়া করে, আমাদের মৃতদেহটা একবার দেখতে দেবেন?
আলেকজান্ডারের অনুরোধ শুনে ইনসপেক্টর বেকনের ভ্রু কুঞ্চিত হল।
দুই কিশোরের পরিচয় জেনে নিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, এই অঞ্চলে তোমরা কখনো সোনালী চুলের কোনো মেয়েকে দেখেছ? তার গায়ে একটা হালকা রঙের ফারকোট?
-এখুনি ঠিক মনে করতে পারছি না স্যার, বলল আলেকজান্ডার, সেজন্যই তো একবার দেখতে চাইছি-দয়া করে আমাদের আবেদনটা বিবেচনা করুন স্যার।
ইনসপেক্টর বেকন কি ভাবলেন। পরে বড় গুদামঘরের সামনে প্রহরারত কনস্টেবলকে ডেকে তিনি নির্দেশ দিলেন, কিশোরদুটিকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনতে।
রান্নাঘরে সন্ধ্যার জন্য চিপস তৈরি করছিল লুসি। এমন সময় একজন কনস্টেবল এসে জানাল, ইনসপেক্টর লুসির সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন।
সামনে থেকে আলুর কুচির বাটিটা সরিয়ে রেখে লুসি বার্তাবাহকের পেছন পেছন এসে একটি ঘরে ঢুকল।
লুসি আসন গ্রহণ করলে ইনসপেক্টর প্রথমে তার নাম এবং লন্ডনের ঠিকানা জেনে নিলেন।
পরে জিজ্ঞেস করলেন, মিস আইলেসব্যারো, আপনি বড় গুদোমঘরে ছেলেদের জন্য রঙের খোঁজে গিয়েছিলেন, তাইতো?
-হ্যাঁ। লুসি জবাব দিল।
-রঙ খুঁজে পাওয়ার পর আপনি একটা ক্রোবার সংগ্রহ করে চাড় দিয়ে পাথরের কফিনটার ঢাকনা তুলে ফেলে মৃতদেহটা আবিষ্কার করেন?
–হ্যাঁ, তাই।
–আচ্ছা, পাথরের কফিনটার মধ্যে আপনি কি খোঁজ করছিলেন?
–একটা মৃতদেহ খোঁজ করছিলাম।
–আপনি মৃতদেহ খোঁজ করছিলেন? এই কাহিনী আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন?
–অদ্ভুত শোনালেও কাহিনীটা সত্যি। আমাকে ব্যাখ্যা করবার সুযোগ দেবেন আশাকরি।
–অবশ্যই। আপনার বক্তব্য আপনি বিস্তারিত ভাবে বলুন।
লুসি তার অদ্ভুত আবিষ্কারের পূর্ববর্তী সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে যথাযথ পেশ করল।
–একটা মৃতদেহ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে আপনি এই বাড়িতে চাকরি নিয়েছিলেন, আর আপনাকে একাজে নিয়োগ করেছিলেন এক বৃদ্ধ মহিলা–তা এই মহিলাটি কে?
–তার নাম মিস মারপল। বর্তমানে তিনি চার নম্বর ম্যাডিসন রোডে বাস করছেন।
ইনসপেক্টর প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো লিখে নিলেন।
-কিন্তু, মিস আইলেসব্যারো, আপনার এই কাহিনীটা একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না কি?
-কাহিনীর সত্যতা যাচাই করার জন্য আপনি স্বচ্ছন্দে মিস মারপলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। শান্ত কণ্ঠে বলল লুসি।
–হ্যাঁ, মহিলার সঙ্গে আমি দেখা করব।
–তাহলে মিস ক্রাকেনথর্পকে আমার বিষয়ে কি বলবেন?
–আপনার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারা গেল না।
–আমার বক্তব্য হল, মিস মারপলের সঙ্গে আমার কাজের যে চুক্তি ছিল তা শেষ হয়েছে। অর্থাৎ একটা মৃতদেহ খুঁজে বার করার জন্য তিনি আমাকে নিযুক্ত করেছিলেন, আমি তা করেছি। কিন্তু মিস ক্রাকেনথর্পের কাজে আমি এখনো নিযুক্ত রয়েছি। বর্তমানে বাড়িতে দুজন তরুণ অতিথি রয়েছে।
যে ঘটনা ঘটল, তাতে আরো কিছু লোকের আগমনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই অবস্থায় বাড়িতে গৃহস্থালির কাজে আমার সহযোগিতা অপরিহার্য।
এখন আপনি যদি মিস ক্রাকেনথর্পকে জানান যে মৃতদেহ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য আমি তার কাছে চাকরি নিয়েছি, তাহলে তিনি হয়তো আমাকে জবাব দিতে পারেন। তা না হলে আমি তাদের প্রয়োজনে লাগতে পারি।
ইনসপেক্টর মনোযোগ দিয়ে লুসির কথা শুনলেন। বললেন, আপনার বক্তব্যের সমর্থন না পাওয়া পর্যন্ত আমি সত্যাসত্য নিরূপণ করতে পারছি না। তাই আপাততঃ কারো কাছেই কিছু আমি বলছি না। আপনি আপনার কাজ আগের মতই চালিয়ে যেতে পারেন।
-ধন্যবাদ। তাই করব আমি।
.
ইনসপেক্টর বেকন বললেন, স্যার, মেয়েটি স্থানীয় বাসিন্দা ছিল না। আমার ধারণা সে বিদেশী।
করোনারের জিজ্ঞাসাবাদ যা হবার তোক, এব্যাপারে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাহায্য চেয়ে পাঠানো যেতে পারে। বললেন চিফ কনস্টেবল।
–আগামীকালই করোনারের আদালত বসবে। ক্রাকেনথর্প পরিবারের সকল সদস্যই শুনেছি উপস্থিত হবে। এদের মধ্যে কোনো একজন মেয়েটিকে সনাক্ত করতে পারবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
–ক্রাকেনথর্প পরিবারের কজন উপস্থিত হচ্ছে?
নামের একটা তালিকা ইনসপেক্টরের হাতে ছিল। সেটা দেখে তিনি পড়ে শোনালেন–উপস্থিত থাকছে হারল্ড ক্রাকেনথর্প-ইনি লন্ডনের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কেড্রিক–এ হচ্ছে সেই ছবি আঁকিয়ে, বিদেশে থাকে। আর একজন আলফ্রেড–তার কাজকর্ম বিষয়ে কিছু জানতে পারিনি।
তালিকাটা শোনানো হলে ইনসপেক্টর বেকন বললেন, কিন্তু ট্রেনের সেই অদ্ভুত কাহিনীটা কেন প্রচার করা হল এখনো বুঝতে পারছি না।
–কাজটা তো সেই বৃদ্ধ মহিলার–মিস মারপল না কি নাম, তাঁর সঙ্গে তুমি দেখা করেছিলে? জানতে চাইলেন চিফ কনস্টেবল।
-দেখা করেছিলাম স্যার। ট্রেনে যে হত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল, এবিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চিত। আর স্পষ্টই স্বীকার করলেন, মৃতদেহটি খুঁজে বার করার জন্য তিনিই সেই তরুণী আইলেসব্যারোকে নিযুক্ত করেছিলেন।
-খুবই চমকপ্রদ ব্যাপার। বললেন চিফ কনস্টেবল, ওই মিস জেন মারপল, নামটা আগে শুনেছি বলে মনে হচ্ছে। ইয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলে হয়তো জানা যাবে।
.
করোনারের বিচার অনুষ্ঠানে লুসির সাক্ষ্য নেওয়া হল। ডাক্তারের রিপোর্টও হাজির করা। হল। কিন্তু কেউ মৃত মেয়েটিকে সনাক্ত করতে পারল না।
ক্রাকেনথর্প পরিবারের মোট পাঁচজন উপস্থিত ছিল। এমা, কেড্রিক, হারল্ড, আলফ্রেড এবং ব্রায়ান ইস্টালি।
এই পরিবারের মৃতকন্যা এডিথের স্বামী ব্রায়ান ইস্টালি। এদের সঙ্গে ছিলেন, পরিবারের আইন সংক্রান্ত উপদেষ্টা সলিসিটর ফার্মের প্রধান মিঃ উইমবোর্ন।
সমস্ত ব্যাপারটা ক্রাকেনথর্প পরিবারের কাছে খুবই দুঃখজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অনতিবিলম্বেই এর ঝামেলা মেটাবার জন্য মিঃ উইমবোর্ন বাড়িতে ইনসপেক্টরের সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন।
করোনারের বিচার সভা থেকে ফিরে সকলে পড়ার ঘরে উপস্থিত হলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইনসপেক্টর বেকন এবং স্কটল্যান্ডইয়ার্ড থেকে আগত ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ডারমট ক্রাডক।
পরিচয় পর্ব সম্পূর্ণ হলে ক্রাডক মিঃ উইমবোর্নকে বললেন, শুনেছি আপনি ক্রাকেনথর্প পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাই আপনাকে জানানো উচিত বলে মনে করছি। মৃত স্ত্রীলোকটিকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা সে স্থানীয় বাসিন্দা ছিল না। সে এসেছিল লন্ডন থেকে, আর আমরা অনুমান করছি, সে এসেছিল ফ্রান্স থেকে।
মিঃ উইমবোর্ন বললেন, ব্যাপারটা আমাদের পরিবারের পক্ষে খুবই দুর্ভাগ্যজনক হয়ে উঠেছে। অথচ পরিবারের কেউই ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত নয়।
তবুও পরিবারের প্রত্যেক সদস্যোর সঙ্গে আমি কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই। আর আশা করছি, এই বাড়ি এবং পরিবারের সম্পর্কে আপনি আমাদের ওয়াকিবহাল করতে পারবেন।
মিঃ উইমবোর্ন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে লাগলেন, এই বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন লব্ধ প্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী জোসিয়া ক্রাকেনথর্প, ১৮৮৪ সালে। ব্যবসার সূত্রে প্রচুর বিত্ত সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে তার বড় ছেলে লুথার ক্রাকেনথর্প এই বাড়িতে বাস করছেন।
–শুনেছি মিঃ লুথার ক্রাকেনথর্পের আরেক ভাই ছিল?
–হ্যাঁ। তিনি ১৯১১ সালে মোটর দুর্ঘটনায় মারা যান।
–এই বাড়ি এবং সম্পদের বিষয়ে কোনো উইলপত্র নিশ্চয়ই আছে।
-তা আছে। মিঃ জোসিয়া ক্রাকেনথর্প তার বিশাল সম্পত্তি ট্রাস্টের হাতে দিয়ে গেছেন। উইলের শর্ত অনুযায়ী, লুথার যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন সঞ্চিত বিত্ত থেকে অর্জিত আয় তিনি পাবেন। লুথারের মৃত্যুর পর সমস্ত বিত্ত তার সন্তানদের অর্থাৎ এডমান্ড, কেড্রিক, হারল্ড, আলফ্রেড, এমা এবং এডিথের মধ্যে সমান ভাবে বণ্টন করা হবে। এডমান্ড যুদ্ধে মারা গেছে। সম্পত্তির ভাগিদার বর্তমানে কেড্রিক, হারল্ড, আলফ্রেড, এমা এবং এডিথের ছেলে আলেকজান্ডার। বাড়িটার বিষয়ে শর্ত হল, এটা পাবে লুথারের জীবিত ছেলেদের মধ্যে যে জ্যেষ্ঠ অথবা তার সন্তান।
–এডমান্ড ক্রাকেনথপই তো মিঃ লুথারের জ্যেষ্ঠপুত্র, তাই তো?
–হ্যাঁ।
–তিনি কি বিবাহিত ছিলেন?
–না।
–তাহলে বাড়িটা পাচ্ছে দ্বিতীয় ছেলে কেড্রিক?
–হ্যাঁ।
মিঃ লুথার ক্রাকেনথর্প এবাড়ি বিক্রি করতে পারবেন না?
-না। কেবল তাই নয়, উইল অনুযায়ী, মূলধনের ওপরে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বললেন মিঃ উইমবোর্ন।
-বাপ ছেলের ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না বোঝা যাচ্ছে। বললেন ক্রাডক।
-আপনার অনুমান ঠিক। পারিবারিক ব্যবসায়ে জ্যেষ্ঠ পুত্রের অনাগ্রহ লক্ষ্য করে বৃদ্ধ জোসিয়া হতাশ হয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর বিত্ত পরবর্তী বংশধরদের জন্য ট্রাস্টের হাতে তুলে দেন।
–কিন্তু লুথার যতদিন জীবিত থাকছেন, ততদিন জীবিত বংশধররা সম্পত্তি থেকে কিছুই পাচ্ছেন না। নিজেদের রোজগারের ওপরই তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে।
–কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি না, বিরস কণ্ঠে বললেন মিঃ উইমবোর্ন, একজন অজানা বিদেশী মহিলার মৃত্যুর সঙ্গে ক্রাকেনথর্প পরিবারের এসব বিবরণের কি সম্পর্ক থাকতে পারে।
–আপাততঃ সম্পর্ক নেই বলেই মনে হচ্ছে, সতর্ক কণ্ঠে বললেন ক্রাডক, তবে কথাগুলো অনাবশ্যক নয়। যাইহোক, মিঃ উইমবোর্ন, আপনাকে ধন্যবাদ। আপাততঃ আর কিছু জানার নেই। লাঞ্চের পরে ধরুন দুটো পনেরো নাগাদ, ইনসপেক্টর বেকন এবং আমি আবার আসব। পরিবারের সকল সদস্যোর সঙ্গে আলাদাভাবে কিছুক্ষণ কথা বলব। মৃত স্ত্রীলোকটিকে সনাক্তকরণের বিষয়ে কারো কাছ থেকে হয়তো কোনো সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
.
করোনারের বিচার সভা থেকে ফিরে এসে লুসি লাঞ্চের রান্না ইত্যাদি প্রস্তুতির কাজে মনোযোগ দিয়েছিল।
সেই সময় বিপত্নীক ব্রায়ান ইস্টালি রান্নাঘরে এসে তার সঙ্গে গল্প জুড়ল।
নিঃসঙ্গ এই মানুষটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সে কিশোর আলেকজান্ডারের পিতা। কর্মক্ষেত্রে বিমানচালনার দক্ষতার জন্য ডি এফ সি মেডেল দ্বারা সম্মানিত।
লুসি কাজের ফাঁকে গল্প করতে করতে লোকটিকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করল। যথাসময়ে লুসির চমৎকার রান্নার প্রশংসার মধ্য দিয়ে লাঞ্চপর্ব সমাধা হল।
পুলিস অফিসার দুজন নির্দিষ্ট সময়েই ফিরে এলেন। কাজেই লাঞ্চের অব্যবহিত পরেই লাইব্রেরি ঘরে পরিবারের সকল সদস্যকে একে একে তাদের সামনে বসতে হল।
ইনসপেক্টর ক্রাডক প্রথমে কথা বললেন কেড্রিক ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে।
ভদ্রলোক বেলিয়ারিকমের ইডিজাতে বিগত ছবছর ধরে আছেন। পেশায় চিত্রশিল্পী। ক্রিসমাস উপলক্ষে দিন কয়েক আগেই তিনি একবার দেশে এসেছিলেন। এবারে এমির তার পেয়ে আবার চলে এসেছেন। খুনের ঘটনার ব্যাপারে পুলিসি হাঙ্গামার সময় এমিকে পাশে থেকে সহযোগিতা করার জন্য।
কেড্রিক জানাল, মৃত স্ত্রীলোকটিকে সে আগে কখনো দেখেনি। এবাড়ির সঙ্গেও কোনোকালে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
কেড্রিকের পরে ডাক পড়ল হারল্ড ক্রাকেনথর্পের। ভদ্রলোক লন্ডনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
ইনসপেক্টরের জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে সে-ও জানাল মেয়েটির কোনো পরিচয় বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। ব্যাপারটাকে সে পরিবারের পক্ষে অপ্রীতিকর এবং দুর্ভাগ্যজনক মনে করে।
তৃতীয় ব্যক্তি আলফ্রেড ঘরে ঢুকলে তাকে দেখে ক্রাডকের সন্দেহ হল, পত্রিকায় তার ছবি কোনো সময় তার চোখে পড়ে অথবা কোথাও দেখেছেন।
যাইহোক, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো লাভ হল না।
এরপর এমা এবং লুথার ক্রাকেনথপের সাক্ষাৎকারও শেষ হল।
ইনসপেক্টর বেকন বললেন, বোঝা যাচ্ছে যাদের সঙ্গে আমরা কথা বললাম, এদের কারও সঙ্গেই খুনের কোনো সম্পর্কে নেই। যদি থাকত, তাহলে এভাবে নিজেদের বাড়ির চৌহদ্দিতে মৃতদেহটা রেখে দিত না।
ইনসপেক্টর ক্রাডক বললেন, তাহলে আপাততঃ হ্যাঁম্পটনেই ফেরা যাক।
তিনি অবশ্য মনে মনে ভাবলেন, তার পুরনো পরিচিত মানুষটির সঙ্গে একবার দেখা করবেন।
.
০৭.
ইনসপেক্টর ক্রাডককে দেখে মিস মারপল বললেন, আপনি এ কেসের দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছেন বলে আমি খুশি হয়েছি। আপনার ধর্মপিতা স্যার হেনরি ক্লিদারিং আমার হিতৈষী বন্ধু। এখন কতটা কি জানতে পারলেন শোনা যাক।
-আপনার বন্ধু মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডির বিবৃতি, রেলের টিকিট কালেক্টার এবং ব্র্যাকহ্যাম্পটনের নোট সবই আমি পেয়েছি। রেলওয়ে ও পুলিস অনুসন্ধান চালিয়েও কাহিনীর কোনো সমর্থন পায়নি।
তাই সকলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঘটনাটা এক বয়স্কা মহিলার কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু আপনার অনুমান পদ্ধতি সকলের বুদ্ধিকেই টেক্কা দিয়েছে।
একটু থেমে ক্রাডক আবার বললেন, আপনার অভাবনীয় কল্পনাকে আর একটু প্রসারিত করলেই তো আমার মনে হয় হত্যাকারীরও একটা হদিস মিলে যেতে পারে।
-তা যদি পারতাম, বললেন মিস মারপল, তাহলে অবশ্যই বলতাম। তবে এব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ যে রাদারফোর্ড হলে বসবাসকারী কেউ একজন হত্যাকারী অথবা খুনের পেছনের সব ঘটনা জানে।
-যে গুদামঘরটায় কফিনে মৃতদেহ রাখা হয়েছিল, সেটা সকলেই চেনে, কোথায় চাবি রাখা হয় তাও জানে। আর রাদারফোর্ড হলের সঙ্গে যুক্ত লোকের সংখ্যাও অনেক। বেশ কিছু বহিরাগত নারী ওখানে ঠিকে কাজ করেছে। তাছাড়া উইমেন্স ইনসটিটিউট ও এ. আর. পি. ওয়ার্ডেন কর্মীরাও হয়েছে। যে কেউই জায়গাটাকে উদ্দেশ্যপূরণের ক্ষেত্রে উপযোগী ভাবতে পারে। বললেন ক্রাডক।
–আপনার অসুবিধা আমি বুঝতে পারি। মৃতদেহ সনাক্ত করতে না পারলে আপনাদের পক্ষে এগনোও সম্ভব হচ্ছে না।
–আমরা নানাভাবেই মেয়েটির পরিচয় জানবার চেষ্টা করছি। ওই বয়সের এবং ওরকম চেহারার নিরুদ্দিষ্ট মেয়েদের খবরও অনুসন্ধান করে দেখছি। পুলিস সার্জন বলেছেন, মেয়েটির বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, স্বাস্থ্যবতী এবং সম্ভবত বিবাহিতা, কমপক্ষে একটি সন্তান তার থাকা উচিত। তার গায়ের সস্তা দামের ফারকোটটি লন্ডনের কোনো দোকান থেকে কেনা নয়, তা-ও জানা গেছে।
–অন্য পোশাক–অন্তর্বাস ইত্যাদি
-হ্যাঁ, ওগুলো বিদেশি, বেশির ভাগই প্যারিস থেকে কেনা। আমরা প্যারিসের পুলিসকে লীর চিহ্ন পাঠিয়ে দিয়েছি। আশা করছি কোনো একটা খবর পাওয়া যাবে।
–সেই পাউডার প্যাকটা
-ওটা খুবই সস্তা জিনিস। কোনো কাজে আসেনি। তবে ওই জিনিসটা সঙ্গে সঙ্গে পুলিসের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলে
মিস মারপল বাধা দিয়ে বললেন, আসলে মৃতদেহটা খুঁজে বার করার ব্যাপারেই আমি বিশেষ আগ্রহী ছিলাম।
–আপনি নিঃসন্দেহ হলেন কি করে যে মৃতদেহটা খুঁজে পাওয়া যাবে?
-ওই মেয়েটির অভাবিত কর্মদক্ষতা দেখে। ও এক অন্য জাতের মেয়ে। তা রাদারফোর্ড হলে কাজকর্ম কেমন করছে?
–দেখে মনে হলো বাড়ির বাসিন্দারা সকলেই তার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমরা অবশ্য তার সঙ্গে আপনার পরিচয়ের কথা গোপন রেখেছি।
-আমার সঙ্গে অবশ্য তার কাজের চুক্তি শেষ হয়ে গেছে।
–তাহলে বলছেন, সে মনে করলে যথারীতি ওখানকার কাজ ছেড়ে দিতে পারে?
–স্বচ্ছন্দে।
–কিন্তু সে তো কাজ আগের মতই করে চলেছে।
–মেয়েটি বুদ্ধিমতী, কোনো বিষয়ে আগ্রহ জাগা অসম্ভব নয়।
যাইহোক, আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।
–লেগে থাকলে কার্যসিদ্ধি হবে। বললেন মিস মারপল।
–কিন্তু আপনার কিছু প্রেরণা না পেলে কিছু চিন্তালব্ধ সূত্র
জলজ্যান্ত একটি মেয়ে নিপাত্তা হয়ে গেল অথচ নিরুদ্দিষ্ট আত্মীয় বা বন্ধুর সন্ধান কেউ করছে না এটাই আমার প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই কোনো থিয়েটার পার্টি, যারা একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ায় তাদের কথা ভাবছি। ওরকম পার্টির মেয়েদের বাড়ির সঙ্গেও বন্ধন বলতে কিছু থাকে না। কোনো মেয়ে হারিয়ে গেলে সাধারণতঃ তার খোঁজ নেবারও তাই কেউ থাকে না।
ক্রাডক হেসে বললেন, আপনার এই কল্পনার বাস্তব ভিত্তি অস্বীকার করা যায় না। বিষয়টা আমরা মাথায় রাখব।
.
মিস মারপল পরদিনই তার বন্ধু মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডিকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে চিঠি লিখলেন। ব্র্যাকহ্যাম্পটনের রাদারফোর্ড হলের একটি পাথরের কফিনের মধ্যে ট্রেনে গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে খুন করা মেয়েটির মৃতদেহ পাওয়া গেছে–এই সংবাদ জানতে পেরে মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি যে পরিতৃপ্তির হাসি হাসছেন চিঠি লিখতে লিখতে মানসচক্ষে তার সেই দৃশ্য ফুটে উঠল।
.
০৮.
বাসন মাজার জন্য পার্সলে গাছ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে লুসি সবজি বাগানে ঢুকেছিল। কেড্রিক ক্রাকেনথপও এই সময় এসে জুটল।
–আপনার এই কাজ আমার একদম পছন্দ নয়।
–কোন কাজ? অবাক হল লুসি।
–এই যে বাড়ির ঝিয়ের কাজ।
-আপার দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করা গেল না। আমি গৃহস্থালীর কাজের সাহায্যকারিণী।
হ্যাঁ, এতেই আপনার অদ্ভুত স্বভাবটা ধরা পড়ে।
-অদ্ভুত
–অদ্ভুত না হলে আর ওই গুদামঘরের ভেতরে একটা সেকেলে কফিনের ভেতরে আপনার চোখ পড়ে?
লুসি হাসল
–বাবার সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
–এসব নিয়ে চিন্তা করার অবসর পাইনি।
–আমি জানি এমা বাদে আমাদের সকলকে তিনি ঘৃণা করেন। নিজে স্বভাবদোষে ঠাকুর্দার কোপে পড়েছিলেন। তিনি তার সমস্ত বিষয়আশয় নাতিনাতনিদের জন্য ট্রাস্টের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন।
আর এমন ব্যবস্থা করে গেলেন যে সঞ্চিত অর্থ থেকে যা আয় হবে কেবল সেটুকু তিনি নিজে ভোগ করতে পারবেন, মূলধন ছুঁতে পারবেন না। আর আমাদের পিতৃদেব করলেন কি, না, এখানে এসে কেবল টাকা জমিয়ে টাকার পাহাড় বানালেন।
ঠাকুর্দার বিত্তের এক কপর্দকও আমরা ভাইবোনেরা কেউ পেলাম না। আমি একজন শিল্পী, বিদেশে পড়ে থেকে মার খাচ্ছি। হারল্ড নিজের উদ্যোগে ব্যবসা করে গণ্যমান্য হয়েছে। তবে বাজারে তার সম্পর্কে নিন্দনীয় গুজব শোনা যায়। আর আলফ্রেড বেচারা, সে হলো পরিবারের কালো ভেড়া, কুলাঙ্গার যাকে বলে। ছোটখাট নানা কাজ ও বিভিন্ন সময় করেছে, আর সবেতেই সন্দেহজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। অনেক ভাগ্য যে এখনো জেলখানায় ঢোকেনি।
–একজন অপরিচিত লোককে এসবকথা বলা আপনার কি উচিত কাজ হচ্ছে?
–কেন, তুমি কি পুলিসের ইনফর্মার?
–বিচিত্র কি?
এই সময় দেখা গেল, এমি বাগানের দরজা দিয়ে আসছে।
–না, আমি যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে।
লুসি সবজি বাগানের ভেতর দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
–কেড্রিক, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। ভাইয়ের দিকে এগিয়ে এসে বলল এমা।
–মেয়েটাকে একটু বাজিয়ে দেখছিলাম। ওর আসল পরিচয়টা কি?
–মিস আইলেসব্যারোর প্রসঙ্গ এখন থাক কেড্রিক, অন্য বিষয় নিয়ে আমি ভয়ানক। চিন্তিত।
-তোমার চিন্তার কারণটা কি জানতে পারি?
–দেখ, মৃত স্ত্রীলোকটির পরিচয় পুলিস এখনো জানতে পারেনি। তবে তারা তাকে ফরাসি বলে সন্দেহ করছে। আচ্ছা কেড্রিক, মেয়েটি কি মার্টিন হতে পারে?
–সেই মার্টিন? স্থির দৃষ্টিতে এমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল কেড্রিক, মৃত মেয়েটি মার্টিন হতে যাবে কেন?
-তার টেলিগ্রামটা তো আমরা ঘটনার সময়েই পেয়েছিলাম। এর পর সে এখানে এসেছিল বলে তোমার মনে হয়?
-ওই গুদামঘরে মরে পড়ে থাকতে? একদম অসম্ভব কল্পনা।
–মার্টিন একটা চিঠিও তো আমাকে লিখেছিল, এসব কথা পুলিসকে জানানো ঠিক হবে মনে কর?
-ওসব চিঠির কোনো ভিত্তি নেই। বাবা তো মনে করেন আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ফন্দি। যাইহোক, আগ বাড়িয়ে পুলিসকে এসব বলতে যাওয়া কেন? তারা তাদের কাজ করুক না। তুমি চুপচাপ বসে থাক।
-তুমি ঠিক বলছ কিনা বুঝতে পারছি না। চিন্তিত ভাবে মাথা নেড়ে এমা বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
রাস্তায় উঠে ডাঃ এম্পার সঙ্গে দেখা হল। •
-তোমার বাবাকে দেখে এলাম। চমৎকার আছেন। কি ব্যাপার, মনে হচ্ছে তুমি কোনো বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত?
ডাঃ এম্পার কেবল এই পরিবারের চিকিৎসকই নন, একজন পারিবারিক বন্ধুও। বিপদআপদে নির্ভরশীল সঙ্গী।
এমা ইতস্ততঃ করলেও তাকে তার ভাবনার বিষয়টা খুলে জানাবে ভাবল।
–আমার ভাই যুদ্ধে মারা গিয়েছে, আপনি তো জানেন–
–হ্যাঁ, শুনেছিলাম সে একটা ফরাসি মেয়েকে বিয়ে করে থাকবে। তা এখন কি
বিয়ের মনোভাবের কথা জানিয়ে আমাকে লেখা চিঠিটা পাবার কদিন পরেই সে যুদ্ধে নিহত হয়। মেয়েটি সম্পর্কে কেবল তার ধর্মীয় নামটা ছাড়া আমরা আর কিছুই জানতাম না। তবে তার একটা চিঠি অন্ততঃ আমরা আশা করেছিলাম। ঠিক মাসখানেক আগে, ক্রিসমাসের সময় আমরা এতদিন পরে মেয়েটির একটা চিঠি পাই।
–হ্যাঁ আমি শুনেছি।
–সে লিখেছিল, ইংলন্ডে এসেছে, আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমরা প্রস্তুত হলাম, এমনি সময়ে সে একটা তারবার্তা পাঠিয়ে জানায়, অনিবার্য কারণে তাকে ফ্রান্সে ফিরে যেতে হচ্ছে।
-বুঝতে পেরেছি, পুলিস মৃত স্ত্রীলোকটিকে ফরাসি বলে ধারণা করছে–আর তোমার আশঙ্কা হচ্ছে নিহত স্ত্রীলোকটি তোমার ভাইয়ের
–হ্যাঁ। পুলিসকে ব্যাপারটা জানানো উচিত কিনা তাই আমি ভাবছি।
-বুঝতে পেরেছি। তোমার ভাইদের সমর্থন তুমি পাবে না, আমি জানি। আমার পরামর্শ যদি চাও, আমি বলব, পরিবারের যে যা খুশি ভাবুক, যা উচিত বলে মনে হচ্ছে, তা অবশ্যই করবে।
আমি হলে অনেক আগেই একথা ওদের জানাতাম। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো, যে কোনো অবস্থায় তোমার বিচারবুদ্ধিকে আমি সবার আগে সমর্থন জানাব।
.
–আমাকে ডাকছেন মিঃ ক্রাকেনথপ?
–আস্তে কথা বল মেয়ে, একটা জিনিস দেখাব তোমাকে, এসো।
বৃদ্ধ এগিয়ে এসে দরজা বন্ধ করলেন।
লুসি দেখল ঘরটার চারপাশে কাগজপত্রের স্তূপ জমে আছে। দেয়ালের কোণায় কোণায় ঝুল। তার ধারণা হল, বৃদ্ধ ঘরটা পরিষ্কার করার কথা বলবে নিশ্চয়ই।
কিন্তু সেসব কোনো প্রসঙ্গে না গিয়ে মিঃ ক্রাকেনথর্প, কিছু মসৃণ অমসৃণ ডেলারমত পাথরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, এসব আমি সকলকে দেখাই না। ভূ-বিদ্যা বিষয়ের নমুনা। আরো দেখাব এসো।
দেয়ালে ঝোলানো পূর্বপুরুষদের কিছু ছবি ও বংশপরিচয়ের তালিকা দেখিয়ে তিনি বললেন, আমার মায়ের দিকের সকলেই ছিলেন রাজা। আমি মায়ের ধারাটা পেয়েছিলাম। শিল্পকলা, প্রাচীন ভাস্কর্য, এসব বিষয়ে ঝোঁক ছিল। অথচ আমার বাবা ছিলেন নিতান্তই স্কুল রুচির মানুষ। দুর্ভাগ্য আমার দুবছর বয়সে আমি মাকে হারাই। মায়ের পূর্বপুরুষদের পরিচয় থেকেই বুঝতে পারবে আমাদের বংশধারা কত প্রাচীন।
লুসি হতভম্ব হলেও বুঝতে পারছিল, বৃদ্ধ তার কোনো আপত্তি বা কাজের কথা এখন কানে তুলবার অবস্থায় নেই।
লুসিকে শক্ত হাতে টেনে একটা বিরাট আকারের কাঠের আলমারির সামনে নিয়ে এলেন বৃদ্ধ। তার হাতের আঙ্গুলের চাপে অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল লুসির। তার শারীরিক শক্তির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল।
–এটা হল এলিজাবেথের যুগের নিদর্শন। তারপর দেখ—
চাবি দিয়ে আলমারি খুলে একটা কাঠের বাক্স বার করে নিয়ে এলেন তিনি। তার ভেতর থেকে কাগজে মোড়ানো একরাশ সোনার মুদ্রা সামনে ঢেলে দিয়ে বললেন, এ হলো মহামূল্য জিনিস, সোভোরেন বলে এগুলোকে। ইংলন্ডেশ্বরের নামাঙ্কিত। এমনি আরো অনেক জিনিস আছে যা এমা জানে, অন্য কেউ জানে না। এসবই হল আমার আর তোমার
এসব তোমাকে কেন দেখিয়ে রাখছি জান মেয়ে। আমি চাই না তুমি আমাকে অসুস্থ আর বুড়ো বলে ভাবো। ওরা আমাকে বুড়ো সাজিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু এখনো অনেক বছর বহাল তবিয়তে টিকে থাকব আমি। ওদের অনুগ্রহ করার জন্য অত সহজে মরছি না।
তোমার বুদ্ধি আছে, তেজ আছে, সেজন্য তোমাকে একটা উপদেশ দিতে চাই–কোনো অল্পবয়সী যুবকের পাল্লায় পড়ে নিজের ভবিষ্যতটা লোপাট করো না। নিজের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নিতে হলে সবুর করো
বৃদ্ধ লুসির কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, বলছি সবুর কর–
এরপর লুসির বাহুতে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন, আমি কি বললাম বুঝতে পারলে তো? আমার এ প্রস্তাব নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে–সত্যি কথা বল–
ঠিক এই সময় দরজার বাইরে থেকে এমার ডাক শুনতে পেয়ে লুসি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
–মিস ক্রাকেনথর্প আমাকে ডাকছেন।
লুসি যখন দ্রুতপায়ে হলঘরে প্রবেশ করল, সে উপলব্ধি করল, বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প তাকে একটি শর্ত সামনে ধরে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন।
.
০৯.
নিউ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসঘরে বসেছিলেন ডারমট ক্রাডক। ইতিপূর্বেই তিনি প্যারিসের পুলিস হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন। মৃত মেয়েটির কিছু ফটোগ্রাফ আগেই তাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এখন জেনে নিশ্চিন্ত হয়েছেন, সেখানকার পুলিস ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দলগুলোর মধ্যে অনুসন্ধান কাজ চালিয়েছে।
এমনি সময়ে একজন কনস্টেবলের নিয়ে আসা একটা স্লিপ থেকে জানতে পারলেন এমা ক্রাকেনথর্প দর্শনপ্রার্থী। তার নির্দেশ পেয়ে কয়েক মুহূর্ত পরেই কনস্টেবল এমাকে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল।
যথারীতি সৌজন্য বিনিময়ের পর আসন গ্রহণ করে প্রাসঙ্গিক দু-চার কথার পরে এমা সরাসরি বলল, আমার তিন ভাইকে তো আপনি দেখেছেন। তাছাড়া আর এক ভাই এডমান্ড যুদ্ধে মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে আমাকে একটা চিঠি লেখে।
ব্যাগ থেকে চিঠিটা বার করে এমা পড়ে শোনাল।
প্রিয় এমা,
তুমি মনে আঘাত পাবে না এই বিশ্বাস নিয়েই জানাচ্ছি, একটি ফরাসি মেয়েকে আমি বিয়ে করছি।হঠাই যোগাযোগ হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মার্টিনকে তোমার পছন্দ হবে। আমি সৈনিক মানুষ, আমার যদি কিছু হয়, মার্টিনকে দেখবে। আশা করছি পরের চিঠিতে আমাদের বিবাহের খবর বিস্তারিত তোমাকে জানাতে পারব। বৃদ্ধ পিতাকে এসব কথা জানিয়ে তার অশান্তি বাড়িয়ে কাজ নেই।
এডমান্ড
ইনসপেক্টর ক্রাডক হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন।
-তারপর বলুন।
এমা বলে চলল, এ চিঠি পাওয়ার দুদিন পরেই একটা তারবার্তায় যুদ্ধে এডমান্ডের মৃত্যু সংবাদ পেলাম। আমি পরে জানতে পেরেছি, সামরিক বিভাগের রেকর্ডে এডমান্ডের বিবাহের উল্লেখ ছিল না।
এরপর মেয়েটির কাছ থেকেও কোনো চিঠিপত্র পাইনি। আমিও অবশ্য খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সম্পূর্ণ নাম জানা ছিল না বলে কোনো ফল হয়নি। তখন ধারণা করে নিই, শেষ পর্যন্ত হয়তো। আমার ভাইয়ের সঙ্গে বিয়েটা হয়নি।
এতদিন পরে মাসখানেক আগে আমি একটা চিঠি পাই। চিঠির তলায় নাম ছিল মার্টিন ক্রাকেনথর্প।
–চিঠিটা আপনার কাছে আছে? আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলেন ক্রাডক।
এমা হাতব্যাগ থেকে চিঠিটা বার করে দিল। ফরাসি হরফে লেখা চিঠিটা পড়লেন ক্রাডক।
প্রিয় মাদমোয়াজেল,
আমার এ চিঠি হয়তো আপনার বেদনার কারণ হবে। আপনার ভাই, আমাদের বিয়ের সংবাদ আপনাকে জানিয়েছিল কিনা আমি জানি না। বলেছিল জানাবে। আমাদের বিয়ের মাত্র কদিন পরেই সে মারা যায়। আর সেই সময়েই আমাদের গ্রামও জার্মানদের অধিকারে চলে যায়।
যুদ্ধের পর এক নতুন ধরনের জীবনযাত্রায় জড়িয়ে যাবার ফলে ভেবেছিলাম, আপনাদের সঙ্গে আর যোগাযোগের চেষ্টা করব না। অবশ্য আপনার ভাই আপনার সঙ্গে যোগাযোগের কথাই বলেছিলেন।
বর্তমানে আমার ছেলের কথা ভেবেই এই চিঠি লিখছি। আমার ছেলে মানে আপনার ভাইয়ের ছেলে। তার উপযুক্ত সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করা আমার সাধ্যে কুলিয়ে উঠছে না।
আগামী সপ্তাহে আমি ইংলন্ড যাচ্ছি। আপনার সম্মতিজ্ঞাপক চিঠি পেলে আপনার সঙ্গে গিয়ে দেখা করব। আমার ঠিকানা, ১২৬ এলাবার্স ক্রেসেন্ট, এন, ১০। আশা করব, আমার চিঠি পেয়ে আপনি মর্মাহত হবেন না। প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
আপনার
মার্টিন ক্রাকেনথর্প
ক্রাডক দুবার চিঠিটা পড়ে ফিরিয়ে দিলেন।
–চিঠিটা পাবার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল মিস ক্রাকেনথর্প।
-বুঝতেই পারছেন, চিঠি পাবার পর আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়ি। আমার মনে হয়েছিল, যদি মহিলা সত্যিই মার্টিন হয়, তবে তাকে উপযুক্ত সম্বর্ধনা জানানো উচিত। অবশ্য এবিষয়ে আমি আমার ভাই হারল্ড আর ভগ্নীপতি ব্রায়ান ইস্টলির সঙ্গেও পরামর্শ করেছিলাম। কিন্তু তারা অবিশ্বাস করে আমাকে সতর্ক হবার পরামর্শ দিয়েছিল।
যাইহোক, আমি চিঠিতে উল্লিখিত ঠিকানায় চিঠি লিখে তাকে রাদারফোর্ড হলে আসার আমন্ত্রণ জানাই।
দিন কয়েক পরেই লন্ডন থেকে একটি তারবার্তা পাঠিয়ে মার্টিন আমাকে জানায় অপ্রত্যাশিত কারণে সে ফ্রান্সে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এর পর এখন পর্যন্ত আর কোনো খবর পাইনি।
–ক্রিসমাসের কত দিন আগে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে?
–ক্রিসমাসের অল্প কদিনই বাকি ছিল তখন তার তারবার্তা আমি পেয়েছিলাম। আমি জানিয়েছিলাম, ক্রিসমাসের পরের সপ্তাহে আসার জন্য। কেননা সেই সময় সকলেই বাড়িতে উপস্থিত থাকবে।
-তাহলে আপনার কি ধারণা, পাথরের কফিনে আবিষ্কার করা মৃতদেহটা মার্টিনের হতে পারে?
-না, একথা আমার কখনো মনে হয়নি। স্ত্রীলোকটি বিদেশিনী বলে আপনারা যখন অনুমান করলেন, তখন মার্টিনের কথা আমার খেয়াল হয়।
–ঠিক আছে মিস ক্রাকেনথর্প, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি। ব্যাপারটা আমাদের নজরে এনে উচিত কাজ করেছেন। পুলিস সার্জনের বক্তব্য হল, স্ত্রীলোকটির মৃত্যু হয়েছিল, মৃতদেহ আবিষ্কার হওয়ার দিন থেকে তিন-চার সপ্তাহ আগে। এখন আমাদের দেখতে হবে যে স্ত্রীলোকটি আপনাকে চিঠি লিখেছিল সে সত্যিই ফ্রান্সে গিয়েছিল কি না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, এবারে যা করার আমরাই করছি।
ভালোকথা, আপনি বলেছেন আপনার ভাই হারল্ড ও আপনার ভগ্নীপতির সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। আপনার বাবা ও অন্যভাইদের এবিষয়ে মনেভাব কি ছিল তাতে বললেন না।
-বাবাকে জানিয়েছিলাম। চিঠিটাকে তিনি দুষ্ট লোকের টাকা আদায়ের ফিকির বলেই মনে করেছিলেন। অন্য দুই ভাই বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করতে চায়নি। তবে আমরা মোটামুটি এরকম স্থির করে রেখেছিলাম যে মার্টিনকে আমরা অভ্যর্থনা জানাব এবং আমাদের পরিবারের আইনগত উপদেষ্টা মিঃ উইমবোর্নকে উপস্থিত থাকতে বলব।
–মিঃ উইমবোর্নের পরামর্শ কি ছিল?
–তাকে জানাবার আগেই তারবার্তাটা পেয়েছিলাম।
–আচ্ছা, চিঠির কথা আপনার সত্যি বলে মনে হয়েছিল?
-সত্যিকথা বলতে, স্নেহার্দ কণ্ঠে বলল এমা, ভাইদের মধ্যে এডমান্ডকেই আমি বেশি ভালোবাসতাম। তাই চিঠিটা আমার কাছে অস্বাভাবিক বা সত্যি বলেই মনে হয়েছিল। আমার ধারণা হয়েছিল, এডমন্ডের মৃত্যুর পর হয়তো অন্য কোনো পুরুষ তার আর তার ছেলের ভার নিয়েছিল।
পরে সেই পুরুষটির মৃত্যু হয়, আর সে এডমান্ডের ছেলের কথা ভেবেই তার পরিবারের কাছে আবেদন করার কথা ভাবে। এডমান্ড নিজেই তাকে সে পরামর্শ দিয়েছিল বলে সে চিঠিতে উল্লেখ করেছিল। এটা সত্যিকথা যে এডমান্ডের পুত্রসন্তানের কথা শুনে আমি খুব খুশি ও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম।
ক্রাডক চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন। পরে বললেন, চিঠিটা সত্যি বলে মনে হবার সঙ্গত কারণ আছে। কিন্তু মার্টিন ক্রাকেনথর্প এতদূর এগিয়ে এসেও হঠাৎ কেন প্যারিস ফিরে গেলেন এটাই ধাঁধা হয়ে উঠেছে। এরপর আর কোনো চিঠিও কেন আপনি পেলেন না? তবে একটা সম্ভাবনা এমন হতে পারে, আপনার কোনো ভাই-এর পক্ষে তদন্তের ব্যবস্থা করা অসম্ভব নয়। কেননা, এডমান্ডের সত্যিকার বংশধর তার ঠাকুর্দার সম্পত্তির ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী। কেবল তাই নয়, উইলের যে শর্তের কথা আমি শুনেছি, তাতে এডমান্ডের ছেলেই রাদারফোর্ড হল এবং সংলগ্ন জমির মালিক হবার কথা।
এই মার্টিন হয়তো প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি যে তাকে ছেলের দাবি নিয়ে উপস্থিত হলে একদল কঠিনহৃদয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্মুখ সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হবে। আইনগত কঠিন পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেই হয়তো সে নীরব থাকাই সঙ্গত মনে করেছে।
এমা চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল।
যাইহোক, আমরা উপযুক্ত তদন্তের ব্যবস্থা করছি।
–আপনার সহৃদয়তার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
এমা বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল।
মিনিট দুয়েক বসে চিন্তা করলেন ক্রাডক। পরে ফোনে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ওয়েদারবলের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন এখুনি ১২৬, এলভার্স ক্রেসেন্ট, নম্বর টেন এই ঠিকানায় গিয়ে মিসেস মার্টিন ক্রাকেনথর্প নামে মহিলার খোঁজখবর জানার চেষ্টা করেন।
-আরো শোন বব, বললেন ক্রাডক, রাদারফোর্ড হলে পাওয়া মৃতদেহের ফটোও সঙ্গে নেবে। আমার ধারণা ওই নামের মহিলা ওই ঠিকানায় বাস করতো কিংবা চিঠিপত্রের খোঁজে আসত।
বিকেলের দিকে একজন থিয়েটার দলের এজেন্টের সঙ্গে তিনি দেখা করলেন। অফিসে ফিরে এসেই পেলেন প্যারিসের একটি টেলিফোন।
এখানে ব্যালে মারিটাক্সি দলের আন্না স্ট্রাভিনস্কা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আপনার পাঠানো বিবরণের মিল পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের প্রস্তাব, এখানে চলে আসুন। ডেসিল, প্যারিস পুলিস হেড কোয়ার্টাস।
ক্রাডক সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন। রাতের স্টিমারেই প্যারিস রওনা হবেন।
.
লুসি আইলেসব্যারো এমির কাছে জানতে চেয়েছিল, সে তার মাসীকে এদিন রাদারফোর্ড হলে তার কর্মস্থল দেখাতে নিয়ে আসতে পারে কিনা। এমি সানন্দে সম্মতি জানিয়েছিল। সেই মত লুসি আজ বিকেলে গিয়ে মিস মারপলকে চায়ের আসরে নিয়ে এসেছে। তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে চুল্লির সামনে বসানো হয়েছে।
-আপনি যে আসতে পেরেছেন এজন্য আমরা আনন্দিত।
কোমল কণ্ঠে বলল এমি।
মিস মারপলের মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হল। চায়ের নিমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন।
হ্যারল্ড ক্রাকেনথর্প পাশেই দাঁড়িয়েছিল। আলফ্রেড একমুখ হাসি নিয়ে তার দিকে স্যান্ডউইচ এগিয়ে দিচ্ছিল, তাকে দেখে তিনিও হাসলেন। কেড্রিক একটা পুরনো জ্যাকেট পরে চুল্লির বেষ্টনীর কাছে দাঁড়িয়েছিল।
বৃদ্ধার সন্ধানী চোখ সকলকেই গভীরভাবে নিরীক্ষণ করল।
মিস মারপলের আগমনটাকে প্রসন্ন মনে মেনে নিতে না পারলেও কেড্রিক ও হারল্ড মেনে নিয়েছিল, তাদের চোখে রহস্যময় মেয়ে লুসি সম্পর্কে আরও কিছু খোঁজখবর তার মাসীর কাছ থেকে জানা যাবে এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে।
মিস মারপল, এমাকে তাদের বাড়ির প্রশংসা শোনালেন, ঘরের বিভিন্ন শিল্পকর্মের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
এমি আলোচনা প্রসঙ্গে জানাল, তার দুভাই লন্ডনে বাস করে। এক ভাই চিত্রশিল্পী। বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে ইডিজাতে থাকে।
–এটা খুবই আনন্দের যে ভাইরা তোমার সঙ্গে রয়েছে। আজকাল তো পরিবারগুলো সব ভেঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বললেন মিস মারপল।
কেড্রিক বলল, আপনার কাছ থেকে আজ লুসির ছেলেবেলার কথা শুনব। ও আমাদের সকলকে জয় করে নিয়েছে।
মুখে খুশির হাসি নিয়ে কেড্রিকের দিকে তাকালেন মিস মারপল। তারপর এইভাবে শুরু করলেন, লুসি বরাবরই খুব বুদ্ধিমতী আর মেধাবী। পাটীগণিতে তার ছিল অসাধারণ দখল
এভাবে তিনি লুসির ছেলেবেলার অনেক মজাদার গল্প উৎসাহের সঙ্গে শুনিয়ে গেলেন। পরে নিজের গ্রামের জীবনের স্মৃতিচারণও করলেন।
এমনি সময় ব্রায়ানের সঙ্গে দুই কিশোর ঘরে ঢুকল। খুনের রহস্য মোচনের সূত্র সন্ধান করে তারা গলদঘর্ম হয়ে এসেছে।
চা পরিবেশিত হবার খানিক পরেই ডাঃ কুইম্পার ঘরে প্রবেশ করলেন।
মিস মারপলের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল।
–ডাক্তারের জীবন আমাকে মুগ্ধ করে। সমাজের জন্য তাদের কত ত্যাগ আর তারা কত মহৎ।
ডাঃ কুইম্পার হেসে বললেন, এককালে ডাক্তারদের বলা হত জোঁক। অবশ্য জোঁক জাতীয় ডাক্তার অনেক আছে।
কথা বলতে বলতেই তিনি একরাশ স্যান্ডউইচের সঙ্গে কেক ও কফির সদ্ব্যবহার করলেন।
–তোমার বাবাকে একবার দেখে আসি চল।
এমা ডাক্তারকে নিয়ে ভেতরে চল গেল। মিস মারপল তাদের দুজনকে লক্ষ্য করলেন।
-মিস ক্রাকেনথর্প খুবই পিতৃভক্ত মেয়ে। মুগ্ধস্বরে বললেন তিনি।
–ওই বুড়োকে কি করে যে সহ্য করে
কেড্রিকের কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠল হারল্ড, এমার জন্যই পরিবারটা সজীব রয়েছে। বাবাও স্নেহ করেন।
এমনি আরও দুচার কথার পর মিস মারপল উঠে পড়লেন। ওঠার সময় তাঁর স্কার্ফ ও হাতব্যাগখানা ফেলে দিলেন।
তিন ভাইই অতিথির সৌজন্যে তৎপরতার সঙ্গে জিনিসগুলো তুলে দিল।
–তোমরা অনেক ভালো। বড় ভালো লাগল। হ্যাঁ, আমার ওই নীল মাফলারটা তুলে দাও। আমার প্রিয় লুসি কোথায় আছে ভেবে চিন্তা হত। এখন আমি নিশ্চিন্ত। আমাকে যে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছে এ তোমাদের বদান্যতার পরিচয়।
–আমাদের আনন্দের পরিবেশে বিঘ্ন ঘটাল কেবল একটা হত্যার ঘটনা।
–কেড্রিক।
হারল্ড ক্রুদ্ধ কণ্ঠে ভাইকে সতর্ক করে দিল।
কেড্রিকের দিকে তাকিয়ে মিস মারপল হাসলেন। বললেন, তোমাকে দেখে আমার ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের ছেলেটির কথা মনে পড়ে। মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলার অভ্যাস। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ছিল। বাপের মৃত্যুর পর বাড়ি ফিরে এসে বাপের সঞ্চিত টাকা দেদার ওড়াচ্ছে।
.
মিস মারপলকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে লুসি বাড়ির আস্তাবলে গাড়ি ঢোকাল।
এমন সময় অন্ধকার কুঁড়ে তার সামনে উপস্থিত হল আলফ্রেড।
এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল লুসির। সুদর্শন আলফ্রেড ঘনিষ্ঠ হয়ে আবেগমিশ্রিত স্বরে বলল, পরিচারিকার বৃত্তিতে তুমি বড় বেমানান লুসি।
–আমি অখুশি নই।
–তুমি যথেষ্ট চালাকচতুর, রূপ আছে, সহজেই লোকের আস্থা অর্জন করতে পার–এ যে কতবড় মূলধন যদি বুঝতে চেষ্টা করতে!
–এই মূলধন নিয়ে আপনার সঙ্গে সোনার ইট বিক্রির ব্যবসায় নামতে বলছেন?
–অতটা ঝুঁকি নিতে বলছি না আমি–যেসব বিরক্তিকর নিয়মকানুন আর আইন স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করে, এসবের সামান্য পাশ কাটিয়ে অনেক উন্নতি করা চলে। তোমাকে অংশীদার হিসেবে পেলে খুশি হই।
-শুনে ভালো লাগছে।
–দেখ, আমার বুড়ো বাপ বেশিদিন বাঁচবে না। তিনি মারা গেলেই আমার হাতে মোটা অঙ্কের অর্থ এসে যাচ্ছে; তখন তোমাকে নিয়ে
-ব্যবসা কাঁদবেন। কিন্তু শর্ত কি?
বিবাহ, অবশ্য যদি তোমার পছন্দ হয়। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ লুসি, আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।
লুসিকে দুহাতে বেষ্টন করল আলফ্রেড।
খিলখিল করে হেসে উঠে নিজেকে মুক্ত করে নিল লুসি।
-এখন ওসব কথা থাক। ডিনারের সময় হয়েছে চলুন।
–তোমার রান্না সত্যিই চমৎকার।
দুজনে বাড়িতে প্রবেশ করল। লুসি ঢুকে গেল রান্নাঘরে।
কিন্তু ডিনার প্রস্তুত করতে গিয়েই আবার বাধা পড়ল।
মিস আইলেসব্যারো, আপনাকে একটা কথা বলব ভেবেছিলাম।
হারল্ড ক্রাকেনথর্প এগিয়ে এলো।
-ডিনারের পরে শুনলে দেরি হয়ে যাবে ভাবছেন?
–মোটেও না। বেশ তাই হবে।
যথারীতি আনন্দময় পরিবেশেই ডিনার পর্ব সমাধা হল। ধোয়ামোছার কাজ শেষ করে লুসি হলঘরে এল।
হ্যারল্ড অপেক্ষায় ছিল। এগিয়ে এসে লুসিকে নিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।
–তোমার কাজের দক্ষতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কালই আমি চলে যাচ্ছি। তাই তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।
-ধন্যবাদ।
-তোমার যোগ্যতা বাজে কাজে অপচয় হচ্ছে। এরকম চলতে পারে না। তোমাকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। এখানকার সঙ্কট কেটে গেলে তুমি লন্ডনে আমার সঙ্গে দেখা করবে।
সেক্রেটারিকে আমার নির্দেশ দেওয়া থাকবে। তোমার মত কর্মদক্ষ কর্মী আমাদের প্রতিষ্ঠানে দরকার। যথেষ্ট ভালো টাকা তুমি পাবে। তাছাড়া ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনার কথা শুনলে তোমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে।
লুসি মনে মনে বলল, বাঁচা গেল, বিবাহিত বলেই হয়তো হারল্ড বিবাহের প্রস্তাব দিল না।
মুখে বিনীতভাবে বলল, ধন্যবাদ মিঃ ক্রাকেনথর্প। আপনার প্রস্তাব আমি মনে রাখব।
-হ্যাঁ, শোন মেয়ে, শুভ কাজে দেরি করতে নেই। জীবনে উন্নতির সুযোগ সবসময় আসে না।
শুভরাত্রি জানিয়ে হারল্ড ক্রাকেনথর্প ভেতরে চলে গেল।
শোওয়ার ঘরে যাওয়ার পথেই সিঁড়িতে কেড্রিকের মুখোমুখি হল লুসি।
–শোন, লুসি, তোমাকে একটা কথা বলব।
–আপনাকে বিয়ে করে ইডিজিতে যেতে চাই কিনা, একথা নিশ্চয়ই?
–ওরকম কথা একদম ভাবিনি।
ভুলের জন্য দুঃখিত।
–একটা টাইম টেবল বাড়িতে পাওয়া যাবে কিনা, জানতে চাইছিলাম।
–ওহ, হলঘরের টেবিলেই রয়েছে একখানা।
–শোন লুসি, নিজেকে তুমি সুন্দরী ভাবত পার, কিন্তু সকলেই তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে এরকম ধারণা রেখো না। এধরনের কথা রটনা হলে ফল ভালো হয় না। জেনে রেখো, আমি যেসব মেয়েকে বিয়ের জন্য বিবেচনা করতে পারি তাদের তালিকায় স্থান পাবার কোনো যোগ্যতা তোমার নেই।
-বটে। খুব অহঙ্কার দেখছি। তবে সম্মা হিসেবে দেখলে অন্য কথা বলবেন।
–একথার অর্থ? কেড্রিকের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল।
–অর্থ ভালোই বুঝতে পেরেছেন। লুসি তার শোবার ঘরে ঢুকে গেল।
.
১০.
প্যারিসের পুলিস হেড কোয়ার্টার্সের অফিসার আর্মড ডারমট ক্রাডকের মধ্যে যোগাযোগ হলে ডেসিল একটি গ্রুপ ফটো দেখালেন।
-বাঁদিক থেকে চতুর্থজন হল আন্না ট্রাভিনস্কি। সে কাজ করত ব্যালে ম্যারিটস্কি দলে। নিতান্ত অনামী গুরুত্বহীন দল। মাঝে মাঝে বাইরে সফরেও যায়। দলটি পরিচালনা করেন মাদাম জোলিয়ে। মেয়েটির বিশদ খোঁজখবর পাওয়া যাবে এর কাছে গেলেই।
.
–আপনার দলের আন্না ট্রাভিনস্কি নামের মেয়েটির সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর দরকার আমাদের।
-বলুন কি জানতে চান?
–মেয়েটি রুশ দেশীয়?
–নাম শুনে ওরকমই মনে হয়। ওটা ছদ্মনাম। দলে মেয়েটির বিশেষ গুরুত্ব ছিল না। ভালো নাচতে পারত না।
–মেয়েটি কি ফরাসি?
-তা হতে পারে। ফরাসি পাসপোর্ট ছিল তার। একবার বলেছিল তার স্বামী একজন ইংরাজ।
স্বামী ইংরাজ বলেছে? জীবিত না মৃত?
–সেটা ভালো জানা নেই। মৃত হতে পারে, আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকতে পারে।
–মেয়েটিকে শেষ কবে আপনি দেখেছিলেন?
–শেষ কবে…শুনুন বলছি। ছ সপ্তাহ আগে দল নিয়ে আমি লন্ডনে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকটি জায়গায় আমরা শো দেখাই। হ্যাঁমারস্মিথে শেষ শো করে আমরা ফ্রান্সে ফিরে আসি। শেষ শোর আগেই হঠাৎ করে মেয়েটি দল ছেড়ে দেয়। আমাদের সঙ্গে ফ্রান্সে ফেরেনি।
–দল ছাড়ার কারণ কিছু জানিয়েছিল?
-হ্যাঁ। খবর পাঠিয়ে জানিয়েছিল, সে তার স্বামীর পরিবারের সঙ্গে বাস করবে। সত্যি বলেছিল কি মিথ্যা, তা বলতে পারব না। এ লাইনের মেয়েরা কখন কোনো পুরুষকে পাকড়াও করে বোঝা যায় না।
-তারিখটা আপনার মনে আছে?
-তা বলতে পারব। ক্রিসমাসের আগের রবিবার আমরা ফ্রান্সে ফিরে আসি। তার দুতিন দিন আগে আন্না চলে যায়। হ্যাঁমারস্মিথে তাকে বাদ দিয়েই শো করতে হয়েছিল আমাদের।
একটানা প্রশ্নগুলো করে গেলেন ক্রাডক। তিনি যেন খানিকটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন।
–মেয়েটির এত খোঁজখবর করছেন কেন বলুন তো? কি করেছে সে?
জানতে চাইলেন মাদাম জোলিয়ে।
-না, করার ব্যাপার নয়, বললেন ক্রাডক, আমরা সন্দেহ করছি, মেয়েটি খুন হয়েছে। প্রতি রবিবার গির্জায় যেত।
–আচ্ছা, মাদাম, তার একটি ছেলে আছে এরকম কথা আপনাকে কখনো বলেছিল?
সন্তানের কথা বলছেন? এসব মেয়েরা ওরকম ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
–এমন তো হতে পারে, আগে তার একটি বাচ্চা হয়েছিল, পরে সে রঙ্গমঞ্চের জীবন গ্রহণ করে।
-হ্যাঁ, এরকম হতে পারে। তবে আমি তার ব্যাপারে কিছু জানি না।
দলের মেয়েদের মধ্যে তার বন্ধু কে কে ছিল?
বন্ধু বলতে দু-তিন জনের সঙ্গে মিশত। তাদের নাম দিতে পারি।
পাউডারের কৌটোটা ক্রাডকের সঙ্গেই ছিল। সেটা দেখান হলে, মাদাম বললেন, এরকম একটা আন্নার ছিল। ফারকোটের কথা অবশ্য কিছু বলতে পারলেন না।
মাদামের সঙ্গে কথা শেষ করে যে কটি মেয়ের নাম তিনি দিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বললেন ক্রাডক এবং ডেসিল।
মেয়েদের কয়েকজন আন্নাকে ভালোই চিনত জানাল। কিন্তু তার সম্পর্কে সঠিকভাবে কোনো কথা বলতে পারল না। মেয়েটি নাকি তার নিজের কথা বিশেষ কিছুই বলত না। তবে যা বলত সবই তার বানানো আজগুবি কথাবার্তা। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে ক্রাডক বিশ্বাস করতে পারলেন না যে আন্না নামের এই মেয়েটিরই দেহ রাদারফোর্ড হলের একটা পাথরের কফিনে পাওয়া গেছে।
ফটোর দেহটা দেখে মাদাম ও মেয়েরা জানাল চেহারার সঙ্গে আন্নার কিছুটা মিল রয়েছে। তবে ওরকম ফুলে ওঠা দেহ দেখে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কি সম্ভব?
তবে তারিখের হিসেব থেকে প্রামাণ্য তথ্য একটাই পাওয়া গেল। আন্না ট্রাভিনস্কি ফ্রান্সে ফিরে যাবে না, এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিসেম্বরের উনিশ তারিখ। আর কুড়ি ডিসেম্বর তারিখে চারটে তিরিশের গাড়িতে ব্র্যাকহ্যাম্পটন যাওয়ার পথে যে মেয়েটিকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়েছিল, তার সঙ্গে আন্নার চেহারার মিল ছিল।
আর একটি সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যায় আন্নার কথা থেকে। সে মাদামকে বলেছিল, তার এক ইংরাজ স্বামী ছিল। এডমান্ড ক্রাকেনথর্পের কথা সে বলে থাকতে পারে।
রাদারফোর্ড হলের মৃতদেহটি যদি আন্না ট্রাভিনস্কি না হয়, তাহলে আন্না ফ্রান্সে ফিরে না এসে কোথায় যেতে পারে? সে কি অন্য কোথাও কোনো পুরুষের সঙ্গে গৃহজীবন শুরু করেছে?
.
লন্ডনে রওনা হওয়ার আগে প্যারিসে ক্রাডক মার্টিন নামে স্ত্রীলোকটির বিষয়ে ডেসিলের সঙ্গে আলোচনা করলেন।
ডেসিল জানালেন, চতুর্থ সাউথশায়ার রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট এডমান্ড ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে মার্টিন নামে কোনো ফরাসি মেয়ের বিয়ে হয়েছিল কিনা তার নথিভুক্ত প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করবেন।
নিজের অফিসে ফিরে এসেই ক্রাডক সার্জেন্ট ওয়েদারবলের রিপোর্ট পেলেন।
১২৬ এলভার্স ক্রেসেন্ট হল ছাত্রদের বোর্ডিং হাউস। চিঠিপত্রের জন্য অনেক লোকই জায়গাটাতে ব্যবহার করে। মার্টিন নামের কোনো মেয়ের কথা ওখানে কেউ মনে করতে পারেনি। ফটো দেখেও সনাক্ত করতে পারেনি।
ওয়েদারলি বলল, আমরা হোটেলগুলোতেও অনুসন্ধান করেছি স্যার। আন্না ট্রাভিনস্কির একটা সন্ধান পাওয়া গেছে রুক গ্রীনের পরে একটা সস্তা হোটেলে। সেখানে থিয়েটারের লোকেরাই বেশি থাকে। আন্না দলের অন্যান্যদের সঙ্গে সেখানে উঠেছিল। ১৯ ডিসেম্বরের রাত্রে শোয়ের শেষে সে সেখান থেকে চলে যায়।
এরপরে ক্রাডক দেখা করলেন ক্রাকেনথর্প পরিবারের আইন উপদেষ্টা উইমবোর্ন হেন্ডারসন অ্যান্ড কার্সস্টেয়ার্স নামক সংস্থার মিঃ উইমবোর্নের সঙ্গে।
ক্রাডকের জিজ্ঞাসার উত্তরে মিঃ উইমবোর্ন জানালেন, ক্রাকেনথর্প পরিবারের বিষয়গুলো বাবাই দেখাশোনা করতেন। ছ বছর আগে তিনি মারা গেছেন। একডমান্ডের বিবাহের কথা বাবা শুনে থাকলেও এর কোনো গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলে হয় না। কাল সকালেই একটা চিঠিতে এমা আমাকে তার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যাওয়ার কথা এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য খবর জানিয়েছে। এডমান্ড বিবাহ করেছিল কখনো এমন কথা উঠেছিল বলে মনে হয় না। তাই এই মুহূর্তে এতবছর পরে কেউ এসে এডমান্ডের একটি পুত্রসন্তান আছে দাবি জানালে ব্যাপারটা গোলমেলে বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। বৈধ কোনো প্রমাণ কি ছিল মেয়েটির?
ধরুন যদি মেয়েটি তার দাবি প্রমাণ করতে পারতো তাহলে তার ছেলের প্রাপ্য সম্পত্তি কতটা হত?
–দেখুন, যতক্ষণ না মেয়েটি প্রমাণ করতে পারছে তার ছেলে এডমান্ড ক্রাকেনথর্পের আইনসিদ্ধ বিবাহজাত পুত্র ততক্ষণ ওরা কোনো কিছুরই অধিকারী নয়। যদি তা প্রমাণ করতে পারে, তবে লুথার ক্রাকেনথর্পের মৃত্যুর পর এডমান্ডের ছেলে তার ঠাকুর্দার ট্রাস্ট সম্পত্তির ন্যায্য অংশের অধিকারী হবে। কেবল তাই নয় লুথার ক্রাকেনথর্পের জ্যেষ্ঠ পুত্রের ছেলে বলে রাদারফোর্ড হল ও সংলগ্ন জমিরও সে মালিক হত। বর্তমানে এটা খুবই উল্লেখযোগ্য উত্তরাধিকার।
-উইল অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে লুথার ক্রাকেনথর্পের মৃত্যুর পর রাদারফোর্ড হলের মালিক হবে কেড্রিক।
-হ্যাঁ, জীবিত সন্তানদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বলে।
–একটা চিঠি পাবার পরে শুনেছি হারল্ড ও আলফ্রেড খুব বিচলিত হয়েছে।
–অসম্ভব। কেন?
–তাদের উত্তরাধিকারের পরিমাণ কমে যাবার আশঙ্কায়?
–নিশ্চয়ই। কেননা, এডমান্ড ক্রাকেনথর্পের ছেলে সম্পত্তির একপঞ্চমাংশের অধিকারী।
–আমার ধারণা ওরা দুভাই খুবই আর্থিক কষ্টে রয়েছে।
–আপনারা দেখছি খোঁজখবর নিচ্ছেন। আলফ্রেড প্রায় সব সময়েই বলতে গেলে যে টানাটানির মধ্যে থাকে। হারল্ড, যতদূর জানি, এখন তার অস্বচ্ছল অবস্থা। তার বাণিজ্যিক সংস্থা খুবই অভাবের মধ্য দিয়ে চলছে।
ইনসপেক্টর, আপনি বিষয়টাকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছেন, বলব তা সঙ্গত হত যদি লুথার ক্রাকেনথর্পকে হত্যা করা হত। ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে হত্যা করে আর্থিক সংকট কতটা সুরাহা হবে?
.
গোপন সূত্রের খবর থেকে যা জানা গেল তাতে ইনসপেক্টর ডারমট ক্রাডকের অনুমান হল বাইরে ব্যবসার ঠাটবাট যতই থাক হারল্ড যে কোনো মুহূর্তে নিরুদ্দেশ হতে পারে। তাই তিনি তড়িঘড়ি তার অফিসেই হারল্ডের সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলেন।
নির্দিষ্ট সময়ে সার্জেন্ট ওয়েদারবলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শহরের অফিসপাড়ায় বিরাট এক বাড়ির পাঁচতলায় উপস্থিত হলেন।
একটি সুবেশা সুশ্রী তরুণী সসম্ভ্রমে তাকে অভ্যর্থনা করে হারল্ড ক্রাকেনথর্পের নিজস্ব অফিস ঘরে পৌঁছে দিল।
সাজানো গোছানো ঘর। সর্বত্র সমৃদ্ধির ছাপ। চামড়ায় মোড়া মস্ত একটা টেবিলের পেছনে নিখুঁত পোশাকে পরিপাটি হারল্ড বসেছিলেন।
প্রাসঙ্গিক সৌজন্য বিনিময়ের পর ক্রাডক কোনোরকম ভূমিকার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, একটা ব্যাপার আমি জানতে এসেছি মিঃ ক্রাকেনথর্প, ডিসেম্বরের ২০ তারিখ, শুক্রবার বেলা তিনটে থেকে মাঝরাত পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন? অবশ্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া না দেওয়া আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।
–আপনাদের সাহায্য করার জন্য আমি সর্বদাই প্রস্তুত।
-এরপর তিনি টেলিফোন তুলে তার সেক্রেটারী মিস এলিসের কাছে অফিসের কর্মতালিকা চেয়ে পাঠালেন। কর্মলিকার বিবরণ থেকে জানা গেল ২০ ডিসেম্বর বেলা ৩টার পরে তিনি সোথেবির বিক্রয় কেন্দ্রে যান। সেখানে কিছু দুর্লভ পাণ্ডুলিপি বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছিল।
–মনে পড়েছে বলছি শুনুন, বলল হারল্ড, এরপর জারমাইন স্ট্রিটের একটা ছোট রেস্টুরেন্ট বাসেলস–সেখানে চা খাই। পরে ঘণ্টা খানেক একটা থিয়েটারে কাটিয়ে আমি ৪৩, কার্ডিগান গার্ডেনসের বাড়িতে ফিরি। সাড়ে সাতটায় কেটারার্স হলে ডিনার সারি এবং বাড়ি ফিরি।
–আপনি ডিনারে বেরন কটায়?
–সম্ভবতঃ ছটায়।
–ডিনারের পরে বাড়ি ফেরেন কটায়?
রাত সাড়ে এগারোটায়।
–দরজা খুলে দিয়েছিলেন আপনার স্ত্রী না গৃহভৃত্য?
-আমার স্ত্রী এলিস ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই রয়েছেন দক্ষিণ ফ্রান্সে। বাইরে থেকে দরজা খোলবার চাবি আমার কাছেই ছিল।
–আপনার বাড়ি ফেরার সময়টা সমর্থন করার মতো দ্বিতীয় কাউকে পাওয়া সম্ভব নয় বলছেন?
-ভৃত্যরা আমার ঢোকার শব্দ পেয়ে থাকতে পারে।
–আর একটা প্রশ্ন, আপনার কি নিজস্ব গাড়ি আছে?
–হ্যাঁ। নিজেই ড্রাইভ করি। বড় একটা ব্যবহার করি না।
–গাড়িটা কোথায় রাখেন?
কার্ডিগান গার্ডেনসের পেছনে একটা গ্যারেজ ভাড়া করা আছে। আপনার আর কিছু জানার আছে?
–আপাততঃ এই পর্যন্তই। ধন্যবাদ।
বাইরে বেরিয়ে এসে ক্রাডক বললেন, তুমি কয়েকটা জায়গায় খোঁজ নেবে। সোথথবির বিক্রয়কেন্দ্রে আর সেই চায়ের দোকানে। যা বলল, তাতে ওই সামান্য সময়ের মধ্যে চারটে তেত্রিশের গাড়ি ধরে গিয়ে ট্রেন ধরা, ট্রেনের কামরায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে ট্রেনে ফিরে এসে আবার ডিনারে যোগ দেওয়া সম্ভবপর বলে মনে হয় না। আর শোন গাড়ি রাখার গ্যারেজেও খোঁজ নেবে।
–খোঁজ নেব স্যার।
.
আলফ্রেড ক্রাকেনথর্পের বাড়ি পশ্চিম হ্যাঁম্পস্টেডে। আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়ি।
সাদর অভ্যর্থনা জানালেও ক্রাডকের মনে হল আলফ্রেড কিছুটা বিচলিত হয়েছে।
ক্রাডক যথারীতি ক্রাকেনথর্পদের এই ভাইয়ের কাছেও ২০ ডিসেম্বরের বিষয়ে জানতে চাইলেন।
–সে তো একমাস আগের কথা। ২০ ডিসেম্বর বিকেলে এবং সন্ধ্যায় আমি কি করেছিলাম এখন আপনাকে মনে করে বলা কি সম্ভব?
বিশেষভাবে চিহ্নিত না হলে স্থানকালের প্রসঙ্গ আমার মনে থাকে না। ক্রিসমাসের দিনটির। কথা মনে করতে পারব। ওই দিনটা বরাবর বাবার সঙ্গে থাকি।
–হ্যাঁ, এবছরেও আপনারা গিয়েছিলেন।
–হ্যাঁ।
–আপনার বাবা শুনেছি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?
-হ্যাঁ। সারা বছর খরচের ভয়ে পেটে কিছু দেবেন না, সেই অবস্থায় একদিন হঠাৎ করে অতিরিক্ত পরিমাণ ভোজ্য পানীয় সহ্য হতে চাইবে কেন?
–এটাই অসুস্থতার কারণ বলছেন?
এছাড়া আর কি হবে?
–ডাক্তারও খুব চিন্তিত ছিলেন।
–ওই একজন জুটেছেন। সেদিন তো তার জিজ্ঞাসাবাদের চোটে অস্থির করে মেরেছিলেন। বাবা কি খেয়েছেন, কি পান করেছেন, কে রান্না করেছে–এই সব আজেবাজে যত প্রশ্ন–কুইম্পারের জন্যই বাবার মন দুর্বল হয়ে পড়ে, নইলে বাবা মোটেই অথর্ব হয়ে পড়েন নি।
ভালো কথা, মৃত স্ত্রীলোকটির বিষয়ে আর কিছু জানতে পেরেছেন কি?
–খানিকটা এগিয়েছি।
-আমার বোনের যত উদ্ভট চিন্তাভাবনা, কোথাকার কে তাকে আমার ভাই এডমান্ডের বিধবা স্ত্রী ভেবে–আপনি আশাকরি বিভ্রান্ত হননি ইনসপেক্টর।
–সেই মার্টিন নামে মেয়েটি আপনাকে কখনো চিঠি লিখেছিল?
আমাকে? রক্ষে করুন মশাই।
-তাহলে ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার আপনি কি করেছিলেন মনে করতে পারছেন না? ক্রিসমাসের আগের শুক্রবার
সেদিন আমি কি করেছিলাম বলতে না পারলেও এটা বলতে পারছি, গুদামঘরে কোনো স্ত্রীলোককে হত্যা করিনি।
-একথা বলছেন কেন মিঃ ক্রাকেনথর্প?
–আপনার জানার আসল কথাটা তো তাই। নির্দিষ্ট দিন ও নির্দিষ্ট সময়টার ওপরে জোর দিচ্ছেন–তার মানেই সন্দেহের এলাকাকে সংকুচিত করে আনা। যাইহোক শুনুন, আমি ওই দিন লিডসে গিয়েছিলাম। টাউনহলের কাছে একটা হোটেলে ছিলাম–এই মুহূর্তে নামটা মনে করতে না পারলেও খুঁজে বার করতে আপনাদের কষ্ট হবে না।
-দেখব আমরা খোঁজ নিয়ে।
–আপনাদের মাথায় কি করে এমন একটা বাপার ঢুকল বুঝতে পারছি না। মৃতদেহটি সত্যই যদি এডমান্ডের বিধবা স্ত্রীরই হয়, আমরা তাকে খুন করতে যাব কেন? এরকম ক্ষেত্রে আমরা তো বাবাকে বলে তার মাসোহারা ও ছেলেটির স্কুলের খরচের ব্যবস্থা করার জন্যই এগিয়ে আসব।
তা যাক ইনসপেক্টর আমি দুঃখিত, এর বেশি সহযোগিতা করা আমার পক্ষে সম্ভব হল না।
বাইরে এসে সার্জেন্ট উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, স্যার, আমি ওকে চিনতে পেরেছি। লোকটি সেই কুখ্যাত ডিকি রজার্সের সঙ্গী, সংরক্ষিত খাদ্যের কেলেঙ্কারীতে জড়িত ছিল। তাছাড়া ঘড়ি আর ইতালির স্বর্ণমুদ্রার কেসেও সোজোর দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে-খুব সেয়ানা তোক।
–ঠিকই বলেছ, মুখটা এজন্যই আমার পরিচিত লাগছিল। কিন্তু এ তো মহাঘুঘু। নানান সন্দেহজনক কারবারের সঙ্গেই এর যোগাযোগ পাওয়া গেছে, কিন্তু বরাবরই সুকৌশলে আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। এই কারণেই বর্তমান ঘটনায় কোনো অ্যালিবি উপস্থিত করতে চায়নি।
–আপনার কি মনে হয় ও-ই আসল খুনী?
–এখনও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। আরও তদন্ত দরকার।
অফিসে ফিরে এসে গোটা ব্যাপারটা পর্যালোচনা করতে বসলেন ক্রাডক। পরে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাগুলোকে দেখার চেষ্টা করলেন।
গভীরভাবে চিন্তা করেও হত্যার কারণ সম্পর্কে কোনো সূত্র দাঁড় করাতে পারলেন না। অজ্ঞাত হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তিকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল। সমস্যার কোনো কিনারা করা সম্ভব হল না।
শেষ পর্যন্ত ভাবলেন, আপাততঃ যে কাজ শুরু করেছিলেন তা সম্পূর্ণ করা যাক। কেড্রিককে জিজ্ঞাসাবাদ বাকি।
চিন্তাক্লিষ্ট মুখে উঠে দাঁড়ালেন ক্রাডক। ঘটনার সর্বশেষ অগ্রগতি মিস মারপলকে জানানো হয়নি। তার সঙ্গে আলোচনায় বসলে অগ্রসর হওয়ার মতো একটা পথ পাওয়া যেতে পারে।
৩. চায়ের নিমন্ত্রণে
১১.
–শুনলাম রাদারফোর্ড হলে আপনি চায়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, সকলকে একপলক দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। প্রিয় লুসিই ব্যবস্থাটা করে দিয়েছিল। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি।
সেই সময় লুসি মিস মারপলের ঘরেই উপস্থিত ছিল। কাজের অবসরে সে তাকে সাহচর্য দিতে এসেছিল।
বর্তমান খুনের সম্ভাব্য কারণ হাতড়ে আমি তল পাচ্ছি না। বুঝলেন মিস আইলেসব্যারো
লুসির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন ক্রাডক, আমার ধর্মপিতা বলেছিলেন, ঈশ্বরের সৃষ্ট সমস্ত অপরাধসন্ধানী গোয়েন্দার মধ্যে মিস মারপল হলেন সবার সেরা। সহজাত প্রতিভা অনুকূল পরিবেশে বিকাশলাভ করেছে।
-বুঝলে লুসি, তোমাকে তো বলেছিলাম, ক্রাডকের ধর্মপিতা স্যার হেনরি ক্লিারিং আমার অনেক কালের পুরনো বন্ধু। বড় সহৃদয় মানুষ তিনি।
–আমি বুঝতে পারছি তিনি আপনার সম্পর্কে মিথ্যা প্রশস্তি করেননি। বলল লুসি।
-আসলে কি জান, আমার যেটুকু বিচক্ষণতা তাহল, মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারণা। অজ পাড়াগাঁয়ে থেকে বিদ্যেবুদ্ধি আর কি হবে বল। তা তোমার অগ্রগতি কতদূর বল।
–আমি একটা ঢিল ছুঁড়েছি। ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার দিন কে কি করছিল, হারল্ড আর আলফ্রেডকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আচ্ছা, মিস আইলেসব্যারো, বাড়িতে এখন কে কে আছে?
–কেড্রিক এখনো আছে। উইক এন্ডের ছুটি কাটাতে ব্রায়ান এসেছে। আজ সকালেই ফোন করে জানিয়েছে, হারল্ড আর আলফ্রেড কাল আসবে। ইনসপেক্টর ক্রাডক এবার তাহলে তো বেশ একটা আলোড়ন উঠবে বুঝতে পারছি।
ক্রাডক হাসলেন। বললেন, কেড্রিকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। একটু পরেই রাদারফোর্ড হলে যাচ্ছি আমি।
–তারা তোমাকে জবাব দিতে পেরেছে? জানতে চাইলেন মিস মারপল।
-হ্যারল্ড দিয়েছে। তবে আলফ্রেড ধরা দিতে চায়নি। অ্যালিবি তদন্ত করে দেখতে হবে। ভালো কথা, কোনো সময় গেলে ডাঃ কুইম্পারকে ধরা যাবে?
–ডাঃ তার রোগী দেখতে আসেন ছটায়। সাড়ে ছটা অবধি থাকেন। ওহ্, আমাকে এখনি উঠতে হবে। ডিনারের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যস্ত হল লুসি।
মিস আইলেসব্যারো, একটা ব্যাপার আপনার কাছ থেকে জানতে চাই। ওই মার্টিন নামের মেয়েটির সম্পর্কে ওদের মনোভাব কি রকম?
–বেচারী এমা তো আপনার কাছে গিয়েছিল বলে সবারই মুখে শুনেছি। ডাক্তার এমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন বলে তার ওপরেও সবাই খাপ্পা। মার্টিনের ব্যাপারটাকে ওরা তিন ভাইই ধাপ্পা আর দুরভিসন্ধিমূলক বলেই মনে করে। এব্যাপারে ব্রায়ানই ব্যতিক্রম। মানুষটিও সাদামাটা, মনে প্যাঁচগোজ নেই। তার বিশ্বাস, মেয়েটি সত্যিই এডমান্ডের বিধবা স্ত্রী। বিশেষ কোনো কারণে ফ্রান্সে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে, তবে তার খবর আবার পাওয়া যাবে।
এমার মনে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে।
–তোমার সম্পর্কে সকলেরই বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করলাম। বললেন মিস মারপল।
এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লুসি হাসতে হাসতে বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের বিবাহপ্রস্তাব সহ তার দুই ছেলের বিশেষ দুই প্রস্তাবের কথা বিস্তারিত ভাবে বলল।
সবশেষে বলল, আসলে, আমি বুঝতে পারি, ওদের আগ্রহের কারণটা হল, সকলেই ভাবছে আমি অনেক কিছু জানি।
-বুঝতে পারছি, খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি। সতর্ক থাকবেন। লোভনীয় প্রস্তাবই শেষ কথা নয়, খুনও হয়ে যেতে পারেন।
লুসি শিউরে উঠল। বলল, কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে ভালো করেছেন।
-বাচ্চা দুটি এখনো আছে? জিজ্ঞেস করলেন মিস মারপল।
–কাল ওরা জেমস স্টডার্ডের বাড়ি যাচ্ছে। ছুটির শেষ কটা দিন ওখানেই ওরা কাটাবে।
-ভালো খবর। ওদের উপস্থিতিতে গুরুতর কিছু না ঘটলেই মঙ্গল। তাছাড়া ওদের ওপরও আক্রমণ হতে পারে।
–কি বলছেন, ছেলেদের ওপর? অবাক হল লুসি।
–হ্যাঁ, আলেকজান্ডারের ওপর।
-ওই বয়সী ছেলেরা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হয়ে থাকে। একটা খুনের রহস্যের সন্ধান করে বেড়ানো খুবই রোমাঞ্চকর। কিন্তু কাজটা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
–মিস মারপল, ক্রাডক বললেন, বর্তমান ঘটনাটাকে রাদারফোর্ড হলের পারিবারিক ব্যাপার বলেই মনে করছেন?
–দ্বিতীয় ঘটনা হল একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি কর্তৃক অপরিচিত স্ত্রীলোক হত্যা-এই দুয়ের মধ্যে নিশ্চিত সম্পর্ক রয়েছে।
খুনী বলে একজন লম্বা কালো লোকের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আমি ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি ওরকম লম্বা কালো লোক রাদারফোর্ড হলে তিনজন আছে। তবে তিন ভাইই লম্বা আর কালো হলেও তিনজনের চেহারাই স্বতন্ত্র। আসল লোককে খুঁজে বার করা এ কারণেই কঠিন হয়ে উঠেছে।
–আমার কিন্তু ধারণা কাজটা অতটা জটিল আর কষ্টসাধ্য নয়।
–মার্টিনের কাহিনী আপনি সত্যি বলে মনে করেন? বললেন ক্রাডক।
–এডমান্ড ক্রাকেনথর্প যে মার্টিন নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিল কিংবা বিয়ে করতে চেয়েছিল–এমার কাছে লেখা এডমান্ডের চিঠিতে তা পরিষ্কার। চিঠিটা নিশ্চয় তুমি দেখে থাকবে। কোনো মিথ্যা কাহিনী শুনিয়ে এমার কি লাভ?
–মার্টিন, এডমান্ডের পুত্রসন্তান, পরিবারের সম্পত্তির উত্তরাধিকার-খুন, এদিকে সবকটি ভাইয়ের আর্থিক অবস্থার সঙ্কট, একেবারে জটপাকানো অবস্থা। খুনটাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের সঙ্গে জড়িয়ে দেখতে গেলে একমাত্র লুথার ক্রাকেনথর্পের মৃত্যুতেই সকলের লাভবান হবার সম্ভাবনা।
মার্টিনের হত্যা, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের পরিমাণে খুব সামান্যই হেরফের ঘটাবে।
–তাহলে খুনটাকে তুমি নিরর্থক বলতে চাইছ? বললেন মিস মারপল।
–কিন্তু বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প এখনো অনেক বছর বাঁচবেন। বলল লুসি।
–ডাক্তারেরও তাই অভিমত। বললেন ক্রাডক।
–অবশ্য ক্রিসমাসের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন ডাক্তার এমন ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিলেন যেন বৃদ্ধকে কেউ বিষ প্রয়োগ করেছে। বলল লুসি।
-আমি ঠিক এই ব্যাপারটা নিয়েই ডাঃ কুইম্পারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
–এই সর্বনাশ, অনেক দেরি হয়ে গেছে
লুসি তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ল।
মিস মারপলের কোলের ওপরে টাইমস পত্রিকাখানা ধরা ছিল। তিনি শব্দ-সমাধান মেলাতে বসেছিলেন। এখন পত্রিকার দিকে চোখ ফেলে বলে উঠলেন, টিনটিন আর টোকে–কোনোটি যে হাঙ্গেরীয় মদের নাম খেয়াল রাখতে পারি না।
–টোকে হল হাঙ্গেরীয় মদের নাম, বলল লুসি, সাত অক্ষর আর পাঁচ অক্ষরের শব্দ, সংকেত কি আছে?
-ক্ৰশওয়ার্ড পাজল নয় মেয়ে, মনে হল হঠাৎ কথাটা
ইনসপেক্টর মুখের দিকে তাকিয়ে মিস মারপলের মনের ভাব বুঝবার চেষ্টা করলেন।
.
১২.
–ডাঃ কুইম্পার, একটা ব্যাপারে একটু খোলাখুলি কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে, তবে অবশ্যই ঘরোয়া ভাবে।
–আপনাদের ওই ঘটনার সঙ্গে আমার তো কোনো সম্পর্ক নেই, ইনসপেক্টর।
-না, সেসব বিষয় নয়। জানতে পারলাম ক্রিসমাসের সময় বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প একটু বাড়াবাড়ি রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?
–হ্যাঁ, সত্যি কথা।
–হজমের গোলমাল বলে আপনি সন্দেহ করেছিলেন
–ঠিকই বলেছেন।
ডাক্তার কুইম্পারের মুখভাব সহসা কঠিন হয়ে উঠল। ক্রাডক লক্ষ্য করলেন।
-আমি আরও জেনেছি, বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের খাদ্য ও পানীয় সম্পর্কে আপনি এমন খুঁটিনাটি প্রশ্ন সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন যাতে মনে হতে পারে, আপনি খাদ্যে বিষ প্রয়োগের সম্ভাবনা আঁচ করেছিলেন। আমার জিজ্ঞাসা হল, আপনি সত্যিই কি সে ধরনের কিছু সন্দেহ করেছিলেন?
–আপনি যখন ঘরোয়া ভাবেই জানতে চাইছেন, ইনসপেক্টর আমি খোলাখুলিই বলতে পছন্দ করব, সেদিন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের মধ্যে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পেয়েছিল, তাতে গ্যাস্ট্রো এন্টারাইটিসের চেয়ে আর্সেনিক প্রয়োগের চিহ্নই বেশি প্রকট ছিল।
–ডাক্তার আপনার জানা থাকতে পারে, পরিবারের ছেলেমেয়েরা সকলেই আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের মৃত্যুতে তাদের সকলেরই লাভবান হবার সম্ভাবনা।
–আপনি কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি। তবে এমাকে আপনার সন্দেহের বাইরে রাখবেন। সকলে যখন একসঙ্গে হয়, তখনই বৃদ্ধের ওপর এধরনের আক্রমণ হয়। আগেও দু-একবার এমন হয়েছে। কিন্তু এমা আর বৃদ্ধ একা যখন থাকে তখন কিছু হয় না।
-খুবই লক্ষণীয়। যদি ধরে নেওয়া যায় যে আর্সেনিক প্রয়োগ হয়েছিল, তাহলে ক্রাকেনথর্প যে বেঁচে গেলেন তার কারণ কি?
–সূক্ষ্মমাত্রার প্রয়োগ। বললেন ডাক্তার, আমি অনেক ভেবেছি, কিন্তু বিষপ্রয়োগকারী প্রতিবারেই মাত্রাটা কেন চেপে রাখছে বুঝতে পারছি না। অবশ্য যদি সত্যি সত্যি একজন বিষপ্রয়োগকারী থেকে থাকে। এমনও হতে পারে সবটাই আমার চিন্তার বাড়াবাড়ি।
-খুবই ভাবনার ব্যাপার হল। বললেন ক্রাডক।
.
-স্যার, আমরা একটা সূত্র খুঁজে পেয়েছি।
ক্রাডক সবে দরজায় বেল বাজাতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আলেকজান্ডার আর স্টডার্ড ওয়েস্ট সামনে এসে দাঁড়াল।
ক্রাডক একটু কৌতুক বোধ করলেন। বললেন, খুব ভালো কথা। চল বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখব।
–ভেতরে নয় স্যার, অলেকজান্ডার বলল, সবার সামনে বলা ঠিক হবে না, চলুন একটা গোপন জায়গায় গিয়ে আপনাকে বলব।
ক্রাডক কৌতুক বোধ করলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি ছেলেদুটির সঙ্গে চললেন।
আস্তাবলের উঠোনের প্রান্তে ঘোড়ার সাজসরঞ্জাম রাখার একটা ছোট ঘর। ভারি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল আলেকজান্ডার। হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালল। ক্রাডক ঘরে ঢুকে দেখলেন, বাগান করার মরচে ধরা যন্ত্রপাতি, ঘেঁড়াখোঁড়া, স্প্রীংয়ের গদি, ছেঁড়া টেনিস নেট, এমনি নানা পরিত্যক্ত জিনিসে ঘর বোঝাই। তার মধ্যেই একপাশে খানিকটা ফাঁকা জায়গা–সদ্য সাফ করা হয়েছে বোঝা যায়। পরিত্যক্ত গাছগুলো পেতে বসার ভালো জায়গা করে নেয়া হয়েছে।
-স্যার, আমরা আঁতিপাতি করে, সব জায়গায় খুঁজেছি–বলল আলেকজান্ডার, পরে এমন একটা জিনিস পেয়েছি, ঠিক বলছি একটা মোক্ষম সূত্র
-আজ সন্ধ্যাবেলায়ই এটা পেয়েছি আমরা। বলল স্টডার্ড।
-বয়লার হাউসে হিলম্যান একটা মস্ত গামলা রেখেছে, বাজে কাগজে ভর্তি–সেই কাগজের স্কুপে
আলেকজান্ডার একটা ফটো রাখার ফোল্ডারের ভেতর থেকে সাবধানে তুলে ধরল একটা দোমড়ানো ধূলি মলিন খাম।
ক্রাডক বেশ মজা অনুভব করছিলেন। তার মনে কি কোনো সম্ভাবনার প্রত্যাশার ইশারাও ছিল না?
খামটা হাতে নিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, খামটা ফাঁকা, তবে ডাক মারফত এসেছে। ওপরের ঠিকানাটা দেখে চমকে উঠলেন, মিসেস মার্টিন ক্রাকেনথর্প, ১২৬, এলভার্স ক্রেসেন্ট, এন-১০।
-নামটা চিনতে পারছেন, এডমান্ড কাকার ফরাসি স্ত্রী, তাকে নিয়েই তো সবাই হৈ চৈ করছে। এটা থেকে বোঝা যায় তিনি এখানে এসেছিলেন। চিঠিখানা হয়তো কোথাও পড়ে গেছে
–পাথরের কফিনে এরই মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে, তাই মনে হচ্ছে না স্যার? বলল স্টডার্ড।
-চলে যাওয়ার আগে আমরা একটা দারুণ কাজ করলাম বলুন? আলেকজান্ডার বলল।
–তোমরা চলে যাচ্ছ?
–হ্যাঁ, কালই চলে যাচ্ছি স্টডার্ডের বাড়ি। ছুটি শেষ হলে ওখান থেকেই স্কুলে চলে যাব।
ক্রাডক ক্রমেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। খামের ওপর ডাকঘরের সিল যথাযথ আছে। ছেলেদের খুশি করার জন্য লুসি যে গোপনে কোনো কারচুপি করেনি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু নিঃসন্দেহ হতে পারছিলেন না তিনি। চিঠিটা যদি সত্যি সত্যি ছেলে-ঠকানো কিছু না হয় তাহলে ঘটনার ওপরে নিঃসন্দেহ একটা নতুন আলোকপাত হবে।
-সত্যি, দারুণ কাজ করেছ তোমরা। অনেক উপকার হবে। চলো এবারে বাড়ি যাওয়া যাক।
দুই বন্ধুর পিঠ চাপড়ে দিলেন ক্রাডক।
.
১৩.
সার্জেন্ট ওয়েদারবলের তদন্তের রিপোর্টের ওপর চোখ বোলাচ্ছিলেন ক্রাডক।
হ্যারল্ড ক্রাকেনথর্পের ২০ ডিসেম্বর তারিখের অ্যালিবি হল সেদিন বিকেলে তাকে সোথবিতে দেখা গিয়েছিল। সেখানে অল্পসময় ছিলেন। রাসেলের সেই চায়ের দোকানের তিনি নিয়মিত খদ্দের নন। তাই ফটোগ্রাফ কেউ চিনতে পারেনি। ডিনারের পোশাক পরার জন্য কার্ডিগান গার্ডেনসের বাড়িতে এসেছিলেন পৌনে সাতটায়। বাড়ির ভৃত্যের সমর্থন পাওয়া গেছে। সে অবশ্য বলতে পারেনি রাতে তার মনিব কখন ফিরে এসেছিল। গাড়ি রাখার গ্যারেজে এমন কেউ ছিল না যার কাছ থেকে গাড়ির মালিক সম্পর্কে কিছু জানা যায়। ক্যাটারার্স ডিনারেও উপস্থিত ছিলেন হারল্ড। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই চলে গিয়েছিলেন।
–সবই দেখছি ঠিকঠাক বলছে। রেলস্টেশনগুলোতে খবর নিয়েছিলে? জিজ্ঞেস করলেন ক্রাডক।
–হ্যাঁ স্যার। চার সপ্তাহ আগের ঘটনা কার কি মনে থাকবে বলুন।
এর পর কেড্রিক সম্পর্কে রিপোর্টও হারল্ডের মতই না-সূচক।
হতাশ ভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ক্রাডক।
–আলফ্রেডের রিপোর্টও কি তাই?
–আলফ্রেডের শেষ অনুচ্ছেদটা দেখুন স্যার।
সেখানে চমকপ্রদ বিবরণই পাওয়া গেল। রীতিমত চনমনে হয়ে উঠলেন ক্রাডক।
লরি থেকে চুরির একটা ঘটনার তদন্তের জন্য ২০ ডিসেম্বর রাত সাড়ে নটায় সার্জেন্ট লাকি মোতায়েন ছিলেন ওয়ার্ডিংটন-ব্র্যাকহ্যাম্পটন রাস্তার মোড়ে একটা ইটভাটার কাছে। সেই সময় পাশের একটা টেবিলে সে দেখতে পায় চিফ ইভান্স ডিকি রজার্সের দলের একজনকে। তার সঙ্গী আলফ্রেড ক্রাকেনথর্পকে সে চিনতে পারে। ডিকি রজার্সের মামলায় তাকে সে সাক্ষী দিতে দেখেছিল। একারণে সে তার ওপর নজর রাখতে থাকে।
কয়েক মিনিট পরে আলফ্রেড বাসে উঠে ব্র্যাকহ্যাম্পটনের দিকে চলে যায়।
ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনের টিকিট কালেক্টর উইলিয়ম বেকার টিকিট ক্লিপ করার সময় আলফ্রেডকে চিনতে পারেন।
ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনে আলফ্রেডকে যখন দেখা যায়, সেইসময় রাত এগারোটা পঞ্চান্নর প্যাডিংটনগামী ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় ছিল। সেই দিনই এক পাগলাটে বৃদ্ধা ট্রেনের মধ্যে খুন হতে দেখেছিল বলে রটনা হয়েছিল।
–তাহলে আলফ্রেড, রিপোর্টটা সরিয়ে রেখে বলে উঠলেন ক্রাডক, আলফ্রেডই সেই লোক! আশ্চর্য!
-ঘড়ির হিসেব ধরে একেবারে ঘটনাস্থলেই তাকে পাওয়া যাচ্ছে।
-তাই তো দেখছি, বললেন ক্রাডক। বোঝা যাচ্ছে, চারটে ত্রিশের গাড়িতে সে ব্র্যাকহ্যাম্পটন স্টেশনে পৌঁছেছিল। সেই গাড়িতেই খুনের কাজটা চুকিয়ে ফেলে। তারপর বাসে করে সে ইটভাটায় গিয়েছিল। সাড়ে নটা অবধি সেখানে থাকে। তারপর বাসে করে রাদারফোর্ড হলে ফিরে রেলবাঁধের তলা থেকে মৃতদেহটা পাথরের কফিনের ভেতরে ফেলে। এরপরে ব্র্যাকহ্যাম্পটন থেকে এগারটা পঞ্চান্নয় লন্ডনগামী ট্রেন ধরতে তার কোনোই অসুবিধা হবার কথা নয়। এটা কি সম্ভব যে ডিকি রজার্সের দলের কেউ তাকে মৃতদেহ স্থানান্তরের কাজে সাহায্য করেছিল?
রজার্সের দল এন্তার বেআইনী কাজ করলেও খুনখারাপির ত্রিসীমানায় থাকে না। যাইহোক, আমাদের পরিশ্রম সফল হল এটাই আনন্দের ব্যাপার। আলফ্রেড—
.
ক্রাডককে সঙ্গে নিয়ে ছেলেরা পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে নিয়ে গেল।
রান্নাঘরে লুসি প্যাস্ট্রি পাকাচ্ছিল। ব্রায়ান ইস্টলি পাশে দাঁড়িয়ে বকবক করছে।
ক্রাডক বললেন, মিঃ কেড্রিকের সঙ্গে একটু কথা বলতে এলাম।
–ভেতরে থাকার তো কথা, আমি দেখছি। ব্রায়ান ভেতরে চলে গেল।
–আলেকজান্ডার, খাবার আলমারীতে জিঞ্জার কেক খানিকটা রয়েছে, তোমরা খেয়ে নাও গে। বলল লুসি। ছেলেরা অমনি দাপাদাপি করে ছুটল।
ক্রাডক খামখানা পকেট থেকে বার করে লুসিকে দেখালেন। সন্দেহ মুক্ত হলেন, ছেলেদের সঙ্গে মজা করার জন্য সে এই নকল সূত্রের অবতারণা করেনি।
ব্রায়ান এসে খবর দিল, কেড্রিক লাইব্রেরি ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করছে। ক্রাডকের প্রশ্নে: উত্তরে কেড্রিক বলল, দু-এক দিনের মধ্যেই আমি ইডিজাতে ফিরে যাচ্ছি।
–তাহলে সময় মতোই আপনাকে ধরা গেছে, বললেন ক্রাডক, আমি জানতে এসেছি ডিসেম্বর ২০ তারিখ শুক্রবার আপনি কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন?
চকিতে ক্রাডকের মুখে তাকিয়ে নিল কেড্রিক। পরে বলল, আমি তো বলেছি আগেই
-হ্যাঁ, ২১শে ডিসেম্বর আপনি ইডিজা ছেড়েছিলেন আর সেই দিনই ইংলন্ডে পৌঁছেছিলেন।
এইসময় পাশের ছোটঘর থেকে এমা বেরিয়ে এল।
–এমাই তো ঠিক ঠিক বলতে পারবে, বলল কেড্রিক, এমা বল তো আমি তো ক্রিস্টমাসের আগের দিন শনিবার এখানে পৌঁছেছিলাম, তাই না?
এমা বিস্মিত হয় বলল, হ্যাঁ, লাঞ্চের সময় এখানে পৌঁছেছিলে।
-ইনসপেক্টর, আপনার ধন্দ ঘুচল?
–কিন্তু আমাদের কাছে যে খবর আছে তা আপনার বক্তব্য সমর্থন করে না। আপনার পাসপোর্টটা একবার দেখি–
-ওই জিনিসটাই তো সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ কুকসের অফিসে পাঠানো দরকার।
–পেয়ে যাবেন নিশ্চয়ই, বললেন ক্রাডক, নথিপত্রে দেখতে পাচ্ছি, আপনি এদেশে প্রবেশ করেছেন ১৯ তারিখ সন্ধ্যাবেলা। আমি আশা করব সেই সময় থেকে ২১ ডিসেম্বর লাঞ্চের সময় পর্যন্ত আপনার গতিবিধির ঠিক ঠিক বিবরণ জানাবেন।
–হাজারো ফর্ম পূরণের এই হলো গেরো, ক্রুদ্ধস্বরে বলল কেড্রিক, বুঝলাম, তা ২০ ডিসেম্বর নিয়ে আপনি এত মেতে উঠলেন কেন?
-হত্যাকাণ্ডটা সেই দিনই ঘটেছিল। বললেন ক্রাডক।
–কেড্রিক, বিষয়টা গুরুতর, বলল এমা, ইনসপেক্টরের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া তোমার উচিত। আপনারা কথা বলুন, আমি যাচ্ছি।
এমা ঘর ছেড়ে গেলে কেড্রিক বলল, ইনসপেক্টর, আপনি ঠিকই বলেছেন, ১৯ তারিখে এক বান্ধবীর সঙ্গে ইডিজা ছেড়ে সেইদিনই আমরা লন্ডনে পৌঁছেছিলাম। আমরা উঠেছিলাম কিংসওয়ে প্যালেসে। সন্ধান নিলেই আপনার লোকেরা সত্যাসত্য জানতে পারবে।
–কুড়ি তারিখের বিবরণটা আমাকে বলুন।
সকালবেলাটা গড়াগড়ি করে হোটেলেই কেটে যায়। বিকেলে জাতীয় চিত্রশালায় গিয়েছি, একটা ওয়েস্টার্ন ছবি দেখেছি, পরে বার ঘুরে হোটেলে ফিরে আসি। রাত দশটার পর বান্ধবীকে নিয়ে জাম্পিং ফ্রগ নামের একটা প্রমোদউদ্যানে গিয়েছিলাম। ইনসপেক্টর, কুড়ি তারিখে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই
মিঃ ক্রাকেনথর্প, বিকেল তিনটে থেকে সাতটা পর্যন্ত আপনার গতিবিধির সমর্থন কিভাবে পাওয়া যেতে পারে।
জাতীয় চিত্রশালা বা সিনেমা হাউসে–আমাকে কেউ চেনে না–কাজেই প্রমাণের সম্ভাবনা তত দেখতে পাচ্ছি না।
-ধন্যবাদ মিঃ ক্রাকেনথর্প।
এমা আবার ফিরে এলো ঘরে। উপযাচক হয়েই সে ক্রাডককে তার কুড়ি তারিখের কাজের ফিরিস্তি শোনাল। পরে জানতে চাইল, নতুন কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা।
ক্রাডক পকেট থেকে সেই খামখানা বার করে দেখালেন।
–মিস ক্রাকেনথর্প, লক্ষ্য করে দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা।
-এটা…এটা তো আমরাই হাতের লেখা। এই চিঠিটাই তো আমি মার্টিনকে লিখেছিলাম। …কিন্তু..আপনি…তার খোঁজ কি পাওয়া গেছে?
-হ্যাঁ, এখন আপনি সেরকম বলতে পারেন। এই খামখানা এই বাড়িতে পাওয়া গেছে–তবে ভেতরে চিঠি ছিল না–
–আমাদের বাড়িতে? সে তাহলে সত্যিই এসেছিল এখানে?
–সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে।
–ওই পাথরের কফিনে…মার্টিনই ছিল
–সম্ভবপর বলেই মনে হচ্ছে।
.
অফিসে ফিরে এসেই আমান্ড ডেসিনের পাঠানো একটা তারবার্তা পেলেন ক্রাডক।
আন্না ট্রাভিনস্কির এক বান্ধবীর কাছে তার একটা চিঠি পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে সে এক পুরুষবন্ধুর সঙ্গে বর্তমানে জ্যামাইকায় আমোদ উপভোগ করছে।
.
উইক এন্ডের ছুটি কাটাতে রাদারফোর্ড হলে সকলের সঙ্গে মিলিত হল হ্যান্ড ও আলফ্রেড।
ছেলেদুটি চলে গেছে। ছত্রাকের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে তাদের কথাই ভাবছিল লুসি।
ওদিকে তুমুল বাদানুবাদে লাইব্রেরি ঘরের হাওয়া গরম হয়ে উঠেছে। অভিযোগের ঝড় বইছে এমাকে নিয়ে। সে নির্বোধের মতো চিঠিখানা নিয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে গিয়েছিল বলেই সকলকে এখন ঝামেলা পোয়াতে হচ্ছে। পুলিস নিশ্চয় কিছু সন্দেহ করছে, নইলে ২০ তারিখটাই তাদের তদন্তের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে কেন?
কেড্রিক এমার সমর্থনে মন্তব্য করতে গেলে ভাইদের মধ্যেও পারস্পরিক ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু হয়ে গেল।
বেচারী এমা চেষ্টা করেও ঘরের উত্তপ্ত আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না।
ডাঃ কুইম্পার এসেছিলেন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পকে পরীক্ষা করতে। কাজ শেষ করে তিনি এসে ঢুকলেন লাইব্রেরি ঘরে। অমনি তিনিও পড়ে গেলেন আক্রমণের মুখে।
-এমাকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন আপনি, উত্তেজিত ক্ষুব্ধ কণ্ঠে চিৎকার করে বলে উঠল হারল্ড, এসবের মানে কি?
ডাঃ কুইম্পার আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার কথায় কেউ কর্ণপাত করল না। কৈফিয়তের মুখে পড়ে গেলেন তিনি। প্রচণ্ড বিরক্তি চেপে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে পড়লেন।
গাড়ির শব্দ শুনে লুসি জানালা দিয়ে তাকিয়ে কেবল ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ ডাক্তারের মুখ দেখতে পেল।
বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প আগেই লুসিকে ফরমাস করেছিলেন, তিনি আজ সুস্বাদু কারি খেতে ইচ্ছুক। লুসি তার জন্যই কারি তৈরির সমস্ত উপাদান সংগ্রহ করে নিয়ে বসেছিল। তার ইচ্ছে, আজ সে পরিবারের সকলকে ভালো ডিনার পরিবেশন করবে।
.
মিস জোস সিম্পকিনসের দুটি সবল সুস্থ যমজ শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাবার ধকল সামলে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ডাঃ কুইম্পার যখন তাঁর বিছানায় এলেন, তখন রাত তিনটে।
অবসন্ন দেহটাকে বিছানায় এলিয়ে দিতে পারলে এবারে স্বস্তি। তিনি হাই তুললেন।
এমনি সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল। নিজের ভাগ্যের উদ্দেশ্যে একটু কটু মন্তব্য করে তিনি রিসিভার তুলে নিলেন।
–ডাঃ কুইম্পার? হ্যাঁ…আমি লুসি আইলেসব্যারো বলছি। বাড়ির সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
ডাঃ কুইম্পার অসুস্থতার লক্ষণগুলো জিজ্ঞেস করে জেনে নিলেন। প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে কিছু উপদেশ দিলেন।
-তুমি এগুলোর ব্যবস্থা নাও…আমি এখুনি রওনা হচ্ছি।
দ্রুত বাইরে বেরুবার পোশাক পরে নিয়ে, আপকালীন ব্যবস্থা হিসেবে কয়েকটি ওষুধ ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর দ্রুত নিচে নেমে এসে গাড়ি বার করলেন।
.
ঘণ্টাতিনেক অমানুষিক পরিশ্রম করে অবস্থা আয়ত্তে আনলেন ডাঃ কুইম্পার। তাকে সমানে সহযোগিতা যুগিয়ে গেছে লুসি।
–আশা করছি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সকলে সুস্থ হয়ে উঠবে। এবারে একটু কফি…
লুসি প্রস্তুতই ছিল। অল্পসময়ের মধ্যেই রান্নাঘরের টেবিলে সে কুইম্পারকে কফি পরিবেশন করল।
কফির শেষ তলানিটুকু পর্যন্ত নিঃশেষে কাপ থেকে টেনে নিয়ে আরামসূচক শব্দ করলেন তিনি। জড়তা আর ক্লান্তি অনেকটাই দূর হল।
–কিন্তু লুসি ভয়ানক এই ব্যাপারটা কি করে ঘটতে পারে আমি বুঝতে পারছি না। ডিনার কে রান্না করেছিল?
–আমিই করেছিলাম। বিমর্ষ কণ্ঠে জবাব দিল লুসি–
–কি কি পদ প্রস্তুত করেছিলে?
-মুরগী সংযোগে ভাত, ছত্রাকের সুপ, মুরগীর লিভার দিয়ে সিলাবাবস (দুধ মেশানো আঙুরের রস), চিকেন কারি ও সস।
–ওহ্ ছত্রাক! সুপ কি টিন থেকে ঢেলে নিয়েছিলে?
–আমিই তৈরি করেছিলাম। এর মধ্যে তো কোনো গোলমাল থাকতে পারে না। আমি নিজে খানিকটা সুপ খেয়েছি–আমি অসুস্থ হইনি।
-হ্যাঁ, তা দেখতেই পাচ্ছি।
–আপনি কি মনে করছেন–
-লুসি, তেমন হলে তুমিও রোগের ভান করে সকলের সঙ্গে ছটফট করতে। তোমার সম্পর্কে আমি জানি–অত্যন্ত সৎ তরুণী তুমি। তাছাড়া ক্রাকেনথর্প পরিবারের সঙ্গে কাজে আসার আগে তোমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। আচ্ছা চিকেন কারি কি তুমি খেয়ে দেখেছিলে?
–না।
কুইম্পার মাথা ঝাঁকালেন।
অবশিষ্ট খাবার কি কি আছে?
–খানিকটা কারি রয়েছে, ছত্রাকের সুপও বেঁচেছে আর চাটনি।
–সবকটাই খানিকটা করে আমি নিয়ে যাব।
এরপর কুইম্পার আবার রোগীদের পরীক্ষা করলেন। লুসিকে কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন।
–ব্যাপারটা খাদ্যের বিষক্রিয়া না বিষপ্রয়োগের চেষ্টা খাবারের নমুনাগুলো পরীক্ষা করলে নিশ্চিত বলা যাবে। আপাততঃ তুমি বিশেষ করে দুজনের ওপর নজর রাখবে। আর এমাকে দেখবে অবশ্যই। আমি আটটা নাগাদ একজন নার্সকে পাঠিয়ে দেব। আমি ফিরে যাচ্ছি।
.
–আর্সেনিক বলেই আমি সন্দেহ করেছি ইনসপেক্টর বেবন। কারিটা সঙ্গে নিয়ে এসেছি, আপনি আপনার লোকেদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিন। বললেন ডাঃ কুইম্পার।
–বলছেন কি? বিষপ্রয়োগের ঘটনা? বেকনের কথায় অস্থিরতার ভাব প্রকাশ পেল।
–আমার তাই মনে হচ্ছে।
–কিন্তু মিস আইলেসব্যারো বলছেন একমাত্র সুস্থ রয়েছেন
–হ্যাঁ।
–তার দিক থেকে ব্যাপারটা সন্দেহজনক…
–কিন্তু তার কি উদ্দেশ্য হতে পারে? তাছাড়া সে আর্সেনিক প্রয়োগ করলে নিজেকে সন্দেহ মুক্ত রাখার জন্য কিছুটা কারি খেত এবং অসুস্থতার লক্ষণগুলোকে বাড়িতে দেখাবার চেষ্টা করত।
-হ্যাঁ, যুক্তিসঙ্গত কথাই বলেছেন। তাহলে পরিবারের অসুস্থদের মধ্যেই এমন কেউ রয়েছে যে নিজেকে সন্দেহের বাইরে রাখবার চেষ্টা করছে।
-এই ব্যাপারটা পরিষ্কার করবার জন্যই আপনাকে বিষয়টা জানাতে এসেছি। তবে আমার মনে হয়, কেউ এমন পরিমাণ খায়নি যাতে মারা যেতে পারে। যাইহোক, আমি একজন নার্সকে আপাততঃ ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি।
-মারা যাবে না বলছেন, তাহলে বিষপ্রয়োগের উদ্দেশ্যটা কি ছিল?
–আমার ধারণা, সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক কারিতে মেশানোর উদ্দেশ্য ছিল যাতে বিষক্রিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় আর ছত্রাকের ওপরে সকলের দৃষ্টি পড়ে। কেননা, সাধারণতঃ ছত্রাক থেকেই বিষক্রিয়া ঘটতে দেখা যায়। আর এই সুযোগে একজনের ওপরেই মাত্রার পরিমাণটা বাড়ানো যাতে শেষ পর্যন্ত সে মারা যায়।
ইনসপেক্টর মাথা নেড়ে ডাক্তারের বক্তব্য সমর্থন করলেন।
এইসময়ে টেবিলের ওপর টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে নিয়ে বেকন বললেন, ডাঃ আপনার নার্স ফোন করেছে।
ডাক্তার ফোন ধরলেন। তাঁকে জানানো হল, আলফ্রেড মারা গেছে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে দুঃসংবাদটা তিনি বেকনকে জানালেন।
.
রিসিভার কানে তুলেই চমকে উঠলেন ক্রাডক।
–কিন্তু আমি যে আলফ্রেডকেই হত্যাকারী সাব্যস্ত করেছিলাম। তদন্তের সব রিপোর্টই তার বিরুদ্ধে ছিল। এখন বুঝতে পারছি আমাদের কোথাও হিসেবে ভুল হয়েছিল।
একমুহূর্ত নীরব থেকে টেলিফোনের অপর প্রান্তের বক্তব্য শুনলেন।
–আশ্চর্য হচ্ছি, একজন অভিজ্ঞ নার্স বুঝতে ভুল করল?
–তার কিছু করার ছিল না স্যার। পাঁচজন রোগীকে তাকে একা সামলাতে হচ্ছিল। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পকে দেখে এসে সে আলফ্রেডকে গ্লুকোজ মেশানো চা দিয়েছিল। সেটা পান করার সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা পড়ে।
তার মানে দ্বিতীয়বার আর্সেনিক প্রয়োগ করা হয়েছিল।
–ডাঃ কুইম্পার সেরকমই মনে করছেন। সার্জেন জনস্টনও তাঁর সঙ্গে একমত।
–কিন্তু আলফ্রেড কেন, তার মৃত্যুতে কারোর লাভবান হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।
-আপনি কি বলতে চাইছেন, খুনীর আসল লক্ষ্য আলফ্রেড ছিল না? চা-টা বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্পের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল–আর কেউ ভুল করে
-হ্যাঁ, কেন না, বৃদ্ধের মৃত্যুতে সকলেই লাভবান হত। আচ্ছা, চায়ের মধ্য দিয়েই বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল বলে ডাক্তাররা নিশ্চিত হয়েছেন?
–হ্যাঁ, কেন না আনুষঙ্গিক জিনিসগুলো নার্স ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নিয়েছিল।
-তার মানে, বেকন, রোগীদের মধ্যেই কেউ এমন রয়েছে যে অন্যদের মতো অসুস্থ নয়। সেই সুযোগ বুঝে বিষপ্রয়োগের কাজটা সেরেছে।
–আমরা এখন আরও সতর্ক হয়েছি। আরও দুজন নার্সকে আমি রেখেছি। মিস আইলেসব্যারো তো রয়েইছেন। আপনি কি একবার এখানে আসছেন?
–কিছুক্ষণের মধ্যেই যাচ্ছি।
.
ইনসপেক্টর ক্রাডকের ডাক পেয়ে লুসি হলঘর ছেড়ে এল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার মুখ শুকিয়ে অতটুকু হয়ে গেছে।
–ভাবতে পারছি না ইনসপেক্টর বেকন, বড় ভয় ধরে গেছে।
শুষ্ক কণ্ঠে বলল লুসি।
–ওই কারিটা যত বিপত্তির কারণ।
–আর্সেনিক যদি কারির মধ্যেই পাওয়া গিয়ে থাকে, তাহলে এ কাজ পরিবারেরই কেউ করেছে।
বাইরের কারুর পক্ষে সম্ভব ছিল না বলছেন?
-বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প কারি খেতে চেয়েছিলেন। আমার অন্যরকম প্রস্তুতি ছিল। তাই অনেক দেরিতে সেটা তৈরি করতে হয়েছিল। এজন্য নতুন কারি পাউডারের টিন খুলতে হয়েছিল। তার মধ্যে কোনো কারচুপি করা সম্ভব ছিল না।
-রান্না করার সময়ে
-হ্যাঁ, আমি যখন ডাইনিং রুমে টেবিল সাজাচ্ছিলাম, তখন যদি কেউ রান্না ঘরে চুপি চুপি ঢুকে থাকে
-বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প আর এমা ছাড়া বাড়িতে আর কে কে ছিল?
-কেড্রিক ছিলেন। লন্ডন থেকে বিকেলে আসেন হারল্ড ও আলফ্রেড। ব্রায়ান ছিল, তবে সে ডিনারের আগেই কার সঙ্গে দেখা করবে বলে চলে গিয়েছিল।
কুইম্পারের ধারণা, ক্রিসমাসের সময়ে বৃদ্ধ আর্সেনিক ঘটিত কারণেই অসুস্থ হয়েছিলেন, কাল রাতে সবাইকে কি সমান অসুস্থ মনে হয়েছিল?
–বেশি অসুস্থ হয়েছিলেন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প। তবে বেশি অস্থিরতা ছিল কেড্রিকের মধ্যে।
–কিন্তু আলফ্রেড খুন হওয়ার কারণটা ভেবে পাচ্ছি না।
চিন্তিতভাবে বললেন ক্রাডক।
–আলফ্রেডই খুনীর লক্ষ্য ছিল বলে আপনি ভাবছেন?
-হ্যাঁ, সেই ব্যাপারটা ভাবছি। কিন্তু সব ঘটনার পেছনেই যে একটা উপলক্ষ কাজ করেছে তেমন সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। দেখুন, এতদিনে মোটামুটি মেনে নেওয়া হয়েছে পাথরের কফিনের মৃতদেহটি এডমান্ডের বিধবা পত্নী মার্টিনের ছিল।
সেই ঘটনার সঙ্গে আলফ্রেডের হত্যার যোগাযোগ রয়েছে যদি ভাবতে হয় তাহলে বলতে হয়, সমস্ত বিপত্তির মূলে হল পরিবার।
–আমি কিছু ধরতে পারছি না।
যাইহোক, ওপরতলার রোগীদের মধ্যেই একজন বিষপ্রয়োগকারী রয়েছে, একথা মনে রেখো। তুমি নিজের সম্পর্কে সতর্ক থাকবে।
.
–ডাঃ কুইম্পার বলেছেন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প আগে আপনারই রোগী ছিলেন। অনেকদিন থেকেই ওই পরিবারকে আপনি জানেন। বললেন ক্রাডক।
হ্যাঁ, বৃদ্ধ জোসিয়া ক্রাকেনথর্পেরও চিকিৎসা আমি করেছি। কিন্তু আমার কাছে আপনি কি জানতে এসেছেন বুঝতে পারছি না। বললেন ডাঃ মরিস।
ক্রাডক বৃদ্ধ ডাঃ মরিসকে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করলেন।
–ওহ, সেই নির্বোধ কুইম্পারের কথা আপনি শুনছেন। একবার লুথার ক্রাকেনথর্পের গ্যাস্ট্রিকের প্রকোপ হয়েছিল, আমি তার চিকিৎসা করেছিলাম। কুইম্পারের মাথায় ঢুকেছে কেউ লুথারকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করেছিল। উদ্ভট সব কথাবার্তা। আর্সেনিক প্রয়োগের ঘটনা দেখলে আমি চিনতে পারব, এটুকু বিশ্বাস আছে।
ক্রাডক বললেন, নিজেদের পেশায় খ্যাতিমান কিছু সংখ্যক ডাক্তার কিন্তু আর্সেনিকের ঘটনা ধরতে পারেননি।
ক্রাডক তার বক্তব্যের সমর্থনে কতগুলো ঘটনা তুলে ধরলেন।
–আপনার বক্তব্য বুঝতে পারছি। আমি ভুল করে থাকতে পারি, তাই তো। কিন্তু আমি তা মনে করি না। তা বেশ, কুইম্পারের কি ধারণা, বিষপ্রয়োগের ব্যাপারে সে কাকে সন্দেহ করছে?
–একটা বিরাট পরিমাণ টাকার প্রশ্নে পরিবারের অনেকেই জড়িত, আপনি তো জানেন।
-হ্যাঁ, জানি বৈকি। লুথারের মৃত্যুর পর সমস্ত বিষয়-আশয় তার ছেলেরা পাবে। তাদের টাকার প্রয়োজনও রয়েছে। তবু আমি মনে করি না তারা টাকার পাওয়ার জন্য বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করার চেষ্টা করবে।
-না, তা অপরিহার্য নয়।
-দেখুন ইনসপেক্টর, আমি আপনাকে এটুকু বলতে পারি, লুথার বারবার গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত হয়েছেন, এটা ঠিক, কিন্তু আমি কখনো আর্সেনিকের কথা ভাবিনি। তার চিকিৎসক হিসেবে যে ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি তা হল, লুথার হল স্বভাব-কৃপণ। তিনি তাঁর ব্যয় সংক্ষেপ করে যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করেছেন বলেই আমার ধারণা–ছেলেদের তিনি সেই সঞ্চয়ে হাত দিতে দেন না।
ক্রাডক বললেন, পরিবারের এই অর্থনৈতিক বিষয়টাই আমাদের বিবেচনার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প তার সঞ্চিত অর্থ নিশ্চয় কারোর নামে উইল করে দিয়েছেন–
–দেখুন, এই পরিবারের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমার পক্ষে আর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
মিসেস কিডার বলল, তুমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছ মিস। মাত্র একজনের ওপর দিয়ে বিপদটা কেটে গিয়েছে। ছত্রাক বড় ভয়ানক জিনিস।
–কিন্তু ছত্রাকগুলোয় কোনো দোষ ছিল না, বলল লুসি।
সে রুগীদের ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য খাবারের ট্রে গুছিয়ে নিচ্ছিল।
–যাই বল, এ বাড়িতে শয়তানের খেলা শুরু হয়েছে আমি বলব। প্রথমে হল একটা খুন, পরে ছত্রাকের বিষে আলফ্রেড মারা গেল। আমার স্বামী তো আমাকে আসতে দিতেই চায় না।
–কিন্তু তুমি তো গা বাঁচিয়ে চলার মেয়ে নও। বলতে বলতে লুসি প্রথম ট্রে-খানা নিয়ে ওপর তলায় চলল।
বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, এসব কি নিয়ে এসেছ? বীফ স্টিক ছাড়া আমি কিছু খাব না।
–ডাঃ কুইম্পার বলেছেন, এখনো আপনার বীফ স্টিক খাওয়ার সময় হয়নি।
-ওসব কথা ছাড়, আমি এখন যথেষ্ট সুস্থ হয়ে উঠেছি। কাল সকালেই দেখবে ঘুরে বেড়াব। ওরা কেমন আছে?
–মিঃ হারল্ড অনেক ভালো। কাল সকালে তিনি লন্ডন চলে যাচ্ছেন।
–কেড্রিক এখনো রয়েছে? এমা কি করছে?
–এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন।
-দেখ মেয়ে, আমি কত দ্রুত সামলে উঠেছি। তবু ওরা বলে আমি বুড়ো মানুষ। তুমি ওসব কথায় কান দিও না। তোমাকে সেদিন যে কথাটা বলেছিলাম, সেটা মনে রেখো।
লুসি এরপরে এমার ঘরে ট্রে নিয়ে এলো।
–লুসি, আমি অনেকটা ভালো বোধ করছি। তোমার মাসীমার সঙ্গে বোধহয় এই কদিন দেখা করতে পারনি?
–একদম সময় পাইনি।
-তিনি নিশ্চয় তোমার কথা ভাববেন। বুড়ো মানুষ। তুমি আজও তার সঙ্গে ফোনে কথা বলো।
এমার উদ্বেগ লক্ষ্য করে লুসির অপরাধবোধ হল। মিস মারপলের প্রতি খুবই অবহেলা হয়ে গেছে। সে স্থির করল, কেড্রিককে খাবারটা দিয়েই মিস মারপলকে ফোন করবে।
কেড্রিকের ঘরে পৌঁছে লুসি দেখল সে বিছানায় উঠে বসেছে। কয়েক তাড়া কাগজের ওপর ব্যস্তভাবে কিসব লিখছে।
–আপনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন দেখে ভালো লাগছে। এখুনি লেখাপড়া শুরু করে দিয়েছেন দেখছি–
পরিকল্পনা ছকছি, বলল কেড্রিক, বুড়ো মারা গেলে এবাড়ি আর আশপাশের জায়গাটা নিয়ে কিছু একটা তো করতে হবে। প্লট ভাগ করে বিক্রি করে দেব, না, কারখানার জন্য রাখব বুঝতে পারছি না।
বাড়িটাতে অবশ্য নার্সিংহোম বা স্কুলও হতে পারে। আবার ভাবছি অর্ধেক জায়গাটা বিক্রি করে বাকি অর্ধেকে নিজে দুঃসাহসিক কিছু করব।
–আপনি যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন বোঝা যাচ্ছে।
–মাথা খেলাতে পারছি বলে? তো আলফ্রেডের ব্যাপারটা কি দাঁড়াল?
–তদন্ত মুলতুবি রয়েছে।
–বাড়িসুদ্ধ লোককে এমন বিষপ্রয়োগ, পুলিসও থৈ পাচ্ছে না। তুমি নিজের দিকে নজর রেখো সুন্দরী।
-তা রাখছি।
.
লাঞ্চের আগে লুসি মিস মাপলের কাছে ফোন করল।
–আপনার কাছে কদিন যেতে পারিনি বলে দুঃখিত। একদম ফুরসৎ করতে পারছি না।
–খুবই স্বাভাবিক। আমাদের অবশ্য এখন কিছু করার নেই, আরও কদিন অপেক্ষা করতে হবে।
–কিসের অপেক্ষার কথা বলছেন?
–এলসপেথ ম্যাকগিলিকার্ডির ফিরে আসার জন্য। আমি অবশ্য তাড়া দিয়ে লিখেছি। তুমি মেয়ে সাবধানে থেকো
–আপনি কি আশা করছেন–
-মৃত্যুর ঘটনা আর ঘটবে কিনা বলছ? দেখ, ভবিষ্যতের কথা কিছু বলা যায় না; বিশেষ করে কাছাকাছিই যখন একজন খুনী রয়েছে।
.
ফোন ছেড়ে লুসি রান্নাঘরে গেল। সে নিজের ট্রে নিয়ে ছোট পড়ার ঘরে গিয়ে বসল। তার খাওয়া শেষ হতে হতেই ব্রায়ান ইস্টালি দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল।
-আপনি এসময়ে
–খবর নিতে এলাম, সকলে কেমন আছে?
–সামলে উঠেছেন। হারল্ড কাল লন্ডনে ফিরে যাচ্ছেন।
ব্যাপারটা কি সত্যিই আর্সেনিক ঘটিত, তুমি কি মনে কর?
–সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বাড়ির মধ্যে চুপি চুপি ঢুকে খাবারে বিষ মেশাচ্ছে, এমন শত্রুতা কে করছে বলতো?
–তেমন লোক আমিও তো হতে পারি। সুযোগ অনেক বেশি।
-না, লুসি, একাজ তুমি করতে পার না। কারির মধ্যে যদি কেউ কারচুপি করে থাকে, তবে যে পাঁচজন খেতে বসেছিল, তাদেরই মধ্যে কেউ একজন।
লুসির খাওয়া শেষ হলে ব্রায়ান তার সঙ্গে রান্নাঘরে এলো।
–দেখো, যা বুঝতে পারছি, বাড়িটা শেষ পর্যন্ত কেড্রিকের হাতেই আসছে। কিন্তু আমি জানি সে সব বিক্রিবাটা করে বিদেশে চলে যাবে।
হ্যারল্ড অবশ্য এমন সেকেলে বাড়ি রাখতে চাইবে না। এমা তো একা মানুষ। এখনো পর্যন্ত বিয়েই করল না। এই নির্জন পুরী রেখে সে কি করবে? আমি আপাততঃ বেকার। কিন্তু বাড়িটা যদি আলেকজান্ডারের হাতে আসত তাহলে আমরা দুটিতে মিলে আনন্দে কাটাতে পারতাম। কিন্তু কি জান, আলেকজান্ডারকে এটা পেতে হলে এই বাড়ির সকলের মরা দরকার। ধ্যাৎ, কি সব আজেবাজে কল্পনা করছি। তবে যাই বল, বুড়ো অতি সহজে মরছে না।
-তাই মনে হয়।
.
রান্নাঘরের মেঝে ঘষে পরিষ্কার করছিল মিসেস কিডার। আর কাজের ফাঁকে রাদারফোর্ড হলের ঘটনা নিয়ে, বাইরে লোকের মুখে যে গুজব রটেছে তা লুসিকে শোনাচ্ছিল।
এমন সময় দরজায় ঘন্টা বাজল।
ডাক্তার কুইম্পার এসেছেন অনুমান করে লুসি এসে দরজা খুলল। কিন্তু দেখে অবাক হল, দীর্ঘাঙ্গী, অভিজাত চেহারার এক মহিলা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। তার পেছনে বাড়িতে ঢোকার পথের ওপরে একটি রোলস গাড়ি দাঁড়ানো। মহিলার বয়স, পঁয়ত্রিশের গায়েই হবে।
এমা ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে দেখা করতে পারি?
আগন্তুক মহিলার সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হল লুসি।
–আমি দুঃখিত, তিনি খুবই অসুস্থ।
–আমি জানি তিনি কিছুদিন ধরে অসুস্থ আছেন। আমার অনুমান, আপনিই মিস আইলেসব্যারো। আমার ছেলে স্টডার্ড ওয়েস্ট সারাক্ষণই আপনার প্রশংসা করছে। আলেকজান্ডার আপাততঃ আমার কাছেই আছে।
মিসেস স্টডার্ড ওয়েস্টের পরিচয় পেয়ে লুসি যথোচিত সম্ভ্রমের সঙ্গে তাকে ড্রইংরুমে এনে বসাল।
–আমার ছেলের কাছে একটা বিষয় জানতে পেরে আমি মিস ক্রাকেনথর্পের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। বিষয়টা খুবই জরুরী। যদি তাকে কথাটা বুঝিয়ে বলেন।
আগন্তুককে বসিয়ে লুসি ওপরে গিয়ে এমাকে সব জানাল।
তাকে নিয়ে এসো।
.
–বোধহয় স্কুলের স্পোর্টসের সময় আপনাকে দেখেছি।
এমার সঙ্গে করমর্দন করে বিছানার পাশে বসানো চেয়ারে আসন গ্রহণ করলেন লেডি।
-এখন মনে পড়েছে, আমিও আপনাকে দেখেছি। বলল এমা।
-একটা গুরুতর কারণেই আমাকে এভাবে চলে আসতে হল। এখানে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, ছেলেরা এ নিয়ে খুবই উত্তেজিত। আমাকে তারা অনেক কথা বলেছে। তারা বলেছে, যে মেয়েটি খুন হয়েছে সে নাকি ফরাসি। আপনাদের ভাই যিনি যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন, তার পরিচিত ছিল। একথা কি সত্যি?
–এরকম একটা সম্ভাবনা আমরা বিবেচনা করেছি। আবেগকম্পিত স্বরে বলল এমা, ঘটনাটা সত্যি হতেও পারে।
নিহত স্ত্রীলোকটিই মার্টিন–পুলিসের এরকম মনে করার কারণ কি? তার সঙ্গে কিছু কাগজপত্র ছিল?
-সেরকম কিছু ছিল না। তবে এই মার্টিনের কাছ থেকে আমি একটা চিঠি পেয়েছিলাম।
–মার্টিনের কাছ থেকে? আপনি চিঠি পেয়েছিলেন?
-হ্যাঁ। সে আমাকে জানিয়েছিল যে সে ইংলন্ডে এসেছে, আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি তাকে আমন্ত্রণ জানাই। কিন্তু পরেই একখানা তারবার্তা পাঠিয়ে সে জানায়, ফ্রান্সে ফিরে যাচ্ছে।
সে সত্যিই ফ্রান্সে ফিরে গিয়েছিল কিনা আমরা জানি না। এরপর এখানে তার ঠিকানা লেখা একটা খাম পাওয়া যায়। তাতেই অনুমান হচ্ছে যে সে এখানে এসেছিল। কিন্তু আসলে
এমার কথা শেষ হবার আগেই লেডি স্টডার্ড ওয়েস্ট বললেন, এ কাহিনীর সঙ্গে আমার কোথায় সম্পর্ক তা আপনার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়। আর পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সেই কথা জানাবার তাগিদ বোধ করেছি আমি।
-বলুন।
–যেকথা কোনোদিনই আপনাকে বলব না বলে আমি ঠিক করেছিলাম, ঘটনাচক্রে তাই আজ প্রকাশ করতে হচ্ছে। দেখুন, আমিই মার্টিন ডুবয়।
বিস্ময়াহত এমা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল ভদ্রমহিলার দিকে। সে যেন কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারছিল না।
–মার্টিন–আপনিই মার্টিন
-হ্যাঁ, সত্যিই আমি মার্টিন। আপনার পক্ষে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কথাটা সত্যি। যুদ্ধের গোড়ার দিকে আমাদের গ্রামেই এডমান্ডের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমাদের মধ্যে বিবাহের কথা পাকা হয়েছিল। সে কথা আপনি জানেন। কিন্তু আমাদের বিয়ের আগেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল।
তারপর খবর পেলাম, সে যুদ্ধে হারিয়েছে। সেদিনের সেই বিভীষিকাপূর্ণ দিনগুলোর কথা এখন অতীতের ইতিহাস। তোমাকে, আজ এতদিন পরে, আমি এটুকু বলতে পারি, তোমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। সেই অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাকে যুদ্ধের কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল। ফ্রান্স জার্মানির অধীন হল, আমি নাম লেখালাম প্রতিরোধ বাহিনীতে।
ফ্রান্সের ভেতর দিয়ে ইংরাজদের ইংলন্ডে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব যাদের ওপর পড়েছিল, আমি ছিলাম তাদের একজন। সেই সময়ই আমার বর্তমান স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই সময় তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর অফিসার।
যুদ্ধ শেষ হলে বিয়ে করলাম। অনেকবার আমার আপনার কথা মনে পড়েছে। ভেবেছিলাম এসে দেখা করব কিংবা চিঠি লিখব।
কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম, নতুন জীবন শুরু করেছি, অতীত স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলে আর কি লাভ। তাই কোনোদিনই আর কোনো ভাবে যোগাযোগ করা হয়নি।
কিন্তু অতীতকে ভুলতে চাইলেই কি সবসময় ভোলা যায়। যখন জানলাম, জেমসের স্কুলের প্রিয় বন্ধু এডমান্ডের ভাগনে, তখন অদ্ভুত আনন্দ হল।
আলেকজান্ডার আর জেমসের বন্ধুত্ব অপার এক সুখের বিষয় হয়ে উঠল আমার কাছে, তুমিও হয়তো লক্ষ্য করে থাকবে, আলেকজান্ডার অবিকল এডমান্ডের মত দেখতে হয়েছে।
যাই হোক, তোমাদের বাড়ির হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ভাষ্য শুনে আমি জানতে পেলাম, মৃত স্ত্রীলোকটিকে এডমান্ডের পরিচিত বা স্ত্রী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তখন তোমার কাছে এসে সত্যি কথাটা জানাবার তাগিদ বোধ না করে পারলাম না। মৃত স্ত্রীলোকটি যে মার্টিন নয়, একথা তোমাকে অথবা পুলিসকে জানানো আমার কর্তব্য বলে মনে হল।
তার সম্মুখে বসা ভদ্রমহিলাকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল এমা, তার প্রতিটি কথা যেন সে গলাধঃকরণ করছিল। গভীর আবেগে সে যেন কথা হারিয়ে ফেলেছিল।
-আমি ভাবতেই পারছি না, ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বলল সে, আমার ভাই যার কথা লিখেছিল, আপনিই সেই মার্টিন। কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি না, তাহলে এমন একটা চিঠি কি আপনিই আমাকে লিখেছিলেন?
-না, না, আমি তোমার কাছে কোনোদিন চিঠি লিখিনি। বললাম যে, তোমাকে চিঠি লেখা উচিত হবে কিনা এই নিয়ে ভেবেছি কিন্তু লেখা হয়নি।
-তবে
এমা গম্ভীর হয়ে গেল। সে যেন অশুভ কিছুর আভাস পেল।
–নিশ্চয় অন্য কেউ তোমার কাছে মার্টিন বলে পরিচয় দিয়েছিল। উদ্দেশ্য বোঝাই যায়। নিশ্চয় কিছু টাকা তোমার কাছে আদায় করা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এরকম চিঠি কে লিখতে পারে?
যেই করে থাকুক, এমা বলল, বোঝা যাচ্ছে আপনাদের ব্যাপারটা তার জানা ছিল।
–হ্যাঁ, কোনোভাবে জেনে থাকতে পারে। কিন্তু সেই সময় আমার তেমন অন্তরঙ্গ কেউ তো ছিল না। ইংলণ্ডে আসার পরও কাউকে এবিষয়ে কিছু বলিনি। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না–এই নকল মার্টিন এতদিনই বা অপেক্ষা করল কেন?
এমা বলল, সবই কেমন গোলমেলে লাগছে। যাইহোক, ইনসপেক্টরকে জানাই, যা করবার তিনিই করবেন। এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে তোমার সঙ্গে পরিচয় হল, তবু আমার খুব ভালো লাগছে।
–এডমান্ড তোমাকে খুব ভালোবাসত। প্রায়ই তোমার কথা বলত।
এমা লেডির হাতের ওপর হাত রেখে বলল, আজ একটা ভারি বোঝা বুক থেকে নেমে গেল। মৃত স্ত্রীলোকটিকে মার্টিন বলে সন্দেহ হওয়ার পর থেকে কেবলই মনে হয়েছে, এই খুনের সঙ্গে আমাদের পরিবার জড়িত। সে যে কী অস্বস্তি তোমাকে বোঝাতে পারব না। হতভাগ্য মেয়েটি যেই হোক, তার সঙ্গে আমাদের পরিবারের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।
.
আলফ্রেডের মৃতুতে হারল্ড ক্রাকেনথর্পের দুরকম প্রতিক্রিয়া হল।
বর্তমানে তার ব্যবসার খুবই টলমল। ভেতরের অবস্থাটা বাইরের ঠাটবাটের আড়ালে ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। দামী আসবাবপত্রে সজ্জিত অফিসে, নিখুঁত আদবকায়দায় সম্পন্ন অবস্থাটাকে ধরে রাখার উপযযাগিতা অস্বীকার করা যায় না।
এই অবস্থা থেকে নিস্তার পাবার একটা পথ হতে গিয়েও হল না। আলফ্রেডের বদলে যদি বৃদ্ধ মানুষটা সংসার থেকে ছুটি নিত,তাহলে ব্যবসার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগত না।
এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে তিয়াত্তর চুয়াত্তর বয়সের একজন মানুষ। বিষপ্রয়োগের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। বয়সে জীর্ণ শরীর শক্তি আর কতটুকু আছে। তার ওপরে বছরের পর বছর অথর্ব হয়ে পড়ে আছেন।
অথচ বৃদ্ধ ঠিক সামলে উঠলেন আর যে কিনা সবল সুস্থ এক যুবক, অতি সাবধানী সেই আলফ্রেডই বিষক্রিয়ায় মারা গেল।
অবশ্য আলফ্রেডের মৃত্যু বিরাট একটা ক্ষতি কিছু নয়। অন্ততঃ পরিবারের ক্ষেত্রেও।
জীবনে সে কখনো বড় কিছু করার চেষ্টা করেনি। সব সময়ই দারিদ্র্য আর অপকর্ম তার সঙ্গী হয়েছিল। ফাটকাবাজদের যা হয়, দিন কতকের প্রাচুর্য তারপর আবার দারিদ্র্য আর অপকর্মে লিপ্ত হওয়া। এই ছিল জীবনচক্র। তাছাড়া তার প্রিয়পাত্রও সে ছিল না কোনোদিন।
তবে একটা দিক থেকে লাভবান হবার সুযোগ হয়েছে আলফ্রেডের মৃত্যুতে। সেটাই হারল্ডের আনন্দের বিষয়।
ঠাকুর্দা জোসেফ ক্রাকেনথর্পের অর্থের একজন ভাগিদার কমল। এখন আর টাকাটা পাঁচভাগ হবে না, চার অংশে বাঁটোয়ারা হবে। ফলে এখন হারল্ডের অর্থের পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে।
শরীরে বেশ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ ছিল, তবু অফিসে না এসে পারেনি হারল্ড। নিজের খাস কামরায় বসে এসব কথাই ঘুরপাক খেয়েছে মাথায়।
শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে আরও একদিন বিশ্রাম নেবে, হারল্ড ভাবল। শরীর এখনো দুর্বল।
কিছুক্ষণ অফিসে থেকে আবার বাড়ি ফিরে এল সে। দরজা খুলে দিয়ে গৃহভৃত্য ডারউইন জানাল, মিসেস হারল্ড ফিরেছেন।
সতর্ক হয়ে গেল হারল্ড। অ্যালিসের যে আজই ফিরে আসার কথা তা সে একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। এই ভুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, এখন যা সম্পর্ক ওদের দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়েছে।
অ্যালিস অতি সাদাসিধে ধরনের স্ত্রীলোক। মোহ তৈরি হবার মতো কিছু নয় সে। তবুও একসময় তার সান্নিধ্য খারাপ লাগত না। তাছাড়া মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের মেয়ে, সমাজের উঁচু মহলে বিস্তর আত্মীয়স্বজন তার।
তাদের সামাজিক মর্যাদা নানাভাবেই হারল্ডের উপকারে এসেছে। এসব কারণে স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী থাকার একটা আকর্ষণ ছিল হারল্ডের।
তার আশা ছিল, আত্মীয় স্বজনের সুবাদে ভবিষ্যতে তাদের সন্তানও সামাজিক মর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী হবে। কিন্তু হতাশ হয়েছে হারল্ড, তাদের কোনো সন্তান হয়নি। সন্তানহীনতার অনিবার্য ফল হল তাদের পারস্পরিক সাহচর্য কারোর কাছেই তেমন আনন্দদায়ক নয়। থাকতে হয় থাকা, নীরস একটা জীবনের ভারবহন মাত্র।
অ্যালিস তার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেই এখন থাকতে বেশি পছন্দ করে। এখন রিভিয়েরা থেকে ফিরে এসেছে।
হ্যারল্ড দোতলায় ড্রইংরুমে ঢুকে অ্যালিসের সঙ্গে মিলিত হল।
–আমি দুঃখিত অ্যালিস, স্টেশনে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। গাড়ির ভিড়ে আটকে পড়েছিলাম। তা সান রাফেল কেমন লাগল?
অ্যালিসের ভাবে ভঙ্গিতে কথায় বার্তায় আভিজাত্যের ছোঁয়া। সে সান রাফেলের বিবরণ দিয়ে স্বামীর স্বাস্থ্যের কথা জানতে চাইল।
–তোমরা সবাই কি করে এমন অসুস্থ হয়ে পড়লে বুঝতে পারলাম না। এমার টেলিগ্রাম পেয়ে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
হারল্ড আর্সেনিকের কথা বলতে গিয়ে বলতে পারল না। একটা পরিবারের শান্তি শৃঙ্খলার পক্ষে ব্যাপারটা অমর্যাদাকর বলে বোধ হল তার।
হ্যারল্ড নিজের ঘরে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম করল। তারপর পোশাক পাল্টে ডিনার টেবিলে গিয়ে বসল। দু-চার কথার পর অ্যালিস বলল, তোমার জন্য একটা পার্সেল হলঘরের টেবিলে রাখা আছে।
বিকেলের ডাকে এল বোধহয়, খেয়াল করিনি–
–আচ্ছা শোন, একটা মেয়ে আমাকে বলল, কোনো এক রাদারফোর্ড হলে গুদামঘরে না কোথায় একটা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আমাদের রাদারফোর্ড হলে নিশ্চয় নয়?
হ্যারল্ড পলকে স্ত্রীর মুখে চোখ বুলিয়ে নিল।
–খুবই অপ্রীতিকর ঘটনা। মেয়েটির মৃতদেহ আমাদের গুদামঘরেই পাওয়া গেছে।
–আমাদের রাদারফোর্ড হলে! কি বলছ হারল্ড। আমাকে বলোনি তো।
–সময় পাইনি। কিন্তু ওই ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু পুলিস যথেষ্ট জ্বালাতন করেছে সকলকে।
–খুনটা তাহলে কে করেছিল?
–পুলিস এখনো জানতে পারেনি। তদন্ত অব্যাহত আছে।
–স্ত্রীলোকটি কিরকম?
–কেউ তাকে সনাক্ত করতে পারেনি। তবে সন্দেহ করা হচ্ছে ফরাসি বলে।
ডাইনিং রুম ছেড়ে বেরিয়ে হারল্ড হলঘরে এল। পার্সেলটা তুলে নিল। দুজনে চুল্লির পাশে চেয়ারে গিয়ে বসল।
পার্সেলটা ছিঁড়ে একটা ট্যাবলেটের বাক্স বার করল হারল্ড। সঙ্গে একটুকরো কাগজ। তাতে লেখা, ডাঃ কুইম্পারের অনুরোধে পাঠানো হল। প্রতি রাতে দুটো ট্যাবলেট সেবনীয়।
বাক্সটা খুলে ট্যাবলেটগুলো চিনতে পারল হারল্ড। এরকম ট্যাবলেটই সে খাচ্ছিল। কিন্তু কুইম্পার বলেছিল, এখন এগুলোর আর দরকার নেই।
হ্যারল্ডের ভ্রূ কুঞ্চিত হল।
অ্যালিস ট্যাবলেটগুলোর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হারল্ড চিন্তিতভাবে বলল, কুইম্পারের পরামর্শে কেমিস্ট পাঠিয়েছে। এগুলো রাতে খেতাম। কিন্তু ডাক্তার আপাততঃ বন্ধ রাখতে বলছিল।
অ্যালিস বলল, দু-চারদিন হয়তো বন্ধ দেওয়া নিয়ম।
-তা হতে পারে। শরীরটা দুর্বল লাগছে। অসুখের পর আজই প্রথম বেরিয়েছিলাম। আমি শুতে যাচ্ছি।
-হ্যাঁ, তোমার এখন যথেষ্ট বিশ্রাম দরকার। তারপর ট্যাবলেটের বাক্সটা স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বলল, এটা খেতে যেন ভুলে যেও না।
শোবার ঘরে এসে হারল্ড দুটো ট্যাবলেট জল দিয়ে গিলে ফেলল। তারপর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল।
.
ডারমট ক্রাডককে খুবই ক্লান্ত হতাশ আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
ফ্লোরেন্সের বাড়িতে মিস মারপলের মুখোমুখি একটা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বসেছিলেন তিনি।
–এখন বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা খুবই জট পাকিয়ে ফেলেছি। আমি নিজেই।
বিষণ্ণ ক্রাডককে সান্ত্বনা দিয়ে মিস মারপল বললেন, না, তেমন কিছু করেছ বলে মনে করছি না আমি। তোমার কাজ প্রশংসনীয়ই হয়েছে আমি বলব।
-আপনি বলছেন প্রশংসনীয় কাজ? এসব কি তাই–পাইকারিহারে একটা পরিবারের ওপর বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে, আর আমি কিছু করতে পারছি না। পরপর মারা গেল দুই ভাই, আলফ্রেড আর হারল্ড–চিন্তা করা যায় না পরিবারটার ওপরে কী চলেছে। সবই ঘটছে আমার চোখের সামনে।
–ট্যাবলেটগুলোতে বিষ মেশানো ছিল! চিন্তিতভাবে বললেন মিস মারপল।
–তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এক নারকীয় পরিকল্পনা।
-হ্যারল্ড যে ট্যাবলেট আগে খেয়েছিলেন হুবহু সেরকমই ছিল দেখতে। সঙ্গে একটুকরো কাগজে লেখা ছিল, ডাঃ কুইম্পারের নির্দেশ অনুসারে পাঠানো হল।
ডাঃ কুইম্পার ওগুলোর অর্ডার দেননি। একজন কেমিস্টের প্যাডে চিরকুট লেখা হয়েছিল। অথচ সেই কেমিস্টও এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। একটা ব্যাপার পরিষ্কার বোঝা গেছে, ট্যাবলেটের বাক্সটা রাদারফোর্ড হল থেকেই পাঠানো হয়েছিল।
-তুমি কি নিশ্চিত যে ওটা রাদারফোর্ড হল থেকেই প্রেরিত হয়েছিল?
–আমি নিশ্চিত। আমরা তদন্ত করে দেখেছি, মানসিক উত্তেজনা প্রশমনের ওই ট্যাবলেটগুলো ওই বাক্সের মধ্যেই ছিল। ওগুলো এমার ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল।
–এমার জন্য
-হ্যাঁ। বাক্সের ওপর এমার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। এছাড়া ছিল নার্সের আর যে কেমিস্ট তাতে ট্যাবলেট ভরেছিল তার হাতের ছাপ। অন্য কারো ছাপ ছিল না। খুবই সতর্কতার সঙ্গে কাজটা করা হয়েছিল।
–প্যাকেটের আসল ট্যাবলেটগুলো সরিয়ে অন্য ট্যাবলেট ভরা হয়েছিল।
–হ্যাঁ। ট্যাবলেটগুলো দেখতে একই রকম ছিল।
–আজকাল হরেক রকমের ট্যাবলেট বেরিয়েছে রোগের জন্য–একটা থেকে আরেকটার তফাৎ ধরা কষ্টকর। অথচ আমাদের সময়ে এমন গোলযোগ ঘটবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। ডাক্তাররা নানান রঙের মিকশ্চার ব্যবহার করতেন। তা ওই ট্যাবলেটগুলো কিসের ছিল?
-একোনাইটের। বিষাক্ত। জলের সঙ্গে মিশিয়ে দেহের বাইরের অংশে প্রয়োগের জন্য দেওয়া হয়।
–সেগুলো খেয়ে হারল্ড মারা গেছে।
–ওকথা চিন্তা করলে এখনো আমার বুকে যন্ত্রণা হয়। ব্যাপারটা খুবই মর্মান্তিক। কাতর স্বরে বললেন ক্রাডক।
–আমি কোনো থৈ পাচ্ছি না। নিজের গলদটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। গোটা ব্যাপারটাই কেমন গুলিয়ে ফেলেছি। এখানকার চিফ কনস্টেবল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ডেকে পাঠিয়েছে। আমি যে এখানে গর্দভের মতো কাজ করেছি তা তারা জেনে যাবে।
–তুমি অতো অধীর হয়ে পড়েছ কেন
–মিস মারপল, আপনার কাছে ভাবাবেগ প্রকাশ করে ফেলেছি বলে কিছু মনে করবেন না। আপনি চিন্তা করে দেখুন আমার ব্যর্থতা কী নিদারুণ। আলফ্রেডকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে, হারল্ডের মৃত্যুও বিষপ্রয়োগে। আমি জানি না শয়তানের মতো কে এসব কাজ করে চলেছে। আবার দেখুন, সেই নিহত স্ত্রীলোকটি, তার কি পরিচয় এখনো জানতে পারলাম না।
এডমান্ড ক্রাকেনথর্পের ঘনিষ্ঠ মহিলা মার্টিন ডুবয় রাদারফোর্ড হলে এসে নিহত হয়েছেন, এই কাহিনীর সঙ্গে সমস্ত ঘটনা এমন সুন্দর ভাবে মিলে যাচ্ছিল যে খুবই আশান্বিত হয়ে উঠেছিলাম।
কিন্তু দেখুন, অবিশ্বাস্য ভাবে আসল মার্টিন আত্মপ্রকাশ করলেন আর আমার এত পরিশ্রম যেন এক ফুকারে নস্যাৎ হয়ে গেল। এখন আর তল খুঁজে পাচ্ছি না।
স্যার রবার্ট স্টডার্ড ওয়েস্টের গৃহিণী বলে যিনি নিজের পরিচয় দেন, তার বক্তব্য সন্দেহাতীত। তাহলে গুদামঘরে পাথরের কফিনে যে মৃতদেহটি নিয়ে আমরা এত দৌড়ঝাঁপ করলাম, দফায় দফায় এত জিজ্ঞাসাবাদ, সেই স্ত্রীলোকটি কে? তার খুনের রহস্য যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেল। আমি তাহলে কোথায়? আবার সেই আন্না ট্রাভিনস্কির ব্যাপারটা দেখছি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, এই ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই।
সম্পর্ক নেই বলেই ভাবছ?
মৃদু কাশির সঙ্গে ফিসফিস করে কথাগুলো বললেন মিস মারপল।
সন্দেহ পূর্ণ দৃষ্টিতে মিস মারপলকে লক্ষ্য করে ক্রাডক বললেন, জামাইকা থেকে লেখা সেই চিঠিতেই তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল।
-কিন্তু সেটাকে সত্যি সত্যি প্রমাণ বলে কি মেনে নেওয়া যায়? বললেন মিস মারপল।
–কেন নয়?
-আমি বলতে চাইছি, ওরকম একটা চিঠি যে কোনো লোক পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে পাঠাতে পারে। মিসেস ব্রিয়ারলির ঘটনাটা শুনলেই তুমি পরিষ্কার বুঝতে পারবে আমি কি বলতে চাইছি। তার স্নায়বিক বিকার এত বেড়ে গিয়েছিল যে সকলে তাকে পরামর্শ দিল কোনো মানসিক হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ছেলেদের এসব জানাতে তিনি সঙ্কোচবোধ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। তিনি চোদ্দখানা চিঠি লিখলেন এবং সেগুলো বিদেশের চোদ্দটা জায়গা থেকে পোস্ট করার ব্যবস্থা করলেন। চিঠিগুলোতে তার ছেলেদের জানানো হলো যে, তিনি মনের আনন্দে বিদেশ ভ্রমণ করছেন।
-বুঝতে পেরেছি, কি বোঝাতে চাইছেন, বললেন ক্রাডক, মার্টিনের কাহিনীটা আমাদের এত সম্ভবপর বলে মনে হল যে জামাইকার সেই চিঠির ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখার কথা বিবেচনা করিনি। জানি না সেখানে সম্ভাব্য কোনো সূত্র অবহেলায় পরিত্যক্ত হল কিনা।
মার্টিন ক্রাকেনথর্পের নাম সইকরা একটা চিঠি এমার কাছেও লেখা হয়েছে। লেডি স্টডার্ড পরিষ্কার জানিয়েছেন তিনি সেই চিঠি কখনওই লেখেননি। তাহলে কে পাঠালো সেই চিঠি? মার্টিন বলে পরিচয় দিয়ে এরকম একটা চিঠি পাঠাবার উদ্দেশ্যই বা কি? নিছকই কি কিছু অর্থ আদায়ের ফিকিরে? এগুলো যে জট পাকানো জটিল রহস্য নিশ্চয় আপনি তা স্বীকার করবেন?
হ্যাঁ, তা স্বীকার করি।
-তারপর আরও আছে দেখুন। এমা মার্টিনের নামে লন্ডনের ঠিকানায় যে চিঠিখানা লিখেছিল তার খামখানা পাওয়া গেল রাদারফোর্ড হলে। মার্টিন যদি সেখানে নাই এসে থাকে তাহলে চিঠির ঠিকানা লেখা খামখানা এলো কি করে? সত্যি সত্যি সে এসেছিল প্রমাণ হয়?
কিন্তু এসেছিল বলে তুমি যা বলতে চাইছ, নিহত স্ত্রীলোকটি সেই অর্থে রাদারফোর্ড হলে আসেনি। সে এসেছিল মৃত্যুর পরে। চলন্ত রেলগাড়ি থেকে তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল রেলবাঁধের ওপরে।
–হ্যাঁ, তা ঠিক।
তা যদি হয় তাহলে কি প্রমাণ হয়? ওই খামটা প্রমাণ করছে যে খুনী রাদারফোর্ড হলে এসেছিল। অনুমান করা যায় অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে খামখানাও মেয়েটির পকেটে ছিল। খুনী যখন পকেট থেকে সবকিছু তুলে নিয়েছিল তখন তার অজ্ঞাতে খামখানা পড়ে গিয়েছিল। অথবা, এমন হওয়াও সম্ভব যে, খুনী সেটা ভুল করে নয়, ইচ্ছাকৃতভাবেই ফেলেছিল। মৃতদেহ আবিষ্কার হবার পর রাদারফোর্ড হলের চত্বর ইনসপেক্টর বেকন এবং তোমার লোকজন আঁতিপাতি করে খুঁজেছে। কিন্তু খামখানা তাদের কারো চোখে পড়েনি। পরে খামখানা উদ্ধার হয় বয়লার হাউস থেকে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে?
-সেটা বোঝা যাচ্ছে, ক্রাডক বললেন, বুড়ো মালী বাইরে আজেবাজে যা কিছু দেখতে পায় সবই বয়লার হাউসের মধ্যে নিয়ে জড়ো করে।
ছেলেদের কাছে সেই কারণেই ওই ঘরটা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার কথা। কোনো কিছু তাদের দৃষ্টিতে আনার খুব সহজ জায়গা।
–আপনি কি বলতে চাইছেন, আমাদের হাতে ফেলবার জন্যই পরে খামখানা সেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল?
–কৌতূহলী হয়ে ছেলেরা আনাচেকানাচে রহস্যোর সূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তারা শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে তা অনুমান করা কিছু কঠিন ছিল না। তাছাড়া খোঁজার জায়গার একটা ইঙ্গিত তাদের দেওয়াও সম্ভব ছিল। এসব ভাবনা আসছে ওই খামখানা পাওয়ার পর। তোমরা তো আন্না ট্রাভিনস্কির সম্ভাবনার কথা বাদই দিয়েছিলে, তাই না?
তার মানে, আপনি বলতে চাইছেন নিহত মেয়েটি আন্নাই হতে পারে?
তা নয়। আমি ভাবছি আন্নার ব্যাপার নিয়ে তোমরা যখন অনুসন্ধান আরম্ভ কর, তখন কেউ তোমাদের সেই লাইন থেকে সরিয়ে আনার কথা ভেবে থাকবে।
-মূল ঘটনাটা তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে, নকল মার্টিন সেজে কেউ অগ্রসর হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কারণে সে বিরত হয়। কিন্তু সেই কারণটা কি হতে পারে?
বেশ তো বলছ তুমি।
–এমন যদি হয়, কোনো লোক তারবার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছিল যে মার্টিন ফ্রান্সে ফিরে যাচ্ছে। তারপর সে মেয়েটিকে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে তাকে হত্যা করে, এ পর্যন্ত আপনি নিশ্চয় মেনে নেবেন?
–এরকম হয়েছে বলে আমি মনে করি না, বললেন মিস মারপল, ঘটনাটা বড় বেশি সরল করে ফেলেছ তুমি।
–সরল করে ফেলছি। আপনার কথায় আবার সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার।
–তোমাকে কোনোরকম ধাঁধায় ফেলা আমার ইচ্ছা নয়।
–তা যদি হয়, স্পষ্ট করে বলুন, আপনি কি জানতে পেরেছেন নিহত স্ত্রীলোকটি কে ছিল?
–এখনো পর্যন্ত জানতে পারিনি, সে ঠিক কে ছিল। তবে সে কিরকম মেয়ে ছিল, তা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমি কি বলতে চাইছি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
–বুঝতে যা পেরেছি তাতে চোখের সামনে কেবল ধোঁয়া দেখছি।
এইসময় জানালার দিকে চোখ পড়ল ক্রাডকের। সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,-লুসি আইলেসব্যারো আসছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি বরং এখন উঠি।
.
একটু চঞ্চলতা নিয়েই ঘরে ঢুকল লুসি। প্রাথমিক সম্ভাষণের পর সে বলল, আপনার টনটিন (Tontine) কথাটার অর্থ ডিক্সনারি খুঁজে বার করেছি।
পায়চারি করে ঘরের এটা সেটা নাড়াচাড়া করে দেখে বেড়াতে লাগল সে।
-দেখেছ তাহলে। শান্তকণ্ঠে বললেন মিস মারপল।
–দেখলাম, ইতালির এক ব্যাঙ্কার, লোরেঞ্জে তোতি, ১৬৫৩ খ্রি. একধরনের অ্যানুইটি, প্রবর্তন করেছিলেন, তারই নাম টনটিন। এর দ্বারা লগ্নীকারীদের মধ্যে মৃতদের অংশ যারা বেঁচে থাকে তাদের লাভের অংশের মধ্যে যুক্ত হয়। এই তো অর্থ, তাই নয়? বর্তমানে আমরা যেই সমস্যার মধ্যে রয়েছি টনটিনের অর্থ তার সঙ্গে বেশ মিলে যাচ্ছে। এখানে শেষ দুটি মৃত্যুর আগে আপনি কথাটা বলেছিলেন।
মিস মারপল কোনো জবাব দিলেন না। লুসির চঞ্চলতা নীরবে নিরীক্ষণ করে চললেন।
তাকের ওপরে রাখা একটা চিনামাটির কুকুর লক্ষ্য করতে করতে লুসি আবার বলল, –আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝবার পক্ষে শব্দটা যথোপযুক্ত। বৃদ্ধ জোসিয়া ক্রাকেনথর্প যে উইল করে গেছেন, তার নিষ্পত্তি হতে পারে যখন একজন মাত্র অংশীদার জীবিত থাকে এবং সে সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হয়। তবুও একটা বিরাট পরিমাণ টাকা ভাগাভাগি হলেও প্রতিভাগে টাকার পরিমাণ নেহাৎ কম দাঁড়ায় না।
কিন্তু মানুষ যখন অতিরিক্ত লোভী হয়ে পড়ে, বললেন মিস মারপল, তখনই অপ্রীতিকর ঘটনার সম্ভাবনা দেখা দেয়। প্রথমেই হয়তো লোভের বশবর্তী হয়ে কেউ খুন করে বসে না, কিংবা খুনের কথা চিন্তা করে না–কেবল কি করে নিজের অংশের চাইতে বেশি কি করে পাওয়া যেতে পারে, সেকথা ভাবতে থাকে।
কথা বলতে বলতে কোলের ওপর থেকে কাটা পশমগোলা নামিয়ে রেখে তিনি আবার বললেন, এরকম একটা ঘটনার সূত্রেই ক্রাডকের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়। অনেক টাকা পাওয়ার কামনা নিয়ে একটা লোক এমন সহজ একটা কাজ করল, যাকে কোনো ভাবেই অন্যায় বলা চলে না। হত্যার প্রশ্ন তখনো দেখা দেয়নি। কিন্তু শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। আর ঘটনার নিস্পত্তি হয়েছিল তিন-তিনটা হত্যাকাণ্ড দিয়ে।
–এখানেও তো আমরা তিনটে হত্যাকাণ্ড দেখতে পাচ্ছি। যাকে মার্টিন বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল, সে তার ছেলের জন্য সম্পত্তির একটা অংশ দাবি করতে পারত। সম্পত্তির দাবিদার ছিল আলফ্রেড এবং হারল্ডও। দাবিদারদের মধ্যে আর মাত্র দুজন এখন অবশিষ্ট আছে।
–কেড্রিক আর এমার কথা বলছ নিশ্চয়ই? বললেন মিস মারপল।
–এমাকে এর মধ্যে টানা যাচ্ছে না। কেন না সে দীর্ঘচেহারার কালো মানুষ নয়। এরকম মানুষ হল কেড্রিক আর ব্রায়ান ইস্টলি। তবে ব্রায়ান ফর্সা। তার চোখ নীল, কটা গোঁফ। কিন্তু সেদিন…।
বলতে গিয়ে থেমে গেল লুসি।
-হ্যাঁ, বল। কোনো ঘটনা নিশ্চয়ই তোমার চোখে পড়েছে; বুঝতে পারছি।
লেডি স্টডার্ড ওয়েস্ট যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন ঘটনাটা ঘটেছে। লুসি বলতে থাকে, বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে তিনি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যখন বাড়িতে ঢুকছিলাম, তখন রাস্তার ওপর একটি লম্বা কালো লোক দাঁড়িয়ে ছিল, সে কে?
-প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি, বাইরে রাস্তায় এসে কে দাঁড়াতে পারে। কেড্রিক তো শয্যাশায়ী এখনো। বাড়িতে দ্বিতীয় নোক বলতে ব্রায়ান ইস্টলি। আমি তার কথা বললাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, ব্রায়ানই হবে। ফ্রান্সে প্রতিরোধ আন্দোলনের সময় সে একবার আমাদের ডেরায় লুকিয়েছিল।
তাকে তখন কাছে থেকে দেখেছি, তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি, কাঁধের গঠন, সব আমার মনে আছে। পরে তিনি বললেন, এতদিন পরে তার সঙ্গে দেখা হলে খুশি হতাম। কিন্তু আমরা অনেক খুঁজেও ব্রায়ান ইস্টলিকে কোথাও পেলাম না।
মিস মারপল নীরবে লুসির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
লুসি বলে চলল, আমি পরে তাকে লক্ষ্য করলাম…সে আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল… আমি নজর করলাম, একজন মানুষ ফর্সা এবং তার চুল বাদামী হলেও তাকে সময় ও স্থান বিশেষে কালোও দেখাতে পারে। তখনই আমার মাথায় আসে আপনার বন্ধু যাকে ট্রেন থেকে দেখেছিলেন, সে ব্রায়ান হতে পারে।
–তা পারে।
–কিন্তু, অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠল লুসি, এতে ব্রায়ানের লাভ কি? টাকাটা তো পাবে তার ছেলে আলেকজান্ডার। তাতে তার ভোগসুখের কিছুটা হেরফের যা হতে পারে, কিন্তু মূলধন নাড়াচাড়া করার অধিকার তো তার থাকবে না।
–সে অধিকার সে পেতে পারে যদি একুশ বছর হবার আগেই আলেকজান্ডারের জীবনে কিছু ঘটে।
সর্বনাশ..অমন কাজ…নিছক টাকার জন্য কোনো পিতা অমন কাজ করবে না–
মিস মারপল বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, টাকার জন্য মানুষ করতে পারে না এমন কাজ নেই। ইনসিওরেন্সের কিছু টাকার লোভে একজন স্ত্রীলোক তার তিনটি ছেলেকে খুন করেছিল–এমন ঘটনাও আমি জানি। টাকার লোভ এমনই যে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এক বুড়ীর কথা তোমাকে বলি, সাদামাটা ভালো মানুষ সে, কিন্তু তার ছেলে ছুটিতে বাড়িতে এলে তিনি তাকে খুন করেছিলেন।
আরও শুনবে? বৃদ্ধা মিসেস স্টানডইচের কাহিনী তো খবরের কাগজেও ছাপা হয়েছিল। প্রথমে তার মেয়ে মারা গেল, পরে ছেলে। তিনি জানালেন, মেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। বিষ পাওয়াও গেল দইয়ের মধ্যে। পরে জানা গেল তিনি নিজেই তাতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। ধরা পড়েছিলেন তিনি তার অবশিষ্ট মেয়ে সন্তানটিকে বিষ প্রয়োগের সময়। এব্যাপারটা অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল। জীবন উপভোগের আকাঙ্ক্ষা এই বৃদ্ধাকে উন্মাদ করে তুলেছিল। ছেলেমেয়েরা তার চেয়ে বেশি দিন বাঁচবে, জীবন উপভোগ করবে, এই ঈর্ষা থেকেই সে তার সন্তানদের খুন করেছিল।
যাইহোক, তুমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছ বুঝতে পারছি। ভেবো না; এলসপেথ ম্যাকগিলিকার্ডির আসার অপেক্ষায় রয়েছি আমি, যে কোনো দিন সে এখানে পৌঁছতে পারে।
তার সঙ্গে এখানকার কি সম্পর্ক তো বুঝতে পারছি না।
–হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার আসাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। তুমি বাছা অত দুশ্চিন্তা করো না।
–চিন্তা না করে তো পারছি না। এই পরিবারের সঙ্গে আমি কেমন জড়িয়ে পড়েছি।
–আমি সেটা লক্ষ্য করেছি। পরিবারের দুজনের প্রতি তুমি আসক্ত হয়ে পড়েছ।
–আপনার একথার অর্থ?
–এই পরিবারের দুটি ছেলের একজন ছেলে অন্যজন জামাই। দুঃখের বিষয় যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দুজন মারা গেছে। আর যে দুজন বেশি আকর্ষণীয় তারা জীবিত। কেড্রিক আকর্ষণীয় একারণে যে সে নিজের মূলকে কখনো বড় করে তুলে ধরে না। তার এই দিকটাই তোমাকে আকর্ষণ করেছে।
মিস্টার ইস্টলি একটি দুর্বল ছিচকাঁদুনে বালক যেন। এরকম চরিত্রেরও আকর্ষণ আছে।
–কিন্তু এদের দুজনের একজন খুনী। কেড্রিক, দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে সে একটুও বিচলিত নয়। এখন থেকেই মনের আনন্দে রাদারফোর্ড হল সম্পর্কে পরিকল্পনা তৈরি করছে। জায়গাটার উন্নতি করার জন্য অনেক টাকার দরকার, একথাও সে বলছে।
–এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না। বললেন মিস মারপল।
এদিকে ব্রায়ানের অবস্থা দেখুন, তার মনোগত ইচ্ছা রাদারফোর্ড হলেই বাস করা। আলেকজান্ডারকে নিয়ে সে ওখানেই থাকতে পারবে। এসম্পর্কে অনেক মতলবও তার আছে।
-তাই বুঝি।
–কিন্তু অবাস্তব সব কল্পনা। খুব কার্যকর নয়। যুদ্ধবিমানের পাইলট বলেই বোধহয় কল্পনার আকাশে ভাসতে ভালোবাসে।
ব্রায়ান সম্পর্কে আর কি মনে হয় তোমার?
মিস মারপল চোখের কোণ দিয়ে তাকালেন লুসির দিকে।
–আর একটা বিষয় নজরে এসেছে দুদিন আগে। আমার সন্দেহ ব্রায়ান সত্যিই সেই গাড়িতে ছিল।
-প্যাডিংটন থেকে চারটে তেত্রিশে যে গাড়ি ছেড়েছিল? তবে সত্যটা না জানতে পারা পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
–আমরা জানতে পারব অবশ্যই, বললেন মিস মারপল, খুনীদের চরিত্র আমি জানি, তারা কখনো হাতগুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। দু দুটো খুন তারা করেছে–এর পর তারা চুপ করে বসে থাকবে না। আর তাই তারা অচিরেই আমাদের নজরে এসে যাবে। পুলিস সকলের ওপরেই নজর রেখেছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, এলসপেথ যে কোনো মুহূর্তে এখানে হাজির হচ্ছে।
তুমি যেভাবে বললে, বুঝতে পারছি বটে, কিন্তু কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে, ওভাবে বলা–
বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সলজ্জ কণ্ঠে বললেন মিসেস এলসপেথ ম্যাকগিলিকার্ডি।
–অস্বস্তির কি আছে বুঝতে পারছি না। বাড়ি পৌঁছলে, কথা বলতে বলতে তুমি বলতেই পার, আমি কি একবার ওপরে যেতে পারি
বন্ধুকে আশ্বস্ত করলেন মিস মারপল।
-যাই বল, বাড়ি পৌঁছেই সঙ্গে সঙ্গেই ওরকম বলা–
-দেখো, এরকম ঘটনা কেউ অস্বাভাবিক ভাববে না। তোমার হজমশক্তির পক্ষে আপত্তিকর যদি কিছু তুমি খেয়ে থাক–ওপরে যাওয়ার প্রয়োজন তোমার হতেই পারে–
–সে না হয় হল, তোমার উদ্দেশ্যটা এবার আমাকে বল।
–সেটা এখনই আমি বলতে চাই না।
–জেন, এ বড় বিরক্তিকর। জরুরী দরকার বলে তুমি আমাকে এতদূর ইংলন্ড অবধি ছোটা করিয়েছ, অথচ
আমি দুঃখিত এলসপেথ। কিন্তু এছাড়া আমার উপায় ছিল না। পুলিস সতর্ক নজর রেখেছে, তবু যে কোনো মুহূর্তে একজন তোক খুন হয়ে যেতে পারে, আমি আশঙ্কা করছি। এক্ষেত্রে আসাটা তোমার কর্তব্য বলেই মনে হয়েছে আমার। কর্তব্যকর্ম আমরা–তুমি বা আমি, কেউই অবহেলা করতে পারি না।
–তা অবশ্যই পারি না।
-কাজেই, তোমাকে যা করতে বলেছি, আমি ভেবেচিন্তেই বলেছি। চল, ওই তো ট্যাক্সি আসছে।
দুই বৃদ্ধা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রাদারফোর্ড হলের দিকে যাত্রা করলেন।
.
ঘণ্টার শব্দ শুনে এমাই দরজা খুলে দিল। মিস মারপল ঘরে ঢুকলেন। তার পেছনে ঢুকলেন মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি।
প্রাথমিক সম্বোধন শেষ করে মিস মারপল বললেন, পরশু বাড়ি যাচ্ছি, তাই মনে হল, তোমাকে বিদায় জানিয়ে আর লুসির প্রতি তোমার সহৃদয় ব্যবহারের জন্য ধন্যবাদ না জানিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
আমার বন্ধু মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডিকেও নিয়ে এসেছি তোমার সঙ্গে পরিচয় করিতে দিতে। উনি এখন আমার কাছে রয়েছেন।
মিস ম্যাকগিলিকার্ডি এমার সঙ্গে করমর্দন করলেন।
এই সময় লুসি ঘরে ঢুকল। মিস মারপলদের দেখে সে খুশি হল।
-কী আশ্চর্য..মাসী তোমরা
–মিস ক্রাকেনথর্পকে বিদায় জানাতে এলাম। উনি তোমার প্রতি এত সহৃদয় ব্যবহার করেন
কেড্রিকও নেমে এসেছিল। তার দিকে তাকিয়ে মিস মারপল বললেন, তোমাদের অসুখের খবর পেয়ে খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। এখন ভালো আছ দেখে স্বস্তি পাচ্ছি।
-হ্যাঁ, আমরা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বলল কেড্রিক।
–লুসির কাছে শুনলাম, ছত্রাক থেকে নাকি হয়েছে
বললেন মিস মারপল।
–কারণটা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। বলল এমা।
–তবে আর্সেনিকের একটা গুজব রটেছে চারপাশে। বলল কেড্রিক।
-কেড্রিক, ভাইকে ভর্ৎসনা করল এমা, ইনসপেক্টর ক্রাডক না এসব কথা বলতে বারণ করেছেন।
–সবাই তো এখন জেনে গেছে। বলল কেড্রিক, আপনারাও নিশ্চয় কিছু কিছু শুনে থাকবেন।
-আমি গত পরশু বিদেশ থেকে ফিরেছি। বললেন মিসেস এলসপেথ।
কেড্রিক হেসে বলল, তাহলে গুজব এখন আপনার কানে ওঠেনি। তবে লুসির মাসীমা নিশ্চয় শুনে থাকবেন যে কারিতে আর্সেনিক মেশানো ছিল–সবাই এখন একথা জেনে গেছে।
–আমি এরকমই কিছুটা শুনেছি। কিন্তু এসব কথা নিয়ে তোমাদের বিব্রত করতে চাইনি।
এই সময় দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প। তিনি লুসিকে চায়ের জন্য তাড়া দিলেন।
-এই মেয়ে, আমার চা এখনো আনননি কেন?
–চা তৈরি মিঃ ক্রাকেনথর্প। আমি এখুনি নিয়ে আসছি।
লুসি চলে গেল। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প মিস মারপল ও মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডির সঙ্গে পরিচিত হলেন।
একটু পরেই ট্রে ভর্তি স্যান্ডউইচ, রুটি, মাখন, কেক নিয়ে ঘরে ঢুকল ব্রায়ান। লুসির হাতে চায়ের ট্রে।
-এত আয়োজন কিসের–এত? তীব্র স্বরে বলে উঠলেন বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প, আজকে আমাদের পার্টি হচ্ছে নাকি? আমাকে তো কেউ জানায়নি।
-বাবা আজ ডাঃ কুইম্পার আমাদের এখানে চা পান করতে আসছেন। তার জন্মদিন। বলল এমা।
-জন্মদিন? বৃদ্ধ চিড়বিড় করে উঠলেন, জন্মদিন তো শিশুবেলায় হয়, ও এসব দিয়ে কি করবে
এদিকে মিস মারপল ব্রায়ানের সঙ্গে পরিচিত হলেন।
লুসির কাছে তোমার কথা অনেক শুনেছি। তোমাকে দেখে আমাদের সেন্টমেরী মিডের এক সলিসিটরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সে হল রনি ওয়েলস। বাপের ব্যবসায়ে ঢুকে কিছু করতে পারল না ছেলেটা। পরে পূর্ব আফ্রিকাতে গিয়ে আরও কিসব করার চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হল। সমস্ত মূলধন জলে গেল। তোমার সঙ্গে তার চেহারার এমন হুবহু মিল, আশ্চর্য তোমার কোনো আত্মীয় নয়তো?
–না, মাদাম, বলল ব্রায়ান, আমার কোনো আত্মীয় আছে বলে জানি না।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ জানালার দিকে সরে গেলেন মিস মারপল।
-বাঃ জানলা দিয়ে বাইরেটা সুন্দর দেখাচ্ছে তো! একেবারে ছবির মতো
এমা হাসিমুখে এগিয়ে গেলো তার দিকে।
–বিস্তর জায়গা ফাঁকা, বলল সে, শহরে আছি বোঝাই যায় না।
সেই মুহূর্তে মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি এমার কাছাকাছি এগিয়ে নিচুস্বরে বললেন, ওপরতলায় একটু যেতে পারি–মিস–
নিশ্চয় নিশ্চয়।
বলে উঠল এমা। লুসির দিকে তাকালো সে।
–আমার সঙ্গে আসুন।
মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডিকে নিয়ে লুসি চলে গেল।
এই তো কুইম্পার এসে গেছেন। বলল ব্রায়ান।
বাইরে গাড়ি থামার শব্দ হল। ঘরে ঢুকলেন হাস্যমুখ ডাঃ কুইম্পার।
-হ্যালো, এমা, কেমন আছ? সদাশয় ঈশ্বর, এসব কি
–আপনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে জমানো কেকটা তৈরি করেছি, বলল এমা, আজকে আপনার জন্মদিন বলেছিলেন
-আশ্চর্য, আমি তো ভাবতেই পারিনি, গত একযুগ কেউ আমার জন্মদিনের কথা মনে করেনি।
মিস মারপলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আপনার সঙ্গে সেদিন পরিচয় হয়েছিল, আশা করি সুস্থ আছেন?
মিস মারপল মাথা নেড়ে স্মিত হেসে জানালেন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন।
–তুমি এ কদিন আমাকে দেখতে আসনি ডাক্তার। বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প ডাঃ কুইম্পারকে উদ্দেশ্য করে অনুযোগ করলেন। এসো, চা খাওয়া যাক–সবই তৈরি।
-হ্যাঁ, সকলে আরম্ভ করুন। আমার বন্ধু না হয় অস্বস্তি বোধ করবেন। বললেন মিস মারপল।
চায়ের টেবিলে গোল হয়ে বসে সকলে চা ও খাবারের সদ্ব্যবহারে মন দিলেন।
মিস মারপল মাখন রুটি শেষ করে স্যান্ডউইচ হাতে নিলেন।
–এটা মাছের, নিন, বলল ব্রায়ান, এটা বানাতে আমি লুসিকে সাহায্য করেছি।
–ওহ, এ বাড়ির খাবার সাবধান, বৃদ্ধ ক্রাকেনথর্প বলে উঠলেন, আমার দুই ছেলেকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে। কে এসব করেছে জানা গেল না।
-ওঁর কথায় ভয় পাবেন না, বলল কেড্রিক, আমিও একখানা নিচ্ছি।
গোটা একখানা স্যান্ডউইচই সে মুখে পুরে দিল।
স্যান্ডউইচ চিবোচ্ছিলেন মিস মারপল। হঠাৎ তিনি হাঁসফাঁস করে উঠলেন। তার সমস্ত মুখ লাল হয়ে গেল। শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল। কোনো রকমে বলার চেষ্টা করলেন, গলায় কাঁটা ফুটেছে।
ডাঃ কুইম্পার উঠে এলেন। মিস মারপলকে জানালার দিকে মুখ করে বসালেন। তাকে মুখ খুলতে বললেন।
পকেট থেকে একটা কেস বের করলেন, তার ভেতর থেকে ছোট্ট একটা চিমটা বেছে নিলেন।
হাঁ মুখ হয়ে বসেছিলেন মিস মারপল। কুইম্পার সামান্য ঝুঁকে পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে তার গলার ভেতর পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন।
সেই মুহূর্তে দরজা খুলে মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি ঘরে ঢুকলেন। তার পেছনে লুসি।
সামনেই জানালার ধারে মিস মারপল চেয়ারের পেছনে হেলান দিয়ে বসে আর ডাঃ কুইম্পার তার গলা ধরে মাথাটা ওপরের দিকে কাত করে দিচ্ছেন। এই দৃশ্যটার দিকে চোখ পড়তেই মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, এই তো সেই লোকটা-ট্রেনের সেই লোকটা।
তৎক্ষণাৎ এক ঝটকায় ডাক্তারের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন মিস মারপল। দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলেন বন্ধুর দিকে।
–লোকটাকে তুমি ঠিক চিনতে পারবে আমি জানতাম, বললেন মিস মারপল, এখন আর কিছু বলল না।
ডাক্তার কুইম্পারের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ডাক্তার, আপনি সেদিন যা ভাবতে পারেননি, তাই ঘটেছিল। ট্রেনে যখন একটি স্ত্রীলোকের গলা টিপে আপনি হত্যা করছিলেন, আপনার সেই কাজ পার্শ্ববর্তী ট্রেন থেকে এই বন্ধু দেখেছিলেন।
খুনে শয়তান, মিসেস ম্যাকগিলিকার্ডি তোমাকে দেখেছিল, বুঝতে পেরেছ?